তাহার নামটি মমতা

তাহার নামটি মমতা
04 May 2021, 12:33 PM

তাহার নামটি মমতা

 

সুমন ঘোষ

 

ভালোবাসলে তিনি সব করতে রাজি। কিন্তু আঘাত করলে প্রত্যাঘাত করতে ছাড়েন না। আহত বাঘ যে বেশি ভয়ঙ্কর হয়, তা সকলের জানা।

 

বিভিন্ন সভা-সমাবেশে বারেবারেই কথাগুলি বলেছিলেন মুখ্যমন্ত্রী তথা তৃণমূল সুপ্রিমো মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। আর তার প্রমাণ মিলল ভোট গণনার পর। তিনি একা মমতা বনাম প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি, কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ, বিজেপির সর্বভারতীয় সভাপতি জে পি নাড্ডা, কেন্দ্রীয় মন্ত্রী স্মৃতি ইরানি, ধর্মেন্দ্র প্রধান, উত্তর প্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী যোগী আদিত্যনাথ.....আরও কত। শেষমেষ মিঠুন চক্রবর্তীও! এখানেই শেষ নয়, তৃণমূল থেকেও একের পর এক নেতা-মন্ত্রী-বিধায়কদের ভাঙিয়ে বিজেপিতে নেওয়া। এক কথায় বিপক্ষে বিরাট বড় এবং লম্বা টিম।

কিন্তু দেখা গেল কী? যতজন প্রচারে এসেছিলেন তত আসনও মেলেনি বিজেপির। একথা বললে হয়তো খুব একটা অত্যুক্তি হবে ‌না। আর উল্টোদিকে একা একজন মহিল‌া। তাও আবার ভোটের মুখে আঘাত লাগত পায়ে। প্লাস্টার করতে হল। আগের মতো ছুটে বেড়ানো তো দূরের কথা, হুইলচেয়ারে বন্দি। তাতেই রাজ্য কাঁপালেন। দূয়ারে সরকার নিয়ে কার্যত প্রতিটি বাড়ির দরজায় পৌঁছে গেলেন হুইল চেয়ার নিয়েই। তবেই না আরও অধিক আসন নিয়ে ক্ষমতায় প্রত্যাবর্তন। তৃতীয়বারের জন্য।

 

একটু পিছিয়ে যাওয়া যাক। কংগ্রেস ছেড়ে তৃণমূল তৈরি। তখন বাম শাসন মধ্যগগনে। মমতাকে বারবার আক্রান্ত হতে হয়। মাথা ফাটিয়ে দেওয়া হয়। কেশপুর, গড়বেতা, গোঘাট, খানাকুলের মতো রাজ্যের বহু জায়গায় কার্যত বিরোধীদের প্রবেশ নিষেধ। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় সভা-সমাবেশ করতে গেলে কর্মী-সমর্থকদের আটকানো হয়। যাতে দূরদূরান্ত থেকে আসা কর্মী-সমর্থকেরা খেতে না পান, সে জন্য বন্ধ করে দেওয়া হত দোকানপাট। এমনকী, যাতে জলও না মেলে তার জন্য কলের হ্যান্ডেল খুলে নেওয়ার মতোও অভিযোগ মিলেছে। সেই সময় কেশপুরে দাঁড়িয়ে তৎকালীন বিরোধী নেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বলেছিলেন, কেশপুর হবে তৃণমূলের শেষপুর।

২০১১ সালে তৃণমূল যখন রাজ্যের ক্ষমতায় আসে তখনও সিপিএম বিরোধী দলে ছিল। পরেরবার অর্থাৎ ২০১৬ সালে বিরোধী দলেরও মর্যাদা হারায়। বিরোধী দলের শিরোপা যায় কংগ্রেসের হাতে। বাম-কংগ্রেস জোট বাঁধে। আর এবার? মাত্র দশ বছরের তৃণমূল শাসনের পর? বামফ্রন্ট শূন্য! শূন্য কংগ্রেসও!

স্বাধীনতার পর প্রথম সিপিএম ও কংগ্রেসের এমন অবস্থা হল।

১৯৫২ সালে বিধানসভায় ২৩৮টি আসন ছিল। কংগ্রেস ২৩৬টি আসনে প্রার্থী দিয়ে ১৪৯টি আসনে জয়লাভ করে। তখনও সিপিএমের জন্ম হয়নি। সিপিআই ৮৬ আসনে প্রার্থী দিয়ে ২৮ আসন পেয়েছিল। ১৯৫৭ সালে আসন বেড়ে হয় ২৫২টি। কংগ্রেস পেয়েছিল ১৫২টি। আর সিপিআই পায় ৪৬ আসন। ১৯৬২ সালে কংগ্রেস ১৫৭ আসন পায় কংগ্রেস। সিপিআই পেয়েছিল ৫০টি। তারপর সিপিআই ভেঙে সিপিএমের জন্ম।

 

১৯৬৭ সালে বিধানসভার আসন বেড়ে হয় ২৮০টি। নির্বাচনে কংগ্রেস ১২৭টি আসন পায়।  সিপিআই পায় ১৬টি আর সিপিএম পায় ৪৩টি আসন।  ৬৭ সালের পর দু’বছরের মধ্যে নির্বাচন হয় ১৯৬৯ সালে। কংগ্রেসের আসন কমে হয় ৫৫টি, সিপিআই ৩০ এবং সিপিএম ৮০টি আসন পায়। আবার দু’বছর পর নির্বাচন হয় ১৯৭১ সালে। ১৯৭১ সালে কংগ্রেস আসন বাড়িয়ে ১০৫ টি আসন পায়। সিপিআই ১৩ ও সিপিএম সবার থেকে বেশি আসন পায়। সিপিএমের আসন ছিল ১১৩টি। ঠিক তার পরের বছরই অর্থাৎ ১৯৭২ সালে ফের নির্বাচন হয়। কারণ, এই কয়েক বছরে জোট জটিলতায় বারবার ভোট করতে হয়। কারণ, জোট গড়ে যেমন সরকার তৈরি হয়েছিল, তেমনই ভাঙতেও সময় নেয়নি।

১৯৭২ সালের নির্বাচনে ফের বিপুল সংখ্যা গরিষ্ঠতা নিয়ে ক্ষমতায় ফেরে কংগ্রেস। কংগ্রেসের আসন সংখ্যা ছিল ২১৬। সিপিআই ৩৫ ও সিপিএম ১৪টি আসন পায়। ফলে পাঁচ বছর টানা সরকার চালাতে সক্ষম হন সিদ্ধার্থ শঙ্কর রায়।

 

এরপরই কংগ্রেস জমানার অবসান। পূর্ণ ক্ষমতা নিয়ে বামপন্থীরা ক্ষমতায় আসে ১৯৭৭ সালে। তারপর থেকে একটানা ৩৪ বছর। যার অবসান হয় ২০১১ সালে। তারপর দশ বছর ক্ষমতায় তৃণমূল। এবারও তৃতীয়বারের জন্য তৃণমূল ক্ষমতায় ফিরেছে। কিন্তু হারিয়ে গিয়েছে দীর্ঘদিন রাজ্যের ক্ষমতায় থাকা দু’টি প্রধান দল। দু’টি দলের ভাগ্যে একটি আসনও জোটেনি। তার জায়গায় ৭৭টি আসন পেয়ে বিরোধী দলের মর্যাদা পেয়ে গেল বিজেপি।

 

এবার তৃণমূলের প্রধান শত্রু বিজেপি। পুরনো দিনের কথা কিন্তু ভুলে গেলে চলবে না। বিজেপিকে একথা মনে রাখতেই হবে। কারণ, তাহার নামটি মমতা।   

Mailing List