‘মহুয়ায় জমেছে আজ মউ গো’ মহুয়া বা মহুলের কত গুণ জানেন?

‘মহুয়ায় জমেছে আজ মউ গো’ মহুয়া বা মহুলের কত গুণ জানেন?
01 Jun 2023, 11:30 AM

মহুয়ায় জমেছে আজ ম গো মহুয়া বা মহুলেকত গুণ জানেন?

 

ড. সমরেন্দ্র নাথ খাঁড়া

     

মহুয়া একটা সুন্দর নাম। মহুয়া নামের অর্থ হচ্ছে মধুর স্বাদের ফল। মহুয়াকে স্থানভেদে মহুল, মহুলা, মোভা, মোহা, মহুভা, মধুকা ইত্যাদি নামে ডাকা হয়।

মহুয়া এর বৈজ্ঞানিক নাম: Madhuca longifolia বা Madhuka indica.

কাজী নজরুল ইসলামের লেখা ;পিলু-মিশ্র কাহারবা রাগের গান -

মহুয়া ফুলের মদির বাসে,

নেশাতে নয়ন ঝিমিয়ে আসে॥

                  লোক সঙ্গীত ঝুমুরের অতি প্রচলিত গান হলো

   “শাল-মহুল-পিয়াল বন

     নাচে উঠে হামদের মন”।

       

     সমস্ত সঙ্গীত প্রেমি মানুষের মনে মাদকতা ছড়ায় মহুয়ার মতো '''মহুয়ায় জমেছে আজ মৌ গো"""-- বিখ্যাত শিল্পী আশা ভোঁসলের গাওয়া গানটি আজও সকলের প্রিয় এবং  সমানভাবে জনপ্রিয়। মহুয়া নিয়ে অনেক গান আছে, তার একটি গান যেটায় মহুয়ার কথা উল্লেখ আছে।

কবিতা পড়ার প্রহর এসেছে রাতের নির্জনে

জোনাকির আলো নেভে আর জ্বলে শাল মহুয়ার বনে

'মহুলবনীর সেরেং’ (Mahulbanir sereng) নামের চলচ্চিত্র হয়েছে। আবার “মহুল” (mahul) নামের গানের দলও (ব্যান্ড) আছে। উচ্চ মাধ্যমিকের বাংলা সিলেবাসে রয়েছে সাঁওতাল পরগনার মহুয়া ঘেরা প্রান্তরে হয়ে হতাশ কবি সমর সেনের লেখা " মহুয়ার দেশ " ।

প্রাসঙ্গিক প্রশ্নঃ মহুয়ার দেশ কিসের প্রতীক?

উত্তরঃ মহুয়ার দেশ নাগরিক যান্ত্রিকতার বৈপরীত্যের সবুজ সভ্যতার প্রতীক। এটার উল্লেখও পাই।

এভাবে মহুলকে নিয়ে তালিকার শেষ নেই। মহুল মূলত জঙ্গলের মহুয়া গাছের ফুল। এই ফুলের নামেই গাছটি পরিচিত। জঙ্গল এলাকার এই গাছগুলি থেকে গ্রামবাসীরা মহুল কুড়িয়ে  জোগাড় করে। রোদে শুকিয়ে পরে তা বিক্রি করে মোটা অঙ্কের টাকা উপার্জন করে।

  মহুয়ার উৎপত্তি মধ্যভারতে। বাংলাদেশ ছাড়াও ভারতীয় উপমহাদেশের সর্বত্র দেখতে পাওয়া যায়।

  এটি মাঝারী থেকে বড়ো আকারের একটি গাছ। ৩০ থেকে ৪০ ফুট পর্যন্ত লম্বা হয়। ১০ বছর বয়স থেকেই ফুল দিতে শুরু করে। পাতা ডিম্বাকার। পাতা ১৫–৩০সে.মি. পর্যন্ত আকারের হয়। পরিণত অবস্থায় গাঢ় সবুজ হলেও কচি অবস্থায় ধূসর বর্ণের হয়। ডালের ডগায় পাতাগুলো ছত্রাকারে সাজানো থাকে। শীতে পাতা ঝরে ও বসন্তে হালকা ঘন সাদাটে আঙুরের মতো নরম ফুল ফোটে। ফুলের বোঁটা মাঝারী। ফুলগুলো রসাল, আঙুরের মতো দেখতে এবং স্বাদ টক মিষ্টি। ফুলের নির্যাসে মাদকতা আছে।

   এর ধূসর রঙের ছাল প্রায় আধা ইঞ্চি পুরু। বসন্তের শেষে সুপারির আকারের ফল হয়।মহুলের ফলকে বলা হয় “কচড়া”। জুন থেকে জুলাই মাসের মধ্যে পাকতে থাকে।

 

ঔষধি গুনাগুন (Medicinal value):

    ভেষজ গুণে মহুয়া অত্যন্ত সমৃদ্ধ। মহুয়ার পাতা, ছাল/বাকল, ফুলের নির্যাস ও তেলের বীজ নানা রোগের চিকিৎসায় বহুকাল থেকে ব্যবহার করা হয়। মরশুমের সর্দি কাশি, অগ্নিমান্দ্য, আন্ত্রিক রোগ, অর্শ, বাত-ব্যথা, মাথার ব্যথা ইত্যাদি রোগের নিরাময় হয়। সাঁওতালেরা মশার হাত থেকে রক্ষা পেতে, কীটপতঙ্গের দংশনের ক্ষেত্রে উপশম পেতে মহুয়া বীজের তেল ব্যবহার করে থাকে। তাছাড়া কৃমির চিকিৎসায় মহুয়া বীজের তেল ব্যবহার করা হয়।

 

     বিশেষজ্ঞদের মতে, প্রাচীনকালে অভাবের সময় মহুলকে সেদ্ধ করার পর ঢেঁকিতে কুটে গুড়ের মতো খাওয়া হতো। এখনও এই ফল ডাসা অবস্থায় রান্না করে খাওয়ার প্রচলন আছে। মহুয়া ফুল (Mahua flower) শুকিয়ে তা থেকে পিঠে তৈরি করে সুস্বাদু স্বাদের খাবার তৈরি করা যায়। মহুয়া ভেজে খাওয়া যায়। মহুয়া সিদ্ধ করে গুড়, তেতুল বীজ প্রভৃতি সহযোগে সুস্বাদু ও সহজপাচ্য খাবার তৈরি করা যায়। পাকা ফলের বীজের শাঁস থেকে তেল তৈরি হয়। ভেষজ তেল হিসেবে এখনো এই তেলের ব্যবহার প্রত্যন্ত গ্রামাঞ্চলে ব্যবহৃত হয়। শস্য তেল আবিষ্কারের আগে জঙ্গলবাসীর কাছে এই তেলই ব্যবহার যোগ্য ছিল।

  এ কথা মাথায় রেখেই কবি ভবতোষ শতপথীর ঝুমুর গানে বলা হয়েছে

   ”মহুল সিঝা জনার গুঁড়ি নাঁঞখ কিছু ঘরে”।    

 

      এ ব্যাপারে মানববিজ্ঞানী তথা নৃতত্ত্ববিদ ড.পশুপতি প্রসাদ মাহাত বলেন, মহুল গাছের গুনাগুন অনেক।বর্ষাকালে চাষের সময় গৃহপালিত পশু ও মানুষ ক্লান্তি দূর করত।

আদিবাসী সংস্কৃতির সঙ্গে মহুয়া গাছ ও ফুল অঙ্গাঙ্গিভাবে ও ওতোপ্রতোভাবে যুক্ত। সকাল থেকেই গাছের তলায় মহুয়ার ফল গরিব পরিবারের বাচ্চা থেকে বুড়ো প্রায় সকলেই কুড়াতে ব্যস্ত হয়ে পরে। সকলেই কিছু উপার্জনের জন্য এর উপর নির্ভর করে আছে।

  আদিজনজাতি কুড়মি সম্প্রদায়ের বিবাহ অনুষ্ঠানে এই গাছের ডাল পুজো আবশ্যিক। এই গাছের ডাল ছাড়া কুড়মি সমাজে বিয়ে হয় না। বরের সঙ্গে বিবাহ সম্পন্নের আগে পাত্রীকে এই গাছ বা ডালের সঙ্গে বিয়ে দেওয়া হয়।

জঙ্গল মহলের সর্বত্রই মহুল গাছ দেখা যায়।ঝাড়গ্রাম জেলার সাপধরা অঞ্চলের পাথরনালা গ্রামের পাশে মৌরসির মহুল বন কয়েক’শ বিঘা বিস্তৃত।পাথরনালা গ্রামের প্রায় ২০-৩০টি আদিবাসী পরিবার এই মরশুমে মহুল কুড়িয়ে মোটা অর্থ উপার্জন করে। গ্রামবাসীরা জানান এই সময় মহুলের দাম অল্প হলেও অসময়ে শুকিয়ে বিক্রি করে কেজি প্রতি ৭০-৯০ টাকা পাওয়া যায়। বাড়ি বাড়ি থেকে ভিন রাজ্যের ব্যবসায়ীরা মহুল কিনে নিয়ে যান। এই মহুল মূলত চোলাই মদ তৈরির উপকরণ হিসাবে ব্যবহৃত হয়।

    পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন গৃহ বা বাসনকোসন সাঁওতাল সংস্কৃতির অবিচ্ছিন্ন অঙ্গ।এই সময় উৎসবস্থলও পরিষ্কার করা হয়।চারিদিকে খড় দিয়ে পাকানো দড়িতে আম পাতা গেঁথে সুন্দরভাবে সাজানো হয়।একটি শাল বা মহুয়া গাছকে ঘিরে ঘর তৈরি করা হয়। গোবর দিয়ে নিকানো পূজাস্থল তৈরি হয়।সন্ধ্যায় গ্রামের মাঝি থানে নাচ, গান হয়। প্রতিটি পরিবারেই মেয়ে জামাইকে আমন্ত্রণ করে আনা হয়।

মূল উৎসবের দিনে পুরোহিতকে পূজাস্থলে নিয়ে আসার জন্য গ্রামের যুবক-যুবতীরা সকালেই স্নান সেরে পুরোহিতের বাড়িতে উপস্থিত হয়। পূজার সামগ্রী নতুন কুলার আতপ চাল,শাল ফুল, মহুয়া ফুল প্রভৃতি নিয়ে প্রস্তুত হলে গ্রামের যুবক-যুবতীগণ নৃত্য ও বাদ্য সহযোগে পুরোহিতকে পূজাস্থলে নিয়ে আসে।একইভাবে পুরোহিতকে বাড়ি পৌঁছে দিয়ে আসে।

 

মহুয়া গাছের বিভিন্ন অংশের ব্যবহার :

  ১)কচিপাতা (অঙ্কুর): গাছের কোমল হালকা সবুজ কচি পাতা/ অঙ্কুরগুলি শাক হিসাবে রান্না করা হয়।

  ২)পাতা: পাতাগুলি চওড়া হওয়ায় পাতাগুলি দিয়ে সেলাই করে বাটি তৈরি করা।

  ৩) ডাল/শাখা: আদিবাসী জনগণের দ্বারা সরু কচি ডালগুলি দাতন বা দাঁত পরিষ্কার করার জন্য ব্যবহৃত হয়।

এটি শুভ গাছ, আদিবাসী বিবাহের মন্ডপের কেন্দ্রীয় স্তম্ভটি গাছের ডাল দিয়ে তৈরি হয়।

  ৪) ফুল: গাছের সবচেয়ে লাভজনক অংশ, ফুলগুলি শুকনো হয় এবং মদ তৈরিতে ব্যবহৃত হয়। ফুলের নির্যাস আদিবাসী,বিশেষত সাঁওতালদের প্রিয় পানীয়।

 

  এবার এই মহুয়া মদকেই হেরিটেজ-এর তকমা দিল মধ্যপ্রদেশ সরকার।এখন থেকে মহুয়া আর নিষিদ্ধ নয়। ‘হেরিটেজ লিকার’-এর তকমা পেতে চলেছে মহুয়া।মহুয়া গাছ থেকে তৈরি মহুয়া মদ পাচ্ছে বিশেষ সম্মান। যা এক সময় নিষিদ্ধ ছিল, এখন তা হতে চলেছে হেরিটেজ লিকার। মধ্যপ্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী শিবরাজ সিং চৌহান (Shivraj Singh Chouhan) নিজেই জানালেন সে কথা। তিনি জানান,শীঘ্রই একটি নতুন আবগারি নীতি চালু হতে চলেছে।এ রাজ্যে ঐতিহ্যগত উপায়ে মহুয়া গাছের ফুল থেকে মদ (Liquor) তৈরি করা হয়।এই মদ এবার বিক্রিতে আইনত সম্মতি দেওয়া হল। 

   ৫) ফল: কাঁচা ফল বীজগুলি বাদ দিয়ে কচড়া নামে সবজি রান্না করা হয়।

    ৬) বীজ: ফলে প্রচুর বীজ থাকে যা থেকে তোরা তেল বের করা হয় এবং চুলের তেল হিসাবে, রান্নার জন্য ব্যবহৃত হয়।থেরাপিউটিক ম্যাসেজের জন্য প্রায় প্রতিটি আদিবাসী গ্রামে একটি তেল কল থাকে এবং তোরা তেল তাদের প্রতিদিনের একটা প্রধান অংশ।

মহুয়া খোল প্রথমে বিষ ও পরে সার হিসাবে ব্যবহৃত হয়। মহুয়া খোল পুকুরের মৎস্যভুক মাছ মারার জৈব বিষ হিসাবে প্রয়োগ করা হয়। যা পরে পচে পুকুরে নাইট্রোজেন ও ফসফেটের জোগান দেয়। পুকুরে সাধারণত বিঘা প্রতি তিনশো কেজি মহুয়া খোল পুকুরের মাছ মারার জন্য প্রস্তুতির সময় প্রয়োগ করা হয়।

     যখন ধান এবং শস্যের অভাব হয় তখন শুকনো ফুলগুলি গুড়ের সাথে মেশানো হয় এবং লাড্ডুর মতো করে মতো খাওয়া বা রান্না করা হয়।এটা ভিটামিন,খনিজ এবং আয়রনের একটি গুরুত্বপূর্ণ উৎস।

    বাংলা, ঝাড়খণ্ড, বিহার, মধ্যপ্রদেশ, উড়িষ্যা, ছত্তিশগড়ের জঙ্গলে পর্যাপ্ত পরিমাণে এই গাছের সঙ্গে বনবাসী মানুষদের কোথায় যেন একটা আন্তরিক যোগাযোগ আছে। এই গাছের পাতার আগুনে ওরা শীতের হাত থেকে রক্ষা পায়।ফুলের গন্ধে জঙ্গলমহল ম ম করে; রূপে,গানে আরণ্যক নির্জনতা মুখর হয়ে ওঠে।বন্যভূমি ছেড়ে  লোকালয়ে বুনো হাতিদের প্রবেশ ঘটে শুধুমাত্র মহুয়ার লোভের কারনে,মহুয়া খেয়ে হাতিও মত্ত হয় আনন্দে।  মহুয়া / মহুল আদিবাসীদের প্রাণের গাছ,আদরের গাছ।

 

তথ্যসূত্রঃ অন্তর্জাল ও পুরুলিয়ার আদিবাসী মানুষজনের সাথে কথোপকথন।

  ছবি : নিজস্ব ও মুক্তি, তপন, পঙ্কজের

লেখক: উপ উদ্যানপালন অধিকর্তা, পশ্চিমবঙ্গ সরকার

Mailing List