জন্মান্তর / গল্প

জন্মান্তর / গল্প
সৌম্যকান্তি ঘোষ
পরপর তিনটে সাংবাদিক বৈঠক করে ডঃ অমলেন্দু দে যখন বাড়ি ফিরল তখন প্রায় রাত নটা বেজে গেছে। বাড়িতে এসেই তার চিরকালের বন্ধু ডক্টর অসীম সরকারের সঙ্গে দেখা। অমলেন্দু বলে উঠলো তা ভাইয়া এত রাতে আমার কাছে? উত্তর এলো "তোমার সঙ্গে যা ঘটেছে সেটা নিজের কানে শুনবে বলেই চলে এলাম।"
তা বেশ করেছ অনেকদিন পর জমিয়ে আড্ডা দেওয়া যাবে।
অসীম: তাহলে স্ট্যানফোর্ড মেডিসিন স্কুলের সেরা অধ্যাপক ও মনোরোগ বিশেষজ্ঞ অমলেন্দু দে মাত্র ৪৫ বছরে কোমাতে চলে গেল। টানা পাঁচ দিন অজ্ঞান থাকার পর গত সোমবার বিকেল ৫ টা নাগাদ তোমার হৃদ স্পন্দনও শূন্য হয়ে গেল। ডাক্তার মৃত বলে ঘোষণা করার আবার আধঘন্টা পরে তোমার হৃদস্পন্দন ফিরে এলো। গত বুধবার তুমি সুস্থ হয়ে উঠলে।
অমলেন্দু: হ্যাঁ বন্ধু চিকিৎসকের মুখে শুনেছি আমার ডেথ সার্টিফিকেট লেখা শুরু হয়ে গিয়েছিল। সেই সময় আমার পালস ফিরে আসে।
অসীম: তা তুমি তোমার চিকিৎসক জীবনে অনেক মনোরোগের সাথে মৃত্যু পরবর্তী অবস্থা তুলনা করেছ, তা নিজের অভিজ্ঞতা কেমন ছিল ওই আধঘন্টার?
অমলেন্দু: দেখো বন্ধু ওই অবস্থাটা অনেকটা একটা স্বপ্নলোকের মতো। অনেক দিন ধরেই আমি কোমাতে ছিলাম। তাই যেন একটা স্বপ্নের রাজ্যে বাস করছিলাম। যেখান থেকে মৃত্যু খুব দূরে নয়। ওই অবস্থায় ই.ই.জি. করলেই পাওয়া যাবে ডেল্টা ওয়েব। তবে ঠিক কখন মারা গেছিলাম সেটা মনে নেই। একটা সময় দেখি, হঠাৎ আমার স্থূলদেহ থেকে সূক্ষ্ম দেহ হালকা হয়ে উপরে উঠতে শুরু করল। দেখলাম আমার মত আরেকজন বেডে শুয়ে আছে। আমি কাউকে কিছু বলার চেষ্টা করলেও কেউ কোন ভ্রুক্ষেপ করল না। এতবার কথা বলার চেষ্টা করলাম স্ত্রীর সাথে কিন্তু কোনও লাভ নেই। ধীরে ধীরে বুঝতে পারলাম এটা আমার সূক্ষ্ম দেহ। গরুড় পুরানে যে অব্যক্ত যন্ত্রণার কথা বলা আছে, মৃত্যুর পর আমার সাথে তাই হচ্ছে। তবে আস্তে আস্তে আমার বায়বীয় শরীরটা ঊর্ধ্বে গমন করতে লাগলো। একটা আলোক চক্রের মধ্যে আমি যেতে শুরু করলাম সেখানে কখনো ঘন্টার ধ্বনি কখনো কি ভয়ঙ্কর শব্দ। সব যেন গোলমাল হয়ে যাচ্ছিল। নিজের পরিচয় ভুলে যেতে শুরু করলাম। কিছুক্ষণ পর এক অন্য জগতে বিচরণ করলাম। সেখানে একের পর এক স্তর অতিক্রম করতে করতে চতুর্থ স্তরে গিয়ে আমি থামলাম। সেই স্তর সত্যিই অসাধারণ নিজের ইচ্ছা শক্তির সাহায্যে সবকিছু সৃষ্টি করা যায়। যেন মনে হচ্ছিল বিভূতিভূষণের দেবযান উপন্যাসের স্তরগুলো দেখছি। আমি পঞ্চম স্তরে যাওয়ার চেষ্টা করতেই প্রচন্ড ইলেকট্রিক শকের মত অনুভূতি হল। তারপর নীচের স্তরে ফেরত এলাম। বুঝলাম আমার কর্মফল অনুযায়ী এটাই আমার জন্য সঠিক স্তর। চতুর্থ স্তরের সব জীবাত্মাদের দেখলাম পরমাত্মাকে পাওয়ার আশায় সাধনা করছে ।তারপর হঠাৎ করে দেখলাম একটি জীবাত্মাকে যেন কোন অদৃশ্য আকর্ষণ নিচের দিকে নিয়ে গেল। একজন সাধুবেশী জীবাত্মা বললেন ওর মায়া এখনো কাটেনি, ওর নতুন জন্ম হবে। একটু পরে আমিও অদৃশ্য টান অনুভব করলাম। তারপর হঠাৎ করে দেখি আমার স্থূল শরীরের মধ্যে আমার এই সূক্ষ শরীর প্রবেশ করছে। তারপর তো জানোই..
অসীম: তা তুমি তাহলে মরেও বেঁচে উঠলে
অমলেন্দু: ঠিক তা নয়। যদি তুমি নিগমানন্দ স্বামীর বই পড়ে থাকো তাহলে আমার জীবন্ত সমাধি হয়েছিল বলতে পার। একটা ছোটখাটো জন্মান্তরের অনুভূতি। আমার মতে, আসলে আমি অনেকদিন ধরে non sleep deep relaxation অভ্যাস করায় আমি অন্যের সূক্ষ দেহ দেখতে পাই। এরকম একটা ধারণা আমার আছে।
একটা বিশাল নিঃশ্বাস ছেড়ে অমলেন্দু খবরের কাগজটা হাতে তুলে নিল শেষ পাতার আগের পাতায় দেখল বড় বড় করে লেখা আছে পথ দুর্ঘটনায় মৃত্যু হয়েছে জনৈক ডাক্তার অসীম সরকারের। নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারছে না। অমলেন্দু এতক্ষণ তাহলে সে তার বন্ধুর মৃত আত্মার সঙ্গে কথা বলছিল।
কি বন্ধু তাহলে তুমি আমার সূক্ষ্ম দেহ দেখতে পেলে, একটা অসাধারণ হাসি হেসে বলল অসীম। ধীরে ধীরে অসীমের চেহারাটা বাতাসে মিলিয়ে গেল।


