জেন ওয়াই ও (অতি) আত্মবিশ্বাস

জেন ওয়াই ও (অতি) আত্মবিশ্বাস
ড. গৌতম সরকার
এই প্রতিবেদনটি 'আমাদের কালে এই আছিল, আজকের কালে কিস্যুই নাই' সুলভ তুলনামূলক প্রবন্ধ নয়, বরঞ্চ এটি জেন এক্স-এর অবিমৃষ্যকারিতা আর জেন ওয়াইয়ের আকাশছোয়াঁ আত্মবিশ্বাসের আত্মানুসন্ধান বলা যেতে পারে। জেন ওয়াই বলতে ১৯৮১ থেকে ১৯৯৬ সালের মধ্যে যারা জন্মেছে তাদেরকে বোঝায়। কর্মসূত্রে একটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সাথে যুক্ত থাকার কারণে এই প্রজন্মকে খুব কাছ থেকে দেখার অভিজ্ঞতা হয়েছে। সেই অভিজ্ঞতা সময়ের সঙ্গে সঙ্গে দ্রুত বদলে যাচ্ছে। একবিংশ শতাব্দীর জন্মলগ্ন থেকে বেশ কয়েকটি ঘটনা ঘটে গেছে। দেশে বিশ্বায়ন ও উদারীকরণের ফল ফলতে শুরু করেছে, প্রযুক্তির উল্লম্ফন বিশ্বরেকর্ড ছাপিয়ে গেছে, ইংরেজি মাধ্যমে পড়াশোনা করা ছাত্রছাত্রীর সংখ্যা অনেক বেড়েছে, দেশে দেশে সাম্যবাদ নিয়ে আলাপ আলোচনা বন্ধ হয়েছে, গ্লোবাল ওয়ার্মিং বেড়েছে, হিমবাহ গলতে শুরু করেছে। আর এই সবের মধ্যে জেন ওয়াই বয়ঃসন্ধি পেরিয়ে যৌবনে পা দিয়েছে। এই প্রজন্মের একটা অংশ স্ব স্ব ক্ষেত্রে সুপ্রতিষ্ঠিত হয়েছেন, কিন্ত আপামর মধ্যবিত্ত জেন ওয়াইয়ের ভবিষ্যৎ কি?
প্রথমেই স্বীকার করে নেওয়া ভালো জেন-ওয়াইরের 'ফিল ফ্রি' অ্যাটিটিডড-এর জন্য তাদের পূর্বসূরি ‘জেন এক্স’ অনেকাংশে দায়ী। একাধিক সন্তানের পরিবারে বেড়ে ওঠা জেন এক্স-এর স্বপ্ন সন্তানের সব আবদার, বায়না মেটানো। সেটা করতে গিয়ে বিশেষ করে মধ্যবিত্ত এবং নিম্ন মধ্যবিত্ত পরিবারের ছেলেমেয়েদের কাছে 'অভাব' শব্দটা তার স্বাভাবিক পরিচিতি হারিয়েছে। কিছুদিন আগেও চেনা-পরিচিতদের বলতে শুনতাম, 'আমার অতটুকু বাচ্চা মোবাইল হাতে নিয়ে অসাধারণ দক্ষতায় ওয়াটসঅ্যাপ, ফেসবুক, ইনস্টাগ্রাম, ট্যুইটার, ইউটিউব সবকিছু খুলে ফেলছে৷' এখন আর কাউকে বলতে শুনি না, আজ বাচ্চাদের সাথে বাবা-মায়েরাও স্মার্টফোন ব্যবহারে স্বচ্ছন্দ্য হয়ে উঠছেন। তাই ব্যাপারটা ট্যালেন্ট বা প্রজ্ঞা নয়, মূল বিষয়টি হল প্রযুক্তিকে জানার আগ্রহ আর অনুশীলন।
এই প্রযুক্তির কল্যানে আজ সবকিছু হাতের মুঠোয়। একটা ক্লিকেই জ্ঞানভান্ডারের তালা খুলে যায়৷ পারিবারিক এক আড্ডায় কাতার ফুটবল বিশ্বকাপ নিয়ে আলোচনার সময় সেই বাড়ির বাচ্চা ছেলেটি আমাদের থামিয়ে বিশ্বকাপের ইতিহাস-ভূগোল বাতলে গেল। খুব খুশি হয়ে যখন জিজ্ঞাসা সে কোন টিমকে সাপোর্ট করে, তখন তার নির্লিপ্ত জবাব, "আমার ফুটবল ভালো লাগে না।” আমার ভয় জেন ওয়াইয়ের এই ভালোলাগাহীন, ভালোবাসাহীন জ্ঞানের চর্চায়।
জেন এক্স বিশ্বাস করত ইংরেজি মাধ্যমে পড়াশোনা করে ইংরেজিটা একটু বলতে-কইতে পারলেই শিক্ষিত হওয়া যায়। অন্যদিকে প্রযুক্তি হাতে পেয়ে জেন ওয়াই নিজেদের সবজান্তা মনে করে৷ আবার সেই পরিচিত বাচ্চাটার কাছে ফিরে আসি। সম্প্রতি মালদ্বীপ ঘুরে এসে যখনই বেড়ানোর গল্প শুরু করতে যাই তখনই বাচ্চাটা থামিয়ে দিয়ে আমাদের গল্পটাকে নিজের মত আর অলংকরণে সম্পূর্ণ করে দেয়। অবাক হয়ে জিজ্ঞাসা করি, "তুই এতসব জানলি কোথা থেকে?' ওর উত্তর, "ইউটিউবে দেখেছি"। অর্থাৎ ভার্চুয়াল দুনিয়ায় পঞ্চেন্দ্রিয়র ভূমিকা আস্তে আস্তে দখল করে নিচ্ছে মোবাইল স্ক্রিন। এভাবেই প্রযুক্তি মানুষের গতিশীলতায় থাবা বসাচ্ছে৷ ঘরে বসেই যদি সবকিছু উপভোগ করা যায় তবে অর্থ, সময়, এনার্জি খরচ করে বাইরে যায় কোন মুর্খ! কয়েকদিন আগে সান্ধ্যকালীন ভ্রমণে একটা পার্কের মধ্যে দিয়ে আসার সময় দেখলাম ছেলেমেয়েগুলো জোড়ায় জোড়ায় বসে আছে কিন্তু কেউ কারোর সাথে কথা না বলে নিজের নিজের মোবাইলে মগ্ন। রকমসকম দেখে ভয় হল, এরপর কি নরনারীর মধ্যে প্রেম-ভালোবাসাও ভার্চুয়াল হয়ে যাবে।
মনোবিজ্ঞানীরা বলছেন, অতিরিক্ত আত্মবিশ্বাসের মূল কারণ হল অনিশ্চয়তাকে পাত্তা না দেওয়া। সবকিছুর একটা মনোমত ফল কল্পনা করে নিয়ে বসে থাকা যে সেটাই ঘটবে। এই প্রসঙ্গে ছোটবেলার এক বন্ধুর কথা মনে পড়ছে। ওয়েস্ট ইন্ডিজ শেষ ইনিংসে ভারতকে তিনশো আশি রানের চ্যালেঞ্জ দিয়েছে, ভারত পাঁচ উইকেটে নব্বই রানে ধুঁকছে। তখনও সে কাঁচা পেয়ারা চিবোতে চিবোতে অম্লান বদনে বলে চলেছে, "চিন্তা করিস না, এই টেস্ট ম্যাচ ইন্ডিয়াই জিতবে"। অতি আত্মবিশ্বাস সৃজনশীলতাকে ব্যাহত করে। সৃষ্টিশীল চিন্তাভাবনা শিক্ষা, অভিজ্ঞতা, প্রজ্ঞা থেকে আসে যেগুলির নিরন্তর অনুশীলন নতুন নতুন ভাবনার জন্ম দেয়, সভ্যতাকে এগিয়ে নিয়ে যেতে সাহায্য করে। আজকের জেন ওয়াই অতিরিক্ত আত্মবিশ্বাসের জোরে চর্চা, অনুশীলনকে ফালতু জ্ঞান করে গুগল বাবাজীকে সহায় করে এগিয়ে যাচ্ছে৷
প্রাচীনকালে মিশরের দেবতা থেউত লেখা আবিষ্কার করে দেশের রাজাকে গিয়ে নিবেদন করলেন, 'রাজামশাই, আমি এমন জিনিস আবিস্কার করেছি যেটা মিশরীয়রদের অধিক জ্ঞানবান করে তুলবে, তাদের স্মৃতিশক্তিকে উন্নত করবে, আমি স্মৃতি আর প্রজ্ঞার এক উৎকৃষ্ট ওষুধ আবিষ্কার করেছি।' থেউতের মুখে সব শুনে রাজা বললেন, 'মহাশয়, আপনি স্মরণ করার কোনও ওষুধ আবিষ্কার করেননি, আপনি আবিষ্কার করেছেন স্মরণ করিয়ে দেওয়ার ওষুধ। আপনি ছাত্রদের প্রজ্ঞার আভাস দিয়েছেন, কিন্তু এর অনুশীলনের কথা বলেননি।'
থেউতের গল্পটি ভীষণরকমভাবে প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠেছে। আজ থেউতের আবিস্কারও বিলুপ্ত হওয়ার প্রহর গুনতে শুরু করেছে। মানুষ এখন পড়তে ভুলেছে, লিখতে ভুলেছে। কদিন আগে পঞ্চান্ন বছর বয়সে 'হ্যারি পটার সমগ্র' দ্বিতীয়বার শেষ করলাম। বইটা আমার পরিবারের কনিষ্ঠতম সদস্যের জন্যই কেনা হয়েছিল, সে একবারও পড়ে দেখেনি। উল্টে আমাকে পড়তে দেখে একদিন চোখেমুখে অনেকটা বিরক্তি নিয়ে বলল, 'কি এতদিন ধরে একটা বই পড়ে চলেছ? মুভিগুলো দেখে নাও না!' আমি কি বলবো বুঝতে না পেরে চুপ করে রইলাম। কয়েকবছর আগে আমার ভাগ্না আমার বাসায় এসেছে। ইউটিউবে একটা পুরোনো বাংলা সিনেমা দেখছি। মিউজিকের সঙ্গে পর্দায় একের পর এক স্লাইডে কুশীলবদের নাম ফুটে উঠছে, চেষ্টা করছি একটা নামও যেন পড়তে বাদ না পড়ে। ভাগ্নাও পাশে শুয়ে মোবাইল স্ক্রিনে চোখ রাখছিল। কিছুক্ষণ পর থাকতে না পেরে বলে উঠল, "আরে মামা এগুলো কি দেখছো? ফাস্ট ফরোয়ার্ড করে মূল সিনেমায় চল না!" আমি এদের কি করে বোঝাই, পূর্বরাগ কাকে বলে!
……….xxx………..
লেখক: অধ্যাপক, অর্থনীতি, যোগমায়া দেবী কলেজ, কলকাতা।


