Lightning প্রাণ কাড়ছে বজ্রপাত, গাছের নীচে আশ্রয় নেবেন না, অতিরিক্ত বজ্রপাতের কারণ কী জানেন?

Lightning প্রাণ কাড়ছে বজ্রপাত, গাছের নীচে আশ্রয় নেবেন না, অতিরিক্ত বজ্রপাতের কারণ কী জানেন?
04 Jul 2023, 10:00 AM

Lightning প্রাণ কাড়ছে বজ্রপাত, গাছের নীচে আশ্রয় নেবেন না, অতিরিক্ত বজ্রপাতের কারণ কী জানেন?

 

ড. প্রভাতকুমার শীট

 

দিন দিন যেন রুষ্ট হয়ে উঠছে ইন্দ্রদেবতা! তার জেরে কি বজ্রপাত ও মৃত্যুহার পাল্লা দিয়ে বেড়ে চলেছে? প্রায় প্রতিদিনই বজ্রপাতে মৃত্যুর খবর আসছে। এক একদিন তো এক একটি জেলাতেই ৮-১০ জনের মৃত্যু ঘটনা ঘটছে। বজ্রপাত ও বিদ্যুতের ঝলকানি একটি প্রাকৃতিক বিপদ। যা অল্প সময়ে প্রাণঘাতী এবং ধ্বংসাত্মক হয়ে ওঠে। ভারতবর্ষের মত উষ্ণ ক্রান্তীয় জলবায়ু অঞ্চলে সাধারণত প্রাক-বর্ষা এবং বর্ষা মরসুমে এই ধরনের প্রাকৃতিক দুর্যোগ ঘটে থাকে। প্রতিবছর প্রায় দেড় থেকে দুই হাজার মানুষ বজ্রপাতে মারা যায়। কিন্তু গত পাঁচ বছর থেকে এই প্রবণতা একটু বেশি। ২০১৯ সালে বজ্রপাতের কারণে ২৮৭৬ জন মারা গিয়েছিল, যা ১৯৬৮ থেকে ২০১২ সালের মধ্যে গড়ে ১৫০০ এরও কম ছিল। 

পশ্চিমবঙ্গ, ঝাড়খণ্ড, বিহার, পাঞ্জাব, উত্তরপ্রদেশ, মধ্যপ্রদেশ, হরিয়ানা, হিমাচল প্রদেশ এবং পুদুচেরির মতো রাজ্যগুলিতে হঠাৎ বজ্রপাতের ঘটনা বেড়েছে। আর্থ নেটওয়ার্কস, মেরিল্যান্ডভিত্তিক তথ্য অনুযায়ী (২০২০) ভারতে মে মাসে এক দিনে ৪১০০০ বজ্রপাত হয়েছিল। এই ঘটনায় ১৪ জন মারা গিয়েছিল। এরা বিশ্বজুড়ে বজ্রপাতের তথ্য পর্যবেক্ষণ ও সংগ্রহ করে।  গবেষকদের মতে দ্রুত নগরায়ণ, উষ্ণায়ণ ও বাতাসে ধূলিকনা বৃদ্ধির কারনে ভারতে বজ্রপাতের ঘটনা ৩৪ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে।

 

কিউমুলোনিম্বাস মেঘে মেঘে ঘর্ষণের ফলে বিদ্যুতের একটি চ্যানেল বরাবর মাটির সাথে যুক্ত হয়, আবার মাটি থেকেও মেঘে ফিরে যায়। বিদ্যুতের ঝলকানিতে প্রায় ৩০০ মিলিয়ন ভোল্ট কারেন্ট থাকে। প্রসঙ্গতঃ বাড়ির বৈদ্যুতিক সংযোগে ২২০ ভোল্ট কারেন্ট থাকে। বজ্রপাত সহ বিদ্যুতের ঝলকানিতে আশেপাশে (চ্যানেল বরাবর) বাতাসের তাপমাত্রা ২৭০০০ ডিগ্রী সেন্টিগ্রেড বৃদ্ধি পায়। কিউমুলাস মেঘ ঘন, লম্বা এবং উল্লম্ব এবং শক্তিশালী হয়। যা উর্ধ্বমুখী বায়ু স্রোতে বয়ে আনা জলীয় বাষ্প দ্বারা গঠিত হয়। বজ্রপাত ছাড়াও এই মেঘগুলি অন্যান্য গুরুতর আবহাওয়া যেমন শিলাবৃষ্টি এবং টর্নেডো সৃষ্টি করতে পারে। তাই বজ্রপাত ও বিদ্যুতের ঝলকানিতে মানুষের প্রাণনাশ, বৈদ্যুতিক যন্ত্রপাতি, গবাদিপশু, গাছপালা ও ফসলের ক্ষয়ক্ষতি হয়।

 

উষ্ণ ক্রান্তীয় জলবায়ু অঞ্চলে বাতাসে ভাসমান ধূলিকণার পরিমাণ (SPM), নাইট্রোজেন ডাই অক্সাইড (NO2), সালফার ডাই অক্সাইড (SO2), ওজোন (O3) এবং অ্যারোসোলের পরিমাণ মূলত দায়ী। শুধু মাত্র ওজোন গ্যাসই প্রায় ৩০-৫০ শতাংশ বজ্রপাতের সংখ্যা ও তীব্রতা বৃদ্ধিতে সহায়তা করে। অটোমোবাইল থেকে গাড়ির ধোঁয়া, কয়লার চুল্লী, শিল্পকলখানা থেকে নির্গত ধোঁয়া প্রভৃতি গ্যাস বায়ুমন্ডলের দূষন ঘটাতে সহায়তা করে। শহরাঞ্চলে কাচ নির্মিত বাড়ি এবং কংক্রিটের আধিক্যের কারণে তাপ-দ্বীপের সৃষ্টি হয়। এর প্রভাব তৈরি হয় কার্বন এবং সালফারের মতো দূষিত কণার সাথে মিলিত কাঠামো, যখন শহরের উপর কম উচ্চতায় ঘন কিউমুলোনিম্বাস মেঘ তৈরি হয় তখন বিদ্যুৎ চমকানোর জন্য আর্দশ।

সাম্প্রতিক প্রকাশিত একটি গবেষণাপত্রে, ভারতে চরম আবহাওয়ার কারণে মৃত্যুর ক্ষেত্রে দীর্ঘমেয়াদী (১৯৭০-২০১৯) পরিবর্তনের মূল্যায়ন করেছে। তাতে উল্লেখ রয়েছে, গ্রীষ্মমন্ডলীয় ঘূর্ণিঝড়ে মৃত্যুর হার বিগত দুই দশকে ৯৪ শতাংশ কমেছে, যেখানে তাপপ্রবাহে ৬২ শতাংশ এবং বজ্রপাতের জন্য ৫৩ শতাংশ মৃত্যুর হার বেড়েছে।  সাধারণত, প্রাক-বর্ষা মৌসুমে বজ্রপাতের মাত্রা বেশি থাকে। যখন বর্ষা বিহার, উত্তরপ্রদেশ এবং প্রতিবেশী রাজ্যগুলিতে শুরু হয়, সেই সময় আর্দ্রতার মাত্রা বৃদ্ধি পায় এবং ভূপৃষ্ঠের তাপমাত্রা বেশি থাকার ফলে বজ্র মেঘ তৈরি হয়। এই বছর জুলাইয়ের মাঝামাঝি থেকে ব্যাপকভাবে বজ্রপাত এবং এর সাথে জড়িত হতাহতের ঘটনা ঘটেছে।

প্রধানত দীর্ঘ বর্ষার "বিরতির" ফলে বৃষ্টির অভাব ও ভূপৃষ্ঠের তাপমাত্রা বাড়ছে। যেহেতু বর্ষা কিছু দিন অন্তর হওয়ায় আর্দ্রতার মাত্রাও বেড়েছে, তাই অধিক সংখ্যক বজ্রমেঘ সৃষ্টি সম্ভাবনা বাড়ছে। বরফ কণার সংঘর্ষের ফলেই চার্জিং ও বজ্রপাতের সংখ্যা বাড়ে। বজ্র মেঘের জন্য তাপ এবং আর্দ্রতা প্রয়োজন। বরফের কণার সংঘর্ষের জন্য প্রায় ৯-১০ কিলোমিটার গভীর মেঘ দরকার। আর সেটাই এখন হচ্ছে। গবেষকদের অনুমান, ভারতে বজ্রপাতের ফ্রিকোয়েন্সি প্রতি বছর ১০ থেকে ২৫ শতাংশ বৃদ্ধি পাবে এবং শতাব্দীর শেষে তা দ্বিগুন হবে।  বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, বজ্রপাতের ঘটনা বৃদ্ধির কারণ জলবায়ু পরিবর্তন। ক্রমবর্ধমান বৈজ্ঞানিক প্রমাণ করেছে আগামীদিনে বিশ্বজুড়ে জলবায়ু পরিবর্তন আরও বজ্রপাত বাড়তে পারে। দ্রুত নগরায়ন এবং জনসংখ্যা বৃদ্ধি বজ্রপাতের ঝুঁকি বাড়িয়ে তোলে।

বিজ্ঞানীরা খুঁজে পেয়েছেন, বজ্রপাতের ঘটনা বৃদ্ধির একটি পূর্বাভাস মাত্রা হল ক্রমবর্ধমান বনের আগুনের সাথে যোগসূত্র। শ্রীনগরের হেমবতী নন্দন বহুগুনা গাড়োয়াল ইউনিভার্সিটির বিজ্ঞানীরা এবং ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজি, কানপুর, মধ্য হিমালয় অঞ্চলের বিভিন্ন আবহাওয়াতে ক্লাউড কনডেন্সেশন নিউক্লিয়াস (সিসিএন) এর ঘনত্ব নিয়ে গবেষণা করেন। তাঁরা বনের আগুনের সময় বায়ুমণ্ডলে ক্লাউড কনডেন্সেশন নিউক্লিয়াস- এর পাঁচগুণ বেশি ঘনত্ব খুঁজে পেয়েছেন স্বাভাবিকের থেকে। অস্ট্রেলিয়ার গবেষকরা বনে আগুন লাগার সময় বজ্রপাতের বর্ধিত সংখ্যার সাথে অতিরিক্ত ক্লাউড কনডেন্সেশন নিউক্লিয়াসকে যুক্ত করেছেন। ফলে বিশ্বব্যাপী বজ্রপাতের সংখ্যা এবং মানুষের মৃত্যু বেড়ে চলেছে। তাঁরা জলবায়ু পরিবর্তন এবং অনিয়ন্ত্রিত নগরায়নের সাথে সম্পর্ক খুঁজে পেয়েছে।

আবহাওয়াবিদের মতে, আজকাল ভারতের গ্রামাঞ্চলের তুলনায় শহরে বজ্রপাত বেশি হচ্ছে। ভবিষ্যতে তাপমাত্রা এবং আর্দ্রতা আরও বাড়বে। আগামী বছরগুলোতে বজ্রপাতে মৃত্যুর হারও বাড়বে। যাইহোক, ভারত বজ্রপাতের বিরূপ প্রভাবকে প্রশমিত করতে কিছু সতর্কীকরণের পথে চলতে হবে।

 ১) আই এম ডি এর দামিনী অ্যাপ এর মধ্যেমে এলাকা ভিত্তিক বজ্রপাতের সতর্কতা প্রদান করা।

২) বজ্রপাত একটি অত্যন্ত স্থানীয় ঘটনা, সেহেতু সতর্কতা প্রায়ই শেষ পর্যন্ত পৌঁছায় না, তা মোবাইল অ্যপসে  নজর রাখা।

৩)  বজ্রপাতের সময় নিরাপদ স্থানে যাওয়া। কিন্তু ধাতব নির্মাণ এড়ানো এবং বন্যাকবলিত নয় এমন নিচু এলাকায় আশ্রয় খোঁজা।

৪) ইলেকট্রিক লাইন (ফোন, বিদ্যুৎ, ইত্যাদি) এবং ধাতব বেড়া, গাছ (তারা বিদ্যুৎ সঞ্চালন করে) এবং পাহাড়ের চূড়া থেকে দূরে থাকা নিরাপদ।

৫)  গাছের নিচে আশ্রয় নেওয়া ঠিক নয়, কারন বেশিরভাগ গাছ পজেটিভ চার্জযুক্ত। তাই নেগেটিভ চার্জযুক্ত মেঘ থেকে বজ্রপাত কে আকর্ষণ করে।

৬) ডপলার আবহাওয়ার র‍্যাডার এর সাহায্যে বজ্রঝড়ের পূর্বাভাস দেওয়া।

 ৭)  রাজ্যগুলিকে দুর্যোগ এবং মৃত্যুর ঝুঁকি আরও ভালভাবে মোকাবেলা করার জন্য তাদের ভৌগোলিক অবস্থানের উপর নির্ভর করে তাদের সীমানার অভ্যন্তরে অঞ্চলগুলির জন্য বজ্রপাত মাইক্রো-জোনেশন করা উচিত।

লেখক: ভূগোলের অধ্যাপক, রাজা নরেন্দ্রলাল খান মহিলা মহাবিদ্যালয়, মেদিনীপুর।

……..

 

Mailing List