জঙ্গলমহলের কুড়কুড়ে (Truffle) ছাতু
জঙ্গলমহলের কুড়কুড়ে (Truffle) ছাতু
প্রভাত কুমার শীট
রাঢ় বাংলার লাল মাটিতে সমৃদ্ধ শাল জঙ্গল। জঙ্গলমহলের চার জেলা পশ্চিম মেদিনীপুর, ঝাড়গ্রাম, বাঁকুড়া, পুরুলিয়া এর বিস্তীর্ণ অঞ্চলে লাল মাটির দেখা যায়। এই মাটিতে শালের আধিক্য স্বাভাবিক উদ্ভিদ হিসেবে। শাল হল পর্ণমোচী বৃক্ষ। শাল পাতা ডিসেম্বর- জানুয়ারি তে ঝরে পড়ে ও মাটির সাথে মিশে অম্লত্ব করে তোলে। ফাল্গুনের হঠাৎ বৃষ্টি, চৈত্রের কাল বৈশাখী, তারপর আষাঢ় শ্রাবনে বৃষ্টির ফলে ওই পাতা গুলো পচে মাটির সাথে মিশে এক ধরনের ছত্রাকের জন্ম নেয়। যা বিজ্ঞানের ভাষায় ট্রাফল (Truffle) নামে পরিচিত।
এটি ভূগর্ভস্থ অ্যাসোকোমাইসেট ছত্রাকের দেহ, যা মূলত টিউবার গোত্রের বিভিন্ন প্রজাতির অন্যতম। টিউবার ছাড়াও, ছত্রাকের আরও অনেক জেনারাকে জিওপোরা, পেজিজা, কোওরোমাইসেস, লিউক্যাঙ্গিয়াম প্রভৃতি। অর্থাৎ এটি মাটির নিচে এক প্রকার কন্দ আকৃতির মাশরুম। শাল জঙ্গল ছাড়া অন্য কোন প্রকার জঙ্গলে এই ধরনের মাশরুমের দেখা মেলে না। রাঢ়বঙ্গের শাল জঙ্গল আর ল্যাটেরাইট মৃত্তিকার যুগলবন্দীতে কন্দ আকৃতির এই প্রকার মাশরুম জন্মায়। যা বননির্ভর মানুষদের রুজি ও খাদ্যের চাহিদা দুটোই মেটায়। বন সংলগ্ন মানুষদের বহু বছরের অভিজ্ঞতা মাটির নিচে থাকা মাশরুম খুঁজে পেতে সাহায্য করে। যদিও বিদেশে শিকারি কুকুর গন্ধ শুঁকে বের করে। এই প্রকার মাশরুমের লোকাল নাম কুড়কুড়ে ছাতু তবে আন্তর্জাতিক মানের এই মাশরুম কে ট্রাফল (truffle) বলে অভিহিত হয়।
মাশরুম মূলত প্রোটিনের উৎস। আর এই প্রোটিনের অভাব রাঢ় বঙ্গের শাল জঙ্গলে ঘেরা আদিবাসী সম্প্রদায় গোষ্ঠীর। নদী, পুকুর প্রায় বর্জিত শাল জঙ্গল ঘেরা ছোট্ট ছোট্ট জনপদ গুলিতে অনেকটাই প্রোটিনের অভাব মেটায় বিভিন্ন প্রকারের মাশরুম। ছাতু সংগ্রহকারিদের মতে, এই ছাতু শ্রাবণ-ভাদ্র এই দুই মাসে পাওয়া যায়। এরপর আশ্বিন থেকে উঠবে জঙ্গলে আর এক প্রকার মাশরুম। সেটি দুর্গাপূজার সময় থেকে পাওয়া যায় বলে লোকাল নাম দুর্গা ছাতু। ট্রাফল কন্দজাতীয় মাশরুম সংগ্রহের ব্যাপারে বাড়ির বড়দের সাথে পাল্লা দিয়ে জুটে যায় বাড়ির খুদে সদস্যরাও। বাড়ির বড়দের সাথে কুড়কুড়ে ছাতুর খোঁজে কার্তিকের সাথে তার ভাই গণেশ ও বন্ধুরা চলে আসে শালের জঙ্গলে। তারপর সংগ্রহ করা ছাতু বাড়ির জন্য খানিকটা রেখে বাকিটা বিক্রি করে পাইকারের কাছে। দাম ১০০ -১২০ টাকা প্রতি কেজি। ফড়েরা ধেড়ুয়া, চাঁদড়া, পিড়াকাটা, লালগড়, গেয়ালতোড়, নয়াগ্রাম, ঝাড়গ্রাম, বেলপাহাড়ী প্রভৃতি জায়গা থেকে সংগ্রহ করে। এরপর কাদা মাটি ধুয়ে প্যাকেটজাত হয়ে পৌঁছে যায় শহরের বাজার। শীততাপ নিয়ন্ত্রিত আধুনিক মলগুলোতে প্রায় তিন থেকে পাঁচ গুণ বেশি দামে বিক্রি হয়। এ বছরে বৃষ্টি কম বলে কুড়কুড়ে ছাতুর উৎপাদনও কম।
মেদিনীপুর সদর ব্লকের ডুমুরকোটার বাসিন্দার মিনতি মাজি বলেন, "সারাদিন ঘুরে মাত্র এক থেকে দেড় কেজি ছাতু সংগ্রহ করি অতিকষ্টে। এই বছর ঠিক মত বৃষ্টিপাত না হওযায় ছাতুর আকৃতি ছোট ও পরিমাণ কম গত বারের থেকে। যেটুকু সংগ্রহ করি অভাবের তাড়নায় বাধ্য হয়ে বিক্রি করি ফড়েদের কাছে"। চাঁদাড়র জঙ্গল থেকে সংগ্রহকারি এক ফড়ের কথায়, ‘‘আমরা প্রতিদিন গড়ে সাত থেকে আট কুইন্টাল ছাতু সংগ্রহ করি। তারপর ঝড়খন্ডের রাঁচির বাজারে নিয়ে যাই বিক্রি করতে। আমাদের এই সব অঞ্চল থেকে প্রতিদিন প্রায় ২৫-৩০ কুইন্টাল ছাতু যায় রাঁচিতে। দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির এই বাজারে মাছ-মাংস কিনতে সংসারে টান পড়েছে জঙ্গল সংলগ্ন আদিবাসী পরিবারে। তাই প্রোটিনের অভাব মেটাতে শাল জঙ্গলে মাশরুম বা কুড়কুড়ে ছাতুই ভরসা।
শালবনি ব্লকের বাঘমারির বাসিন্দা ছন্দা সরেনের মতে, "আমরা তো জঙ্গলে বসবাস করি, তাই জঙ্গল থেকে বিভিন্ন ছাতু সংগ্রহ করে রান্না করে খাই। কুড়কুড়ে ছাতু যেন মাংসের মত স্বাদ"। লালগড়ের বাসিন্দা অঞ্জলি টুডু পাকা রাস্তায় বসে ছাতু থেকে মাটি ধুয়ে নিচ্ছে। তিনি বলেন "সারাদিন গরু চরানো পাশাপাশি জঙ্গল থেকে কুড়কুড়ে ছাতু সংগ্রহ করি বাড়িতে খাওয়ার জন্য। ভাল করে না ধুয়ে নিলে পেট খারাপ হয়। ছাতুর ওপরের খোলস ছাড়িয়ে নেওয়ার পরে রান্না করি। হাতির ভয়ে গভীর জঙ্গলে থেকে সংগ্রহ করি না"। শালবনির মুগাডিহির বাসিন্দা চন্দনী হেমরমের আক্ষেপ, এ বছর পর্যাপ্ত পরিমানে বৃষ্টির অভাবে কুড়কুড়ে ছাতুর সৃষ্টি হচ্ছে না। হলেও আকৃতি খুবই ছোট। তাছাড়াও সচরাচর হাতির আনাগোনায় ছাতুর খোঁজে গভীর জঙ্গলে যাওয়া সম্ভব নয়। যেটুকু সংগ্রহ করি বাড়ির জন্য, বিক্রি করার কিছু থাকে না। জঙ্গলমহলে আদিবাসীদের পুষ্টির চাহিদা মেটাতে কুড়কুড়ে ছাতুই ভরসা। তাছাড়াও ট্রাফল পরিবেশ ও বাস্তুতান্ত্রিক ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ। কারন এরা ইকটোমাইক্রাইজাল ছত্রাক এবং তাই সাধারণত গাছের শিকড়ের সাথে সহজে মিশে যায়। ছত্রাকগুলি পরস্পর নিজেদের মধ্যে পুষ্টিচক্র সম্পূর্ণ করে এবং খরা সহ্যকরণে গুরুত্বপূর্ণ পরিবেশগত ভূমিকা রয়েছে।
......
লেখক: অধ্যাপক, ভূগোল, রাজা নরেন্দ্রলাল খান মহিলা মহাবিদ্যালয়।