‘ভূ-ভারতে প্রয়োজন আজ তব শিরদাঁড়া’, বিদ্যাসাগরের মতো শিরদাঁড়া এখন যেন বেশি করে প্রয়োজন হয়ে পড়েছে, জন্মদিনে শ্রদ্ধার্ঘ

‘ভূ-ভারতে প্রয়োজন আজ তব শিরদাঁড়া’, বিদ্যাসাগরের মতো শিরদাঁড়া এখন যেন বেশি করে প্রয়োজন হয়ে পড়েছে, জন্মদিনে শ্রদ্ধার্ঘ
বাসবী ভাওয়াল
"উপাধি উল্লেখ যার নাম পরিচয়
ধন্য বঙ্গমাতা গর্ভে ধরো এ তনয়"-
আজ ২৬শে সেপ্টেম্বর। বিদ্যাসাগরের দ্বিশতবর্ষ পূর্ণ হয়েছে আগেই। জাগ্রত বাংলার শ্রেষ্ঠ মানব, বাংলা ভাষার যথার্থ শিল্পীকে জানাই আমার সশ্রদ্ধ প্রণাম। নারীর অধিকার সুপ্রতিষ্ঠিত করতে, নারীকে অত্যাচারের হাত থেকে মুক্তি দিতে তাঁর নিরলস প্রয়াস অবিস্মরণীয়। বাংলা বর্ণমালা শিখতে গেলে তাঁর রচিত বর্ণপরিচয় অপরিহার্য। যুগের চেয়ে অনেক বেশি অগ্রণী এই ব্যক্তিত্ব শিক্ষা ও সমাজ সংস্কারে যে ভূমিকা পালন করেছিলেন তা ছিল তৎকালীন সময়ে এভারেস্ট আরোহণের চাইতেও কঠিন। অনেক বিরোধীতা, অনেক সমালোচনার তীক্ষ্ণ বাণে জর্জরিত হয়েও নিজ লক্ষ্যে অবিচল ছিলেন তিনি। দরিদ্র আর্ত নিপীড়িত মানুষের পাশে দাঁড়াতে কখনও পিছপা হননি।
"বিদ্যার সাগর তুমি বিখ্যাত ভারতে, করুণার সিন্ধু তুমি সেই জানে মনে- দীন যে দীনের বন্ধু।" - মাইকেল মধুসূদন দত্ত যখন প্রবাসে অর্থসংকটে তখন নিজে ধার করে অর্থ পাঠিয়েছেন, সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছেন। প্রতিভার মর্যাদা দিয়েছেন, প্রতিভাবানকে বাঁচিয়েছেন। নিজের একমাত্র পুত্রকে বিধবার সাথে বিবাহ দিয়ে কথা আর কাজের সঙ্গতি রেখেছেন। বিধবা বিবাহ করে নারায়ণ আমার মুখ উজ্জ্বল করেছে বলে আনন্দ প্রকাশ করা এই মহান মানুষটিই পরবর্তী কালে পুত্রের সাথে সম্পর্ক পরিত্যাগ করেছেন। ঘরে বাইরে চরম আঘাত পেয়েও শালগাছের মতন ঋজু থেকেছেন। বিধবা বিবাহ প্রবর্তনের পর শান্তিপুরের তাঁতীরা কাপড়ে লিখত "বেঁচে থাকো বিদ্যাসাগর চিরজীবি হয়ে, সদরে করেছে রিপোর্ট বিধবাদের হবে বিয়ে।" একদিকে প্রবল প্রশংসা অন্যদিকে কঠোর সমালোচনা। রক্ষণশীলদের দ্বারা আক্রমণ - "শুয়ে থাকো বিদ্যাসাগর, চিররোগী হয়ে।"
তবুও পিছিয়ে থাকেননি, সমাজের সংস্কারে মেয়েদের বিবাহের বয়স বেঁধে দেওয়া, মেয়েদের শিক্ষার অঙ্গনে আনার জন্য নিজ ব্যয়ে বিদ্যালয় স্থাপন, রবিবার ছুটির দিন প্রবর্তন, বাংলা গদ্য সাহিত্যের বিস্তার, সংস্কৃত ব্যাকরণের উপক্রমণিকা রচনা প্রভৃতি নানা ধরনের কাজের মধ্যে দিয়ে স্মরণীয় হয়ে আছেন। আত্মগরিমাহীন এই মানুষটি আপনজনদের কাছ থেকে আঘাতে জর্জরিত হয়েছেন, তৎকালীন মহীরুহ অনেক ব্যক্তিত্ব কঠোর বাক্যবাণে জর্জরিত করেছেন তাঁকে, তবু তিনি ছিলেন কর্তব্যে অবিচল।
এই ভীরুর দেশে তিনি একমাত্র পুরুষসিংহ যাঁর তালপাতার চটি সাহেবদের সমুচিত জবাব দিয়েছিল। ভগবৎ প্রেমকে গুরুত্ব না দিয়ে মানবপ্রেমে নিয়োজিত করেছিলেন নিজেকে। আবার আক্ষেপ করে সাত কুরু মাটি তুলে মানুষের আবাদ করতে চেয়েছিলেন। আজ দুশো বছর পরেও তাঁর মতন আধুনিক সমাজ মনস্ক ব্যক্তিত্ব বিরল। মাতা ভগবতী দেবীর মানবদরদী ব্যক্তিত্ব তাঁকে আরো বেশি উৎসাহিত করেছিল সমাজের সংস্কারে, মানুষের প্রতি ভালোবাসা ও দায়বদ্ধতা পালন করতে। অন্তরে তাঁর করুণার প্রগাঢ়তা, সরল অনাড়ম্বর জীবন, দরিদ্র, আর্ত রোগীদের পরিষেবা, দেহোপজীবিনীদের জন্য চোখের জল ফেলে সাহায্যের হস্ত প্রসারণ সব দিক থেকেই বাংলার শ্রেষ্ঠ মানব,সারা বিশ্বের শ্রেষ্ঠ বাঙালি। এই ছোট্ট পরিসরে তাঁর মতন মহান ব্যক্তিত্ব নিয়ে আলোচনা করা সিন্ধু তে বিন্দুমাত্র। পরিশেষে হৃদয়ের প্রগাঢ় শ্রদ্ধা নিবেদন করে বলি,
আশীর্বাদ করো যেন জাতির মাঝে আত্মবিশ্বাস জাগ্রত হয়, সঙ্কট মোচন হয়। আমার নিজের ভাষায়-" সঙ্কটাপন্ন জাতি আজ সম্পূর্ণ দিশেহারা, ভূ-ভারতে প্রয়োজন আজ তব শিরদাঁড়া।"
লেখিকা – প্রধান শিক্ষিকা, শালবনী নিচমঞ্জরী হাইস্কুল, পশ্চিম মেদিনীপুর।


