মুদ্রাস্ফীতি, অস্থির মুদ্রাব্যবস্থা, শেয়ার বাজারে পতন, মুক্তি মিলবে কবে? লিখছেন অর্থনীতিবিদ ড. গৌতম সরকার

মুদ্রাস্ফীতি, অস্থির মুদ্রাব্যবস্থা, শেয়ার বাজারে পতন, মুক্তি মিলবে কবে? লিখছেন অর্থনীতিবিদ ড. গৌতম সরকার
ড. গৌতম সরকার
গত কয়েকবছর ধরে দেশ জুড়ে খারাপ সময় অব্যাহত, শেয়ার বাজারও তার থেকে নিষ্কৃতি পায়নি। একটা সময় কোভিড-১৯ অব্যর্থ নিশানায় শেয়ার বাজারের মেরুদণ্ডে আঘাত হেনেছিল, আর কিছুদিন আগে রিজার্ভ ব্যাংক অব ইন্ডিয়া রেপো রেট বাড়াতে ক্ষতবিক্ষত হয়েছে শেয়ার বাজার। অর্থনৈতিক সংকটের তালিকায় নতুন সংযোজন ভারতীয় টাকার মূল্যে রেকর্ড পতন। গত মে মাসের নয় তারিখে ডলার প্রতি টাকার দাম কমে হয়েছিল ৭৭ টাকা ৪৬ পয়সা। তখনকার হিসেবে এটাই ছিল সর্বকালের সর্বনিম্ন মান। তারপর এই হ্রাস চলতেই থেকেছে। গত ২৪ জুন শুক্রবার এই হিসেব দাঁড়িয়েছে, ১ ডলার সমান ৭৮.৩৪ টাকা।
যেকোনও অর্থনীতিতে বিনিময় মূল্য নির্ধারিত হয় দুটি পদ্ধতিতে, এক, স্থির বিনিময় পদ্ধতি; আর দুই, পরিবর্তনশীল বিনিময় পদ্ধতি। প্রথম ক্ষেত্রে টাকা-ডলার বিনিময় হার বৈদেশিক মুদ্রার চাহিদা-যোগানের উপর নির্ভর করে না, সরকার বিনিময় হার অপরিবর্তিত রাখতে নিজ তহবিল থেকে প্রয়োজনমতো ডলার বেচা-কেনা করে। দ্বিতীয় পদ্ধতিতে ডলারের পরিপ্রেক্ষিতে টাকার মূল্য কি হবে সেটি বৈদেশিক মুদ্রার বাজারে চাহিদা-যোগানের ঘাত-প্রতিঘাত দ্বারা নির্ধারিত হয়। একটি দেশ আমদানির দাম মেটাতে ডলারের চাহিদা সৃষ্টি করে, আর বাইরের দেশে দ্রব্য ও পরিষেবা রপ্তানি করে ডলার উপার্জন করে। এখন ডলারের চাহিদা যদি যোগানের তুলনায় বেড়ে যায়, অর্থাৎ আমাদের আমদানি খরচ যদি রপ্তানিবাবদ আয়ের থেকে বেশি হয় তাহলে টাকার পরিপ্রেক্ষিতে ডলারের দাম বাড়ে। এই মুহূর্তে বিভিন্ন আভ্যন্তরীণ এবং ভূ-রাজনৈতিক কারণের জন্য ঠিক সেই ঘটনাটিই ঘটে চলেছে। রিজার্ভ ব্যাঙ্ক চেষ্টা করছে ডলার বিক্রি করে ডলারের দাম কিছুটা নিয়ন্ত্রণ করতে কিন্তু ডলারের তহবিল কমে গেলে দেশের সার্বিক ক্ষেত্রে যে নেতিবাচক প্রভাব পড়বে সেই কথাও ভাবতে হচ্ছে।
ডলার হল এমন একটি মুদ্রা, যেটি আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে সবচেয়ে বেশি ব্যবহৃত হয়। ১৭৬০ সালে সর্বপ্রথম ডলার ছাপানো হয় এবং কালক্রমে এই মুদ্রা আন্তর্জাতিক বাজার নিয়ন্ত্রণ করতে শুরু করে। এই মুহূর্তে পাঁচটি মার্কিন অঞ্চল এবং এগারোটি দেশে সরকারি মুদ্রা হিসাবে ডলার ব্যবহার করা হয়। স্বভাবতই প্রশ্ন ওঠে, এত সব মুদ্রার মাঝে ডলারের গুরুত্ব সর্বাধিক হওয়ার কারণটা কি। একাধিক কারণ আছে।
এক, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর ইউরোপ এবং এশিয়ার অধিকাংশ দেশের আর্থিক অবস্থা সঙ্গিন হয়ে ওঠে। এই সমস্যা সমাধানে বিশ্ব ব্যাঙ্ক ১৯৪৪ সালে ১ আউন্স সোনার দাম ৩৫ ডলারে নির্দিষ্ট করে। তারপর থেকেই আন্তর্জাতিক বিনিময়ে ডলারের একাধিপত্য শুরু হয়।
দুই, 'মার্শাল প্ল্যান' নামক একটি পরিকল্পনা গ্রহণের মাধ্যমে যুদ্ধবিধ্বস্ত ইউরোপের দেশগুলোকে ডলার সাহায্য দেওয়া শুরু হয়।
তিন, আন্তর্জাতিক রিজার্ভ কারেন্সি হিসেবে বিশ্বব্যাপী ডলারের ব্যবহার বাড়তে থাকায় 'ফরেন এক্সচেঞ্জ রিজার্ভ' হিসেবে সর্বপ্রথম ডলার স্বীকৃতি লাভ করে।
টাকা-ডলার বিনিময় মূল্যের অস্থিরতার সাথে শেয়ার বাজার অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত। অনেকদিন ধরেই ভারতের শেয়ার বাজার অস্থির আচরণ শুরু করেছে। অদূর ভবিষ্যতে বিশেষজ্ঞরা এই অস্থিরতা দূর হওয়ার বিশেষ সম্ভাবনা দেখছেন না। তাঁরা যে কারণগুলো দেখাচ্ছেন সেগুলো হল,
এক, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ আরও অনেক সমস্যার সাথে সাথে বিশ্বের বাজারে পেট্রোলিয়াম এবং উপজাত দ্রব্যের দামের বৃদ্ধি ঘটিয়েছে। আর বাজার শর্ত মেনে জ্বালানি তেলের দামবৃদ্ধির সাথে সাথে সমস্ত দ্রব্য ও পরিষেবাই মহার্ঘ্য হয়ে উঠেছে। এদিকে টাকার অবমূল্যায়ন ঘটায় আমদানি খাতে ব্যয় বেড়ে চলেছে যেহেতু স্বল্পকালে আমদানি কমানো সম্ভব হয় না। এই সমস্যা শুধু ভারতের নয়, সব দেশই এক সমস্যায় ভুগছে। এর ফলশ্রুতিতে বিশ্বব্যাপী ডলারের চাহিদা বৃদ্ধি পেয়ে ডলারের দামের ঊর্ধ্বগতি ধরে রাখছে।
দুই, অন্যদিকে দেশকে কোভিড শূন্য করতে চিনে লাগাতার লকডাউন শুরু হয়েছে। এর ফলে ওই দেশ থেকে আমদানিকৃত চূড়ান্ত দ্রব্য থেকে শুরু করে কাঁচামালের সরবরাহে টান পড়েছে। শুরু হয়েছে মুদ্রাস্ফীতি।
তিন, এর মধ্যে মূল্যবৃদ্ধি সামলাতে আমেরিকার কেন্দ্রীয় ব্যাঙ্ক 'ফেডারেল রিজার্ভ' সুদের হার বাড়িয়ে দিয়েছে। সেই কারণে লগ্নিকারীরা আমেরিকান ডলারে অর্থ বিনিয়োগ লাভজনক মনে করছে। ভারতও রেপো রেট বাড়িয়ে অবস্থা সামাল দেওয়ার চেষ্টা করছে, কিন্তু দেশীয় এবং বিদেশীয় বিনিয়োগকারীরা আমেরিকার আর্থিক বাজারকে অনেক বেশি নির্ভরযোগ্য সাব্যস্ত করে ভারত থেকে তাদের লগ্নি তুলে নিয়ে আমেরিকার বিভিন্ন সংস্থায় বিনিয়োগ করছে। একটি হিসেব বলছে, ৫ মে-র মধ্যে ভারতে প্রায় দুহাজার কোটি টাকার বেশি মূল্যের শেয়ার বিক্রি করে দেওয়া হয়েছে।
জ্বালানি তেলের দামের সঙ্গে ডলারের দামের একটা ওতপ্রোত সম্পর্ক আছে। মার্কিন মুলুক আবার তেলের অন্যতম বৃহৎ গ্রাহক হওয়ার কারণে ডলারের দামের বাড়াকমার সাথে তেলের দামও বাড়ে বা কমে। অন্যদিকে ডলার অন্য বিদেশি মুদ্রা, সোনা বা শেয়ারের তুলনায় অনেক বেশি স্থিতিশীল এবং নির্ভরযোগ্য, তাই বিশ্বব্যাপী আর্থিক বাজারের এই টালমাটাল অবস্থায় সবাই চাইছে ডলারে বিনিয়োগ করতে।
ডলারের অঙ্কে টাকার মূল্য কমে গেলে তার সরাসরি প্রভাব পড়ে সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রায়। পেট্রল-ডিজেলের দাম বৃদ্ধির প্রত্যক্ষ প্রভাব ছাড়িয়ে আমজনতাকে বেশি কাবু করে এর পরোক্ষ প্রভাব। এই পরোক্ষ প্রভাব শুরু হয় পন্য পরিবহনের ব্যয় বৃদ্ধির মাধ্যমে। এই ব্যয়বৃদ্ধি মুদ্রাস্ফীতি ডেকে আনে। মুদ্রাস্ফীতি হলে আমদানিকৃত দ্রব্যের দাম বেড়ে যায়, শুধু চুড়ান্ত দ্রব্যই নয়, অন্তর্বর্তী দ্রব্যের দামেরও বৃদ্ধি ঘটে। এর ফলে ওই অন্তর্বর্তী দ্রব্য দিয়ে এদেশে তৈরি হওয়া চূড়ান্ত দ্রব্যেরও দাম বাড়বে। সব দিক দিয়েই টান পরে ক্রেতার পকেটে, ক্রয়ক্ষমতার হ্রাস ঘটে সাধারণ মানুষকে কম গুণসম্পন্ন জীবনের সাথে মানিয়ে নিতে হয়।
এইরকম অস্থির মুদ্রা কোনও অর্থনীতির জন্যই কাম্য নয়। একটি দূর্বল মুদ্রা সবসময় মুদ্রাস্ফীতিকে ডেকে আনে। এপ্রিল মাসে ভারতের 'কনজিউমার প্রাইস ইনডেক্স' গত আটবছরের মধ্যে সর্বোচ্চ ৭.৭৯ শতাংশে পৌঁছেছিল। এই টালমাটাল সময়ে অস্থির শেয়ার বাজারের ধাক্কা সরাসরি লেগেছে ভারতীয় অর্থনীতিতে। এর জেরে পতন ঘটেছে ভারতীয় মুদ্রার। রিজার্ভ ব্যাঙ্ক এই পতন রুখতে নিজের মজুত থেকে ডলার বিক্রি করছে, কিন্তু এই পলিসি দীর্ঘকালীন ভিত্তিতে চলতে পারে না কারণ একটা সময় দেশের বৈদেশিক মুদ্রার অপর্যাপ্ততা বহুদেশীয় প্রতিযোগিতামূলক বাণিজ্যে ভারতকে অনেক পিছিয়ে দেবে। গত বুধবার, ২২ জুন দেশে শেয়ার বিক্রির মোট পরিমাণ ছিল ২৯২০.৬১ কোটি টাকা, এর ফলে ৭১০ পয়েন্ট পতন ঘটে সেনসেক্স এখন ৫১ হাজারের ঘরে নেমে এসেছে। অন্যদিকে বিশ্বব্যাপী ডলারের ক্রমবর্ধ্বমান চাহিদার কারণে আরও বেড়ে চলেছে ডলারের দাম। ভারতের মূল আমদানি দ্রব্যসমূহ যেমন, জ্বালানি তেল, ভোজ্য তেল এবং অকৃষি পণ্যের প্রতিটারই দাম লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে।
এই অবস্থায় আশার আশ্বাস জোগাচ্ছেন বিশেষজ্ঞরা। শেয়ার মার্কেটে ধস অবিচ্ছিন্ন, সেনসেক্সের পতন ঘটতে ঘটতে তলানিতে পৌঁছেছে, দ্রুতগতিতে মূলধন দেশের বাইরে বেরিয়ে যাচ্ছে, সেই সময় বিশেষজ্ঞরা জানাচ্ছেন, পতনের ধারা অব্যাহত থাকলেও এখনই বিনিয়োগকারীদের হতাশ হওয়ার কারণ নেই। বরঞ্চ ভবিষ্যতে বড় লাভের মুখ দেখতে হলে এখনই নতুন করে শেয়ার বাজারে বিনিয়োগ করতে হবে। তাঁদের মতে, অন্যান্য দ্রব্যের মত শেয়ার বাজারও চাহিদা-যোগানের নিয়ম মেনে চললেও, আর্থ-সামাজিক এবং রাজনৈতিক কারণেই এই বাজারে বেশিরভাগ পতন লক্ষ্য করা যায়। এই মুহূর্তে একাধিক আভ্যন্তরীণ ইস্যু ছাড়িয়ে রাশিয়া-ইউক্রেনের মধ্যে চলতে থাকা যুদ্ধই শেয়ার বাজারকে বেশি কাবু করে তুলেছে। তবে বিশেষজ্ঞদের মতে দীর্ঘমেয়াদি বিনিয়োগের ক্ষেত্রে এটাই হতে পারে প্রকৃষ্ট সময়। তবে অবশ্যই বাছতে হবে সেইসব প্রতিষ্ঠানগুলিকে যারা সাময়িক অস্থির অর্থনৈতিক অবস্থা কাটিয়ে আগামী দিনে মাথা তুলে দাঁড়াতে পারবে বা এই টালমাটাল সময় যাদের ব্যবসায় তেমন বিশেষ প্রভাব ফেলতে পারবে না। এই সময় এই ধরণের সংস্থাগুলির শেয়ারের দাম কমলে তা সস্তায় বিনিয়োগকারীরা কিনে নিক, এরপর বাজারের গ্রাফ যখন ঊর্ধ্বমুখী হবে তখন সেই শেয়ার বিক্রি করে তারা বড় লাভের মুখ দেখতে পারবে। তবে এত গেল সমগ্র অর্থনীতির একটা অত্যন্ত ছোট অংশ। যুদ্ধ হোক বা মহামারী-অতিমারীর ছোবল, গত তিনবছর ধরে সার্বিকভাবে ধুঁকতে থাকা বিশ্ব অর্থনীতিকে আবার স্বাভাবিক গতি দেওয়াটা খুব জরুরি হয়ে উঠেছে। একমাত্র শুভবুদ্ধির জাগরণ আর সুনির্দিষ্ট আর্থ-সামাজিক পরিকল্পনাই পারবে সেই পথের দিশা দিতে। আমাদের সাধারণ মানুষের অপেক্ষা বেড়েই চলেছে।
…………xxx………….
লেখক: অর্থনীতির সহযোগী অধ্যাপক
তথ্যঋণ: ইন্টারনেট


