হেরিটেজের হদ্দমুদ্দ: প্রসঙ্গ গুরুসদয় মিউজিয়াম

হেরিটেজের হদ্দমুদ্দ: প্রসঙ্গ গুরুসদয় মিউজিয়াম
ভারতীয় সংস্কৃতি বা ভারতের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যকে কেন্দ্র করে সাম্প্রতিককালে এক বিশেষ জাতীয়তাবাদী আলোড়ন সৃষ্টি হয়েছে। ভারতীয় সত্তার পুরিপুষ্টি সাধনে এ ধরণের উদ্যোগ আপাতভাবে খারাপ কিছু নেই। বরং তা সাধুবাদ যোগ্য। তবে এই উদ্যোগের মধ্যে এক অর্থে নতুনত্ব কিছু নেই। স্বাধীনতা পূর্ববর্তী সময়ে ভারতীয় সংস্কৃতির সংরক্ষণ, প্রচার ও প্রসারে এক অকৃত্রিম ভালোবাসা ও যথাবিহিত যোগ্যতার প্রমাণ পাওয়া যেত। কিন্তু বর্তমানে যা হচ্ছে, এর মধ্যে আদপে দেশের সংস্কৃতিকে রক্ষা করার অবিমিশ্র আগ্রহ ও প্রচেষ্টা সত্যিকারের কতটা রয়েছে তা ভেবে দেখার। কথার সঙ্গে কাজের একটা দুস্তর ব্যবধান কিন্তু থেকে যাচ্ছে।
শুরু হয়েছিল লালকেল্লাকে বেসরকারি সংস্থার হাতে তুলে দেওয়া নিয়ে। চুক্তি অনুযায়ী লালকেল্লার রক্ষণাবেক্ষন, পরিচর্যা ও বাণিজ্যিক ব্যব্যহারের স্বত্ব দেওয়া হয় একটি কর্পোরেট সংস্থাকে। দেশ ও বিদেশের বহু প্রথিতযশা মানুষ এই হস্তান্তরের বিরুদ্ধে আশঙ্কা ব্যক্ত করেছিলেন। শুধু লালকেল্লা নয়, এরকম উদাহরণ আরও রয়েছে। এ ব্যতিরেকে আর যেটুকু রয়েছে, সেগুলির ক্ষেত্রেও যথার্থ সদিচ্ছার অভাব দেখা যাচ্ছে। এর অন্যতম একটি বড় উদাহরণ হল কলকাতার জোকায় অবস্থিত গুরুসদয় মিউজিয়ামের প্রতি কেন্দ্রীয় সরকারের বিমাতৃসুলভ আচরণ। যা প্রশ্ন তুলে দিয়েছে দেশীয় সংস্কৃতি সংরক্ষণে সত্যিই কতটা আগ্রহী মোদি সরকার।
গুরুসদর দত্তের অমূল্য সংগ্রহ নিয়ে তারই প্রতিষ্ঠিত ‘ব্রতচারী গ্রামে’ তৈরি হওয়ী গুরুসদর মিউজিয়ামকে জনগণের জন্য উন্মুক্ত করে দেওয়া হয়েছিল ১৯৬৩ সালে। মূলত, ব্রতচারী আন্দোলনের উদ্গাতা গুরুসদর দত্তের দেহাবসানের অনেক বছর পর। একটি ‘সংগ্রহ বাড়ি’ হিসেবে তারই ইচ্ছা অনুসারী এই সংগ্রহশালার প্রতিষ্ঠা। গ্রাম বাংলার বিভিন্ন প্রান্ত থেকে সংগ্রহ করা ১৯-২০ শতকের প্রায় ২০০-র বেশি নকশী কাঁথা। ১৭-২০ শতকের প্রায় ৯০০ এর মতো কালী ঘট-পট, ২৭০টি পটচিত্র, ৩৬৩টি চৌকোপাট, একশোর মতো দশাবতার তাস, ১৬ শতকের টেরাকোটা প্যানেল ইত্যাদি মিলিয়ে প্রায় তিন হাজারের বেশি সামগ্রী নিয়ে এই সংগ্রহশালা গড়ে উঠেছিল। পৃথিবীর আর কোথাও এই সমস্ত দুস্প্রাপ্য লোকশিল্প পরম্পরা সংগৃহীত নেই। গুরুসদয় দত্তের এই মহতী প্রচেষ্টাকে বিশিষ্ট লোক সংস্কৃতিবিদ অধ্যাপক ফ্রাঙ্ক কোরম ভার্নাকুলার ন্যাশানালিজমের একটি অত্যুজ্জ্বল নমুণা হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। বাস্তবিকই ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলন, জাতীয়তাবাদ ইত্যাদির গভীরে গ্রোথিত রয়েছে এর ইতিহাস।
ভারত সরকারের মহামান্য রাষ্ট্রপতির প্রতিনিধির সঙ্গে গুরুসদয় মিউজিয়ামের প্রতিনিধির একটি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয় ১৯৮৪ সালে। সেই অনুযায়ী, ভারত সরকার মিউজিয়ামের কর্মচারীদের বেতনের দায়িত্ব নেয়। পাশাপাশি পরিচালন ও গঠনকাঠামো সম্পর্কে কিছু শর্তবিদিও আরোপ করা হয়। সেই মতোই চলছিল। তাল কাটে ২০১৭ সালে। বর্তমান সরকার এক তরফাভাবে চুক্তি লঙ্ঘন করে, বেতন বন্ধ করে দেয়। এক গভীর সঙ্কট ঘনিয়ে আসে ভারতীয় সংস্কৃতির ধারক ও বাহক একটি সংস্থার ভবিষ্যতের উপর। বেতনহীন অবস্থায় এই সমস্ত কর্মীরা যে কেবল চরম কষ্টে আছেন তা নয়, অপরিনামদর্শী সিদ্ধান্তের ফলে, অর্থের অভাবে ব্যহত হচ্ছে রক্ষণাবেক্ষন। নষ্ট হতে বসেছে অমূল্য প্রত্নসামগ্রী ও সাংস্কৃতিক সম্ভার। এর দায় কিন্তু প্রবল জাতীয়তাবাদের নিনাদকারী একটি দলের পরিচালিত সরকারের।
বতর্মানে এভাবেই তালাবন্দি হয়ে রয়েছে
সংস্থা নিয়ে অভিযোগ থাকলে তা নিরসনের ব্যবস্থা তো চুক্তির মধ্যেই ছিল। সে পন্থা অবলম্বন না করে, আর্থিক দায়ভার ছেঁটে ফেলে ঐতিহ্য রক্ষার কোন নিদর্শন কেন্দ্র সরকার তুলে ধরলেন? প্রশ্নটা কিন্তু উঠছেই।


