শত্রু পরিবেষ্টিত হয়ে একটি দেশ কিভাবে অহিংস পথ অনুসরণ করবে?
শত্রু পরিবেষ্টিত হয়ে একটি দেশ কিভাবে অহিংস পথ অনুসরণ করবে?
ড. রাজকুমার কোঠারি
জাতিসংঘ তার ৬১তম সাধারণ পরিষদে ২ অক্টোবর- গান্ধির জন্মদিবসকে আন্তর্জাতিক অহিংসা দিবস হিসেবে ঘোষণা করে। এটি প্রথমে দক্ষিণ আফ্রিকা এবং তারপর ভারতে গান্ধী দ্বারা পরিচালিত অহিংস পদ্ধতির সর্বজনীন স্বীকৃতি প্রতিফলিত করে। গান্ধি নামটি বর্তমানে অহিংসা এবং বিশ্বশান্তির সমার্থক হয়ে উঠেছে। গান্ধি 'সর্বদয়' এর পক্ষে দাঁড়িয়েছেন, সবার মঙ্গল চেয়েছেন। তিনি এমন একটি আদর্শ রাম রাজ্য কল্পনা করেছেন যেখানে মানুষের দ্বারা মানুষের শোষণ অনুপস্থিত থাকবে।
গান্ধি বৈশ্বিক সমস্যা নিয়ে খুব একটা উদ্বিগ্ন ছিলেন না। যদিও তিনি বিভিন্ন স্থানে এবং বিভিন্ন সময়ে এই বিষয়ে তাঁর মত প্রকাশ করেছেন। গান্ধির বিশ্ব শান্তির ধারনা এমন একটি সংস্কৃতি গড়ে তোলার কথা বলে, যেখানে মানুষ শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের নীতি অনুসরণ করতে সক্ষম হবে।
গান্ধি যুদ্ধকে সংখ্যালঘু মানুষের সৃষ্টি হিসেবে বিবেচনা করেন, যারা বাকিদের উপর তাদের ইচ্ছা আরোপ করে। অর্থাৎ সংখ্যাগরিষ্ঠ স্বভাবতই অহিংস ধারণায় বিশ্বাসী। অন্যথায় মানবতা শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে টিকে থাকতে পারত না। গান্ধি তাই সমস্ত বিবাদ নিষ্পত্তির জন্য নৈতিক পথকেই আদর্শ পথ হিসাবে বেছে নেন। ইতিহাসের দিকে তাকালে আমরা দেখি গৌতম বুদ্ধ অহিংসা ও সহানুভূতির বার্তা দিয়েছেন। অশোক যুদ্ধ ত্যাগ করতে বুদ্ধের শিক্ষা অনুসরণ করেছেন এবং কলিঙ্গপর্বের পর শান্তির পথ অনুসরণ করেছেন। প্রভু মহাবীর ও যীশু খ্রীষ্ট শান্তির জন্য ভালবাসা ও ক্ষমার বাণী প্রচার করেছেন। বিংশ শতাব্দীতে গান্ধি অহিংসার গুরুত্ব ও কার্যকারিতা বাখ্যা করেছেন।
কিন্তু প্রশ্ন হল, শত্রু দ্বারা পরিবেষ্টিত হয়ে একটি দেশ কিভাবে অহিংস পথ অনুসরণ করবে? গান্ধির মতে, শত্রুর ধারণার কোনও অস্তিত্ব নেই। বরং কিছু প্রতিপক্ষ থাকতে পারে যাদের পেশিশক্তি নয়, ভালবাসা দ্বারা জয় করতে হবে। গান্ধির অহিংসার ধারণা এইভাবে মানুষ এবং মানুষ, মানুষ এবং প্রকৃতি, মানুষ এবং সমাজ আর সমাজ এবং সমাজের মধ্যে একটি ইতিবাচক সম্পর্ক স্থাপনের কথা বলে।
গান্ধি যুক্তি দেখান যে, সামাজিক ন্যায়বিচার এবং সমতার উন্নয়নের জন্য মানুষের শোষণ বন্ধ করা প্রয়োজন। মানবিক মূল্যবোধকে এমনভাবে উন্নীত করতে হবে যে, ব্যক্তি তাকে সমগ্র বিশ্বের নাগরিক হিসেবে বিবেচনা করতে শুরু করবে। এই প্রসঙ্গে জয়জগৎ (বিশ্বের বিজয়) ছিল গান্ধীর মুল স্লোগান।
গান্ধি স্বাধীন রাষ্ট্রের একটি বিশ্ব ফেডারেশন তৈরি করার কথা বলেন। লীগ অফ নেশনস এবং ইউনাইটেড নেসান্সের প্রতি গান্ধির সামান্য আস্থা ছিল। কারণ, তাদের অহিংস চেতনার অভাব ছিল এবং তারা নিরস্ত্রীকরণ এবং বিশ্বশান্তি প্রতিষ্ঠা করতে ব্যর্থ হয়েছে। গান্ধি সর্বজনীন নিরস্ত্রীকরণের পক্ষে যুক্তি দেখান। তাঁর মতে, যদি একটি রাষ্ট্র নিরস্ত্রীকরণ অনুসরণ করতে শুরু করে তাহলে অন্যরা তা অনুসরণ করবে এবং এইভাবে বিশ্ব শান্তি প্রতিষ্ঠার পথ সুগম হবে।
গান্ধির মতে জিডিপি এবং জিএনপির মতো সূচক ব্যবহার করে উন্নয়ন পরিমাপ করা যায় না। ব্যক্তিত্বের মান সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির ব্যক্তিত্ব এবং চরিত্রের উন্নতি দ্বারা বিচার করা উচিত। গান্ধি এইভাবে উন্নয়নের একটি বিকল্প ধারণা প্রদান করেন যা আরও মানবিক এবং প্রকৃতির সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ। তিনি ক্ষুদ্র শিল্পের প্রসারের প্রয়োজনীয়তার উপর জোর দেন। যা স্থানীয়দের প্রয়োজনের যত্ন নেবে এবং পরিবেশ রক্ষা করবে।
গান্ধির মতে, আধুনিক সভ্যতা বিশ্বের সমস্যা সমাধানে ও দ্বন্দ্ব নিরসনে বার্থ হচ্ছে। আধুনিক সভ্যতা ভোক্তা এবং বস্তুবাদী ধারনার দ্বারা পরিচালিত। এটি প্রকৃতিকে দূষিত করে এবং মানব বিচ্ছিন্নতার দিকে নিয়ে যায়। আধুনিক সভ্যতা আসলে আধুনিক নয়। দক্ষিণ আফ্রিকায় গান্ধি আধুনিক সভ্যতার সবচেয়ে নিষ্ঠুর রূপের সাক্ষী হয়েছেন।
পরিশেষে আমরা গান্ধীর ধারণা বর্তমান বিশ্বে কতটা প্রাসঙ্গিক তা দেখার চেষ্টা করব। গান্ধী আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে একতরফা ভাবে সহিংসতা প্রত্যাখ্যানের উপর জোর দেন। কিন্তু এর ফলে বাস্তবে অনেক সমস্যা দেখা দিতে পারে। লাদাখে ভারত-চীন সীমান্তে এই নীতি বিপর্যয় নিয়ে আসতে পারে।
অধ্যাপক জয়ন্তানুজ বন্দ্যোপাধ্যায় বিশ্বশান্তি ও অহিংসার প্রতি গান্ধিবাদী দৃষ্টিভঙ্গির গুরুত্বপূর্ণ ঘাটতি তুলে ধরেছেন। গান্ধী বিশ্বশান্তি এবং অহিংসার প্রতি একটি অত্যন্ত সরল দৃষ্টিভঙ্গি উপস্থাপন করেছেন। বন্দ্যোপাধ্যায়ের মতে, শ্রীঅরবিন্দ গান্ধির চেয়ে বেশি বৈজ্ঞানিক ছিলেন। যখন তিনি বলেন যে, আন্তর্জাতিক সম্প্রীতির প্রথম পদক্ষেপ ছিল একটি বিশ্বসংস্থার হাতে সামরিক শক্তিকে মনোনিবেশ করা।
যদিও বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে সামাজিক ও রাজনৈতিক লক্ষ্য অর্জনের জন্য সহিংস পদ্ধতির ব্যবহার নিয়ে পুনর্বিবেচনা করা হয়েছে, তবুও এটি এখনও বিশ্বব্যাপী নীতি নির্ধারক এবং সুশীল সমাজকে প্রভাবিত করেনি। অহিংস এজেন্ডাকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য আন্তর্জাতিক সংস্থা, শিক্ষাবিদ, অ্যাক্টিভিস্ট, সুশীল সমাজ, অভিনেতা এবং নীতি নির্ধারকদের পক্ষ থেকে সমন্বিত প্রচেষ্টা প্রয়োজন।
পরিশেষে, গান্ধি সত্য এবং অহিংসার নীতির উপর ভিত্তি করে একটি অ-শ্রেণিগত, অ-বস্তুবাদী, অ-সাম্রাজ্যবাদী এবং অ-বর্ণবাদী বিশ্বব্যবস্থা তৈরি করতে চেয়েছিলেন। এই দৃষ্টিকোণ থেকে, গান্ধির সত্য এবং অহিংসা নীতির উপর ভিত্তি করে বিশ্বশান্তির ধারণার একটি বৃহত্তর এজেন্ডা ছিল, যা বর্তমান বিশ্বে বিশেষ প্রয়োজন।
লেখক: আধ্যাপক, রাষ্ট্রবিজ্ঞান, ডায়মন্ড হারবার বিশ্ববিদ্যালয়


