অন্তরিন / গল্প (পর্ব-১৫)

অন্তরিন / গল্প (পর্ব-১৫)
সুপ্রিয় বন্দ্যোপাধ্যায়
সুন্দর জিজ্ঞাসা করে, অবাক বিস্ময়ে:
--- তারপর... ?
--- 'তার আর পর নেই, নেই কোনো ঠিকানা'। অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে ভাইকে গ্র্যাজুয়েট পর্যন্ত লেখা-পড়াটা শেষ করালাম। তারপর ও নিজের চেষ্টাতেই একটা সরকারী চাকরি যোগাড় করে নিয়েছে, এ. জি. বেঙ্গলে .... আর আমার পরের যে বোনটা, অতসী.... তারও বি. এ. পাশ করার পর একটা ভাল ছেলে দেখে, বিয়ে দিয়ে দিয়েছি। ব্যাঙ্কে চাকরি করে।
--- আর তুমি, নিজে ----
মুখের কথা কেড়ে নিয়ে জবা বলে,
--- হ্যাঁ, ঠাকুরের কৃপায় চাকরি যা হোক একটা জোগাড় হয়ে গেছিল, বুঝলে সুন্দর। আর সেই যোগাযোগ-টাও অকল্পনীয় ভাবে আমার কাছে এসেছিল।
--- কিভাবে?
--- বাবার দূর-সম্পর্কের এক খুড়তুতো ভাই দিল্লিতে থাকতেন। কলকাতায় মেয়ের শ্বশুরবাড়ি, মেয়ের সাথে দেখা করে দিল্লী ফিরে যাবার আগে একবার দেশের বাড়িতে এলেন।
--- ওঁনার-ও কি দেশে জায়গা-জমি কিছু ছিল?
--- হ্যাঁ, ওঁনার ছোট ভাই সেসব দেখাশুনো করতেন। তা, এসে যখন শুনলেন, বাবার কথা, তখন আমাদের বাড়িতে এলেন মা'র সাথে দেখা করতে। তারপর সবকিছু শুনে বললেন আমার মা'কে --- যদি আমি দিল্লী যেতে চাই, তবে ওখানে একটা চাকরির ব্যবস্থা উঁনি করে দিতে পারেন।
--- তোমার মা রাজি হলেন?
--- তুমি তো আমার মা'র সাথে আলাপ করেছ, যখন আমাদের বেলঘরিয়ার বাড়িতে গিয়েছিলে। আমার মা খুব ঠান্ডা মাথার মানুষ, ভেবে-চিন্তে চলেন। আমাকে ডেকে জিজ্ঞাসা করলেন। আমি তো হাতে চাঁদ পেলাম। কারণ, সত্যি বলতে কি, টিউশনি করে আর অত বড় সংসারটা আর টানতে পারছিলাম না।
--- তখন তোমার ছোট ভাই চাকরি পায় নি?
---না। তুমি বললে বিশ্বাস করবে না, আমি খুবই বিনীত ভাবে ওঁকে জানালাম যদি একটা চাকরির ব্যবস্থা হয়, তবে খুবই উপকার হয়। উনি ফিরে যাবার সময় আমাকে সাথে করে নিয়ে যান, আর ওনার তদ্বিরে চাকরিটা আমার হয়ে যায়।
--- কোথায় চাকরির ব্যবস্থা করে দিলেন তিনি?
--- দিল্লিতেই। কেন্দ্রীয় স্বাস্থ্য দপ্তরের বেশ ভাল একটা পদে চাকরি করতেন। যদিও আমি সাধারণ M.B.B.S, তবুও উনি সেন্টাল গভর্নমেন্ট হেলথ স্কিম-এর ডিসপেন্সারিতে একটা ডাক্তারের চাকরি করে দিলেন।
--- থাকতে কোথায়?
--- সে ব্যবস্থাও উনিই করে দিয়েছিলেন। ওয়ান রুমের একটা গভর্নমেন্ট কোয়ার্টার যোগাড় করে দিয়েছিলেন। তবে যে কটা দিন চাকরি পাইনি, সেই কটা দিন ওঁদের বাড়িতেই থাকতাম। কাকিমা খুবই ভালো ছিলেন, খুবই খেয়াল রাখতেন আমার।
--- হ্যাঁ, ১৯৫৪-তে দিল্লীতে সেন্ট্রাল গভর্নমেন্ট হেল্থ স্কিম অর্থাৎ C.G.H.S কেন্দ্রীয় সরকারের অধীনস্থ সব কর্মচারীদের জন্য ও পেনসনারদের জন্য ডিসপেন্সারিতে চিকিৎসার ব্যবস্থা করেছিলেন, জানি। পরে নানা জায়গায়, যেমন ভোপাল, চণ্ডীগড়, মুম্বাই ব্যাঙ্গালোর, দেরাদুন, এমনি নানান জায়গায় ছড়িয়ে গেছিল।
--- হ্যাঁ, ওই চাকরির সুবাদে আমার বিভিন্ন জায়গা ঘোরা হয়েছে।
--- যে ভালো, তার ভালোই হয়। তবে আজ তোমার মুখ থেকে সব কথা শুনে এটা বুঝতে পারছি যে, তুমি না থাকলে তোমাদের সংসারটাই একেবারে ভেসে যেত।
--- তা নয় জানো সুন্দর, আজকের এই দিনে দাঁড়িয়ে আমার যা মনে হয়, যদি উদ্দেশ্য সঠিক হয়, তাহলে ঈশ্বর ঠিক পথটাই দেখিয়ে দেন। খালি বিশ্বাসটুকু ওঁনার প্রতি রাখতে জানতে হয়। তবে হ্যাঁ, বাবার বড়ো মেয়ে হিসেবে যা যা কর্তব্য ছিল, সাধ্যমতো তা পালন করার চেষ্টা করে গেছি।
--- তোমার মা এখন কেমন আছেন, জবা?
একটু সময় নিয়ে, উত্তর দিল সে,
--- ২০০৬-এ মা মারা গেছেন। তবে শেষের দিনগুলো আমার কাছেই থাকতেন।
--- কি হয়েছিল, জানতে পারি?
--- নিশ্চয়ই, ... মা ক্যান্সারে মারা গিয়েছিলেন।
--- Oh, so sad....
--- মা তোমাকে খুব পছন্দ করেছিলেন... মাঝেমধ্যে তোমার প্রসঙ্গে কথা উঠলেই বলতেন... ছেলেটি খুব ভালো, ওকে যদি আমার ----
কথাটা ঘুরিয়ে দিয়ে বলল জবা,
--- আচ্ছা, তুমি জানতে চাইছিলে না, ঢাকুরিয়ার বাড়ির কথা?
--- হ্যাঁ,হ্যাঁ, --- তোমাদের ওই বাড়িটা আমার খুবই পছন্দের ছিল। অবশ্য একবারই গেছিলাম, তোমাদের ওই বাড়িতে। ফাইনাল ইয়ারের পরীক্ষার আগে, ... সবাই মিলে তপন, অনিল, সৈকত, অনুজ, বৈশাখী... আমাদের গ্রুপের সবাই।
--- ওটা আমাদের মামার বাড়ি ছিল। কিন্তু মা, দিদিমার একমাত্র সন্তান ছিলেন বলে, ওই বাড়িটাও আমাদেরই হয়ে গেছিল।
--- ওই বাড়িটাও কি বিক্রি করে দিতে হয়েছিল তোমাদের?
একটা চাপা দীর্ঘশ্বাস ফেলে জবা:
--- না, ওটাতে আমার ছোট ভাই থাকে, আমরা যেতে পারি না ভাই বিয়ে করার পর। তাই ও বাড়িও আর আমাদের নয়।
কথাটার মানে ঠিক বুঝতে পারল না সুন্দর।
(ক্রমশঃ)


