জঙ্গলমহলের বর্ণময় বাহা পরব, আচার ও ইতিহাস

জঙ্গলমহলের বর্ণময় বাহা পরব, আচার ও ইতিহাস
16 Mar 2023, 11:15 AM

জঙ্গলমহলের বর্ণময় বাহা পরব, আচার ও ইতিহাস

 

ডঃ সুবীর মণ্ডল

 

বাঁকুড়া ও পুরুলিয়া জেলাকে নিয়ে দক্ষিণ –পশ্চিম বাংলা। এই দুই ভূখণ্ডে আনুমানিক পনেরো লক্ষ আদিবাসি সম্প্রদায়ের মানুষ দীর্ঘদিন ধরেই বসবাস করে আসছে‌। এরা অরণ্য সন্তান। আবার উৎসব প্রিয় জাতিও। সারা বছরই নানান উৎসবে মেতে ওঠে। এই অঞ্চলের আদিবাসী সমাজের সবচেয়ে জনপ্রিয় লোকোৎসব হল বাহা উৎসব, যা বাহা পরব নামে খ‍্যাত। বাহা পরব হল আদিবাসীদের বসন্ত উৎসব। দোলপূর্ণিমার হোলি খেলা শেষ হলেই আদিবাসী সমাজের বাহাপরব শুরু হয়। বাহাপরবের আধিক্য লক্ষ্য করা যায় দক্ষিণ বাঁকুড়া, ঝাড়গ্রাম ও পুরুলিয়ার বিভিন্ন এলাকায়, রানিবাঁধ, রাইপুর, ঝিলিমিলি, পচাপানি, সুতান, বেলপাহাড়ি, ডাঙিকুসুম, কাঁকড়াঝোড়, বারিকুল, বান্দোয়ান, মানবাজার, হীড়বাঁধ, কাশীপুর, ওন্দা, জয়পুর, সারেঙ্গা, সোনামুখী, কাশীপুর, হুড়া, ছেঁদাপাথর, ধানাড়া, শালুইপাহাড়ি, হাড়মাসড়া, মুকুটমণিপুর, খড়িডুংরি, সিমলাপালের      লক্ষীসাগর, বিক্রমপুর ইত্যাদি অঞ্চলে। সেই সঙ্গে ঝাড়গ্রাম, পশ্চিম মেদিনীপুর ও পুরুলিয়া সহ পশ্চিমবঙ্গের  প্রতিবেশী রাজ্য ঝাড়খণ্ডের  বিভিন্ন জেলায়।                            

 

এখানকার আদিবাসীদের জীবন ও সংস্কৃতিতে অরণ‍্য প্রকৃতির প্রভাব অপরিসীম। প্রকৃতি তাদের আর এক মা। তাই পার্থিব মায়ের মতনই  প্রকৃতি মাকে তারা নিজেদের উৎসব উদযাপনের মধ‍্য দিয়ে আপন করে রেখেছে, এর মধ‍্যে দিয়েই তাদের লোকায়ত ঐতিহ্য বহতা নদীর মতো প্রবাহিত। ফাল্গুন -চৈত্র মাসে কবির ভাষায়  "বসন্তের বাতাস যখন কাহাকে কোন খবর না দিয়ে হু হু করিয়া আসিয়া পড়িত " তখন বাঁকুড়া, পুরুলিয়া, ঝাড়গ্ৰাম তথা জঙ্গলমহলের আদিবাসী অঞ্চলে 'বাহা ' বা 'শারুল' পরবের জন্য আয়োজনের তৎপরতা লক্ষ্য করা যায়। অ -আদিবাসীদের দোল উৎসবে আবিরের ব‍্যবহার আছে, কিন্তু আদিবাসী সমাজের বাহা উৎসবে আবিরের কোন ভূমিকা নেই। আমরা যখন দোলের আগে 'ন‍্যাড়া বা বুড়ি' পোড়ানোর মধ‍্যে দিয়ে অতীতের সব গ্লানি, ক্লেদ মুছে দিয়ে নতুন যৌবনকে স্বাগত জানাই, তখন বাঁকুড়া পুরুলিয়ার আদিবাসী অধ‍্যুষিত গ্ৰামে গ্ৰামে আদিবাসী সমাজ প্রকৃতির 'উজ্জীবন 'কে বাহাপরব বা বসন্ত উৎসবের মাধ‍্যমে বরণ করে নেয়।                                         

এই অঞ্চলের আদিবাসিদের সমস্ত উৎসব- ই প্রকৃতিকে ঘিরে। বসন্তেই ফোঁটে পলাশ, শিমুল, মহুয়া। বাহা মানে  সাঁওতালি ভাষায় ফুল। বাহাপরব আর কিছু নয়, সে হল ঋতুরাজ বসন্ত বরণের ব‍র্ণময় উৎসব। এই প্রসঙ্গে রিজলি লিখেছেন, --  "   sarhul or sarjam Baha Spring festival corresponding to the Baha  Bonga of Santals  and Hos in   march-April when sal tree is bloom,Each households sacrifices cock and make offering sal flowers to the founder of of the village whose honor the festival is held" মানুষের সঙ্গে প্রকৃতির সংযোগের এ- এক প্রকৃষ্ট উদাহরণ।        

                                                  

সাঁও়তালি ক‍্যালেণ্ডারে ফাল্গুন হল প্রথম মাস। এই সময় 'নব আনন্দে' প্রকৃতি জাগে। আম, শাল, পলাশ, মহুল ইত‍্যাদি গাছে নতুন পাতা, মুকুল ধরে। প্রকৃতির কোলে বেড়ে ওঠা এখানকার জঙ্গলমহলের আদিবাসী লোকায়ত মানুষ  বিশ্বাস করে এ হচ্ছে গাছেদের প্রজননের  সময়। এই সময় কোনো মানুষজন যদি ফুল, পাতা, শাখা ছেঁড়ে তাহলে সেটা গ্ৰামের পক্ষে অমঙ্গল। যদি ভুল করে কেউ গাছের ডালপালা জঙ্গল থেকে জোগাড় করে তবে সেটা গ্ৰামের বাইরে কোনো ঝোপঝাড়ের আড়ালে রেখে দেয় ।কারণ এর শাস্তি স্বরূপ পুরোহিত পুজো করে সেই ঘরে আর আশীর্বাদী শাল ফুল দেয়  না। তাই ফাল্গুন মাস এলেই এই অঞ্চলের আকাশে বাতাসে ভেসে আসে মাদকতাময়  বাহাগান –

'আজ ফাল্গুনে আগুন লাগে পলাশে শিমূলে 

অজয়, শিলাই, কংসাবতী, দামুদরের কূলে, 

দ্রীমডি ডিডিং দ্রীমডিডিং ধামসা মাদল বোলে।'

                                                             

এই বাহা পরবকে কেন্দ্র করে সমস্ত আদিবাসী তরুণ- তরুণী উজ্জীবিত হয়। বাহা উৎসবে যৌবনের বা তারুণ‍্যের উচ্ছলতা  লক্ষ্য করা যায়।এই উৎসবের মধ‍্যে   দিয়ে আদিবাসী তরুণ-তরুণী তাদের মনের মানুষ(সঙ্গী ) খুঁজে নেওয়ার একটা  সুযোগ পেয়ে যায়।আসলে বাহা উৎসব জীবন-যৌবনের উজ্জীবন আর উদযাপনের সম্মিলন। উৎসবের আগে আদিবাসী মানুষ গাছের ফুল,পাতা কোনো কিছুই ব‍্যবহার  করে না।জঙ্গলমহলের আদিবাসী মেয়েরা ফুল ভালোবাসে।পরবের দিন থেকেই তারা খোঁপায় শাল,মহুল ফুল গোঁজে।এই ভূখণ্ডের আদিবাসী সমাজ প্রকৃতি কে সঙ্গে নিয়ে বাঁচতে চায়। এইসব পরব, লোকাচার আর লোকবিশ্বাসের মধ‍্যে দিয়ে নিজেদের সুরক্ষার ব‍্যবস্থা নিজেরাই  করে নেয়। ক্ষেত্র সমীক্ষায় দেখেছি সাঁওতালদের বাহা পরবের সঙ্গে কুড়মিদের 'শারুল' পরবের বড় ধ‍রনের পার্থক্য নেই।                                         

দ‍‌ক্ষিণ- পশ্চিম বঙ্গের বসবাস কারী আদিবাসী মানুষের কাছে বাহা পরব হলো বর্ষবরণে এক মহৎ উৎসব। তিনদিনের উৎসব। (১)প্রথমদিনের অনুষ্ঠানকে বলে' উম'। এইদিনটি পরিস্কার পরিচ্ছন্নতার দিন। এইদিন 'নাইকে' (গ্ৰামের পুরোহিত) জাহের থানে (পুজোর জায়গা) স্নান করে এসে গোবর দিয়ে ভালোকরে জায়গাটিকে পরিস্কার করে। জাহের থানে মারাংবুরু, জাহের এরা আর ধরম ঠাকুরের যে শিলা থাকে, তাকে ভালো করে তেল দিয়ে স্নান করায়। জাহের আর কিছু নয়, সে হলো উর্বর প্রকৃতি যেখানে বীজের মধ‍্যে দিয়ে নতুন সৃষ্টি করে 'মারাংবুরু' দেবতা। 'নাইকে ' গ্ৰামবাসীদের সঙ্গে নিয়ে জাহের থানের উপরে খড়-বাঁশ দিয়ে ত্রিভুজাকৃতি একটি ঘর তৈরি করে‌                      

(২) দ্বিতীয় দিন শুধুমাত্র পূজার আয়োজন করা হয়‌। গ্ৰামের নারী -পুরুষ বাজনা সহকারে নাচগান করতে করতে 'নাইকে ' কে  স্নান করাতে নিয়ে যায় । অবিবাহিত পুরুষের কাঁধে মাটি অথবা কা‍সার ঘটিতে জল থাকে‌। শালগাছের নিচে কুলোতে জাহের এরা থানে দেবতাকে শালফুল,পাতা দিয়ে নিবেদন করে পুরোহিত।

এছাড়া মারাংবুরুর কাছে সাদা মোরগ, জাহের এরার কাছে ধূসর  রঙের মোরগ আর ধরম দেবতার কাছে পাঁঠা বলির ব‍্যবস্থা করে  পুরোহিত। পুজো শেষ করে 'নাইকে ' গ্ৰামের প্রতিটি বাড়িতে যায়।'নাইকে' আশীর্বাদ স্বরূপ শালফুল তুলে দেন  গ্ৰামের প্রত‍্যেক বাড়ির মেয়েদের হাতে। এরপর বাড়ির মেয়েরা 'নাইকের' পা মুছিয়ে দেয়। মেয়েরা নতুন  শাড়ি ভাঁজ করে  তার  ওপরে শালফুল নেয়। ঐ ফুল তারা খোঁপায় গুঁজে একে অন‍্যের হাত ধ‍রে যুথবদ্ধ ভাবেই নাচতে শুরু করে।                        

(৩)তৃতীয় দিন সবাই এক সঙ্গে শুধু নাচগান আর হাঁড়িয়া খায়। এই বিস্তীর্ণ ভূখণ্ডের অনেক জায়গায় এই পরব দুই-তিন দিন ধরে চলে।পুজোর সময় গ্ৰামের মানুষ দেবতার মঙ্গল কামনায় প্রতীকি হাতি -ঘোড়ার বিগ্ৰহ ইত‍্যাদি উৎসর্গ করেন।কেউ কেউ আতপচাল,বাতাসাও নৈবেদ্য হিসাবে দিয়ে থাকেন। এই অঞ্চলের আদিবাসী সমাজের মানুষ বিশ্বাস করে, গরাম ঠাকুর হাতিঘোড়ার  পিঠে চেপে পুরো গ্ৰাম প্রদক্ষিণ করে , সমস্ত অমঙ্গলের  হাত থেকে  গ্ৰামের মানুষকে রক্ষা করবেন।বাহা আর ঝুমুর গান গেয়ে আনন্দে সারাদিন কাটিয়ে দেয়।  নাচ ও গান এই উৎসবের অন‍্যতম অনু‌ষঙ্গ।বাহা পরবের গানকে এই অঞ্চলে 'বাহাসেরেঞ ' বা বাহা গীতিও বলে থাকে। আদিবাসী সমাজের কামনা বাসনা প্রকাশিত হয় এই গানের মধ্য দিয়ে।                                                                  

 "সারজম বাহা হো     মাতকম গেলে

নাওয়া বাহা হো  ন ওয়া গেলে "

মুলুঃ বঁসা হো বাহা বঁসা --"

অর্থাৎ  

"ওগো শাল-মহুয়ার ফুল

ওগো নতুন ফুল নতুন ফল

আঁধার নিশার শেষে                      

ওগো বাসন্তী চাঁদ"

 শিক্ষার প্রসার ঘটলেও রাঢ়বাংলার সমস্ত আদিবাসী সম্প্রদায়ের মানুষ বংশ পরমপরাগত ভাবে আজও নিজেদের সংস্কৃতিকে ধরে রেখে চলেছে। আদিবাসী সংস্কৃতি ধারক বাহক হিসেবে এই পরবের সমাজ তাত্ত্বিক গুরুত্ব অপরিসীম। আজকের পরিবর্তন শীল সমাজ ব‍্যবস্থায় নাচ আর গানের মাধ্যমে উৎপাদন প্রক্রিয়ার অনুষঙ্গ হিসেবে বাহ উৎসব উদযাপিত হয় মহাসমারোহে। জাতিসত্তা বজায় রাখার জন‍্য এই সব পরব পরম বিশ্বাসে পালন করে চলেছে।বর্তমান আধুনিক যুগে সামাজিক, অর্থনৈতিক পরিস্থিতিতে আগামী প্রজন্ম কতদিন সঠিক ভাবে এই পরব পালন করবে সে বিষয়ে একটা প্রশ্ন থেকে যায়।  (তথ্যসূত্র - লক্ষণ কিসকু, পরেশ চন্দ্র সর্দার, শিক্ষক সুশীল মাহালী)

লেখক: শিক্ষক, খাতড়া হাইস্কুল, বাঁকুড়া। সাহিত্যিক ও লোক গবেষক।

Mailing List