রাধাকৃষ্ণণের দৃষ্টিতে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ, এক অনন্য কাহিনী লিখছেন সত্যব্রত দোলই

রাধাকৃষ্ণণের দৃষ্টিতে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ, এক অনন্য কাহিনী লিখছেন সত্যব্রত দোলই
06 Sep 2023, 05:32 PM

রাধাকৃষ্ণণের দৃষ্টিতে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ, এক অনন্য কাহিনী লিখছেন সত্যব্রত দোলই

 

সত্যব্রত দোলই

 

ড. সর্বপল্লী রাধাকৃষ্ণণের ভাবজীবনকে হাতে গোনা যে কয়েকজন মণীষী বিশেষভাবে প্রভাবিত করেছিলেন, অন্যতম হলেন বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। কবিগুরুর ব্যক্তিত্ব ছটায় রাধাকৃষ্ণণ আশ্চর্য হয়ে গিয়েছিলেন। রাধাকৃষ্ণনের কাছে রবীন্দ্রনাথ ছিলেন ভারতমাতার সুযোগ্য সন্তান। বিশ্বের শ্রেষ্ঠ মানুষদের মধ্যে অন্যতম। রাধাকৃষ্ণণ তাঁর আত্মজীবনীমুলক রচনা ‘ফ্র্যাগমেন্টস্ অফ আ কনফেশন'-এ লিখেছেন, “আমার সমসাময়িক দুই মহান ভারতসন্তান, কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ও মহাত্মা গান্ধীর সঙ্গে তিরিশ বছর ধরে আমার বিশেষ বন্ধুত্বের সম্পর্ক ছিল। আমার জীবনে এই দুই মহামানবের প্রভাব যে কী গুরুত্বপূর্ণ তা আমি সহজেই অনুভব করতে পারি।”

 

১৯১২ খ্রিস্টাব্দে রবীন্দ্র রচনাবলীর সাথে রাধাকৃষ্ণণের প্রথম পরিচয় ঘটে। সেই সময় রাধাকৃষ্ণণ মাদ্রাজ প্রেসিডেন্সি কলেজে অধ্যাপনা করতেন। ১৯১৩ খ্রিস্টাব্দে রবীন্দ্রনাথ প্রথম এশিয়াবাসী হিসাবে সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার পান তাঁর ‘গীতাঞ্জলি' বা 'সং অফারিংস' কাব্যগ্রন্থের জন্য। ইংরেজি অনুবাদে রবীন্দ্র রচনাবলী পড়ে রাধাকৃষ্ণণ অবাক হয়ে গিয়েছিলেন। রবীন্দ্র রচনাবলী রাধাকৃষ্ণণের মনোজগতে এক গভীর ভাবের উদয় ঘটিয়েছিল। বিশেষ করে 'গীতাঞ্জলি' এবং “সাধনা : দ্য রিয়েলাইজেশন অফ লাইফ'-এর কবিতাগুলি পড়ে রাধাকৃষ্ণণ অত্যন্ত আনন্দ পেয়েছিলেন। রাধাকৃষ্ণণ এতদিন বিশ্বাস করতেন যে, গূঢ়তর অন্বেষণার মাধ্যমে আমরা পরম ব্রহ্মের সন্ধান করতে পারি। অন্য কোনও অর্থে ব্ৰহ্মকে উপলব্ধি করা সম্ভব নয়। কিন্তু রবীন্দ্রনাথের কবিতার সঙ্গে পরিচিত হওয়ার পর তাঁর এই ভ্রান্ত ধারণা দূর হল। রাধাকৃষ্ণণ উপলব্ধি করলেন কবিতার মাধ্যমে আমরা সর্বশক্তিমানের চরণ স্পর্শ করতে পারি। শুধু দার্শনিক অভিজ্ঞান থাকলেই চলবে না। থাকতে হবে আবেগধর্মী মন। তা না হলে ঈশ্বরের সান্নিধ্য আমরা অনুভব করতে পারব না।

১৯১৭ খ্রিস্টাব্দে রাধাকৃষ্ণণ বিখ্যাত 'দ্য কোয়েস্ট' পত্রিকায় রবীন্দ্রনাথের জীবনদর্শন ও সাহিত্য দর্শন সম্পর্কে দুটি গুরুত্বপূর্ণ প্রবন্ধ লিখেছিলেন। এই প্রবন্ধগুলি সঙ্কলিত হয়ে ১৯১৮ খ্রিস্টাব্দে 'ফিলোজফি অব রবীন্দ্রনাথ টেগোর' নামে একটি গ্রন্থ প্রকাশিত হয়। এই গ্রন্থের প্রবন্ধগুলিতে রাধাকৃষ্ণণ রবীন্দ্রনাথের রচনার উপরে নানা বিশ্লেষণ করেছেন। একজন ধীশক্তি সম্পন্ন পাঠকের মতো রবীন্দ্রনাথের প্রত্যেকটি কবিতার প্রতিটি শব্দকে নিয়ে গভীরভাবে আলোচনা করেছেন। রবীন্দ্রনাথের প্রতিটি ভাবনাকে বিশ্লেষণ করারও চেষ্টা করেছেন। এমনকি রবীন্দ্রনাথের কবিতায় কেমন সুন্দরভাবে প্রাচীন ভারতের অধ্যাত্মবাদ মিশে আছে এবং রবীন্দ্রনাথ কেমনভাবে নিজের সাহিত্য প্রতিভার সঙ্গে সেই অধ্যাত্মবাদকে মিশিয়ে সহজ সরল করে পাঠকের কাছে পৌঁছে দিয়েছেন- সে সম্পর্কেও রাধাকৃষ্ণণ বিচার বিশ্লেষণ করেছেন। নিজের বিশ্লেষণী মনোভাবের মাধ্যমে এতদিন পর্যন্ত রবীন্দ্র-রচনার যে সমস্ত দিক অনুদ্ভাসিত ছিল সেই সমস্ত দিকও তুলে ধরেছেন রাধাকৃষ্ণণ। 'ফিলোজফি অফ রবীন্দ্রনাথ টেগোর' গ্রন্থটি প্রকাশের আগে রাধাকৃষ্ণণের সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের চাক্ষুস পরিচয় ছিল না। গ্রন্থটির প্রকাশক 'ম্যাকমিলন অ্যাণ্ড কো. লিমিটেড'-এর পক্ষ থেকে গ্রন্থটির পাণ্ডুলিপি রবীন্দ্রনাথের কাছে পাঠানো হয়েছিল তাঁর অনুমোদনের জন্য। রাধাকৃষ্ণণ সেই উপলক্ষে রবীন্দ্রনাথকে বইটির একটি ভূমিকা লিখে দিতে অনুরোধ করেছিলেন। রবীন্দ্রনাথ অবশ্য সেই অনুরোধ রাখেন নি। ১৯১৮ খ্রিস্টাব্দের ৯ মে রাধাকৃষ্ণণকে একটি চিঠিতে রবীন্দ্রনাথ লেখেন, “আমার পক্ষে আপনার এই গ্রন্থটির ভূমিকা লেখা সত্যিই বেশ কঠিন। যদি আমাকে এই সম্পর্কে কিছু লিখতে হয়, তা হলে আমাকে কি কি করতে হবে আমি সেটা বুঝতে পারছি না। আর যদি আপনি বলেন পাঠকদের উদ্বুদ্ধ করার জন্য কিছু লেখা আবশ্যক তা হলে আমি বলব আমি সে কাজও করতে পারব না। আমাকে যদি আমার রচনার মধ্যে দার্শনিকতার অস্তিত্ব সম্পর্কে কিছু বলতে বলা হয়, তা হলে তো আমার অবস্থা ঐ গল্পের মনজিয়্যার জোর্ডেন-এর মতো হয়ে যাবে। যে কিনা নিজেই জানে না যে সারাজীবন ধরে সে নিজের অজ্ঞাতসারে পদ্যের বদলে শুধু গদ্যের কথাই বলে এসেছে। অবশ্য যদি এ ব্যাপারে কেউ বলেন যে, আমার রচনার মধ্যে দার্শনিক তত্ত্বের সোনা নিরন্তর গলিত অবস্থায় বয়ে চলেছে এবং সেই সোনার কণাগুলি কুড়িয়ে নিলে সোনার বাট তৈরি হতে পারে, তাহলে আমার মনের অহংকার তৃপ্তি পেতে পারে। কিন্তু সেই সোনার কণা খোঁজার দায়িত্ব পাঠককেই নিতে হবে। ..... ধরুন যদি আমার শরীরে বিশেষ কোনও রোগ বাসা বেঁধে থাকে, আর যদি আমার ডাক্তারবাবু সেই রোগটি সম্পর্কে কোনো গবেষণামূলক বৈজ্ঞানিক প্রবন্ধ রচনা করে আমাকেই সেই প্রবন্ধের যোগতত্ত্বের সত্যতা সম্পর্কে জামিনদার হতে বলেন, তাহলে সেটা সত্যিই একটা হাসির ব্যাপার হবে। কারণ সেই ক্ষেত্রে আমাকে রোগভোগের যন্ত্রণা সহ্য করতে হবে আর আমার শারীরিক কষ্টটা বুঝবেন ডাক্তারবাবু|’’

 “ফিলোজফি অফ রবীন্দ্রনাথ টেগোর' প্রকাশিত হওয়ার পর পাঠক মহলে বেশ সাড়া পড়েছিল। বইটি প্রকাশের পরে রবীন্দ্রনাথ রাধাকৃষ্ণণকে একটি চিঠিতে লিখেছিলেন—“আমি যতদুর আশা করেছিলাম, এই বইটা তার চেয়ে অনেক বেশি ছাড়িয়ে গেছে, আর এ ব্যাপারে আপনার আন্তরিকতা, ঐকান্তিক চেষ্টা, গভীর অর্ন্তদৃষ্টি সত্যিই আমাকে মুগ্ধ করেছে। আমার মনে হয় পাণ্ডিত্য প্রকাশের নগ্নতা আর দুর্বোধ্য বৈজ্ঞানিক পরিভাষা থেকে মুক্ত হওয়ায় এই বইটার মধ্যে ভাষার এক সাবলীল সৌন্দর্য প্রকাশ পেয়েছে। সেই কারণে আপনাকে ধন্যবাদ জানাচ্ছি।”

বিশিষ্ট দার্শনিক ড. শরৎ কুমার দাস বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ে একবার 'টেগোর অ্যাণ্ড দ্য ডিফারেন্ট প্রবলেমস্ অফ ফিলোজফি' নামে একটি ভাষণ দিয়েছিলেন। তিনি এই ভাষণে কবিগুরু এবং রাধাকৃষ্ণণের পারস্পরিক মধুর সম্পর্কের কথা উল্লেখ করেছিলেন। এই দুই মনীষী সাধারণত কোন কোন বিষয় নিয়ে আলোচনা করতেন ড. দাস সে সম্পর্কেও বিবরণ দিয়েছিলেন। একবার রাধাকৃষ্ণণ রবীন্দ্রনাথকে প্রশ্ন করেছিলেন—“অ্যাকাডেমি বা শিক্ষায়তন স্তরে কত তো সৃজনশীল বিষয় পড়ানো হয়, কিন্তু পরিবর্তনশীল ভারতীয় দর্শনশাস্ত্রের পড়াশোনা কি একেবারেই বন্ধ হয়ে গেল। গুরুদেব আপনি কি এ ব্যাপারে কোনো চিন্তা ভাবনা করেছেন ?” রবীন্দ্রনাথকে রাধাকৃষ্ণণ আরও বলেছিলেন- বর্তমানে ভারতীয় দর্শন কেবলমাত্র ভাষ্য আর ব্যাখ্যার মধ্যেই নিজেকে আবদ্ধ করে রেখেছে। আর এই কারণে দর্শনের সঙ্গে সাধারণ মানুষের যোগসূত্রতা হারিয়ে যাচ্ছে। দর্শন নিজের জনপ্রিয়তা হারাচ্ছে। রাধাকৃষ্ণণের প্রশ্ন ও উদ্বেগের কথা শুনে রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন-“হ্যাঁ ঠিকই বলেছেন। এটা সত্যিই বেশ চিন্তার ব্যাপার। তবে আমার কিন্তু মনে হয় আমাদের সেই দর্শনচিন্তা একেবারে নিজের গতিকে হারিয়ে ফেলেনি। হতে পারে তার জীবনীশক্তি কিছুটা ঝিমিয়ে পড়েছে। কিন্তু জীবনীশক্তি একেবারে কিন্তু শেষ হয়ে যায়নি। "

রাধাকৃষ্ণণ রবীন্দ্রনাথের কাছে আরও জানতে চেয়েছিলেন- “আপনি বলতে চাইছেন যে আমাদের ভারতীয় দর্শনচিন্তা তার নিজের বাঁধাধরা পথ দিয়ে না গিয়ে অন্য একটি পথে নিজেকে প্রকাশ করেছিল? কেন হয়েছিল? এমন ঘটনা ঘটার পেছনে কি এমন কারণ আছে বলে আপনি মনে করেন?” রবীন্দ্রনাথ উত্তরে বলেছিলেন—“এটা হতে পারে যে ভারতের সৃজনশীল চিন্তাধারা ক্ষুদ্রতর স্তরে বা কোনো সংকীর্ণ স্তরে প্রবাহিত হতে পারেনি। হয়তো তার অগ্রগতি এখন কিছুটা পরিমাণে রুদ্ধ হয়ে গেছে। কিন্তু সে এখন জনতার মনের মাটিতে ঝরে পড়ছে। আর সেইভাবে সে বিভিন্ন অঞ্চলের জমিকে উর্বর করছে।” এই প্রসঙ্গে আলোচনা করতে গিয়ে রবীন্দ্রনাথ টেনে এনেছিলেন বিখ্যাত ভাববাদী এবং মানবতাবাদী কবি ও দার্শনিকদের কথা। এই সব মানুষেরা কিন্তু চিরাচরিত প্রথায় তত্ত্বজ্ঞানের মাধ্যমে কোনো দর্শনচর্চা করেননি। তাঁরা নিজেদের কবিতায়, গানে বা ছবিতে দর্শনতত্ত্বের কোনো দুরূহ বিষয় দর্শকের মনে প্রবেশ করিয়েছেন। যেমন—দাদু দয়াল, কবীর ও মধ্যযুগের বাংলা বাউল গানের সম্প্রদায়।

১৯২৫ খ্রিস্টাব্দে 'ইণ্ডিয়ান ফিলোজফিক্যাল কংগ্রেস'-এর প্রথম অধিবেশনে সভাপতির পদে আসীন থেকে রবীন্দ্রনাথ একটি অসাধারণ ভাষণ দেন, যার শিরোনাম ছিল 'আমাদের জাতীয় জনতার দার্শনিক চিন্তাধারা'। এই ভাষণটি ১৯২৬ খ্রিস্টাব্দের জানুয়ারি মাসে মর্ডান রিভিউ পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছিল 'ফিলোজফি অফ আওয়ারস্ পিপ্‌ল ' নামে। সেই সময় ভারতীয় দর্শনের অবস্থা দেখে রাধাকৃষ্ণণ অত্যন্ত কষ্ট পেতেন। তাঁর সেই কষ্ট দুর করবার জন্য রবীন্দ্রনাথ তাঁর ভাষণে নানা যুক্তি-তর্ক দিয়ে বোঝাতে চেয়েছিলেন যে, ভারতীয় দর্শনের ধারাবাহিক অবনতি ও অবক্ষয় সাময়িক। মানুষের মনে দর্শন অন্বেষা হারিয়ে যায়নি। যুগ পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে হয়তো তার বাহ্যিক রূপে কিছু পরিবর্তন এসেছে, কিন্তু আত্মিক রূপটি রয়েছে অপরিবর্তনীয়। রাধাকৃষ্ণণ তাঁর ভাষণে বলেন যে, অদূর ভবিষ্যতে আবার ভারতীয় দর্শন তার আলোকে সারা বিশ্বকে আলোকিত করতে পারবে এবং আরও বেশি করে মানুষ ভারতীয় দর্শন সম্পর্কে আগ্রহ প্রকাশ করবে।

এই দুই মণীষী মাঝে মধ্যেই নানা বুদ্ধিদীপ্ত আলোচনায় অংশ নিতেন। দুজনেই একে অপরকে শ্রদ্ধা করতেন। তাঁদের পারস্পরিক আলোচনা থেকে আমরা জানতে পারি যে, রাধাকৃষ্ণণ ছিলেন ঐতিহ্য আশ্রয়ী দার্শনিক অভীক্ষার জনক। রবীন্দ্রনাথ তাতে আধুনিকতার ছোঁয়া লাগিয়ে দিয়েছিলেন। রবীন্দ্রনাথ সাহিত্য কর্মের মাধ্যমে ঈশ্বরানুভূতির কথা বলেছেন, আর রাধাকৃষ্ণণ আধ্যাত্মিক চেতনার দ্বারা ঈশ্বরকে স্পর্শ করতে চেয়েছেন। অর্থাৎ তাঁরা ভিন্ন ভিন্ন পথে একই উত্তুঙ্গ শিখরে আরোহণের চেষ্টা করেছিলেন।

১৯৩০ খ্রিস্টাব্দের মে মাসে রবীন্দ্রনাথ অক্সফোর্ডের ম্যানচেস্টার কলেজে 'হিবার্ট বক্তৃতা' দিয়েছিলেন। বক্তৃতার শিরোনামে ছিল 'দ্য রিলিজিয়ন অফ ম্যান'। শত ব্যস্ততার মধ্যেও রাধাকৃষ্ণণ সেদিন দর্শকাসনে বসে মুগ্ধ হয়ে রবীন্দ্রনাথের ভাষণের প্রতিটি কথা শুনেছিলেন। এই বিষয়ে পরে এক আলাপচারিতায় গুরুদেবের প্রশংসাও করেছিলেন।

১৯৩১ খ্রিস্টাব্দের ২৬ ডিসেম্বর কলকাতার ঐতিহাসিক টাউন হলে কবিগুরুর সংবর্ধনা উৎসব পালিত হয়েছিল। ঐ সভায় রাধাকৃষ্ণণ সভাপতির আসন অলঙ্কৃত করেছিলেন। রাধাকৃষ্ণণ তাঁর ভাষণে রবীন্দ্রনাথকে আধুনিক ভারতের একজন মহান রূপকার হিসাবে বর্ণনা করেন। রাধাকৃষ্ণণ ঐ সভায় রবীন্দ্রনাথ সম্পর্কে একটি সুন্দর মন্তব্য করেছিলেন – “আমরা জানি ইতিহাস কোনোদিন কোনো আধিপত্য বিস্তারকারী পুরুষের নাম মনে রাখে না। আমরা কোনো একটি বিশেষ শহরের সৌন্দর্য

 

কাহিনী হয়তো ভুলে যেতে পারি। কিন্তু রবীন্দ্রনাথ তাঁর কাব্য আর সঙ্গীতের মাধ্যমে আমাদের সারাজীবন মুগ্ধ করে রাখবেন। যদিও রবীন্দ্রনাথ জন্মসূত্রে একজন ভারতীয়, কিন্তু তিনি কোনো গোষ্ঠীগত বা ভাবগত বা জাতিগত ভাবধারার মধ্যে নিজের সৃষ্টিকে সীমাবদ্ধ রাখেন নি। রবীন্দ্রনাথের সৃষ্টি সেই সর্বজনীন উপাদান দিয়েই তৈরি হয়েছে, যা সমগ্র বিশ্বের অন্তরে একটি স্পন্দন জাগিয়ে তুলেছে। তিনি জীবনকে মধুরতর করেছেন আর সভ্যতাকে করেছেন মহত্তর, সেখানে তার কোনো বিনাশ নেই।”

রবীন্দ্র-সাহিত্যের একজন যথার্থ সমালোচকের মতোই রাধাকৃষ্ণণ রবীন্দ্র সাহিত্যকে ভাগ করেছিলেন মূলত তিনটি ভাগে । প্রথম ভাগে ছিল এমন একটি আন্তরিক সততা যার মাধ্যমে আমরা আধ্যাত্মিক মান অর্জন করতে পারি। দ্বিতীয় ভাগে ছিল সন্ন্যাস বা ত্যাগ। যেখানে পবিত্র জীবন যাপন করাকেই সামগ্রিক উন্নয়নের মাপকাঠি বলে বিচার করা হয়ে থাকে। আর তৃতীয় ভাগে ছিল সেই সমস্ত মানুষদের কথা যারা জাতির সামগ্রিক উন্নয়নে নিজেদের নিবেদন করেছেন। একজন দক্ষ শিল্পীর মতোই রাধাকৃষ্ণণ যেন একটি বড় ক্যানভাসে অতি নিপুণভাবে এই তিনটি শ্রেণির কথা এঁকেছেন। আর আজও আমরা প্রতিটা মুহূর্তে তাঁর সাহিত্যের আস্বাদ অনুভব করতে পারি। এটাই হল রবীন্দ্র-সাহিত্যের শ্রেষ্ঠত্ব।

 

১৯৩৩ খ্রিস্টাব্দে রাধাকৃষ্ণণ অন্ধ্র বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাধ্যক্ষ ছিলেন। সেই সময় তিনি রবীন্দ্রনাথকে আমন্ত্রণ জানিয়ে ছিলেন অন্ধ্র বিশ্ববিদ্যালয়ে কয়েকটি বক্তৃতা দেওয়ার জন্য। রবীন্দ্রনাথ সাদরে সেই আমন্ত্রণ গ্রহণ করেছিলেন। সেই বছর ৮.৯, ১০ ডিসেম্বর এবং ১৯৩৪-এর ২ জানুয়ারি রবীন্দ্রনাথ ওয়ালটেয়ার শহরে কয়েকটি বক্তৃতা দিয়েছিলেন। রবীন্দ্রনাথ সেইসব বক্তৃতার মাধ্যমে ভারতীয় সংস্কৃতির বিভিন্ন দিক সম্পর্কে তাঁর সুচিন্তিত মতামত দিয়েছিলেন। পাশাপাশি সমকালীন ভারতীয় রাজনীতির গতিপ্রকৃতি, ভারতের আধ্যাত্মচেতনার পুনরুজ্জীবন, বিশ্বমানবতাবাদ প্রভৃতি বিষয়ে নিজের বক্তব্যকে তুলে ধরেছিলেন। আর প্রতিটি আলোচনাসভায় রাধাকৃষ্ণণ দর্শকাসনে বসে গুণমুগ্ধ শ্রোতার মতো কবিগুরুর বক্তব্য শুনতেন।

 

১৯৩৬ খ্রিস্টাব্দে রাধাকৃষ্ণণ 'সমকালীন ভারতীয় দর্শন' নামে একটি গ্রন্থের সম্পাদনা করেন। ঐ গ্রন্থে প্রকাশিত হয়েছিল। রবীন্দ্রনাথের লেখা 'রিলিজিওন অব অ্যান আর্টিস্ট' নামে একটি প্রবন্ধ। ঐ গ্রন্থটির একটা খণ্ড রাধাকৃষ্ণণ রবীন্দ্রনাথের কাছে পাঠিয়েছিলেন। আর সেই সঙ্গে ওয়ার্ল্ডস আনবর্ণ সোল' নামে তাঁর বক্তৃতার একটি অনুলিপিও পাঠিয়েছিলেন। বইটি পড়ে রবীন্দ্রনাথ অত্যন্ত খুশি হয়েছিলেন। উপহার প্রাপ্তি স্বীকার করে রাধাকৃষ্ণণকে রবীন্দ্রনাথ একটি চিঠিও লিখেছিলেন। এই চিঠির মাধ্যমে রবীন্দ্রনাথ তাঁর অন্তরের ভালোবাসা জানিয়েছিলেন রাধাকৃষ্ণণকে।

 

১৯৩৮ খ্রিস্টাব্দে রবীন্দ্রনাথের ব্যক্তিগত অনুরোধে রাধাকৃষ্ণণ শান্তিনিকেতনে এসেছিলেন। তখন রাধাকৃষ্ণণ ছিলেন। অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক। রাধাকৃষ্ণণ শান্তিনিকেতনে ছাত্র-ছাত্রীদের উদ্দেশ্যে একটি মনোজ্ঞ ভাষণ দিয়েছিলেন। এই জন্য রবীন্দ্রনাথ তাঁকে ধন্যবাদ জানান এবং বলেন, “রাধাকৃষ্ণণের মতো একজন বিশ্বমানব যে আমার ক্ষুদ্র আশ্রয়ে এসেছেন, এতে আমি কৃতজ্ঞ”।

রবীন্দ্রনাথের জীবনের অন্তিম লগ্নে রাধাকৃষ্ণণ একটি অপ্রীতিকর ঘটনার সম্মুখীন হন। লর্ড কার্জন সেই সময় ছিলেন অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের আচার্য। অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের তরফে প্রস্তাব দেওয়া হয়, রবীন্দ্রনাথকে সাম্মানিক ডি. লিট উপাধিতে ভূষিত করা হবে। কার্জন এই প্রস্তাবের বিরোধিতা করেন। তিনি দম্ভের সঙ্গে বলেন, রবীন্দ্রনাথের থেকে অনেক উপযুক্ত ব্যক্তি ভারতে আছেন যাঁদের ডি.লিট উপাধি পাওয়া উচিত। পরে লর্ড হ্যালিফ্যাক্স যখন অধ্যক্ষ হলেন তখন এই প্রস্তাবটি পুনরায় উত্থাপিত হয়। হ্যালিফ্যাক্স এই প্রস্তাবে পূর্ণ সম্মতি দেন। তারপর সেই প্রস্তাব পাঠানো হয় রবীন্দ্রনাথের কাছে। জানতে চাওয়া হয় এই উপাধি গ্রহণ করতে তিনি সম্মত আছেন কিনা। রবীন্দ্রনাথ সেই প্রস্তাবে সম্মতি জানান। কিন্তু সেই সঙ্গে একটি শর্ত রাখেন যে, পুরস্কার প্রদানের অনুষ্ঠানটি যেন শান্তিনিকেতনে হয়। অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্তৃপক্ষ সমস্ত প্রথাকে অগ্রাহ্য করে কবিগুরুর অনুরোধ মেনে নিয়েছিলেন। ভারতের তৎকালীন প্রধান বিচারপতি স্যার মরিস স্কোয়ার এবং ড. রাধাকৃষ্ণণকে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিনিধি হিসেবে পাঠানো হয়েছিল শান্তিনিকেতনে। ১৯৪০ খ্রিস্টাব্দের ৭ আগস্ট আনুষ্ঠানিকভাবে কবিগুরুর হাতে সাম্মানিক ডি.লিট উপাধি তুলে দেওয়া হয়। তাঁর হাতে উপাধিপত্র এবং ফলক তুলে দিয়ে রাধাকৃষ্ণণ বলেছিলেন- “আজ প্রাচ্য ও পাশ্চাত্য সভ্যতার মধ্যে বহু ইপ্সিত মেলবন্ধন ঘটে গেল। যাঁরা মনে করেন এই দুই সভ্যতা ভিন্ন পথের পথিক, তাঁদের ধারণা কতখানি ভুল তা প্রমাণিত হল। একজন ভারতীয় হিসেবে এই ঐতিহাসিক ঘটনার সাক্ষী থাকতে পেরে আমি নিজেকে গৌরবান্বিত বলে মনে করছি।”

১৯৪১ খ্রিস্টাব্দের ৭ আগস্ট রবীন্দ্রনাথের মৃত্যু হয়। এই ঘটনায় রাধাকৃষ্ণণ শোকাভিভূত হয়ে পড়েন। তিনি একটি শোক প্রস্তাব পাঠান। সেই শোক প্রস্তাবে তিনি রবীন্দ্রনাথকে বিশ্বের অন্যতম শ্রেষ্ঠ মণীষী বলে সম্মান জানান ।

কবিগুরুর মৃত্যুর পরেও রাধাকৃষ্ণণের মনে কবিগুরুর প্রতি শ্রদ্ধা ও সম্মান এতটুকুও কমে যায়নি। আর তার প্রকাশ দেখা যায় ১৯৬১ খ্রিস্টাব্দের ৯ মে রবীন্দ্রজন্মশতবার্ষিকী উপলক্ষে শান্তিনিকেতনে দেওয়া রাধাকৃষ্ণণের একটি বক্তৃতার মাধ্যমে। এই বক্তৃতার বিষয়বস্তু ছিল—'টেগোর’স ভিউ অন এডুকেশন'। রবীন্দ্রনাথ একটি নিজস্ব শিক্ষাদর্শন প্রবর্তন করেছিলেন। তিনি চেয়েছিলেন প্রাচীন ভারতীয় সভ্যতার আধুনিকীকরণ। শান্তিনিকেতনে তিনি প্রাকৃতিক পরিবেশে ব্যবহারিক শিক্ষাদানের পদ্ধতি চালু করেন। তিনি ভারতের তপোবন কেন্দ্রিক শিক্ষাব্যবস্থার পুনঃপ্রবর্তন চেয়েছিলেন। কঠিন কঠোর অনুশাসনের মাধ্যমে শিক্ষা অর্জন করতে হবে-এই ছিল তাঁর অভিমত। তবে এর পাশাপাশি স্বাস্থ্যমুলক বিনোদনের উপকরণ থাকা দরকার। এই শিক্ষা ভাবনার সার্থক রূপায়ণের জন্য তিনি বোলপুরে বিশ্বশিক্ষাকেন্দ্র স্থাপন করেছিলেন। সেই শিক্ষাকেন্দ্র আজ বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ে পরিণত হয়েছে। এর পাশাপাশি তিনি গ্রামীন সভ্যতার পুনরুজ্জীবনের জন্য আপ্রাণ চেষ্টা করে গেছেন। এই স্বপ্ন সফল করার জন্য বোলপুরের কাছে শ্রীনিকেতনে একটি শিল্প শিক্ষাশ্রম স্থাপন করেন ।

 

রাধাকৃষ্ণণ রবীন্দ্র-শিক্ষাদর্শন সম্বন্ধে অবহিত ছিলেন। শান্তিনিকেতনে 'রবীন্দ্রনাথের শিক্ষা ভাবনা' বিষয়ে ভাষণে তিনি কবিগুরুকে আধুনিক ভারতের এক শিক্ষাপুরুষ হিসেবে বর্ণনা করেছিলেন। কবিগুরুর প্রতিষ্ঠিত শিক্ষাব্যবস্থা যাতে জনসাধারণের কাছে আরও বেশি গ্রহণযোগ্য হয়ে উঠে, তাই উপস্থিত শ্রোতাদের কাছে আহ্বান জানিয়েছিলেন। পরবর্তীকালে রাধাকৃষ্ণণের ঐ ভাষণটি একটি গ্রন্থে সঙ্কলিত হয়েছে। প্যারিসে রবীন্দ্র শতবার্ষিকী সভার উদ্বোধনী বক্তৃতাতেও রাধাকৃষ্ণণ তাঁকে বিশ্বের অন্যতম শ্রেষ্ঠ মণীষী হিসেবে উল্লেখ করেছেন। হায়দ্রাবাদে রবীন্দ্রভারতী নামে জাতীয় থিয়েটারের উদ্বোধনী ভাষণেও রাধাকৃষ্ণণ রবীন্দ্র প্রতিভার মূল্যায়ন করেছেন নতুন দৃষ্টিভঙ্গীতে। তিনি রবীন্দ্র প্রতিভার বিভিন্ন দিক সম্পর্কে শ্রোতাদের অবহিত করেছিলেন।

 

এই সমস্ত ঘটনাবলী থেকে বোঝা যায়, রাধাকৃষ্ণণের কাছে রবীন্দ্র প্রতিভা কীভাবে প্রকাশ পেয়েছিল। রাধাকৃষ্ণণের একাধিক দার্শনিক চিন্তার মধ্যে রবীন্দ্রমননের প্রচ্ছন্ন এবং প্রত্যক্ষ প্রভাব ছিল। রাধাকৃষ্ণণ কখনও রবীন্দ্রনাথের প্রতিভাকে অঙ্গীকার করার চেষ্টা করেননি। তিনি কৃতজ্ঞ চিত্তে রবীন্দ্রমননের গুরুত্বকে স্বীকার করতেন। মুক্ত মনের মহামানব ছিলেন বলেই বোধ হয় রাধাকৃষ্ণণ এইভাবে রবীন্দ্র প্রতিভার প্রশংসা করেছেন অকুণ্ঠ চিত্তে ।

লেখক: অধ্যক্ষ, রয়্যাল অ্যাকাডেমি, মেদিনীপুর।

Mailing List