বর্ষা মানেই ঘাটালে বন্যা! ঘাটাল মাস্টার প্ল্যান- অতীত ও বর্তমান

বর্ষা মানেই ঘাটালে বন্যা! ঘাটাল মাস্টার প্ল্যান- অতীত ও বর্তমান
ড. প্রভাতকুমার শীট
বর্ষা মানেই বানভাসি। রাঢ় বঙ্গীয় নদ-নদী গুলিতে (শিলাবতী, কংসাবতী, ঝুমি প্রভৃতি নদী) জলস্তর বেড়ে যাওয়া। তার জেরেই বানভাসি হওয়ার ভয়। শিলাবতী নদীর উপত্যকায় বসবাসকারী ঘাটালের বাসিন্দারা মোটামুটি তিন প্রজন্ম বন্যা পরিস্থিতির সাক্ষী।
দেশে স্বাধীনতা এসেছে। জাতীয় রাজনীতিতেও হাজারও বদলের পাশাপাশি বাংলার রাজনৈতিক রং এক সবুজ থেকে লাল হয়ে ফের এখন অন্য সবুজে। কিন্তু ঘাটাল রয়েছে ঘাটালেই। তার প্লাবন-ভাগ্যে কোনও বদল আসেনি। প্রতিবছর বর্ষায় ভারী বৃষ্টি (টানা দুই থেকে তিন দিন) হলেই ঘাটালে বন্যা পরিস্থিতি তৈরি হয়। নদীর দুকুল ছাপিয়ে গ্রামের পর গ্রাম জলমগ্ন হয়। লক্ষ লক্ষ মানুষ দুর্ভোগে পড়েন। পানীয় জলের হাহাকার দেখা দেয়। এক গ্রাম থেকে অন্য গ্রামের যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। সাপের কামড়ে, বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হয়ে অথবা জলের তলায় তলিয়ে গিয়ে প্রাণহানিও ঘটে।
ঘাটালবাসীকে এই দুর্ভোগ থেকে মুক্তি দিতে পাঁচ দশক আগে "ঘাটাল মাস্টার প্ল্যান" নামক বিশেষ পরিকল্পনা গৃহীত হলেও আজও তার বাস্তবায়ন হয়নি। রাজনীতির জটে নাকি আটকে রয়েছে। ১৯৫৯ সালে মানসিংহের রিপোর্টের ভিত্তিতে, স্থায়ীভাবে বন্যা নিয়ন্ত্রণ করতে তৎকালীন কংগ্রেস সরকার ঘাটাল মাস্টার প্ল্যান তৈরি করে। কিন্তু তাতে কেন্দ্রীয় পরিকল্পনা কমিশনের অনুমোদন পেতেই সময় লেগে যায় প্রায় দু’দশক। ১৯৯০ সালে অনুমোদন মিললে, ১৯৮২ সালে শিলাবতী নদীর তীরে ঘাটাল মাস্টার প্ল্যানের সূচনা করেন তৎকালীন বাম সরকারের সেচমন্ত্রী প্রভাস রায়। কিন্তু কাজ শুরু হওয়ার অল্প দিনের মধ্যেই প্রকল্পটি বন্ধ হয়ে যায়। ২০০৬ সালে ফের বিষয়টি নিয়ে তোড়জোড় শুরু হলে ফের ৯০০ কোটি টাকা বরাদ্দ হয় প্রকল্পটির জন্য। ১৯৮২ সালে যা ৫০ কোটি বলে ঠিক হয়েছিল। কেন্দ্র এবং রাজ্য, দু’তরফে যথেষ্ট সক্রিয়তা না থাকায়, সে বারও প্রকল্পটি হিমঘরে চলে যায়। ২০০৯ সালে কেন্দ্র সরকারের অধীনে একটি সংস্থাকে মাস্টারপ্ল্যানের প্রকল্প রিপোর্ট তৈরি করা হয়। যেখানে আনুমানিক ব্যয় ধরা হয়েছিল ১৭৪০ কোটি টাকা। ২০১৫ সালে গঙ্গা ফ্লাড কন্ট্রোল কমিশন (জিএফসি) প্রকল্পের ছাড়পত্র দেয়। তাতে প্রায় ১২১৫ কোটি টাকা মঞ্জুরের সুপারিশ করে। তারপর ২০২২ সালে কেন্দ্রীয় প্রকল্পটি ফ্লাড ম্যানেজমেন্ট এন্ড বর্ডার এরিয়ার প্রোগ্রামের অন্তর্ভুক্ত হয়। কিন্তু এখনো পর্যন্ত কোনও টাকা বরাদ্দ হয়নি। এই নিয়ে চলেছে রাজনৈতিক চাপানউতোর। মাস্টার প্ল্যান রূপায়িত না হওয়ায় ঘাটালবাসী এখন এই প্রকল্পের নাম শুনলেই ক্ষোভে ফুঁসে ওঠেন। বিরক্ত হন। তাদের ধারণা বানভাসি ঘাটাল কে বাঁচাতেই পারবে ঘাটাল মাস্টার প্ল্যান। অথচ, সব জেনে বুঝেও, কোনও সরকার কোনও কিছুই করছে না। শুধু কুমীর ছানার মতো ব্যবহার করা হচ্ছে।
কেন ঘাটাল প্লাবিত হয়? ঘাটাল প্লাবিত হওয়ার পিছনে রয়েছে বেঙ্গল বেসিনে নিওটেকনিকের প্রভাব ও ভৌগলিক কারণ। ছোটনাগপুর মালভূমি থেকে উৎপন্ন শিলাবতী, কংসাবতী, দ্বারকেশ্বর-সহ একাধিক নদীর ভূমি ঢাল পরিবর্তন করে ভাগীরথী হুগলি নদীর পশ্চিমে রাঢ় সমভূমিতে এসে মিশেছে। ফলে ভাগীরথী হুগলির পশ্চিম তীরে উপনদীগুলি, এই হঠাৎ ঢাল পরিবর্তনের ফলে রাঢ় সমভূমিতে অনেকগুলো শাখায় বিভক্ত হয়ে পড়ে ও তাদের নদী খাত ক্রমশ সরু হয়ে যায়। বিশেষ করে বেঙ্গল বেসিনে নিওটেকনিক পরিবর্তনের কারনে নদীগুলি চরিত্র পরিবর্তন হয়েছে। এই নদীগুলি প্রধানত বর্ষার জলে পুষ্ট। সারাবছর নদী খাতের জল খুব অল্প থাকে। কিন্তু বর্ষাকালে নদীগুলি ভয়ংকর চেহারা নেয় ও প্রায়শই দুকূল ছাপিয়ে বন্যার সৃষ্টি করে।
বাঁকুড়া ও পশ্চিম মেদিনীপুরের বিস্তীর্ণ এলাকা এবং বিশেষত ঘাটাল বন্যাপ্লাবিত। শিলাবতী ও জয়পন্ডা নদীর প্রবল স্রোতের কারনেই এই বিপর্যয়। শিলাবতীর উৎস পুরুলিয়া জেলার হূড়া থানার বড়গ্রাম মৌজার একটি পুকুর! এই গ্রামেই শিলাবতী ও জয়পন্ডার নিত্য পুজো হয় এবং গ্রামবাসীদের মুখে শোনা যায় শিলাবতী নামক প্রাগার্য কন্যা ও তার পালক ব্রাহ্মণ পিতা সম্পর্কে এক অমর কাহিনী।
শিলাবতী নদী (এছাড়া শিলাই নামেও পরিচিত) বাঁকুড়া এবং পশ্চিম মেদিনীপুর জেলার মধ্য দিয়ে প্রায় দক্ষিণ-পূর্ব দিক দিয়ে প্রবাহিত হয়ে পশ্চিম মেদিনীপুরের ঘাটালে দ্বারকেশ্বরের সঙ্গে মিলিত হয়ে পরে রূপনারায়ণ নামে গঙ্গায় মিশেছে।
প্রায় প্রতি বছর শিলাবতী বন্যার কারণ হয়ে দাঁড়ায়, বিশেষ করে পশ্চিম মেদিনীপুরের চন্দ্রকোনা-১, চন্দ্রকোনা-২ এবং ঘাটাল ব্লক। খাতড়ার কাছাকাছি শিলাবতী নদীর উপর একটি ছোট জলাধার রয়েছে, যা কদমদেউলী বাঁধ হিসাবে পরিচিত, যেখানে মুকুটমনিপুর কংসাবতী বাঁধ থেকে একটি খাল জুড়েছে।
পুরুলিয়ায় ও সংলগ্ন বাঁকুড়া জেলায় শিলাবতী নদী ছোট নদী হিসাবেই পরিচিত, কেবলমাত্র বর্ষাকালেই নদীটি জলে ভরে ওঠে ও বন্যার কারণ হয়। বাঁকুড়া জেলার ইন্দপুর, হাতিরামপুর, তালডাংরা, সিমলাপাল, ভূতশহর-এর মধ্যে দিয়ে প্রবাহিত হয়ে মেদিনীপুর জেলায় প্রবেশ করেছে।
শিলাবতী নদী ৬৯ মাইল দীর্ঘপথ অতিক্রম করে ঘাটালের মধ্য দিয়েই প্রবাহিত হয়েছে। বছরের পর বছর পলি জমে জমে নদীগর্ভ ভরাট হয়ে জলধারণ ক্ষমতা কমে গিয়েছে সেগুলির। যে কারণে একটু বর্ষাতেই ঘাটাল মহকুমার বিস্তীর্ণ এলাকা প্লাবিত হয়ে যায়। তাতে একরের পর একর জমি, ফসল, বাড়িঘর, রাস্তাঘাট, পশুপাখির সলিল সমাধি ঘটে। একদিকে একটানা বৃষ্টি এবং ডিভিসি-র ছাড়া জলে সহজে বানভাসি হয় সমগ্র এলাকা। প্রতিবছরই বন্যার কবলে পড়ে ঘাটালবাসী।
সবচেয়ে ঘাটালের পরিস্থিতি ভয়ঙ্কর হয়েছিল ১৮৮৮, ১৯১৩, ১৯২২, ১৯৪২, ১৯৫৬, ১৯৫৯, ১৯৬৮, ১৯৭১, ১৯৭৩, ১৯৭৮, ১৯৮৪, ১৯৯৫, ২০০৭, ২০১৩, ২০১৭, ২০২১ সালের বন্যায়। কারণ বানভাসি পরিস্থিতির জেরে ঘাটাল এলাকা ২৫০ -৭০০ বর্গ কিলোমিটার এলাকা বন্যার জলে ২-৩ মিটার ডুবে গিয়েছিল। বন্যার জল কমতে সময় লেগেছিল ১৫ থেকে ৩০ দিনেরও বেশি। যত দূর চোখ যায়, শুধু জল আর জল, যাতে ‘জমিন-আসমান’-এর ফারাক বোঝাই দুঃসাধ্য হয়ে পড়ে। ঘাটাল মাস্টার প্ল্যান রূপায়িত হলে হয়তো বন্যা চিরতরে বন্ধ হবে, এমন ভাবাও কতটা যুক্তিযুক্ত তা নিয়েও প্রশ্ন থাকে। বিশেষত, বর্তমানে শহর সম্প্রসারণ, জনসংখ্যা বৃদ্ধি, রাস্তা সম্প্রসারণ, নতুন রাস্তা নির্মাণ প্রভৃতি একাধিক বিষয় অনেক প্রতিকূল হয়েও দাঁড়াবে। কিন্তু বানভাসি মানুষ ও বন্যার পরিস্থিতির কিছুটা উন্নতি হবে, তা নিশ্চিত করেই বলা যায়। বিশেষ করে দাসপুর, চন্দ্রকোনা, কেশপুর, ঘাটাল, মেদিনীপুর বেশ কিছু অঞ্চল। নদী বাঁধ ভাঙ্গনের প্রবণতা কমবে ও বন্যা নিয়ন্ত্রণ হবে। কংসাবতী, শিলাবতী নদী সংস্কার ও বাঁধ নির্মাণের ফলে বন্যার তীব্রতা ও ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ কমবে। সেই আশায় বুক বেঁধেছে ঘাটাল সহ মেদিনীপুরবাসী।
লেখক: ভূগোলের অধ্যাপক, রাজা নরেন্দ্রলাল খান মহিলা মহাবিদ্যালয়, মেদিনীপুর।


