Loving-Jesus প্রেমময় যীশুখৃষ্ট --- ‘মসিহ’ ঈশা / দ্বিতীয় পর্ব

প্রেমময় যীশুখৃষ্ট --- ‘মসিহ’ ঈশা / দ্বিতীয় পর্ব
(এক তথ্যসমৃদ্ধ ধারাবাহিক ধর্মীয় কাহিনী)
সুপ্রিয় বন্দ্যোপাধ্যায়
(পূর্বকথা)
আমরা সাধারণতঃ যীশুখৃষ্টের জীবনীটাই বেশি জানি, আর জানি ওঁনার কর্মময় জীবনের কথা, ঐশ্বরিক জীবনের প্রেমদানের কথা। আমরা জেনেছি, তাঁর উপদেশ-বাণী, অবশেষে কষ্টের জীবনের কথা--- ক্রুশ বিদ্ধ ঘটনার করুণ কাহিনী। আর অবশ্যই পুনরুত্থিত হবার ঘটনা।
তবে, আমরা একটু বিস্তারিত ভাবে ওঁনাকে জানার চেষ্টা করব, বোঝার চেষ্টা করব। উনি যে আমাদের পরিত্রাতা ঈশ্বরের পরমপ্রিয়-পুত্র।
আমাদের হিন্দু ধর্মে ঈশ্বরের প্রেরিত পুত্রকে বা দূতকে বলা হয় অবতার।
হিন্দু শাস্ত্র মতে মানুষ বা মনুষ্যেত্বর প্রাণীর রূপে শ্রী বিষ্ণু ভগবান বা ঈশ্বরের পৃথিবীতে আগমন। পৃথিবীর পাপ ভার, অধর্মের নাশ, ও ধর্মস্থাপনের উদ্দেশ্যে ঈশ্বর বিভিন্ন সময়ে অবতার-রূপে পৃথিবীতে আবির্ভূত হন।
অধম নিজে হিন্দু-ধর্মাবলম্বী এক মানুষ হবার কারণে সর্বধর্ম-সহিষ্ণুতায় বিশ্বাসী। কোনো মানুষের যেমন নিজ-ধর্মের প্রতি অতি অনুরাগ থাকা উচিত, তেমনি ভিন্ন ধর্মের প্রতি উষ্মা বা বীতশ্রদ্ধ বা বিরূপ ভাব পোষন করা উচিত নয়। সবার ওপরে মানব ধর্ম; সেই ধর্মে বিশ্বাসী হয়ে সর্বদাই জাগতিক নিয়মে সৃষ্ট বিভিন্ন ধর্ম--- যেমন: হিন্দু, বৌদ্ধ, খৃষ্টান, পার্সী, জৈন, ইসলাম প্রভৃতি নানা ধর্মের মধ্যে যোগসূত্র খুঁজে নিতে হয়।
বিশ্বাত্মা বা জগদীশ্বর এক এবং অদ্বিতীয়। ভিন্ন ভিন্ন রুপে, তিনি ভিন্ন ভিন্ন স্থানে প্রকট হয়েছেন তিনি; তাঁর করুণা অসীম যে তিনি মানুষকে শুদ্ধ চেতনা দিয়ে সর্বশ্রেষ্ঠ জীব করে মর্তে পাঠিয়েছেন। আমরা নানা সময়ে তাঁর ভিন্নভিন্ন রূপে, তাঁরই নানা কলেবর নিয়ে মতের অনৈক্য প্রকাশ করে থাকি --- কিন্তু আমরা জানি যে, যা ‘জল’, তাই ‘ওয়াটার‘ আবার তাই-ই ‘পানি‘। নাম ভিন্ন, কিন্তু কার্যকারিতা বা উদ্দেশ্য এক --- শীতলতা দান করা, মানুষের তৃষ্ণা মেটানো।
তেমনি-ই ঈশ্বর। যিনিই কৃষ্ণ, তিনিই আল্লাহ্, আবার তিনিই গড --- কিংবা বুদ্ধ, নানক, কবীর, মহাবীর --- সব।
কয়েকটি টুকরো মিছরি মুখে পুরে দিলে যেমন সমান মিষ্টত্বে মন ভরে ওঠে, তেমনি এই সব ধর্মের ঈশ্বর এক ও অদ্বিতীয়। সব পথ দিয়েই তাঁর কাছে পৌছানো যায়।
যা বলছিলাম...আমাদের হিন্দুশাস্ত্রের “ভগবদ্গীতা” ও “দেবীমাহাত্ম্যম্“ -এ বলা আছে, শ্রী ভগবান বিষ্ণু ও ঈশ্বরী শক্তি জগজ্জননীর বিভিন্ন রূপে আবির্ভাবের কথা। এঁরা আসেন অবতার-রূপে।
এখন প্রশ্ন উঠতে পারে, “অবতার“কে? কাকে আমরা “অবতার“ বলতে পারি?
সহজ ভাবে শ্রীরামকৃষ্ণ দেবের ঘনিষ্ঠ ভক্ত, ‘পাঁচ-সিকে পাঁচ আনা’-র ভক্ত নট-নাট্যকার গিরিশচন্দ্রের কথায় “যিনি মর্তে আবির্ভূত হয়ে ভক্তদের নিজের মতোন করে কোনটা ভালো, কোনটা মন্দ বুঝিয়ে দেন --- যিনি দুধ আর জলের মধ্যে থেকে জলটা বাদ দিয়ে কেবল সার-বস্তু হিসেবে দুধটুকুই গ্রহণ করে --- ধর্মের সারবত্তাটি মানুষকে বুঝিয়ে দেন----যিনি নররূপে আসেন মানুষের মতো সুখ-দুঃখে তাদেরই মতো অতি সাধারণ হয়ে কেবল বিপথগামী মানুষকে সঠিক পথটা দেখিয়ে দেবার জন্য ------ তিনিই ‘অবতার‘।’’
অনেকে আবার মানতে চান না এই অবতারত্ব ---- তাঁরা বলেন, এটা অসম্ভব। এমনকি, স্বয়ং স্বামী বিবেকানন্দ তাঁর পূর্বাশ্রমে যখন নরেন্দ্রনাথ বলে পরিচিত ছিলেন, তিনিই তা মানতে চাননি। তিনি বলেছিলেন, “কি করে ঈশ্বর নিজে থেকে মানুষের কাছে এসে ধরা দেবেন? তিনি যে ‘অবাংমনোসগোচরম্’ ---- বাক্য-মনের অতীত তিনি। আর যিনি বাক্য ও মনের অগম্য, তিনি কিভাবে মানুষের কাছে আসবেন?’’
সেদিন কিন্তু দুই প্রিয় শিষ্যের বিবাদ থামিয়ে দিয়েছিলেন যুগপুরুষ শ্রীরামকৃষ্ণ পরমহংসদেব; তখন তিনি অসুস্থ, গলার ক্যান্সারে বেশ কষ্ট পাচ্ছেন। ভক্তদের সেবা-যত্নে কাশীপুরের বাগান-বাড়িতে আছেন। ধীরে, অথচ, দৃঢ়তার সাথে বলেছিলেন সেদিন, “অবতার আসেন অন্তর্যামী রূপে, মানুষকে নিজের লোকের মতো বুঝিয়ে দিতে। যুগে যুগে তিনি মানুষের কাছে আসেন তাদের ভুলটা শুধরে দিয়ে সঠিক পথে চালনা করতে। তাই তো, “পঞ্চভূতের ফাঁদে, ব্রহ্ম পড়ে কাঁদে।“
অবতার দু’রকমের --- অংশাবতার ও পূর্ণাবতার।
শ্রীভগবান যদি আংশিক-ভাবে অবতীর্ণ হন, তখন তিনি অংশাবতার; আর পরিপূর্ণভাবে অবতীর্ণ হলে, পূর্ণাবতার।
বিভিন্ন পৌরাণিক আখ্যানে চার, ছয়, দশ, ষোল, বাইশ, তেইশ --- এমনকি ঊনচল্লিশ অবতারের কথা বলা থাকলেও, বিষ্ণুর দশ অবতারের কথাই যুক্তি গ্রাহ্য। তাঁরা হলেন–মৎস, কূর্ম, বরাহ, নৃসিংহ, বামন, পরশুরাম, রাম, কৃষ্ণ, বুদ্ধ আর কল্কি।
তবে, এরপরে ও প্রামাণ্য ভাবে তৎকালীন সমাজের পন্ডিত ও শিক্ষিত-সমাজের অভিজ্ঞ পুরুষ, গৌরীকান্ত তর্কলঙ্কার ও বৈষ্ণব রা রাণী রাসমণির জীবদ্দশায় তাঁর জামাতা মথুরামোহন বিশ্বাসের ডাকা এক তর্ক সভায় দক্ষিণেশ্বরে মা ভবতারিণীর মন্দিরের পুজারী গদাধর চট্টোপাধ্যায়কেও অবতার বলে প্রমাণিত করেছিলেন। উত্তর কালে, ইনিই শ্রীরামকৃষ্ণ পরমহংসদেব বলে পরিচিত হন।
আর প্রভু যীশুর এই যেনর রূপে আবির্ভাব, সেটাকেও ম্যাথাউ ---ঈশ্বরের পুত্র বা জগতের পরিত্রাতা হিসাবে মান্যতা দিয়েছিলেন। তিনিও তাঁর ইহুদি গোষ্ঠীর এক অল্প সংখ্যক লোক জনেরা যীশুকে ঈশ্বরের প্রতিভূ বলেই মনে করতেন।
ইসলাম ধর্মে ও খৃষ্ট ধর্মের পবিত্র ধর্ম-গ্রন্থ বাইবেলের নিউ টেস্টামেন্টর বা নতুন নিয়মে আখ্যায়িত যিশুকে মেনে নিয়েছিল সানন্দে।
ইসলাম ধর্মের পবিত্র ধর্ম-গ্রন্থকোরান ও হাদিস-এ (“সময়ের সমাপ্তি“) যিশুকেই ‘ঈশা’ বলে ব্যক্ত করা হয়েছে। এখানে তিনি হলেন আল্লাহ্ (একেশ্বর) রসুল ( ঈশ্বরের বার্তা-প্রচারক বা বাহক) ----- একজন অদ্বিতীয় ও গুরুত্বপূর্ণ নবী (অদৃশ্যের সংবাদ-দাতা বা ঈশ্বরের দূত --- পয়গম্বর)।
ইসলামের ওই পবিত্র গ্রন্থে ঈশার মা-কে‘ মরিয়ম‘ বলে পরিচিত করা হয়েছে, ( খৃষ্ট ধর্মে যিনি ‘মেরী‘ বলে আখ্যায়িত) এবং তাঁর জীবনের বেশ কিছু বর্ণনা দেওয়া আছে।
ইসলামে ঈশাকে ‘মসিহ‘ বলে আখ্যায়িত করা হয়েছে ---- যার অর্থ ‘অভিষিক্ত‘; কোরান ও হাদিসের বিভিন্ন ঘটনা সমূহের এক কেন্দ্রীয় চরিত্র হলেন ঈশা। এবং এখানে ঈশার মা মরিয়মকে কেন্দ্র করে একটি পুরো অধ্যায় (সুরা) আছে, তা আলোচিত হয়েছে “সুরামরিয়ম’’ নামে।
বন্ধুরা, ঈশ্বর এক এবং অদ্বিতীয়। নামে ভিন্ন --- কিন্তু আধারে এক।ধর্ম-পথ আলাদা, কিন্তু সব পথ-ই গিয়ে তাঁর কাছে মিশেছে।
তাই, সোচ্চারে আমরা বলতে পারি, যিনি যীশু --- তিনিই ঈশা; আবার যিনিই ঈশা --- তিনিই যীশু। সব মিলে-মিশে একাকার।
(ক্রমশঃ)



