তুলনাহীন 'তুলিন', অফুরন্ত সৌন্দর্যে ভরা পুরুলিয়ার শেষ গ্রাম

তুলনাহীন 'তুলিন', অফুরন্ত সৌন্দর্যে ভরা পুরুলিয়ার শেষ গ্রাম
07 Jun 2023, 11:00 AM

তুলনাহীন 'তুলিন', অফুরন্ত সৌন্দর্যে ভরা পুরুলিয়ার শেষ গ্রাম

                           

ড. সমরেন্দ্র নাথ খাঁড়া

                 

তুলনাহীন তুলিন, ছোট্ট একটি গ্রাম। তুলিন হল সুবর্ণরেখা নদীর পাশে অবস্থিত ভারতবর্ষের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের পুরুলিয়া জেলার ঝালদা মহকুমার ঝালদা ব্লকের একটি গ্রাম এবং একটি গ্রাম পঞ্চায়েত। তুলিন পুরুলিয়ার (Purulia) শেষ গ্রাম। তুলিন পশ্চিমবঙ্গ এবং ঝাড়খণ্ডের সীমান্তে অবস্থিত একটি উন্নত গ্রাম। এটি মহকুমা ঝালদা থেকে ১১.৬ কিমি দূরে এবং পুরুলিয়া জেলা সদর থেকে ৫৪.৮ কিমি দূরে অবস্থিত।পাশেই সুবর্ণরেখা নদী এবং তার পরেই ঝাড়খণ্ড সীমান্ত।যার চারিপাশে সুন্দর পাহাড় ও শাল -পিয়ালের সবুজের সাগর।ঠিক যেনো প্রকৃতির ক্যানভাসে তুলির টানে আঁকা ছবি  'তুলিন'।

       গ্রামের মোট ভৌগলিক আয়তন ৭৬১.৯৪ হেক্টর। মোট এলাকা ৭৬১.৯৪ বর্গ কিমি (২৯৪.১৯ বর্গ মাইল)।স্থানীয় বাসিন্দারা বাংলা, কুরমালি, স্থানীয় হিন্দি ভাষায় কথা বলে। অঞ্চলটা ছোটনাগপুর মালভূমির সর্বনিম্ন ধাপ। সাধারণভাবে এটা হল বিক্ষিপ্ত পাহাড়ের সাথে তলিয়ে যাওয়া জমি।

   ভারতের ২০১১ সালের আদমশুমারি অনুসারে, তুলিনের মোট জনসংখ্যা ছিল ৯৮৪৪ জন।যার মধ্যে ৫,০৫৪ (৫১%) পুরুষ এবং ৪,৭৯০ (৪৯%) মহিলা।০ থেকে ৬ বছর বয়সের মধ্যে ১,২২২ জন ব্যক্তি ছিল।তুলিনে মোট শিক্ষিত লোকের সংখ্যা ছিল ৬,৬০২ (৬ বছরের বেশি জনসংখ্যার ৭৬.৫৭%)।

     তুলিন (Tulin) হল রাজ্য মহাসড়ক ৪এ এর উৎপত্তিস্থল/সমাপ্তি বিন্দু, যা চাস মোড় পর্যন্ত চলে। তুলিন হল দক্ষিণ-পূর্ব রেলওয়ের NSC বোস গোমোহ-হাতিয়া লাইনের একটি স্টেশন।

দর্শনীয় স্থান :

                   অন্ততঃ দুটো রাত থাকলে দেখে নেওয়া যায় -

 তুলিনের কাছে পিঠের গ্রাম্য পরিবেশ।প্রকৃতি দেখেই কাটালে খুব ভালো লাগবে।বাংলো থেকে ২০ কিমি দূরেই বানসা পাহাড়,কামারা,বুরুডি পাহাড়,সাপ পাহাড় (চপদ), সুবর্ণরেখা ওল্ড রেলওয়ের ব্রিজ,লায়েক বাঁধ,মাঘা নদের দিকে পলাশ বন ও কেরওয়ারির জঙ্গল।অসংখ্য ছোট ছোট পাথুরে পাহাড় আর সুবর্ণরেখা বা স্থানীয়দের ভাষায় স্বর্নরেখা নদী তুলিনকে ঘিরে রেখেছে।সন্ন্যাসী লজ, ১০০ বছরের বটবৃক্ষ, PWD বাংলো ও একে একে শিকার, শিলফোর, কালিপাহাড়, নহবাহড়়াড্যাম, বহু প্রচীন মন্দির আছে।

    আর মাহাতোমারা হয়ে যুড়াবন জঙ্গল, উপজাতি গ্রামগুলোতে যাওয়া যায়।বাংলো থেকে বেরিয়ে বাম দিকে ১.৫ কিমি সোজা গিয়ে,তারপর ডানদিকে এগিয়ে হনুমান মন্দিরের কাছে "Y"  ফর্ক থেকে নামোপাড়া দিয়ে সংকীর্ণ রাস্তা বেয়ে নেমে গেলে সুবর্ণরেখার পাথুরে বুকে পৌঁছে যাওয়া যায়।সুবর্ণরেখা নদীর বুকে ১৩০ বছরের মা শ্মশান কালীর মন্দির আছে। পুণ্যার্থীরা স্নান সেরে পুজো দেন।কার্তিক সংক্রান্তিতে এখানে কীর্তন,ভজনের আসর বসে।মহাদেব,মহালক্ষ্মী,ধর্মরাজ,সূর্য, হনুমান, শিব, কালি মন্দির, শীতলা ও গায়ত্রীদেবীর মন্দির রয়েছে।পুরানো ব্রিটিশ আমলের ব্রীজের পিলারগুলো আজও স্বগৌরবে সুবর্ণরেখার বুকে দাঁড়িয়ে আছে। নতুন ব্রীজ থেকে স্বর্নরেখার অপরূপ রূপ দেখে মন মাতোয়ারা হয়ে যায়। সুবর্ণের বুকে সূর্যাস্ত স্মৃতি পটে আঁকা থাকবে।ঝালদার পাশেই পাট ঝালদা অবস্থিত।পাট ঝালদার প্রাকৃতিক সৌন্দর্য অতুলনীয়।পাট ঝালদা ঘুরতে গেলে কপিলা পাহাড় চোখে পড়বে।চারিদিকে চাষের জমি,পলাশের বন,সায়র বাঁধের পাশে কপিলা পাহাড়ের অবস্থান এক কথায় রমণীয়।পুরনো ঝালদা পার হয়ে কালিং ডুংরির পাদদেশে শিকরা পাহাড় কাছে বিশুদ্ধানন্দ তপোবন আশ্রম অবস্থিত।রাজা উদ্ভবচন্দ্র সিংহ বিশুদ্ধানন্দজিকে এই আশ্রমটি দান করেছিলেন।টলটলে জলের বড় বাঁধ আশ্রমের সামনে রয়েছে।আশ্রমটির আমবাগান ও অশ্বত্থ গাছে ছাওয়া পরিবেশ এক মনোরম পরিবেশ সৃষ্টি করে।আশ্রম থেকে দেড় কিলোমিটার হাঁটাপথে সোনাদাঁড়ি অর্থাৎ মেঠো কুয়ো।সোনাদাঁড়ির জলের রং দুধগোলা জলের মতো; জল মিষ্টি ও পুষ্টিকর।জায়গাটির অবস্থান এককথায় অনির্বচনীয়।এই সৌন্দর্যের টানেই প্রতি বছর বহু লোক শীতকালে পিকনিক করার জন্য এখানে উপস্থিত হন।রেললাইন পেরিয়ে পঞ্চকোট রাজাদের রাজবাড়ির ধ্বংসাবশেষ দেখতে যাওয়া যায়।রাজবাড়ি এলাকায় রাজপরিবারের কুলদেবতা মুরলিধারীর মন্দির আছে।একাধিক বার বাজ পড়ার ফলে মন্দিরটি পরিত্যক্ত হয়েছে।পুরনো রাজবাড়ির চত্বর ঘুরে দেখতে ভালো লাগবে। এ ছাড়াও অসংখ্য অপরূপ পাহাড় যেমন - জাবর পাহাড়,বেলামু,জারগো ইত্যাদি নিয়ে গড়ে উঠেছে। এই শহরে কেবল পাহাড়েই নয়,বহু নদীও শহরটিকে ঘিরে রেখেছে।ঝালদা থানায় পুরুলিয়া জেলার প্রধান নদী কাঁসাইয়ের উৎপত্তিস্থল।ঝালদার পশ্চিম দিক শালদহ জোড় ঘিরে রেখেছে।গুর্জর,রূপাই, ঠ্যাংকাটা,ঘাঘ নামের নদী সুবর্ণরেখায় মিশেছে।প্রত্যেকটি নদীতে ড্যাম রয়েছে।ঝালদায় ঘুরলে নদীগুলি অপরূপ রূপ চোখে পড়ে।ঝালদা শহরের একদম মাঝখানে রয়েছে শিলফোঁড় পাহাড়।যা বর্তমানে কালীপাহাড়ি নামে খ্যাত।কালীপাহাড়ি বেশি উঁচু নয়,সিঁড়ি আছে।ওপরে উঠলে দক্ষিণাকালী কালীমন্দির দেখা যাবে।পাহাড়টিকে ঘিরে গড়ে উঠেছে শিলফোঁড় হিলক পার্ক।১৯৭৩ সালে ঝালদা মিউনিসিপাল বোর্ডের তত্ত্বাবধানে এই পার্কটি গড়ে ওঠে।পাহাড়ের ওপর উঠলে সমগ্র ঝালদা শহরটিকে দেখা যায়।পাহাড়,পার্ক,মন্দিরের   সমন্বয়ে ঝালদা শহর ,সত্যি অতুলনীয়।

          এই পাহাড়ের ডান দিকের রাস্তাটির দু’পাশ বড় বড় গাছে ছাওয়া এবং পরিত্যক্ত লাক্ষা কুঠিগুলি পড়ে আছে। বাঁ পাশে রয়েছে মায়া সরোবর।মহাপ্রাণ আচ্ছুরাম মাড়োয়ারি এই সরোবরটি তৈরি করেন।তিনি তাঁর স্ত্রীর স্মৃতির উদ্দেশে এই মায়া সরোবরটি তৈরি করিয়ে দেন।লাক্ষা শিল্পে বৈদেশিক বাণিজ্যে সাফল্যের জন্য রাষ্ট্রপতি স্বর্ণপদক পান।তাই তাকে ‘ল্যাক প্রিন্স’ বলা হতো।আচ্ছুরামের নাম ঝালদার ইতিহাসে স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে।তিনি ঝালদাতে একটি কলেজও স্থাপন করেন।মায়া সরোবর পার হয়ে গেলেই অসংখ্য মন্দির ও বিশ্রামাগারসহ শ্মশান দেখতে পাওয়া যাবে।শ্মশানটি শালদহ জোড়ের তীরে অবস্থিত।চারিদিকের পরিবেশ অতীব মনোরম।এখানে একটা পার্ক গড়ে তোলা হয়েছে।ঝালদা ঘুরতে গিয়ে পায়ে পায়ে দেখে নেওয়া যায় জালান কুঠির মধ্যেকার পুকুরের দক্ষিণ পাড়ে শ্রীরানি সতীজির মন্দির।গোপালজি জালানের স্মৃতিতে তাঁর পুত্র ও কন্যারা এই মন্দির বানিয়েছেন। ঝালদার অন্নপূর্ণা মন্দিরটি এক কথায় নয়নাভিরাম। সুবর্ণবণিক সমাজ এই মন্দির ১৯১২ সালে প্রতিষ্ঠা করে। এই মন্দিরটি ঝালদার সম্পদ।

 তুলিন থেকে সাইটসিং এর জন্য পুরুলিয়ায় দিকে  কংসাবতী নদীর তীরে দেউলঘাটাতে পাথরের মূর্তি ও পোড়া মাটির মন্দির, মুরুগুমা ড্যামের সূর্যাস্ত, খয়রাবেরা ড্যাম এর সৌন্দর্য, অযোধ্যা পাহাড় এবং ওখানে মার্বেল লেক, বামনী ফলস, তুরগা ফলস, আপার ও লোয়ার ড্যাম। তারপর বাঘমুন্ডির দিকে পাখি পাহাড় ও প্যারডি লেক ঠিক গর্গাবুরুর পাশে, তারপর বাঘমুন্ডি থেকে তুলিন ফেরার পথে চড়িদা মুখোশ গ্রাম।এই সব জায়গায় এক ঘণ্টা কিছু মিনিট লাগে তুলিন থেকে সবই প্রায় ২০ থেকে ৫০ কি.মি এর মধ্যে।

     ঝাড়খণ্ডের সাগুম দ্বারম অর্থাৎ স্বাগত তোরণ স্বাগত জানায়।এখান থেকে অনেক জায়গা দেখা যেতে পারে। এদিকে ঝাড়খন্ডের দিকে রাজরাপ্পা, জনা ফলস, হুন্ডু ফলস, সিতা ফলস, দশম ফলস,পালানি ফলস, গেটালসুদ ড্যাম, পাত্রাতু ভ্যালী, পাত্রাতু লেক,  পাত্রাতু ড্যাম ও ঘুরতে যাওয়া যায়। এগুলো সব ৩০ কি.মি থেকে ১০০কি.মি এর মধ্যে।এই সব জায়গা শুধমাত্র ঘোরার জন্য নয়, কিছুদিন একা সময় কাটাতে, প্রি ওয়েডিং শুট, শুটিং, ফটোগ্রাফি, লেখা, ছবি আঁকা ইত্যাদি করার জন্য দারুন জায়গা।

থাকার ব্যবস্থা-

 তুলিন গ্রামে থাকার জায়গা কম আছে।তবে যদি রাজকীয় ভাবে পুরোনো ঐতিহ্যে থাকতে চাইলে সব রকমের সুযোগ সুবিধা যুক্ত " Tulin Heritage Bungalow" উপযুক্ত জায়গা।পুরুলিয়াতে একটাই হেরিটেজ বাংলো আছে যেটায় রাজকীয় ভাবে থাকা ও খাওয়ার সুব্যবস্থা আছে।এই বাংলো এমনই এক জায়গা এখানে বন্ধু বান্ধব, ফ্যামিলি নিয়ে আসার জন্য দারুন।

   ঝালদা শহরে কয়েকটা লজ, গেস্ট হাউস এবং আশপাশে দু একটা লজ আছে। আমন্ত্রণ লজ, স্টেশন রোড, ঝালদা, চলভাষ: ৮০০১৫৫৭২৫১

পথনির্দেশ:

কোলকাতা--দুর্গাপুর ব্যারেজ--বাঁকুড়া --পুরুলিয়া-- ঝালদা--তুলিন ।ট্রেনে কলকাতার থেকে মুরি স্টেশন (ঝাড়খণ্ড)।হাওড়া থেকে হাওড়া- রাঁচি শতাব্দী এক্সপ্রেস , ক্রিয়াযোগ এক্সপ্রেস অথবা হাওড়া - রাঁচি ইন্টারসিটি এক্সপ্রেস ধরে খুব কম সময়েই পৌঁছে যাওয়া যায় " মুরী" স্টেশনে। সেখান থেকে অটোতে তুলিন যাওয়া যায়।

 সাঁতরাগাছি-পুরুলিয়া ধরে দুপুরে পুরুলিয়া পৌঁছে, বিকেল তিনটেতে তুলিন যাবার ট্রেন বিকেল সাড়ে চারটার আগেই তুলিনে পৌঁছে যাওয়া যায়।

 বাঁকুড়ার ধলডাঙায় পুরুলিয়ার রাস্তা ধরে, পৌঁছে যাওয়া যায় ঝালদা। তুলিন তার ১০/১২ কিমি দূরে।

 কলকাতা থেকে আসার দুটো পথ ভায়া বর্ধমান পানাগড় ফ্লাইওভার দিয়ে আসানসোল রঘুনাথপুর হয়ে তুলিন।কলকাতা থেকে তুলিনের দূরত্ব ( by road) ৩১৮ কিমি। সময় লাগে ৭ ঘণ্টা।

 তথ্য:

১)তুলিন: সুবর্ণরেখার তীরে পুরুলিয়ার শেষ গ্রাম ....... রণজিৎ দত্ত।

২) সীমান্ত বাংলার তুলনাহীন তুলিন, প্রকৃতির অফুরান সৌন্দর্য্যের স্বর্গ রাজ্য :  - ড. সুবীর মন্ডল

Mailing List