রাঢ়বাংলার ভাদুগান সঙ্কটের মুখে, লিখছেন ডঃ সুবীর মণ্ডল

রাঢ়বাংলার ভাদুগান সঙ্কটের মুখে, লিখছেন ডঃ সুবীর মণ্ডল
22 Sep 2023, 10:45 AM

রাঢ়বাংলার ভাদুগান সঙ্কটের মুখে, লিখছেন ডঃ সুবীর মণ্ডল

 

ডঃ সুবীর মণ্ডল

 

ভাদু গান রাঢ় বাংলার একটি প্রাচীন সংস্কৃতির অংশ। আর ভাদু দেবী নন, রাঢ়ের ঘরের মেয়ে। ভাদু বাংলার  গ্রাম--গঞ্জের প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর মানুষজনের স্বপ্নের লোকউৎসব। ভাদ্র মাসের  সংক্রান্তির  দিনে এই লৌকিক দেবীর পুজো হয়। ব্রত পালন  শুরু হয় মাসের পয়লা তারিখ থেকে। ভাদু গান ও উৎসব একান্ত ভাবে পশ্চিমবঙ্গের  চার-পাঁচটি জেলার নারী সমাজের নিজস্ব  উৎসব। বর্ধমান জেলার আসানসোল মহকুমা, সমগ্র দক্ষিণ বাঁকুড়া, পুরুলিয়া, বীরভূম, পশ্চিম মেদিনীপুর, ঝাড়গ্রাম, ঝাড়খণ্ডের রাঁচি, হাজারিবাগ, সেরাইকেল্লার প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর মানুষজনের স্বপ্নের  উৎসব ভাদু। জনপ্রিয়তার  নিরিখে ঝুমুর, টুসুর পর ভাদু গানের স্হান। জঙ্গলমহলের আদিবাসি সমাজ  ও কুর্মি সমাজের মধ্যে বর্ষার সময় করম গান ও উৎসব পালন করার রীতি আজও বহমান। করম গানের হিন্দু সংস্করণ  হিসাবে ভাদু গান কে ধরেছেন  লোকসংস্কৃতিবিদ ডঃ আশুতোষ ভট্টাচার্য।  তিনি ভাদু গানকে  আর্যেতর সমাজ  উদ্ভূত ধরে,হিন্দু ধর্মের  পৌত্তলিকতার প্রভাবজাত বলেছেন। আধুনিক লোক গবেষকদের অভিমত ভিন্ন হলেও ডঃ আশুতোষ ভট্টাচার্যের অভিমত সর্বজন স্বীকৃত।

গ্রামীণ বাংলার একটি বিশেষ সংস্কৃতি হল ভাদু গান। ভাদ্র মাস হলো কিছুটা অবসরের মাস। একসময় রাঢ় বাংলার বেশ কিছু জেলায় অলস ভাদ্রে কোনো ছেলেকে মেয়ের পোশাক পরিয়ে গ্রামে গ্রামে ঘুরে  প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর মানুষজনেরা  ভাদু নাচ দেখাত কিছু রোজগারের আশায়। এখনো কোথাও কোথাও ভাদু উৎসব চলে, তবে তা আগের মতো নয়। ভাদু গান মানভূম সংলগ্ন অঞ্চলে অন্যতম লোকসংস্কৃতি সম্পদ। কৃষি নির্ভর রাঢ়ের এই গ্রামগুলি বর্ষার অবসানে শরতের ভাদ্র মাসে ভাদু উৎসবে মুখর হয়ে উঠত। সময়ের হাত ধরে এখন ভাদু উৎসব অনেকটাই ম্লান হয়ে গিয়েছে।বলা চলে ভাদু গান আজ অবলুপ্তির পথে।

রাজনন্দিনী ভাদু রাঢ়ের কুলবধূ। দেবী নন,ঘরের  মেয়েএই ভাদু গানের পিছনে আছে এক রাজকুমারীর করুণ  অশ্রুসজল কাহিনি। জনশ্রুতি, মানভূমের ( পুরুলিয়া)অন্তর্গত কাশীপুরের রাজনন্দিনী হলেন ভাদু। তাঁর রূপ সৌন্দর্য ছিল অনুপম ও ঈর্ষণীয়। তাঁর বিবাহের ঠিক হয় বীরভূমের হেতমপুরের এক রাজপুত্রের সঙ্গে। বিয়ের দিন বিবাহ করতে আসার পথে ডাকাতদলের হাতে খুন হন ভদ্রাবতীর হবু স্বামী। শোকে- দুঃখে মুহ্যমান হয়ে ভদ্রাবতী আত্মঘাতী হয়। কারো মতে, ভদ্রাবতী বা ভাদু চিতার আগুনে আত্মাহুতি দেয়। আবার কারো মতে, জলে ঝাঁপ দিয়ে মৃত্যুকে বেছে নেয়। সেই ঘটনা মনে রেখে ভাদু গানের সূচনা। আধুনিক লোক গবেষকদের অভিমত রাজার প্রিয় ভদ্রাবতীকে জনমানসে স্মরণীয় করে রাখতে রাজা নীলমণি সিং দেওর ভাদু গানের প্রচলন করেন। কেউ কেউ মনে করেন, ভাদু মানে লক্ষী।যেহেতু লক্ষী বিভিন্ন  সময়ে পূজিতা হন।তাই ভাদ্র মাসের  লক্ষীকে পৃথক ভাবে চিহ্নিত করার জন্য ভাদু পুজোর  প্রচলন  হয়। তবে অন্য মতও রয়েছে।সেই  মতের সঙ্গে বাস্তবের কাহিনী জড়িয়ে আছে। অনেক লোক গবেষক ভাদুর সঙ্গে  মীরাবাঈয়ের মিল খুঁজে পান।কেউ কেউ ভাদুকে বাঁকুড়ার মল্লরাজাদের  কন্যা ভদ্রাবতী বলে মনে করেন। জনশ্রুতি তাঁর অকালমৃত্যুতে ভাদু পুজোর  প্রচলন।

ভাদু রাঢ়ের একটা জনপ্রিয়  লোকসঙ্গীত কিন্তু এর প্রচলন পুরুলিয়ার কাশীপুরের রাজপরিবারের হাত ধরে। আর তা শুরু হয় পয়লা ভাদ্র থেকে ভাদু পুজোর মধ্য দিয়ে। আগে ওই গানের আসরে ব্যবহৃত বাদ্য যন্ত্র ছিল ঢোল আর জুড়ি। সময়ের দাবি মেনে  পরবর্তিতে সংযোজিত হয়েছে হারমোনিয়াম, ক্যাসিও এবং তবলা। কথায় আর সুরেও লেগেছে আধুনিকতার  ছোঁয়া। অনুপ্রবেশ ঘটেছে ছায়াছবির গানের সুরেরও। কেবল তাই নয়, ভাদুকে কোথাও কোথাও বাংলা ছায়াছবির নায়িকাদের সঙ্গেও তুলনা করা হয়। ভাদু গানের বিষয়বস্তু তাঁর কুমারী জীবন, ইচ্ছা, আকাঙ্ক্ষা, অভিপ্রায়, বিয়ে, বেদনা বিধূর করুণ অকাল মৃত্যু এবং সাম্প্রতিক আঞ্চলিক কিছু ঘটনা ও বৈশিষ্ট্য। কিন্তু সোসাল মিডিয়ার ও আধুনিক গণমাধ্যমের দাপটে ভাদুর মতো লোকসংস্কৃতির ধারাটি আজ চরম সংকটের মুখে। ডিজিটাল যুগে লোক জীবনের হৃদয় থেকে, যেভাবে হারিয়ে যাচ্ছে ভাদু গান, তাতে একদিন লুপ্ত হয়ে যাবে বলে আশঙ্কা! অথচ একসময় রাঢ়দেশীয় গৃহবধূরা ভাদুকে প্রণাম করে স্বামীর মঙ্গল কামনা করতেন।

‘ভাদু লে লে লে পয়সা দু-আনা, কিনে খাবি মিছরির দানা।’ জনপ্রিয় এই ভাদু গান, কয়েক বছর আগে পর্যন্ত গেয়ে ও নেচে পাড়ায় পাড়ায় ঘুরে বেড়াতে দেখা যেত বেশ কিছু ভাদু শিল্পীদের ভাদ্র মাসে। কিন্তু বর্তমান মুঠোফোন, অত্যাধুনিক সাউন্ড সিস্টেম ইত্যাদির আড়ালে দুই দশকের বেশি সময় ধরে এই ভাদু গান এবং ভাদু শিল্পীরা চরম সংকটের মুখে। পুরুলিয়া,বীরভূম,ঝাড়গ্রাম, পশ্চিম মেদিনীপুরে,বাঁকুড়ায় আর সেই ভাবে দেখা যায় না এই সকল ভাদু শিল্পীদের। অথচ কয়েক বছর আগেও বীরভূম, বাঁকুড়া, বর্ধমান, পুরুলিয়ার মতো রাঢ় বাংলায় গ্রামে গ্রামে দেখা যেত ভাদু শিল্পীদের। তবে বীরভূমে বেশকিছু গ্রামের সাধারণ প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর   মানুষ এই ডিজের যুগেও টিকিয়ে রেখেছেন এই ভাদু শিল্পকে।

ভাদ্র মাসের পয়লা তারিখ থেকে একটি মেয়েকে ঘাগরার মতো শাড়ি পরিয়ে ও মাথায় ওড়না দিয়ে ভাদু সাজিয়ে গানের সঙ্গে নাচানো চিরাচরিত রীতি। আর মাটির ভাদু মূর্তি কোলে করে নিয়ে গ্রামে গ্রামে ঘুরে টাকা পয়সা আদায় করেন ভাদু শিল্পীরা। ভাদু শিল্পীরা মুখে মুখে রচনা করেন গান, তাঁদের গানে উঠে আসে তাঁদের জীবন যন্ত্রণার প্রসঙ্গ, উঠে আসে সামাজিক, রাজনৈতিক, সাম্প্রতিক বিষয়। ঢোল, হারমোনিয়াম, কাঁসা ইত্যাদি বাদ্যযন্ত্র সহযোগে গান শোনান ভাদু গানের লোকশিল্পীরা।

টুসু ও ঝুমুর গানের বিপরীতে ভাদু গানগুলিতে প্রেম এবং রাজনীতি সর্বোতভাবে বর্জিত। সাধারণত গৃহনারীদের জীবনের কাহিনী এই গানগুলির মূল উপজীব্য। পৌরাণিক ও সামাজিক ভাদু গানগুলি বিভিন্ন পাঁচালির সুরে গীত হয়। সাধারণত রামায়ণ, মহাভারত ও কৃষ্ণ-রাধার প্রেম পৌরাণিক গানগুলির এবং বারোমাস্যার কাহিনী সামাজিক গানগুলির বিষয় হয়ে থাকে। এছাড়া চার লাইনের ছড়া বা চুটকি জাতীয় ভাদু গানগুলিতে সমাজ জীবনের বিভিন্ন অসঙ্গতির চিত্র সরস ভঙ্গীতে ফুটিয়ে তোলা হয়। উদাহরণ ----

"হলুদ কনের ভাদু তুমি হলুদ কেন মাখনা,

শাশুড়ি ননদের ঘরে হলুদ মাখা সাজে না।

কলগাছে চাবি ছিল, হলুদ বল্যে মেখেছি

ও শাশুড়ি গাল দিওনা পাশা খেলতে বসেছি।"

বর্তমান ভাদু গানের অবলুপ্তির সময়ে অনেক শিল্পী আছেন যাঁরা ভাদু গানকে বাঁচিয়ে রাখার চেষ্টায় রয়েছেন, তাঁরা চরম আর্থিক অনটনে এই ভাদু গান করেন এমনটা নয়, বরং তাঁরা ভালবেসে এই ভাদু গানকে আঁকড়ে ধরে রেখেছেন কেবলমাত্র গান বাঁধার নেশায় এবং সমাজ সচেতনতামূলক বার্তা সাধারণ মানুষদের কাছে তুলে ধরার জন্য। সমাজ  শিক্ষার মাধ্যম হয়ে উঠেছিল এক সময় ভাদু গান।

ভাদু গান হলো রাঢ়ের লোকগান, তাই এই গানের মাধ্যমে গ্রাম্য মানুষের কাছে সচেতনতামূলক বার্তা পৌঁছে দেওয়া সব থেকে বেশি সহজ। তাঁরা সারা বছর ধরে গান রচনা করেন এবং ভাদ্র মাসে গ্রামে গ্রামে গিয়ে ঘুরে বেড়ান, ছড়িয়ে দেন ভাদু গান। তাঁদের ভাদু গানের মধ্যে ফুঁটে ওঠে জল অপচয় বন্ধ করার বার্তা, গাছ লাগানোর বার্তা, প্লাস্টিক বর্জন করার বার্তা, নেশামুক্ত সমাজ গড়ে তোলার বার্তা, বাল্যবিবাহ বন্ধ করার মতো নানান সামাজিক সচেতনতামূলক বার্তা। তবে তাঁদের কথায় যেমন ফুটে ওঠে সামাজিক সচেতনতামূলক বার্তা, যেমন গান বাঁধার তাগিদে ভাদুকে আঁকড়ে ধরে রাখার কথা, পাশাপাশি তাঁদের কথাতেই রয়েছে আক্ষেপ। তাঁরা জানান, গ্রামগঞ্জে এখনও পর্যন্ত ভাদু গানের চাহিদা থাকলেও রোজগার বলতে সামান্যটুকু। বাঙালি লোকসংস্কৃতির একটা দিক হল এই ভাদু গান, আবার একথা অনস্বিকার্য যে, সংস্কৃতিই একটা দেশের ও জাতির পরিচয়পত্র।

 পরিবর্তনের স্রোতের সঙ্গে মানিয়ে নিতে না পেরে বিলুপ্ত হতে চলেছে ভাদু গান। শিকড় ভুলে বাঙালি মজেছে বাজারি সংস্কৃতিতে। গ্রামবাংলার আর সব লোকশিল্পীর মতো ধুঁকছেন ভাদুশিল্পীরাও। অনেকেই অবশ্য পূর্ব পুরুষদের রেওয়াজ বজায় রাখতে নেশার মতোই আগলে রেখেছেন এই সংস্কৃতি। তাই এই ঐতিহ্যবাহী ভাদুকে বাঁচিয়ে রাখতে হলে অবশ্যই আমাদের কিছু করে দেখানো প্রয়োজন, সঙ্গে সঙ্গে সরকারি সহযোগিতাও জরুরি। ভাদু উৎসবের  সঙ্গে জড়িয়ে আছে জিলিপি তৈরির রেওয়াজ। ভাদুমাকে খুশি করতে তৈরি  হয় বিশাল আকৃতির জিলিপি। রাঢ় বাংলার ঘরে ভাদু কোনও দেবী নন, একেবারেই ঘরের মেয়ে। তাই মেয়েরা সহজেই গেয়ে ওঠেন---

"আমার  ভাদু সোনার জাদু/ কে পঠাইলে কোলকেতা/ সেই কলকেতারই লুনা জলে,/ ভাদু হইল শ্যামলতা---" 

ভাদু নিয়ে  বিশেষ করে জঙ্গলমহলের মানুষের মধ্যে দেখা যেত প্রচুর আবেগ এবং  ভালোবাসা। সেই সময় বাজারে ভাদু মুর্তি না পেয়ে ফিরে যেত অনেকে। বর্তমানে আধুনিকতার ছোঁয়ায় সেই সব অতীত। বিক্রি নেই সেভাবে। অতীতে বাঁকুড়ার জেলার পাঁচমুড়ার ভাদু শিল্পীরা এই মরসুমে ভাদু বিক্রি করে আর্থিক ভাবে বেশ লাভবান হতেন। কিন্তু বর্তমানে ভাদু বিক্রি না হওয়ায় ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছেন তাঁরা।

ভাদুশিল্পী পলাশ কুম্ভকার জানান, আগে তারা ছোট ও বড়ো মিলিয়ে ছশো থেকে আটশো ভাদু প্রতিমা তৈরি করতেন। তাও মানুষ ভাদু পূজার দিন প্রতিমা না পেয়ে ফিরে যেত। বর্তমানে দুশো - আড়াইশো ভাদু তৈরি করেও সব বিক্রি করতে পারেন না। এখনকার ছেলে মেয়েরা ও বাড়ির বয়স্করাও ভাদু গান  থেকে দূরে সরে গেছে। এজন্য আধুনিক ব্যস্ত জীবনকে দায়ী করেছেন তিনি।আরেক শিল্পী মলয় কুম্ভকার বলেন, ‘ভাদু বানিয়ে আগের মতো লাভ হয় না। মানুষের ভাদুপুজোয় মন নেই। মানুষ মূলধারার সঙ্গে যুক্ত হতে চায়। তারা টিভিতে বা ফোনে যা দেখে তাকেই অনুকরণ করে। যার জেরে ক্রমশ কমছে ভাদু জনপ্রিয়তা।’

 এই  উৎসবের  সঙ্গে রাঢ় অঞ্চল আর জঙ্গলমহলের অর্থনৈতিক উন্নতির একটা বিশেষ যোগ আছে। ভাদু প্রতিমা বিক্রি করেএকটা সমাজের মানুষ আর্থিক উপার্জন করে থাকে। আজ ভাদুশিল্পীরাও অর্থনৈতিক সঙ্কটের মুখোমুখি। গ্রামীণ এই লোকসংস্কৃতি আজ চরম সংকটের সামনে।অবলুপ্তির হাত থেকে বাঁচার জন্য দরকার সরকারী সহযোগিতা ও আর্থিক, সেই সঙ্গে মানসিকতার পরিবর্তন। আগামী প্রজন্ম কে এগিয়ে আসতে হবে।

লেখক: শিক্ষক, খাতড়া হাইস্কুল, বাঁকুড়া

Mailing List