দলমা থেকে আসা জুলুমবাজি, হাতি-মানুষের সংগ্রাম, সহবস্থান এবং ভবিষ্যৎ, জঙ্গলমহলে হাতিও বহিরাগত!

দলমা থেকে আসা জুলুমবাজি, হাতি-মানুষের সংগ্রাম, সহবস্থান এবং ভবিষ্যৎ, জঙ্গলমহলে হাতিও বহিরাগত!
27 Sep 2022, 12:30 AM

দলমা থেকে আসা জুলুমবাজি, হাতি-মানুষের সংগ্রাম, সহবস্থান এবং ভবিষ্যৎ- জঙ্গলমহলে হাতিও বহিরাগত!

. প্রভাতকুমার শীট

 

জাতি ধর্ম বর্ণ নির্বিশেষে হাতি শুধু আর পাঁচটি প্রাণীর মতো প্রাণী নয়। তার উত্তরণ ঠাকুর হিসেবে। অর্থাৎ মাঙ্গলিক। শুধুমাত্র বাংলা নয় ওড়িশা, বিহার, আসাম রাজ্যেও হাতি একইভাবে সমাদৃত।

ছোটনাগপুর মালভূমির দলমা পাহাড় থেকে প্রতিবছর হাতির দল ঢোকে দক্ষিণবঙ্গের জেলাগুলিতে। বেলপাহাড়ি, ঝিলিমিলি, কাঁকড়াঝোর, কুইল্যাপাল প্রভৃতি এলাকাগুলি দলমার বন্য হাতিদের আরণ্যক পরিযায়ী পথ। ১৯৮০-র দশকের প্রথম দিকে দলমার হাতি যাতায়াত করে এই রাজ্যে। সেই সময় প্রতি বছর ধান পাকার মরশুমে ৬-৮ টি হাতির ছোট দল লাকাইসিনির পাহাড়ি পথ ধরে নেমে আসত কাঁকড়াঝোর উপত্যকায়। তারপর দুলকি, ঘুরপাহাড়ি পথ পার হয়ে নেস্তরিয়া, বাঁশপাহাড়ির ঢালু পথ ধরে তারা পৌঁছে যেত লালজলার ভ্যালিতে। এরপর একটা লম্বা সময় ঘুরপাক খেতে খেতে ওরা পৌঁছে যেত ভুলাভেদা, তামাজুড়ির জঙ্গলে।

১৯৮৩-৮৪ সাল নাগাদ পরিযায়ী হাতিদের পথ লম্বা হয়। ক্রমাগত বেলপাহাড়ি, নারাণপুর, শিলদা, কেচন্দা পর্যন্ত। ১৯৮৫-৮৬ সাল নাগাদ হাতির দলগুলি তারাফেনি, ভৈরববাঁকি ও কাঁসাই নদী পার হয়ে রাতের অন্ধকারে ঢুকে পড়েছিল গোয়ালতোড়, লালগড়, ভীমপুর, রামগড়, ধেড়ুয়ার জঙ্গলে। পরে পরে আরও এগিয়ে ওরা ১৯৯০ এর মধ্যেই পৌঁছে যায় চন্দ্রকোনা, গড়বেতা, পিয়ারডোবা, ধাদিকা, গনগনির শালবন পার হয়ে বাঁকুড়ার বিষ্ণুপুর, জয়পুর এমনকি সোনামুখীর জঙ্গলেও। ২০০০ সাল থেকে দলমার হাতিরা তাদের ঘাঁটি এলাকা ও বিচরণভূমি গড়ে নিয়েছে - গোয়ালতোড়, লালগড়, ভীমপুর, কাঁটাপাহাড়ি, শালবনি, গড়বেতা, পিয়ারডোবা, ধাধিকা, বিষ্ণুপুর, জয়পুরের অরণ্যভূমিতে।

এই হাতিগুলি ছিল বিহারের দলমা অভয়ারণ্যের স্থায়ী বাসিন্দা। প্রতি শীতেই এরা নিয়ম মেনে বাংলার দক্ষিণ পশ্চিমের বনাঞ্চলে চলে আসতো নভেম্বরের মাঝামাঝি সময়ে। আবার ফেব্রুয়ারির মাঝামাঝি এরা নিজভূমি দলমা অভয়ারণ্যে ফিরে যায়। প্রধানতঃ উষ্ণ-আর্দ্র জলবায়ু, তরঙ্গায়িত রাঢ়ভূমি, ঘনসন্নিবিষ্ট জঙ্গল, পর্যাপ্ত পানীয় জলের যোগান এবং চারপাশে পাকা ধানের সুগন্ধ হাতিগুলিকে আকৃষ্ট করেছে।

সেই ১৯৮০ সালের শেষ দিকে দলমা এলাকায় নতুন করে একটি তামার খনির কাজ শুরু হয়। আকরিক তুলতে যেখানে প্রতিনিয়ত চলত ডিনামাইট ব্লাস্টিং। সঙ্গে চালু হলো বিহার সীমান্তে সুবর্ণরেখা প্রকল্পের কাজ। সিংভূমের ঠিকাদার, মাফিয়া, সরকারি আমলা এবং রাজনৈতিক নেতা, ফড়ে, দালাল একজোট হয়ে মাত্র ছয় মাসের মধ্যে নিশ্চিহ্ন করে দিলো সুবর্ণরেখা ভ্যালির প্রায় ৪০০ মাইল শাল-বন। ১৯৮৭-৯২ এর মধ্যে অবিভক্ত মেদিনীপুর জেলার পশ্চিমাংশে একটি অস্থির রাজনৈতিক অশান্তিও শুরু হয়। ক্ষমতা দখল করেই শুরু হয় জঙ্গল নিধন। কারণ, জঙ্গল বেচলেই নগদ টাকা। ভুলাভেদা, তামাজুড়ি, কাঁকড়াঝোর থেকে জঙ্গল লুট হয়ে যায়। ঠাকুরান পাহাড়, গাড়রাসিনি, ওদোলচুয়া, বেতাই, ভাঁড়ারু এলাকার পাহাড় প্রায় ন্যাড়া হয়ে গেল। ডুলুং আর তারাফেনি অববাহিকায় শাল, পিয়াল, কেঁদ, বহেড়ার সারি মুখ থুবড়ে পড়ল অতি দ্রুত। সেই সময় চোরা শিকারিদের হাতে প্রায় ৮ টি চিতারও মৃত্যু ঘটে। ১৯৯২ সাল নাগাদ অবস্থা এতটাই করুন হয় যে, জঙ্গল প্রায় নিশ্চিহ্ন হয়ে পাহাড়গুলি ন্যাড়া হয়ে যায়। তখন তিন-চার কিলোমিটার দূরে ছাগল, গরু চরলেও খালি চোখে দেখা যেত। সেই সময় দিনরাত পাথর ফাটাচ্ছে ডিনামাইটে। পাহাড় জঙ্গল দাপিয়ে বেড়াত ঠিকাদারদের বুলডোজার। বনের হাতিরা হয়ে পড়ল আশ্রয়হীন। জঙ্গলে তাদের খাবারের ভাঁড়ারও শূন্য। ঝর্ণা ও প্রাকৃতিক জলের উৎস গুলি যাচ্ছিলো শুকিয়ে। সুবর্ণরেখার জলে তীব্রতর গতিতে চলছিল শিল্প দূষণ। তার পেট চিরে পাহাড় ফাটিয়ে গড়ে উঠেছিল বাঁধ, জলধারা। যেটুকু জল গড়িয়ে আসছিল তাতে মিশছিলো সিংভূমের কারখানাগুলির রাসায়নিক বর্জ্য।

ফলে দলমার মূল অভয়ারণ্য ছেড়ে হাতির বড় দলগুলি ঢুকতে শুরু করলো এ রাজ্যের জঙ্গলে। ১৯৯০ তে হাতির বড় দলদুটি যারা তখন রাঁচির দিক থেকে চান্ডিল পেরিয়ে মূল দলমায় এসেছিলো মরশুমি ভ্রমণে তারা আর চান্ডিলের ওপারে ফিরে যেতে পারল না। কারণ, তত দিনে পাহাড় কেটে বানানো হয়ে গেছে গভীর সেচ খাল। সেই গভীর খাল পার হয়ে ওরা যেতে অপরাগ। এর আগে এই বড় দল দুটি শুধুমাত্র শীতের তিনমাস অনিয়মিত ভাবে এ রাজ্যে সাময়িক ভাবে হানা দিত। এবার ওদের তাড়া খেয়ে সীমান্ত দলমার ছোট দলগুলি নিজ নিজ এলাকা ছেড়ে পালিয়ে আসতে থাকল দুলকি সুর পাহাড়ির পথ ধরে পশ্চিমবঙ্গের জঙ্গলে। তা ১৯৯০ দশকের পর থেকে পাকাপাকি ভাবে বসবাস করতে লাগল। বর্তমানে, চিচিড়া, কুঁটিয়া, জামবনি, কেন্দুয়া, মানিকপাড়া, বিনপুর, মালাবতী, ধেড়ুয়া, গুরগুড়িপাল, শালবনি, গড়বেতা ও নয়াগ্রামের জঙ্গলে বসবাস করে। এই সমস্ত এলাকায় ল্যাটেরাইট মাটিতে জঙ্গলগুলি যথেষ্ট ঘন ও সন্নিবিষ্ট। এখানকার খণ্ডিত জঙ্গলগুলিতে বিভিন্ন স্থানে পানীয় জলের যোগান আছে। কিন্তু স্থানীয়ভাবে এসব এলাকাগুলি প্রবল জনবহুল। এর চারপাশে পাকা ধানের ভান্ডার ও শস্য খামার সমৃদ্ধ। হাতিরা এখানে দিনের বেলায় ঘন জঙ্গলে লুকিয়ে বিশ্রাম নেয়। এবং সন্ধ্যা থেকে মধ্যরাত্রি পর্যন্ত সবজি ও ধানজমিতে নিয়মিত হানাদারি চালায়।

হাতিরা যখন থেকে স্থায়ীভাবে পশ্চিমাঞ্চলের জঙ্গলে বসবাস করতে শুরু করেছে ঠিক তবে থেকে মানুষ ও হাতির মধ্যে সংঘাত চরম হয়ে উঠেছে। হাতি ও মানুষের মধ্যে ক্ষমতা ও অঞ্চল দখলের লড়াই শুরু হয়। হাতি তাড়ানোর নাম করে হুলাপাটিরা নৃশংস ভাবে হাতিদের পুরুষাঙ্গে ও গায়ে উত্তপ্ত লৌহশলাকার ছেঁকা দেয়। এর ফলে হাতিরা আরো ক্ষিপ্ত ও উগ্র হয়ে ওঠে। এর ফলে প্রাণহানি, ঘরবাড়ি নষ্ট, শস্যখামার নষ্টের মত উপদ্রব লেগেই আছে। হাতি তাড়ানোর জন্য কিছু কিছু জায়গায় শাল জঙ্গলও কেটে দেওয়া হচ্ছে। এটি একটি জ্বলন্ত সামাজিক সমস্যা। এই সমস্যার জন্য কি শুধু হাতি বা মানুষ দায়ী? তা বিচার্য বিষয়!

কিন্তু ভারতবর্ষের ইতিহাস ঘাঁটলে অন্যরকম ছবি ধরা পড়ে। মহাভারতের যুদ্ধে মদ্ররাজ শল্যের মতো মহারথীদের হাতির পিঠে চড়ে যুদ্ধ করতে দেখা যায়, যার নিদর্শন রয়েছে বহু মন্দিরের ভাস্কর্যে। এ দেশে মৌর্য ও গুপ্তযুগের যুদ্ধেও হাতির ব্যবহার হয়েছে। বাংলার শশাঙ্কের রাজত্বকালে যুদ্ধ ব্যতিরেকে ও তাদের ব্যবহার করা হতো মানুষের প্রয়োজনের বিভিন্ন কাজে। রামায়ণে বাল্মীকির যুগে নৃপতিরা হাতি রাখতেন সযত্নে। তাঁরা 'নাগবান' নামে অভয়ারণ্য বানাতেন হাতিপালন ও তাদের সংকর প্রজাতি সৃষ্টি করতে। 'নাগ' শব্দটির অর্থ হলো হস্তী। ভরত যখন চিত্রকূট পর্বতে রামচন্দ্রের সঙ্গে দেখা করছেন, তখন রামচন্দ্র নির্দেশ দেন তাঁর নাগবনগুলি যেন যত্নসহকারে রক্ষা করা হয়। কি সুন্দর ভালোবাসা ও মধুর সম্পর্ক ছিল। অযোধ্যা নগরীতে উরাবত, মহাপদ্ম, অঞ্জন এবং বামন প্রজাতির হাতির বর্ননা আছে রামায়ণে। সে সময়কার অতীব সুন্দর দেখতে, শান্ত স্বভাবের দাঁতাল হাতিকে আখ্যায়িত করা হত "প্রিয়দর্শন" নামে। বাস্তবে আজকের যুগে বিশ্বের বৃহত্তম আরণ্যক প্রাণী হলো হাতি। প্রাজ্ঞ অরণ্যবিদগণ হাতিকে জঙ্গলের রাজা আখ্যা দিয়েছেন। যে জঙ্গলে হাতি থাকে সে জঙ্গলে কেউ চুরি করতে ঢোকে না। কাজেই হাতিরা স্থায়ী ভাবে জঙ্গলে বাস করলে জঙ্গলটিও স্থায়ী হয়।

১৯৬০ এর দশকে বাংলা বিহারের মাহুতরা বর্ষচক্রের চুক্তিতে এক রাসপূর্ণিমা থেকে আর এক রাসপূর্ণিমা পর্যন্ত হাতি ভাড়া নিত। এরা ভাড়া হাতির পিঠে চড়ে তার শুঁড়ে তেল-হলুদ লেপে পৌঁছে যেত গ্রাম থেকে গঞ্জে, গঞ্জ থেকে ছোট বড় শহরে। হাতি দেখিয়ে কিছু রুজি রোজগারের আশায়। হাতি যায় গৃহস্থের আঙিনায়। শুঁড় উঁচিয়ে গৃহস্থের মঙ্গল কামনা করে। গৃহস্থ সরল মানুষ। ইন্দ্রবাহন ঐরাবতের সেবায় সাধ্যমত দান করতেন। সেই দান গ্রহণ করতেন মাহুতেরা। সেইসব দিনগুলি কোথায় যেন হারিয়ে গেছে।

আজ থেকে প্রায় ৫০-৬০ বছর আগেও বেলেবেড়া, ঝাড়গ্রাম, রাইপুর, কুইল্যাপাল, রানিবাঁধের রাজারাও হাতি পুষত। এদের হাতি পোষার কারন ছিলো জঙ্গলজাত অর্থনীতি ও রাজ সাম্রাজ্য। এদের মধ্যে বেলেবেড়া রাজবাড়িতে 'প্রহরাজ' নামের হাতিটি কিংবদন্তি হয়েছিলো। যা বেলেবেড়া রাজ এস্টেটের পরিবার প্রহরাজ পদবির অধিকারী। এ সময় সব এলাকায় পাকা রাস্তা ছিলো না। ছিলো না মোটর চালিত পরিবহন। ফলে জঙ্গলের কাঠ রপ্তানির কাজে হাতিদের ব্যবহার ছিলো ব্যাপক। চিল্কিগড় থেকে ধলভূমগড় পর্যন্ত চালু ছিলো হাতির ডাকব্যবস্থা। পরবর্তীকালে জমিদার প্রথা উচ্ছেদের কারনে ও হাতি পোষার খরচ চালাতে অপারগ হয়ে রাজারা পোষা হাতিগুলি জঙ্গলে ছেড়ে দিতে বাধ্য হন।

 

এখনো ঝাড়গ্রাম, পশ্চিম মেদিনীপুর, বাঁকুড়া ও পুরুলিয়া জেলার সাঁওতাল, হো, কোরা, কুর্মি প্রভৃতি আদিবাসী সম্প্রদায় শালগাছ ও হাতিকে পূজা করেন। আজও দেখা যায় -আদিবাসী সম্প্রদায়ের ঘরের দেওয়ালে অলংকরনে ও বড়াম (গড়াম) থানে ডোকরা ও পোড়ামাটির হাতি মানত করার রেওয়াজ। সুতরাং, হাতি হল মনুষ্যজাতির মাঙ্গলিক। তাহলে কেন হাতি ও মানুষের এতই দ্বন্দ্ব ও সংঘাত?

আজও পশ্চিমবঙ্গের জঙ্গলঘেরা জেলগুলিতে হাতি সমস্যাটি জ্বলন্ত, খবরের কাগজ বা সংবাদ শিরোনামে উঠে আসে প্রতিনিয়ত। বনদপ্তরের তথ্যে অনুসারে, ১৯৭৬ থেকে ১৯৯৪ সাল পর্যন্ত হাতির কারনে মানুষের মৃত্যু হয়েছে ১১৪ জনের এবং ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ ১৫৯.৯৯ লক্ষ টাকা। আবার প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে মানুষের কারনে ১২-১৫ টি হাতির মৃত্যু হয়েছে। ১৯৯৪ এর পর থেকে হাতির কারনে ক্ষয়ক্ষতি এবং মানুষের প্রাণহানির সংখ্যা ক্রমবর্ধমান। ২০১৫ সালের তথ্যে অনুসারে - সারা রাজ্যে ১০৮ জন মানুষ মারা যায় হাতির কারনে। তার মধ্যে দক্ষিণবঙ্গে ৭১ জন। ২০১৬ সালে ১৮ জনের মৃত্যু হয়েছে ও হাতি মারা যায় ৪ টি। ওই বছর বাঁকুড়াতে ১৫৭৮ হেক্টর শস্যজমি নষ্ট এবং ১৬৭৭ বসতি বাড়ি ভেঙে দেয়। এরই সাথে ঝাড়গ্রাম ও পশ্চিম মেদিনীপুর জেলায় ৫০০ হেক্টর শস্যজমি নষ্ট করে বুনোহাতির দল। সরকারকে ১.২১ কোটি টাকা ক্ষতিপূরণ দিতে হয়েছিল। দক্ষিণবঙ্গের জেলাগুলিতে ২০১৯-২০২০ সালের মধ্যে ১১৬ জন মানুষের মৃত্যু হয়েছে এবং ৮০ জন আহত হয়েছে হাতির হানায়। শুধুমাত্র জঙ্গলমহলের জেলাতে ১৭ জনের মৃত্যু হয়েছে। প্রায় ৩৫০ হেক্টর জমির ফসল ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। সাম্প্রতিক (২০২২) হাতির হানায় মৃত্যু হয়েছে ঝাড়গ্রামে জেলাতে চারজন। 

রেসিডেন্সিয়াল হাতিগুলি জঙ্গলে ফেরার ফাঁকে খাবারের খোঁজে লোকালয়ে ঢুকে ফসলের ক্ষতিও করে। হাতির হানায় মানুষের মৃত্যু ও ঘরবাড়ি নষ্ট করে। পাকাধান নষ্ট, বীজতলা নষ্ট, তিল, আলু, নানারকম সবজি নষ্ট করে দেয়। আবার উল্টো দিকে হাতিগুলি কখনো হুলাপাটির তাড়া খেয়ে অসুস্থ হয়ে পড়ে বা বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হয়ে মৃত্যু ঘটে। ২০১৯ সালে মেদিনীপুরের নেপুরাগ্রামে তিনটি দাঁতাল হাতির মৃত্যু হয়েছিল বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হয়ে। হাতির মৃত্যুতে গ্রামবাসীরা শোকে আচ্ছন্ন হয়েছিল। শেষ পর্যন্ত শ্রাদ্ধ শান্তি করিয়ে পাত পেড়ে ভোজও হয়েছিল। তাহলে হাতি ও মানুষের মধ্যে সরাসরি কোনো দ্বন্দ্ব বা সংঘাত নেই। 

গত দশ বছরে ১৬ বার হাতির ঢুকেছে অরণ্য শহর ঝাড়গ্রামে। প্রশ্ন উঠছে হাতিরা কেন শহরের ঢুকছে? কেনই বা রাজপথে ঘোরাফেরা করছে? তাহলে কি তাদের জঙ্গলে অধিকার ফিরে পেতে চাইছে? এই প্রশ্ন এখন সবার মুখে ঘুরে বেড়াছে। হাতির বিপদ আমরাই ডাকছি। অনেক সময় সরকারি জমি ও বনভূমি বেশিরভাগই দখল করে বসবাস করছি বা চাষের জমি তৈরি করে ফেলছি। কখনো কখনো জলাভূমি খননের কাজে বনভূমি উচ্ছেদ করছি। তাতেই মানুষ-হাতির দ্বন্দ্ব ক্রমাগত ক্রমবর্ধমান। জঙ্গল লাগোয়া জনপদে রাত হলেই হাতির উপদ্রব শুরু হয়। ফসল বাঁচাতে রাত জেগে পাহারা দেয় গ্রামবাসীরা। তাড়া খেয়ে হাতিরা দিকভ্রষ্ট হয় ও আক্রমণাত্মক হয়ে ওঠে। সামনে যাকে পাচ্ছে তাকেই শুঁড়ে তুলে আছড়ে ফেলছে। আর তাতেই হাতিদের খুনি বলে দাগিয়ে দেওয়া হচ্ছে। মানুষ ও হাতির দ্বন্দ্বের মূল কারন হল বনভূমির ক্রমহ্রাসমানতা ও বনভূমির মধ্যে হাতিদের পরিমিত খাদ্যের অভাব। এই দুই সাঁড়াশি আক্রমণে হাতিরা তাদের খাদ্য স্বভাবকে পরিবর্তন করে ফেলেছে শস্যক্ষেত্রে। এর ফলেই দ্বন্দ্ব ক্রমশ বেড়ে চলেছে ও লোকালয়ে হানা দিচ্ছে।

ভারতের উপগ্রহ চিত্র (ISRO - Indian Space Research Organization) এবং সরকারি তথ্য অনুযায়ী পশ্চিমাঞ্চলের জেলগুলিতে বনভূমির পরিমান ও ঘনত্ব এবং ভূগর্ভের জলস্তর নিম্নমুখী। তথ্য দিলে বিষয়টি পরিস্কার হবে - অবিভক্ত মেদিনীপুর জেলায় ১৮৬২ সালে বনভূমির পরিমাণ ছিলো ৩১১০৪০ হেক্টর বা জেলার মোট ভূমির ২২.৮২ শতাংশ। প্রায় ১০০ বছর (১৯৬৪) পরে কমে দাঁড়ায় ১৩১৬৭৩ হেক্টর, যা জেলার মোট ৯.৬৬ শতাংশ। তারপরে নানা ধরনের সরকারি, আধাসরকারি এবং বেসরকারি বনসৃজন প্রকল্প ও উদ্যোগের মাধ্যমে ১৯৯৩ সালে এসে বনভূমির পরিমাণ বেড়ে দাঁড়ায় ১৭০১৮৯ হেক্টর যা প্রায় ১২.০৪ শতাংশ। এখন বনভূমির পরিমাণ ১৭০৯০০ হেক্টর যা প্রায় ১২.১৪ শতাংশ (ঝাড়গ্রাম, পূর্ব মেদিনীপুর, পশ্চিম মেদিনীপুর মিলিয়ে)। ঠিক একই চিত্র বাঁকুড়া ও পুরুলিয়া জেলাতেও। বর্তমানে বনভূমির পরিমাণ যথাক্রমে ১৪৬৩৫৬ হেক্টর (২১.২৭ শতাংশ) এবং ৯০৪০০ হেক্টর (১৪.৪৫ শতাংশ), যা মোট জেলার এক তৃতীয়াংশের যথেষ্ট কম।

সেই ১৮৯৮ সালে গড়ে উঠল খড়গপুর-ঝাড়গ্রাম রেলপথ। ১৯০৩ এ তৈরি হল মেদিনীপুর-শালবনি-গড়বেতা-বিষ্ণুপুর-বাঁকুড়া-আদ্রা রেলপথ। সৃষ্টি হল দ্রুতগামী শহরমুখী পরিবহন পথ। বাড়তে থাকল ছোট-বড় নগরায়ন। সব মিলিয়ে কাঠের চাহিদা বাড়তে থাকল। নতুন উদ্যমে শুরু হল গাছকাটা। পাশাপাশি স্থানীয় ভূস্বামীরা নানা ছল চাতুরির আশ্রয় নিয়ে এসব এলাকায় জঙ্গলগুলিকে নিজেদের মালিকানায় নিয়ে নিতেন। এরা যে সময় স্থানীয় ভাবে কাঠ পরিবহনের কাজে হাতির ব্যবহার করতেন ও হাতি পুষতেন। কিন্তু কাঠের ব্যাবসা লাভজনক হবার ফলে এসব এলাকার শাল, পিয়াল, বহেড়া ও কেঁদ গাছ কাটা পড়ে নির্বিচারে। ঐ সময় বাঁকুড়া, মেদিনীপুর ও পুরুলিয়ার সামন্ত পুঞ্জিরা পাঁচ বছরের জন্য নিলাম ডেকে ঠিকাদারদের কাছে শাল বন ইজারা তুলতো। এর ফলেই অপরিনত গাছে ছেদ ও বড় গাছের ঘনত্ব কমে গেল। আবার মাওবাদীদের কার্যকলাপের সুযোগে চোরাশিকারী ও ঠিকাদাররা বনভূমি লুট করে। ক্রমশ জঙ্গলগুলিতে বড় গাছের পরিবর্তে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র গাছ ও ছোট ছোট কাটছাঁট বনভূমি (Patches of Forest) পরিনত হয়। সেই কারণে পুরুলিয়া, বাঁকুড়া, মেদিনীপুর জেলায় বনভূমিগুলি যেন খাপছাড়া ও পরস্পর বিচ্ছিন্ন, ঘনসন্নিবিষ্ট নয়। বহু জায়গায় আবার চারপাশে চাষের জমি ও বসতির মধ্যে দ্বীপের মতো অবস্থান করছে।  শিল্পায়ন ও নগরায়নের ফলে অরণ্য ভূমির উচ্ছেদ ক্রমবর্ধমান। সাম্প্রতিক শালবনিতে ইস্পাত প্রকল্পের জন্য অরণ্যভূমির উচ্ছেদ ক্রমবর্ধমান। ঝাড়গ্রামেও রেললাইন সম্প্রসারণে ও প্রশাসনিক অফিস আদালত গড়ে তোলার জন্যও বহু পুরানো শালগাছ কেটে ফেলা হয়েছে। যা নিয়ে পরিবেশবিদরা উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন।

  হাতিদের পরিব্রাজনের কারন হিসাবে বৃহৎ বনভূমির পরিবর্তে ছোট ছোট অবনমন বনভূমির (Patches of Forest) সৃষ্টি ও বনভূমির মধ্যে পর্যাপ্ত পরিমাণে খাদ্যের অভাব (Depletion of natural food habitat in the forest)। বর্তমানে জঙ্গলে বন্যপ্রাণীর প্রাকৃতিক খাবার, বাসস্থান এবং জলভান্ডারে টান পড়েছে। তাই হাতিগুলি দিনে দুইবার - লাঞ্চ ও ডিনারের নামে আবাদি জমিতে ঢুকে পড়ছে। খুব ভোরে লাঞ্চ সেরে দিনের আলো বাড়ার আগে জঙ্গলে ঢুকে যায়। ডিনার খেতে নামে সন্ধে নামলে। সাধারণত সন্ধে থেকে ভোর রাত্রি পর্যন্ত চলে, মধ্যদিনে দলমার হাতিরা বিশেষ জমিতে নামে না। আদিবাসী সম্প্রদায়রা দারিদ্র্যের অভাব মোচনের জন্য হাঁড়িয়া ও মহুয়া খায়। যে মদ তারা নিজেরাই বানায়, হাতিরা হাঁড়িয়া ও মহুয়ার লোভে গ্রামে ঢোকে। প্রতিবছর দলমার হাতিরা ঘরবাড়ি ভেঙে মদ লুঠ ও চুরি করে। এতেই আর্থ সামাজিক বিপর্যয় নেমে আসে আরণ্যক আদিবাসী পরিবারে।

ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক এর হিসাব অনুসারে - ভারতবর্ষের জঙ্গলগুলিতে মোট ১৭০০০-২২০০০ বন্যহাতি এখনো টিকে আছে। ১৯৭৫ এর আগে প্রতিবছর ১৫০-২০০ টি হাতি খুন হত চোরাশিকারীদের হাতে। কিন্তু এখন কিছুটা নিয়ন্ত্রণে - ভারতবর্ষের বন্যপ্রাণী সংরক্ষন আইন (১৯৭২) এর সৌজন্যে। কিন্তু ১৯ শতকে বাঁকুড়া, পুরুলিয়া, মেদিনীপুর ও বিহারের দুমকা জেলা ও ছোটনাগপুরের দলমার জঙ্গলে বাস করত কয়েক হাজার বুনো হাতি। ১৯৮২-৮৩ নাগাদ প্রায় ১০৭-১১০ টি হাতি পশ্চিমাঞ্চল - বাঁকুড়া, পুরুলিয়া ও অবিভক্ত মেদিনীপুর জেলায় প্রবেশ করে। এই সব অঞ্চলে প্রতি বছর বিভিন্ন কারনে ৬-৭ টি হাতির মৃত্যু ঘটে চলেছে। ২০১৯ সালে বিদ্যুতেপৃষ্ঠ হয়ে তিনটি দাঁতাল হাতির মৃত্যু হয় মালাবতীর জঙ্গলে। এইসব জঙ্গলে হাতি সংরক্ষণ ও বনভূমি করিডর গড়ে তুলতে হবে। ছোটনাগপুর মালভূমি সংলগ্ন ঘন জঙ্গলঘেরা বাঁকুড়া, পুরুলিয়া, ঝাড়গ্রাম ও পশ্চিম মেদিনীপুর জেলায় বিচিত্র প্রাণীসম্পদ; সঙ্গে আদিবাসী নৃসমাজ ব্যবস্থা। জেলাগুলিতে এখন প্রতিনিয়ত জঙ্গল কাটা চলছে উন্নয়নের নামে। আর এই জঙ্গলের অভাবে গণ্ডার, বাঘের মতও দলমার হাতিগুলিও একদিন হারিয়ে যাবে। দলমার দামালের সংরক্ষণে  এলিফ্যান্ট করিডোর গড়ে তোলা হোক। তবেই রক্ষা পাবে দুইই নৃসমাজ ও বন্যপ্রাণী। 

 

ঝাড়গ্রামের, বেলপাহাড়ি-জামবনি-নয়াগ্রাম-মানিকপাড়া-লোধাশুলি; বাঁকুড়া জেলার ঝিলিমিলি, পুরুলিয়া জেলার কুইল্যাপাল এবং পশ্চিম মেদিনীপুর জেলায় ধেড়ুয়া-চাঁদড়া ও শালবনি-গোয়ালতোড় রেঞ্জের বিস্তীর্ণ বনভূমিতে এলিফ্যান্ট করিডোর (Elephant Corridor) গড়ে তোলা যেতে পারে। স্থানীয় মানুষকে ট্যুরিজম গাইডের  প্রশিক্ষণ দিলে তারাই ট্যুরিস্টদের সঙ্গে নিয়ে গিয়ে হাতি দেখাতে পারবে। তার ফলেই হতে পারে গ্রামীন কর্মসংস্থান ও আর্থ সামাজিক উন্নয়ন। পাশাপাশি জঙ্গলে হাতিদের খাদ্যসামগ্রীর বিভিন্ন ধরনের গাছ লাগানো দরকার।  বনের মধ্যে পর্যাপ্ত পরিমাণ খাদ্যের ভান্ডার গড়ে তুললে কিছুটা এই সংঘাত কমানো সম্ভব হবে।

লেখক- অধ্যাপক, ভূগোল বিভাগ, রাজা নরেন্দ্রলাল খান মহিলা মহাবিদ্যালয়, মেদিনীপুর

Mailing List