‘মুঘল সম্রাটদের আম্রপ্রীতি’, এক অজানা কাহিনী লিখছেন উপ-উদ্যানপালন অধিকর্তা ড.সমরেন্দ্র নাথ খাঁড়া

‘মুঘল সম্রাটদের আম্রপ্রীতি’, এক অজানা কাহিনী লিখছেন উপ-উদ্যানপালন অধিকর্তা ড.সমরেন্দ্র নাথ খাঁড়া
13 May 2023, 11:40 AM

‘মুঘল সম্রাটদের আম্রপ্রীতি’, এক অজানা কাহিনী লিখছেন উপ-উদ্যানপালন অধিকর্তা ড.সমরেন্দ্র নাথ খাঁড়া

 

ড. সমরেন্দ্র নাথ খাঁড়া

         

বাবার হ’ল আবার জ্বর সারিল ঔষধে। ছোটবেলায় ইতিহাস পড়ার সময় প্রায় সবাই এই লাইনটা মুখস্থ করতাম। মুঘল সম্রাট পর পর কে কে ভারতবর্ষ শাসন করেছেন তা মনে রাখার জন্য। বাবর-হুমায়ন-আকবর- জাহাঙ্গীর-শাহজাহান-ঔরঙ্গজেব। ফলের রাজা আমের প্রতি এইসব সম্রাটদের কেমন ভালোবাসা ছিল তা আমরা তাদের সব-লিখিত জীবনী, দিনলিপি বা সমসাময়িক লেখক-পর্যটকদের বিবরণ পড়ে জানতে পারি। তাঁদের আম্রপ্রীতির কথা সুললিত ভাষায় লিপিবদ্ধ করা আছে। ভারতবর্ষে মুসলিম শাসনকালে মূলত আম চাষ ও আমবাগান তৈরি জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। দিল্লির সুলতান কায়কোবাদ, জালালুদ্দিন, আলাউদ্দিন খিলজি, গিয়াসউদ্দিন তুঘলক সব নবাবই আম পছন্দ করতেন। তাঁদের পৃষ্ঠপোষকতায় ভারতবর্ষে আম চাষের প্রসার ঘটে।কিন্তু মোগল আমলে আমের ব্যাপকভাবে পরিচিতি ঘটে।

বাবর:

বাবরনামায় জহিরুদ্দিন বাবরের (১৫২৬-১৫৩০) আমপ্রীতির উল্লেখ পাওয়া যায়। তিনি আমকে বলতেন ‘পোর-ই-হিন্দ’। অর্থাৎ হিন্দুস্থানের সেরা পছন্দসই ফল। বাবরের ভারতবর্ষ আক্রমণ এবং মুঘল সাম্রাজ্য স্থাপনের পিছনে আমের একটা প্রচ্ছন্ন ভূমিকা ছিল। পঞ্জাব-রাজ দৌলত খান লোদী প্রথমবার বাবরকে হিন্দুস্থান আক্রমণ করতে বলেন। তখন দিল্লীর সুলতান ছিলেন ইব্রাহিম লোদী। তাঁর সাথে যুদ্ধ করার ব্যাপারে তিনি চিন্তায় পড়ে যান। কিছুতেই মনস্থির করে উঠতে পারছিলেন না।এমন সময় পুনরায় দৌলত খানের দূত তাঁর কাছে ভারত আক্রমণ করার কথা বলতে হাজির হন।সঙ্গে আনেন নজরানা–মধুপূর্ণ পাত্রে ডোবানো ভারতবর্ষের বিখ্যাতসব আধপাকা আম। এই নজরানা পেয়ে বাবর তো মহা খুশি। একের পর এক হিন্দুস্থানের আম চেখে দেখলেন। হিন্দুস্থানী আমের খুশবু আর স্বাদ তাঁর দিল জিতে নিল। ১৫২৬ সালে বাবর ভারত আক্রমণ করলে পাণিপথের প্রথম যুদ্ধ হয়। ইব্রাহিম লোদিকে পরাস্ত করে এদেশে মুঘল সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠা করেন। সম্রাট বাবর স্বয়ং তাঁর স্মৃতিকথা ‘তুজুক-ই-বাবরী’তে আম সম্বন্ধে লিখেছেন - ‘ফার্সিতে আমের নাম নাঘজাক।........... আম কাঁচা অবস্থায় গাছ থেকে পেড়ে বাড়িতে পাকানো হয়। পাকা ফলের গায়ে একটা ছোট্ট ফুটো করে শাঁস অংশ চুষে খাওয়া হয়।কাঁচা আম দিয়ে হয় চাটনি আর আচার।আম বর্ষাকালে পাকে সব মিলিয়ে আম হিন্দুস্থানের সেরা ফল।'

বাবর হিন্দুস্থানের গরম কোনকালেই সহ্য করতে পারতেন না। তাই বাদশার জন্য গরমকালে কাঁচা আমের চাটনি আর শরবতের ব্যবস্থা করে সুরাহা করা হ’ত এবং বাদশাও খুশী হতেন এবং পছন্দ করতেন।

হুমায়ন:

হুমায়ন যখন বাংলার গৌড় আক্রমণ করেন, তখন গৌড়ের প্রতিটি বাগানে আম ফলেছিল। সেই দৃশ্য দেখে তিনি গৌড়কে বলেছিলেন ‘জন্নতাবাদ’। শেরশাহ তাঁর পিছনে ধাওয়া করেছে জেনেও আমের লোভে তিনি ছ'মাস গৌড়ে ছিলেন। আর, এই আমের প্রতি মোহের জন্য তাঁকে কি খেসারত দিতে হয়েছিল, তা আমাদের সকলেরই জানা।

আকবর:

মুঘল সম্রাট আকবর (১৫৫৬-১৬০৫) ছিলেন অত্যন্ত আমপ্রিয় বাদশা। রাজদরবারে তাঁর জন্য নাকি আম

সাজানো থাকতো।আম না পেলে গোঁসাও করতেন। আমকে তিনি বলতেন ‘শের-ই-হিন্দুস্থান’। অর্থাৎ হিন্দুস্থানের সেরা। সম্রাট তো নিজে হাতে ছুড়ি দিয়ে ডাঁশা আম কেটে খেতে ভালোবাসতেন।সমস্ত আমের খোসা একটা সর্পিল অংশের মধ্যে আবদ্ধ রাখতে ভালোবাসতেন।

 সম্রাট আকবরের আমের প্রতি আসক্তি নিয়ে অসংখ্য গল্প প্রচলিত আছে। সম্রাট আকবর একবার এক ভোজসভার আয়োজন করলেন।সেই ভোজসভায় রাজন্যবর্গসহ মন্ত্রী,সভাসদ সকলে হাজির হলেন। ভোজসভায় সম্রাট আকবরের প্রিয় সভাসদ বীরবলও উপস্থিত ছিলেন।বীরবল পেট পুরে বিভিন্ন সুখাবার খেলেন। বীরবল সম্রাটকে জানালেন, তিনি এত খেয়েছেন যে তার পেটে আর খাওয়ার মতো কোনো জায়গা নেই। আর নতুন করে কিছু খেতে পারবেন না।এমন সময় একজন খাবার পরিবেশনকারী বীরবলের পাত্রে বেশ কয়েক টুকরা আম দিয়ে যান।বীরবল সুমিষ্ট আমের লোভ সামলাতে পারলেন না।আমের সেই টুকরাগুলো তৃপ্তি সহকারে খেয়ে নিলেন।সম্রাট আকবর  স্বচক্ষে সেই দৃশ্য দেখলেন।তিনি বীরবলকে বললেন, ‘কী বীরবল, তোমার পেটে নাকি জায়গা নেই? আমগুলো তো নিমেষেই সাবাড় করে দিলে!’

    বীরবল সম্রাটকে মিনতি করে বললেন, ‘মহামান্য সম্রাট! আপনি যখন রাস্তা দিয়ে যাওয়া শুরু করেন,তখন রাস্তায় লোকজন থাকলেও তারা সরে যায়,রাস্তা ফাঁকা হয়ে যায়। মহারাজ আপনিও যেমন সম্রাট, তেমনি আম হচ্ছে সম্রাট বা ফলের রাজা।আমার পেট ভরা থাকলেও সে আমার পেটে জায়গা করে নিয়েছে।’

         বীরবলের এ কথায় সম্রাট আকবর বেশ খুশি হলেন। বীরবলকে তিনি এক ঝুড়ি আম উপহার দিলেন। এই হলো আমের ‘ফলের রাজা’ উপাধি পাওয়ার কাহিনি।তিনি শুধুমাত্র রাজ্য বিস্তারেই মন দেননি – দেশে উন্নত কৃষিব্যবস্থা গড়ে তুলতেও উদ্যোগী হয়েছিলেন।তিনি বিহারের দ্বারভাঙ্গার কাছেই এক লক্ষ আম গাছের সুবিশাল আমবাগান ‘লাখবাগ’ / ‘লক্ষবাগ’ তৈরী করেছিলেন। তিনি দিল্লিতেও বাংলা ও বিহার থেকে উন্নত প্রজাতির আমের চারা নিয়ে বাগান তৈরী করেন।সে সময়ে দিল্লীর বাজারে উত্তরপ্রদেশের কিরানার আম অত্যন্ত জনপ্রিয় ছিল। আকবরের আত্মজীবনী ‘আইন-ই-আকবীর’র একটা বড় অংশ জুড়ে আমের আবুল ফজল বর্ণনা করেছেন।‘ফলের রাজ্যে স্বাদ্যে-গন্ধে আম তুলনাহীন। ইরানের ভোজনবিলাসীরা একে তরমুজ বা আঙুরের থেকেও বেশি পছন্দ করেন।আকারে এই ফল অনেকটা অ্যাপ্রিকটের মতো দেখতে এবং ওজন একসের (৯৩২ গ্রাম) বা তার চেয়ে সামান্য বেশি।গ্রীষ্মকালে আম পাকতে শুরু করে, বর্ষা নাগাদ গাছে গাছে টুসটুসে পাকা আম দেখা যায়। ভারতবর্ষের প্রায় সবপ্রান্তেই আমের দেখা মেলে – তবে বঙ্গদেশ, গুজরাট, মালওয়া, খান্দেশ ও দাক্ষিণাত্যের......আমের স্বাদই আলাদা। ইদানীং বাদশাহের আদেশে পাঞ্জাবেও আমগাছ লাগানো হচ্ছে।........ এদেশে আমগাছের গোড়ায় দুধ ও গুড় ঢালা হয়। প্রচলিত বিশ্বাস এর ফলে গাছের আম মিষ্টি হবে।' আবুল ফজল সেযুগে আম সংরক্ষণের এক অদ্ভুদ উপায়ের কথাও উল্লেখ করেছেন – ‘দু'আঙুল লম্বা ডাল (বোঁটা) সমেত একটা আধপাকা আমকে গাছ থেকে পাড়ার পর ডালের (বোঁটার) ভাঙা অংশে গরম মোম লাগাতে হবে।তারপর ডাল (বোঁটা) সমেত আমটিকে ডুবিয়ে রাখতে হবে মধুভরা পাত্রে।' এইভাবে রাখার ফলে আমের যথার্থ স্বাদ ও সুবাস কমপক্ষে দেড় থেকে দুই বছর অক্ষুন্ন থাকে। সম্রাট আকবর লাহোরে রাজধানী প্রতিষ্ঠার সময়ে আমকে সুমিষ্ট করার জন্য আমগাছের চতুর্দিকে দুধ ও গুড় থেকে তৈরী একধরনের সার প্রয়োগ করিয়েছিলেন।

জাহাঙ্গীর:

   জাহাঙ্গীর (১৬০৫-১৬২৭) আমের বড় পৃষ্ঠাপোষক হ’য়ে ওঠেন। জাহাঙ্গীর তাঁর ডায়েরিতে লিখেছেন -‘আজ দাক্ষিণাত্য, বুরহানপুর, গুজরাত আর মালব পরগনা থেকে আম পাঠিয়েছিল। আঁশ নেই, বড় বড় দেখতে,বেশ রসালো আর মিষ্টি। তবে রসে গন্ধে আগ্রার আমের ধারেকাছে কেউ নেই।' তাঁর আমলে এক ভক্ত ওমরাহ মুকব খান জাহাঙ্গীরকে উত্তরপ্রদেশের কাছে মুজফ্ফরনগরে এক বিরাট আমের বাগান করে এবং একই গাছ থেকে ৩ সেপ্টেম্বর থেকে ১৭ই অক্টোবর – দুইমাস ধরে আম খাইয়ে তাজ্জব করে দিয়েছিলেন। বাদশা স্বয়ং তাঁর রাজদরবারের ঘনিষ্ঠ ওমরাহ মুকব খানের কিরানার আমবাগানের ফলনের ব্যাপারে তদারকি করতেন। কারণ ওই বাগানের উন্নত জাতের আম জাহাঙ্গীরের রসনাকে অক্টোবর মাস পর্যন্ত তৃপ্ত করত। উৎফুল্ল, তৃপ্ত সম্রাট ঘোষণা করেন – রাজকর্মচারীরা

আমের বাগান করলে তাদের সমস্ত খাজনা মুকুব করে দেওয়া হবে। এর ফলে রাজা ও নবাবদের মধ্যে আমের বড় বড় বাগান তৈরী করার সুস্থ প্রতিযোগিতা শুরু হয়ে যায়। তবে জাহাঙ্গীরের আমলে খোদ সম্রাটের বাগান ছাড়া অন্য কারো বাগানে আমগাছের কলম তৈরী করা নিষিদ্ধ ছিল। ‘তুজুক-ই-জাহাঙ্গীরী’ তে তিনি লিখেছেন –‘কাবুলের কোন ফলে নেই হিন্দুস্থানী আমের সৌন্দর্যসুষমা বা রসনাতৃপ্তির স্বর্গীয় অনুভূতি।' তাঁর আমলে আসা ভূ-পর্যটক টমাস রো -এর লেখা থেকে জানা যায় রাজস্থানের টোডায় জাহাঙ্গীরের অর্থানুকুল্যে প্রায় দু'মাইল লম্বা ও দেড় মাইল চওড়া আমবাগানের কথা।

শাহজাহান:

       সম্রাট শাহজাহানও (১৬২৮-১৬৫৮) পিতার পদাঙ্ক অনুসরণ করেছিলেন। নিয়ম ছিল আম নিয়ে বৈজ্ঞানিক চর্চা ও কলম তৈরী হবে শুধুমাত্র বাদশাহি বাগিচায়। শাহজাহান অন্যদেরও কলম তৈরী করার স্বাধীনতা দেন। এভাবেই ঘটে গেল আমের গণতন্ত্রীকরণ। তাজমহলের পাশাপাশি ক্ষুদ্র এই ঘোষণা শাহজাহানের এক কৃতিত্ব। বলা হ’ল যাঁরা আমের চর্চা ও কলম তৈরী করবেন ফল, বিশেষ করে আম চাষে তাদের খাজনা মুকুব করা হবে। বুর্হানপুরের সুবেদার শাহজাহানের জন্য প্রতি বছর ঘোড়া ও উটের পিঠে চাপিয়ে আম পাঠাতেন। বুর্হানপুরের আম সম্রাটের অতীব প্রিয় ছিল। সম্রাট শাহজাহানের জীবনীগ্রন্থ ‘শাহনামা'য় আম্রপ্রীতির উল্লেখ আছে। আম অনুরাগ প্রসঙ্গে সম্রাটের একটি চিঠি বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। শাহজাহান তখন আগ্রার মসনদে আসীন। পুত্র ঔরঙ্গজেবের ঔদ্ধত্য ও দৌরাত্ম্যে তিতিবিরক্ত হয়ে এক চিঠিতে সম্রাট তাকে লিখলেন – 'তোমার অযোগ্যতা, দীর্ঘসূত্রতা ও কুশাসন আমার সহ্যের সীমা ছাড়িয়ে যাচ্ছে। ........ কিন্তু বুরহানপুরের আমার প্রিয় গাছের আম আমাকে না পাঠিয়ে নিজে আত্মসাৎ করে তুমি যে কাজ করেছ তা ক্ষমার অযোগ্য।'

ঔরঙ্গজেব:

সম্রাট ঔরঙ্গজেবের (১৬৫৮-১৭০৭) আমলেও আমের কদর ছিল। বুরূহানপুরের বিখ্যাত আমের ভাগ কাউকেই দিতেন না। ঔরঙ্গজেব পারস্য সম্রাট শাহ আব্বাসকে ইসফাহানের তাবিয়াত খানের মারফত কিছু তাজা আম উপহার হিসাবে পাঠিয়েছিলেন। সম্রাট ঔরঙ্গজেব বুরহানপুরের সাদা পাথরের সুরম্য প্রাসাদের লাগোয়া তার মোসা মীর খলিলের আমবাগানে এক অপরূপা সুন্দরী যুবতীর লাফিয়ে লাফিয়ে আম পাড়ার দৃশ্য উপভোগ করতেন।শাহজাদা দ্বারা শিকো আমগাছ পরিচর্যার একমাত্র বিজ্ঞানসম্মত পদ্ধতি বিষয়ক জ্ঞানগর্ভ ও বিস্তৃত লেখা লিখে গেছেন। সম্রাট শাহজাহানের বিদ্ধান এই পুত্রের কৃষিবিজ্ঞান বিষয়ক গ্রন্থ ‘নুশক-দার-যগন্নি-ফালাহৎ' (Art of Agriculture) সেই সময়ের উল্লেখযোগ্য আকরগ্রন্থ।আমগাছ পরিচর্যা, আমের ফলন বাড়াবার যেসব উপায় লিপিবদ্ধ করেছেন তা আধুনিক উদ্ভিদবিজ্ঞানী,উদ্যানবিজ্ঞানীদের অবাক করে দেয়।বর্তমান উদ্যান গবেষকদের গবেষণার পাথেয় হ’তে পারে।

        মুঘল সম্রাটদের রাজ্যবিস্তার, রাজ্যশাসনের সাথে সাথে আমের প্রতি অনুরাগ, ভালোবাসা আমকে আমজনতা,আম দরবারের মত তামাম বিশ্বের কাছে অতি পরিচিত জনপ্রিয় এক ফলে পরিণত করেছে।

                        .......................

Mailing List