জলের তলায় জাকার্তা, বদলাচ্ছে রাজধানী, কিন্তু মানুষের কী হবে?

জলের তলায় জাকার্তা, বদলাচ্ছে রাজধানী, কিন্তু মানুষের কী হবে?
ড. গৌতম সরকার
বৈশ্বিক উষ্ণায়ন এবং আবহাওয়া পরিবর্তন-এর প্রভাব কতটা ভয়ঙ্কর হতে পারে, তার একটা জ্বলন্ত উদাহরণ হল ইন্দোনেশিয়ার রাজধানী শহর 'জাকার্তা'। পরিবেশ বিশেষজ্ঞদের মতে, আগামী ৩০ বছরের মধ্যে এই শহর সমুদ্রের তলায় পুরোপুরি নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে। ইন্দোনেশিয়া হল দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার একটি দ্বীপ রাষ্ট্র। এই দেশের রাজধানী শহর জাকার্তা। আশঙ্কা করা হচ্ছে, জাভা সমুদ্রের জলস্তর ক্রমাগত বাড়তে থাকায় আগামী দিনে এই রাজধানী শহরের অনেকটা অংশ সমুদ্রের নিচে বিলীন হয়ে যাবে।
এই পরিপ্রেক্ষিতে হাজার দ্বীপের দেশ ইন্দোনেশিয়ার প্রেসিডেন্ট জোকো উইদোদো গত ২৬ আগস্ট ২০১৯ সালে ঘোষণা করেছিলেন দেশের নয়া রাজধানী হবে আরেক দ্বীপ শহর বোর্নিও। খবরে প্রকাশ মধ্যবর্তী এই সময়কালে করোনা ভাইরাসের অতর্কিত আক্রমণে রাজধানী স্থানান্তরকরণের পরিকল্পনা সাময়িকভাবে আলোচনার পিছন সারিতে চলে গিয়েছিল। সম্প্রতি এটি আবার আলোচনার শিরোনামে এসেছে। খবরে প্রকাশ ২০২২-২৩ সালের মধ্যেই রাজধানী স্থানান্তরণের কাজ শুরু হয়ে যাবে। গত ১৮ জানুয়ারি দেশের সংসদে এই সংক্রান্ত বিল সর্বসম্মতিক্রমে পাশ হয় এবং তাতে সিলমোহর পড়ে যায়। সরকারি প্রতিবেদন অনুযায়ী, আইনি প্রক্রিয়া সম্পন্ন হলেই বোর্নিও হবে ইন্দোনেশিয়ার নতুন রাজধানী। বর্তমান রাজধানী শহর জাকার্তা থেকে প্রায় দু-হাজার কিলোমিটার দূরে অবস্থিত এই শহরের নতুন নামকরণ হয়েছে, 'নুসানতারা'।
সপ্তদশ শতক থেকে ইন্দোনেশিয়ার রাজধানী শহর জাকার্তা। সম্প্রতি সেই শহর প্রতি বছর ২৫ সেন্টিমিটার করে সমুদ্রের নিচে চলে যাচ্ছে। সরকারি তরফে 'মৃত্যুপথ যাত্রী' শহরটাকে বাঁচানোর চেষ্টা না করে দেশের রাজধানী সরিয়ে নিয়ে যাওয়ার পরিকল্পনা করা হচ্ছে। স্কুল, কলেজ, অফিস, খেলার মাঠ, সরকারি অফিস, বাসস্থান, রাস্তাঘাট নিয়ে প্রাণবন্ত এই শহরের অস্তিত্ব আগামী কয়েকবছরের মধ্যে নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে ভাবতেই আতঙ্ক জাগে। দেশের সরকারের পক্ষ থেকে রাজধানী স্থানান্তরনের বহু কারণ দর্শানো হয়েছে, কিন্তু আসল কারণটি কবুল করা হয়নি, সেটা হল- শহরটি আস্তে আস্তে ডুবে যাচ্ছে। তাছাড়া রাজধানী শহর না হয় সরিয়ে নিয়ে যাওয়া হল, কিন্তু এই শহরে বসবাসকারী ১ কোটি মানুষের কি হবে? সরকারকে তো তাদেরও যথাযথ পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করতে হবে, সেই ব্যাপারে সরকারি তরফে কোনো সুস্পষ্ট উদ্যোগ পরিলক্ষিত হচ্ছে না।
একদিকে শহর ডুবছে, অন্যদিকে সমুদ্রের জলস্তর ফুলে উঠছে, এই দুইয়ের মাঝে পড়ে হাঁসফাঁস অবস্থা দশ মিলিয়নের ওপর অধিবাসীর। বিশেষজ্ঞদের মতে এর কারণ বহুবিধ।
এক, গ্লোবাল ওয়ার্মিংয়ের প্রভাবে বিশ্বের সমুদ্রতলের গড় উচ্চতা বৃদ্ধির বার্ষিক পরিমান একের আট ইঞ্চি, এবং ইন্দোনেশিয়ার রাজধানী জাকার্তা বসে যাচ্ছে বছরে প্রায় চার ইঞ্চি। এই যুগ্ম ফলায় আশঙ্কা করা হচ্ছে গোটা শহরটি আগামী ২০৫০ সাল নাগাদ সমুদ্রের নিচে হারিয়ে যাবে।
দুই, বিশ্ব উষ্ণায়নের প্রভাবে পৃথিবীর তিনটি গ্লেসিয়ার অঞ্চলে বরফ গলতে শুরু করেছে- দক্ষিণের মেরু অঞ্চল আন্টার্টিকা, উত্তরের গ্রিনল্যান্ড এবং হিমালয় পর্বতমালা। এই সম্মিলিত গলনের ফলে সমুদ্রের জলস্তর বেড়ে যাচ্ছে এবং সমুদ্রকুলবর্তী এলাকা প্লাবিত হওয়ার আশঙ্কা তৈরি হচ্ছে।
তিন, সাইক্লোন, প্রাকৃতিক বিপর্যয়, এবং অতিবৃষ্টির কারণেও জাকার্তা শহর ও আশপাশের অঞ্চল অনেক সময়েই জলের নিচে চলে গিয়ে মানুষের জীবনযাত্রা অচল করে দেয়।
চার, সবচেয়ে বড় কারণ হল, গোটা জাকার্তা শহরে মিউনিসিটিপ্যালিটির তরফে পানীয় এবং অন্যান্য ব্যবহারের জলের সরবরাহের ব্যবস্থা নেই। তাই শহরের ১ কোটির মধ্যে চল্লিশ শতাংশ বাসিন্দা মাটির নিচের জলের উপর নির্ভরশীল। এভাবে ক্রমাগত ভূগর্ভস্থ জলের নিষ্কাশনের ফলে মাটির নিচে ক্রমশ ফাঁকা অংশ তৈরি হচ্ছে। যার ফলে শহরের জমি দিনদিন বসে যাচ্ছে।
পাঁচ, নগরায়নের রূপরেখা তৈরিতে দিনদিন মাথা তুলে দাঁড়াচ্ছে বড় বড় অট্ট্যালিকা থেকে শুরু করে ছোটবড় ঘরবাড়ি, শপিং মল, রাস্তাঘাট, পরিবহন, পর্যটন। এ সমস্ত কিছুতেই ব্যবহার করা হচ্ছে ভূগর্ভস্থ জল। যখন যোগানের তুলনায় চাহিদা বেড়ে যায়, তার অবশ্যম্ভাবী ফল হয়ে পড়ে অভাব, এখানেও অর্থনীতির সূত্র মেনে সেটিই হচ্ছে। মাটির নিচে জলস্তরের হ্রাস মাটিকে বসিয়ে দিচ্ছে।
ছয়, এই কারণটি পঞ্চম কারণের সাথে সম্পৃক্ত। গোটা শহর জুড়ে কংক্রিটের জঙ্গল বেড়ে গিয়েছে, অন্যদিকে সবুজ দিনদিন হারিয়ে যাচ্ছে। এই কংক্রিটের বাধা ঠেলে মাটির নিচে পৌঁছতে বাধা পাচ্ছে বৃষ্টির জল। এর ফলে জলস্তর কমছে আর ভুমিক্ষয়
বাড়ছে। পরিস্থিতি এমন হয়ে দাঁড়িয়েছে, প্রতি বছর উত্তর জাকার্তার বিভিন্ন এলাকা গড়ে ২৫ সেন্টিমিটার করে জলের তলায় চলে যাচ্ছে। বিশেষজ্ঞদের দাবি, বিশ্বের মধ্যে সবচেয়ে দ্রুত ডুবছে এই শহর, আগামী এক দশকের মধ্যে শহরের চার ভাগের এক ভাগই হারিয়ে যাবে সমুদ্র গভীরে।
সরকারি তরফে কয়েকটি ব্যবস্থা গ্রহনের কথা বলা হয়েছে৷
এক, জাকার্তা প্রশাসনের তরফে ভূগর্ভস্থ জলের ব্যবহারের ক্ষেত্রে বিভিন্ন বিধিনিষেধ আরোপ করা হয়েছে, বিশেষ করে সেই ব্যবহার যদি ব্যবসায়িক প্রয়োজনে হয়। কিন্তু সমস্যার কথা হল, মাটির নিচের জল ব্যবহার করতে না পারলে কিভাবে প্রয়োজন মিটবে তার কোনও বিকল্পের কথা বলা হয়নি।
দুই, শহরের উত্তরে সমুদ্র বরাবর দীর্ঘ লম্বা দেওয়াল তৈরির কথা ভাবা হয়েছে। এই সমুদ্র দেওয়াল তৈরির উদ্যোগ নেদারল্যান্ড এবং ইন্দোনেশিয়ার তরফে নেওয়া হয়েছিল ২০১১ সালে, যে প্রকল্পে বিনিয়োগের সিংহভাগ এসেছে নেদারল্যান্ড সরকারের পক্ষ থেকে। এই গার্ডওয়াল বন্যার সময় শহরকে সমুদ্রজলে ভেসে যাওয়া থেকে রক্ষা করবে।
তিন, সমুদ্র দেওয়াল তৈরির পাশাপাশি সরকার সিদ্ধান্ত নিয়েছে, জাকার্তার সৈকত বরাবর কতকগুলি কৃত্রিম দ্বীপ সৃষ্টি করবে। এই দ্বীপগুলিকে সম্মিলিতভাবে ঈগল পাখির মত দেখতে লাগবে। যদিও এই পরিকল্পনা চূড়ান্ত বিরোধের মুখে ভেসে গেছে। ২০১৭ সালে নবনির্বাচিত সরকার এই পরিকল্পনা বাতিল করে দিয়েছে।
চার, সাম্প্রতিক সমস্যা থেকে রক্ষা পাওয়ার আরেকটি উপায় হল প্রাকৃতিক। জীববিজ্ঞানীদের মতে ম্যানগ্রোভ বাস্তুতন্ত্র সমুদ্রজলকে শান্ত করে, বন্যার প্রকোপ কমিয়ে ক্ষতির বার্ষিক পরিমান পনের শতাংশ কমাতে পারে। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত এই মুহূর্তে জাকার্তায় একটিই ম্যানগ্রোভ অরণ্য অবশিষ্ট আছে।
এতকিছুর পরও সমুদ্রের উচ্চতা ক্রমশ বেড়েই চলেছে। ১৯০০ সালে গড় বার্ষিক বৃদ্ধির হার ছিল ১.৭ মিলিমিটার, ২০০০ সালে বেড়ে হয় ৩.২মিলিমিটার। কিন্তু ২০১৮-১৯ সালে জলস্তরের গড় উচ্চতা ১৯০০ সালের তুলনায় প্রায় ১৩-২০ সেন্টিমিটার বৃদ্ধি পেয়েছে।
আর পাঁচটা গণতন্ত্রের মত ইন্দোনেশিয়াতেও সমস্যার চিরকালীন সমাধানের তুলনায় সমস্যা থেকে পালিয়ে গিয়ে তাৎক্ষনিক সমাধানের নীতিতে সরকার বিশ্বাসী। তাই প্রেসিডেন্টের মুখে আসল কারণ ব্যতিরেকে রাজধানী সরাবার আরও হাজারটা কারণ শোনা যাচ্ছে। প্রেসিডেন্ট বর্ণিত কারণগুলি একবার দেখে নেওয়া যাক-
এক, বোর্নিওতে ভূমিকম্প ও অন্যান্য প্রাকৃতিক বিপর্যয় কম হয়;
দুই, এই শহরের অবস্থান দেশের একদম কেন্দ্রস্থলে।
তিন, বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ শহর এই শহরের কাছাকাছি অবস্থান করছে, যেমন- বালিকপাপান এবং সামারিন্দা।
চার, শহরের উন্নত পরিকাঠামো;
পাঁচ, প্রচুর খালি জমি আছে যেখানে বিভিন্ন সরকারি প্রশাসনিক ভবন তৈরি করা যাবে।
সাধারণ মানুষের জিজ্ঞাসা, রাজধানী না হোক সরিয়ে অন্য শহরে নিয়ে যাওয়া হল, কিন্তু এই শহরের কি হবে! প্রেসিডেন্ট যতই এই শহরের জনসংখ্যা, অর্থনৈতিক পরিকাঠামোর নিন্দা করুক না কেন, দীর্ঘদিন ধরে সরকারের উদাসীনতাই আজকের এই বিপুল সমস্যার কারণ। এই শহরের ভিতর দিয়ে বয়ে গেছে ১৩টি নদী। সেই নদীগুলোর জল ঠিকঠাক উপসাগরে পৌঁছতে পারছে না। সমুদ্র বাঁধের অবস্থাও খুব খারাপ। শহরের ৪০ শতাংশ ইতিমধ্যেই জলের তলায় চলে গেছে। এসব দেখে এতদিন সরকার কি করছিল? কিছুই করেনি, হাত গুটিয়ে বসে থেকে আস্তে আস্তে শহরটাকে মৃত্যুমুখে এগিয়ে দিয়েছে। আর আজ ভাবছে রাজধানী কয়েক হাজার কিলোমিটার সরিয়ে নিয়ে যেতে পারলেই সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে।
জাতীয় সংরক্ষণের স্বার্থে রাজধানী সরিয়ে নিয়ে যাওয়া একটা অবশ্যম্ভাবী সিদ্ধান্ত হলেও, এই বিপর্যয়ের কবলে পড়া এক কোটির উপর মানুষের কি হবে? এই নিয়ে ইন্দোনেশিয়ান সরকার তার অবস্থান স্পষ্ট করছে না কেন? পরিবেশবিদরা জানিয়েছেন, ভূগর্ভস্থ জলের অনিয়ন্ত্রিত শোষণ, ক্রমাগত আবহাওয়া পরিবর্তন, এবং সমুদ্রের জলস্তরের ক্রমশ বৃদ্ধি পাওয়ার ফলে একটু একটু করে তলিয়ে যাচ্ছে শহরটি। এগুলো কি সরকার জানতো না? প্রথম থেকে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করলে কে বলতে পারে সমস্যা হয়ত এত প্রকট হতো না। ওয়ার্ল্ড ইকোনোমিক ফোরাম-এর রিপোর্ট বলছে, জাকার্তার হাতে আর একদম সময় নেই। সময়-অসময়ে জাভা সি-এর একদম পাশে অবস্থিত এই শহরে বিপুল পরিমাণে সমুদ্রজল ঢুকে পড়ে মানুষের দৈনন্দিন জীবন অচল করে দিচ্ছে। তবে মনে রাখতে হবে, জাকার্তা শহরের এই ঘটনা কোনও একক প্রদর্শনী নয়। পৃথিবীর বহু সমুদ্রতীরবর্তী শহরের ভবিষ্যৎ একই পথে প্রবাহিত হতে চলেছে। সরকারি তরফে এবং সাধারণ মানুষের ঐকান্তিক চেতনাই এই বিপদ থেকে পরিত্রানের একমাত্র উপায়। কিন্তু সেই চেতনা জাগরণের জন্য নিষ্ঠাসহকারে আমাদের অনেক নাগরিক অভ্যাস ছাড়তে হবে। আমরা কি সেইসব ত্যাগ স্বীকারে আদৌ প্রস্তুত?
..……….xxx…………
লেখক: অর্থনীতির সহযোগী অধ্যাপক


