অন্তরিন / সপ্তম পর্ব (গল্প)

অন্তরিন / সপ্তম পর্ব (গল্প)
সুপ্রিয় বন্দ্যোপাধ্যায়
এক কাপ জল ইলেকট্রিক ফ্লাস্ক- এ চাপানোর সঙ্গে সঙ্গেই জল গরম হয়ে গেল। কাপে কফি আর দুটো সুগার কিউব দিয়ে গরম জল ঢেলে চামচ দিয়ে গোলাতে গোলাতে সোফায় এসে বসল।
আজ সেই তখন থেকেই একের পর এক পারস্পরিক ঘটনায় খুব ধকল যাচ্ছে সুন্দরের ওপর। আর কিছু নয়, মনের ওপরও চাপ পড়ছে।
এক চুমুক কফি, আঃ ---- সব কিছু যেন ভুলিয়ে দেয়।
চায়ে চুমুক দিতে দিতে ভাবল, সেদিন ঐভাবে যদি অর্ককে তার মন আর বাড়ি থেকে বার করে দিতে না পারত, তাহলে পরে যে কি হতো কে জানে---। মাঝেমধ্যে নিজেকে কঠিন হতে হয়।
প্রথম থেকেই অর্কের কেমন একটা বেপরোয়া ভাব --- যা ভাববে, তাই করবে।
আসলে বিরাটী থেকে চলে এসে এই আভিজাত্য পাড়ায় বাড়ি করার পর নার্সিংহোমের কাজে এতটাই ব্যস্ত থাকতে হয়, যে ঘরের দিকে সময় দিতে পারেনি।
বাবা মারা গেলেন, মা-ও আর কলকাতায় থাকতে রাজি হলেন না। কাজের পর বড় মামা --- মাকে নিয়ে মামার বাড়ি হাজারিবাগে চলে গেলেন। ছোট বোন সুমিত্রার বিয়েতে মাস খানেকের মত ছিলেন, তারপর আবার সেই হাজারিবাগ।
এর পর নানান ঘটনার স্রোত বয়ে গেছে ওর এই সুদূর-প্রসারি জীবন-নদীতে ------।
দুই ছেলের মধ্যে ব্যবধান বেশি নয় --- দুবছরের মত প্রায়। বড়ো ডাক্তারি পড়তে লন্ডন গেল, তখন ছোটটা ডাক্তারি পড়ছে। পরে তিনি বিলেত থেকে ফিরে যা করলেন ----।
কফির কাপটা ধুয়ে কিচেন সেল্ফে রেখে আবার সোফায় এসে বসল। দুবছর আগে হলেও একটা সিগারেট ধরিয়ে আয়েস করত, কিন্তু গত তিন বছর ধরে তাও বন্ধ। ছোট্ট একটা ধাক্কা বুকে, তারপর সব কিছু থেকে অব্যাহতি। নিজে প্রফেশানে থেকে আর ডাক্তারের পরামর্শ উপেক্ষা করে কি করে?
পাইপ খাওয়ার অভ্যাসটা ওদেশ থেকেই শুরু হয়েছিল, মাঝেমধ্যে চুরুট-টাও চলত। তবে এম্ফোরা বা ফ্লাইঙ ডাচম্যান-এর স্বাদের কাছে চুরুট খেলো বলে মনে হতো।
ঐ সময়েই সে বিলেতে বসে খবর পায় ইন্দ্রাণীর বিয়ের।
বর চ্যাটার্ড একাউনটেন্ট্।
আসলে ওর সঙ্গে প্রায় অতগুলো বছর একসাথে পড়াশুনা করার ফাঁকে ফাঁকে খুবই মনের কাছাকাছি চলে এসেছিল। ফোর্থ ইয়ারের সময় থেকেই পড়ার চাপটা একটু বেশিই বাড়ল। বিরাটী ফিরতে বেশ রাত হয়ে যেত।
ক্লাসে আরেকটা ছেলে কাছেই থাকত, দর্জিপাড়ায় --- বিডন স্ট্রিটের কাছেই। অনুজ নাম।
খুবই পরোপকারী, কিন্তু পড়াশোনায় তুখোড়। ও-ই একদিন হঠাৎ করে বলল:
--- সুন্দর, তোর যদি অসুবিধা না থাকে, তবে তুই আমাদের বাড়িতে থেকে যেতে পারিস। মাঝে তো এই কটা দিন!
--- যাঃ, তা আবার হয় নাকি! তোর বাড়িতে অন্যান্য লোকজন নেই, তারা সব কি ভাববে?
অনুযোগ করেছিল সুন্দর। মা-র ও মত ছিল না মোটেই; কিন্তু পরে এমন অবস্থা হল যে ঐটি ছাড়া আর অন্য কোনো বিকল্প রাস্তা রইলো না। টাইফয়েডে ভুগে শরীর এমন দুর্বল হয়ে পড়ল, তখন সুন্দরের মা-ই মত দিলেন অনুজদের বাড়িতে থেকে পড়াশুনা চালিয়ে যেতে বললেন।
মোটেই মত ছিল না তার অন্যের বাড়িতে থেকে ফাইনাল ইয়ারের পরীক্ষা দেওয়া। কিন্তু অনুজের বাবা মৃণালবাবুর ব্যবহার আর মা রেণুকাদেবীর কথা সেদিন আর উপেক্ষা করতে পারে নি সে।
(ক্রমশঃ)



