অন্তরিন / গল্প (পর্ব তেরো)

অন্তরিন / গল্প (পর্ব তেরো)
সুপ্রিয় বন্দ্যোপাধ্যায়
ইন্দ্রাণী, ওরফে জবা বলে চলে:
--- অনেক দিনের কথা, তবুও বলি সুন্দর --- আমাদের ফাইনাল ইয়ারের পরীক্ষার পর তোমার নিশ্চয়ই মনে আছে আমরা কদিনের জন্য গ্রামের বাড়িতে চলে গিয়েছিলাম, সেখানে ছিলাম, মানে থাকতে হয়েছিল ---- বিশেষ আর্থিক কারণে।
বাবা যে ভদ্রলোকের কাছে কাজ করতেন, তিনি হঠাৎ করেই মারা যান। পেশায় তিনি উকিল ছিলেন, বাবা তার কাছে টাইপের কাজ করতেন। দীর্ঘদিন ওঁনার সাথে থাকতে থাকতে দুজনের মধ্যে একটা ভাল বোঝাপড়া হয়ে গেছিল।
তার ওপর বাবার আরো একটা বিশেষ গুণের জন্যও বাবাকে উনি খুবই পছন্দ করতেন: সেটা হল, টাইপরাইটার রিপেয়ার করতেও বাবা জানতেন। চার-পাঁচটা মেসিন, যখন যেটা খারাপ হতো, বাবা সারিয়ে নিয়ে কাজ চালিয়ে নিতেন।
তবে বাবা একাই যে ছিলেন ওনার কাছে, তা নয়, আরো দুজন কাজ করতেন।
একদিন কোর্টের মধ্যেই হার্ট এটাক হলো, কোনো সময় দিলেন না।
কাজেই, আমাদের দুঃখের দিন শুরু, যাও বা কোনো রকমে টেনেটুনে চলছিল, তাও আর চলল না।
অধৈর্য হয়ে সুন্দর বলল,
--- তোমাদের বাড়িও তো বিক্রি করে দিয়েছিলে তোমরা। আমি তোমাদের কোনো খবর না পেয়ে তোমাদের বাড়ি গিয়েছিলাম, জানো সেটা?
--- কি করে জানব, বল! তখন তো আমরা দেশের বাড়িতে।
--- হঠাৎ করে বাড়ি বিক্রি করতে গেলে কেন তোমরা?
--- সবকিছুই অদৃষ্ট। দেশের জায়গা-জমি কিছু ছিল, সেগুলো দীর্ঘদিন ধরে না যাবার ফলে দখল হয়ে ছিল। আর কলকাতাতে রোজকার না থাকলে খাবই বা কি। সম্বল বলতে খালি ছিল বাড়িটা, তাও আবার ভাগের। কাজেই, ঐ বাবাকে তখন আমাদের বাড়ির পোরশন তার জ্ঞাতি ভাইদের কাছে কিছু টাকার বিনিময়ে বিক্রি করে, সেই টাকাকে মূলধন করে জমি চাষ করতে হোল।
--- তবে তো জমিদারি করে ভালোই চলছিল -----
পরিহাস করে বলল সুন্দর।
--- আজ্ঞে না মশাই, সে সুখও আর বেশি দিন টিকলো না কপালে; জমিগুলি আর টিকিয়ে রাখা গেল না।
--- কেন?
--- তুমি তো আর জমি-জমার খবর কখনও রাখোনি, ডাক্তার মানুষ, কলকাতায় পড়াশোনা করেছ, আর তোমার মা শক্ত হাতে ওসব সামলেছেন।
--- হ্যাঁ, সেটা ঠিক কথা। আমাকে কোনোদিন ওদিকটায় মাথা ঢোকাতে হয় নি।
--- তবে সাহেব, আপনি আর জানাবেন কি করে বলুন!
--- যাকগে, তারপর কি হলো, বল।
--- হবে আর কি, ১৯৪৬ সালের সেপ্টেম্বরে যে তেভাগা আন্দোলন শুরু হয়, তাতে কৃষকদের দাবি ছিল, উৎপন্ন ফসলের তিন ভাগের দুভাগের মালিক হবে যারা ফসল ফলাবে, অর্থাৎ কৃষকরা ---- আর যারা জমির মালিক, তারা পাবে এক ভাগ। এবার এটা নিয়ে অনেক দিন ধরেই টালবাহানার পর, ১৯৫৬-৫৭ থেকে ভারতে এই ব্যাপারটা ভীষণভাবে দানা বাঁধে। আর ধীরে ধীরে ১৯৬০-৬১ থেকে আমাদের দেশ- গ্রামেও তার আঁচ লাগে।
--- বাব্বা, তোমার দেখছি জমি-জমার ব্যাপারে ভালো ধারণা আছে।
--- কি করব মশাই, বাবা তো আমাকেই অনেকটা শিখিয়ে-পড়িয়ে তৈরি করে দিয়েছিলেন, কিন্তু ---
গলা ভারি হয়ে আসে।
কিন্তু কি?
--- শেষ পর্যন্ত ঐ জমির এক ভাগ ধান-ও আর আমার বাবা পেতেন না।
--- মানে?
--- হ্যাঁ, ওই ভাগটা চলে যেত দালাল আর নেতাদের ঘরে।
--- তার মানে জমির ধান তোমরা ঘরে তুলতে পারতে না।
--- না, দয়া করে যা দিত, আমরা খেতে পেতাম না। আর তাতেই রাগে, দুঃখে একদিন বাবা সব জমি জলের দরে বেচে দিলেন।
--- সেকি!
--- আর যেদিন টাকা নিয়ে বাড়ি ফিরে এলেন, সেদিন মা'র হাতে সব টাকাগুলো দিয়ে বললেন: কাল থেকে আমি আর সংসার চালাব না, তুমি চালাবে।
থেমে গেল জবা। অধৈর্য হয়ে সুন্দর বলল,
--- তারপর---?
--- পরের দিন সকালে ঘুম থেকে আর ওঠেনি বাবা। সেরিব্রাল।
কাঁপা কাঁপা গলায় শেষটুকু খালি বলতে পারল,
--- আর চালের চিন্তা করতে হয় নি বাবাকে।
সুন্দর রিসিভারটা ধরে গুম হয়ে দাঁড়িয়ে থাকল।
(ক্রমশঃ)



