ধরণীর বুকে স্বর্গ নরক / গল্প     

ধরণীর বুকে স্বর্গ নরক / গল্প     
05 Nov 2023, 02:15 PM

ধরণীর বুকে স্বর্গ নরক / গল্প     

কামাল কাদের 

 

বুড়িগঙ্গার নদীর ওপারে গ্রামটি। বর্তমানে গ্রাম বললে ভুল বলা হবে। বুড়িগঙ্গার উপরে ব্রিজটি চালু হওয়ার পর সেই গ্রামটিকে এখন ছোট খাটো শহর বললে বাড়িয়ে বলা হবে না। নাম তার হাসনাবাদ। সেখানে অত্যাধুনিক এক হাসপাতাল রয়েছে। হাসপাতালটির নাম " রিভার ভিউ ক্লিনিক " ।

কবির তার মাকে সেই হাসপাতালে ভর্তি করতে নিয়ে এসেছে। মা জেবুন্নেসার দুটি কিডনিই অকেজো। "ডায়ালাইসিসের " উপর  নির্ভর করে জীবন চলছে।কিডনি ট্রান্সপ্লান্টের অপেক্ষায় দিন গুনছেন। কতদিন অপেক্ষা করতে হবে তা শুধু আল্লাহই জানেন।

মাকে যে ওয়ার্ডে রাখা হলো, সে ওয়ার্ডের  সংলগ্ন ওয়ার্ড থেকে এক রোগীর আর্ত চিৎকারে কবির রীতিমতো চমকিয়ে উঠলো। ক্ষনে ক্ষনে রোগী আকাশ পাতাল ভেদ করে হাউ মাও করে কেঁদে উঠছে  আর বলে চলছে  ," ডক্টর ,আমাকে মেরে ফেলো, আমি আর বাঁচতে চাইনা, এ ব্যথা কি যে ব্যথা আমি তোমাকে বোঝাতে পারবোনা, এ ব্যথা আমি আর সহ্য করতে পারছিনা, আমাকে ইঞ্জেকশন দিয়ে মেরে ফেলো "। 

" জীবন -মৃত্যু আল্লাহর হাতে ,আমরা আপনার ব্যথার উপশমের জন্য ' মরফিন ' ইনজেকশন দিয়ে চলছি , এর বেশী আমাদের কিছু করণীয় নেই "। ডাক্তার সহানুভূতির স্বরে বললেন। 

- তাহলে " মরফিন " ইঞ্জেকশনের মাত্রা বাড়িয়ে দাও।

- তা হয় না !

- কেন হবে না।

- মাত্রা বাড়িয়ে দিলে আপনি মারা যাবেন।

- আমি তো মরতে চাই !

- আমরা ডাক্তার হয়ে এ অপরাধ করতে পারিনা। আইনের চোখে এ কাজ অবৈধ। আমাদের কাজ হলো মানুষকে বাঁচানো, মারা নয়। আল্লাকে ডাকুন, আমাদের চিকিৎসা বিদ্যায় যা করা যায় তাই করে যাচ্ছি।   

রোগী হামিদ চৌধুরী লিভার ক্যান্সারে আক্রান্ত। রোগ সমস্ত শরীর ছড়িয়ে এখন ফুস ফুসে এসে বাসা বেঁধেছে। লিভার ট্রান্সপ্লান্ট করারও সুযোগ নেই। এমতঅবস্থায় রোগীর অসহ্য ব্যথাটিকে কন্ট্রোল করে তাকে যতদূর সম্ভব বাঁচিয়ে রাখা যায় তারই চিকিৎসা চলছে। 

কবির মাকে হাসপাতালে ভর্তি করিয়ে বাসায় ফিরলো। আজকের হাসপাতালের সেই করুন চিৎকার তার মনের গহীনে তোলপাড় শুরু করে দিলো ,কেমন যেন এক মিশ্র প্রক্রিয়া অনুভব করলো। মানুষের জীবনে কেন বিধাতা এতো কষ্ট দেয়? এতে তো  মনে হয় ,স্বর্গ-নরক তো এই পৃথিবীতেই রয়ে আছে। এর চেয়ে কষ্ট নরকে আর কি হতে পারে! মৃত্যুর পর কে স্বর্গে যাবে আর কে নরকে যাবে এ কথা আমরা কেউ জানিনা। আমরা সবাই কি সম্পূর্ণ ভাবে নিষ্পাপ! পাপ মুক্ত হয়ে দুদিন নিশ্চিন্ত মনে আরাম আয়েসে পৃথিবীতে থাকা যাবে এমন চিন্তা কি আমরা করতে পারি। তা হতে পারে না, কারণ দিন কাল যা পড়েছে প্রতি পদে পদে আমাদের পাপের সম্মুখীন হতে হচ্ছে, পাপের বোঝা বেড়ে যাচ্ছে। অনেকের ক্ষুধার জ্বালায় পেট পুড়ে ছাড় খার হয়ে যাচ্ছে ,বিনা চিকিৎসায় অসহ্য বেদনায় শরীরের সর্বাঙ্গ বিকলাঙ্গ হয়ে চলছে। তবুও আমরা সান্তনার সুরে বলে চলি ,"  যেখানে দুঃখ নেই ,সেখানে সুখ কখনো থাকেনা। জীবন  শুরু  হয় শুন্য থেকে ,শেষ হয় শুন্য দিয়ে  "। 

 পরদিন কবির বিকেলে তার মার সাথে হাসপাতালে দেখা করার জন্য গেলো। মার শয্যার পাশে একটা চেয়ার নিয়ে বসলো। আবারও পাশের ওয়ার্ড থেকে আর্তনাদ, তার সাথে সেই করুন সুর শুনতে পেলো, " ডাক্তার আমাকে মেরে ফেলো "।

কিছুটা কৌতূহলবশতঃ সে পাশের ঘরে ঢুকলো। দেখতে পেলো  ভদ্রলোকের মাথায় এক যুবতী হাত বুলিয়ে যাচ্ছে ,আর বলছে, " বাবা তুমি অস্থির হলে চলবেনা। এতে অসুখ আরো জটিলতায় মুখোমুখি হতে পারে , ডাক্তাররা যতদূর সম্ভব তাদের চেস্টার কোনো ত্রুটি করছেনা। শান্ত হও" ।

যুবতী কবিরকে এক নজরে দেখে জিজ্ঞাসা করলো, " আপনার পরিচয় ? "

- আমার নাম কবির ,পাশের ওয়ার্ডে আমার মা একজন ভীষণ অসুস্থ রোগী। আপনাদের ওয়ার্ড থেকে  করুন আর্তনাদের চিৎকার শুনতে পেয়ে তাই দেখতে এলাম। মনে করবেননা আমি কোন কমপ্লেইন নিয়ে এসেছি। শুধু  এসেছি মানুষটিকে এক নজরে দেখতে যিনি কিনা এমন অসহ্য ব্যথায় কষ্ট পাচ্ছেন।   

- আমার নাম মমতা। বিছানায় যে ব্যক্তিটি অসহ্য বেদনায় কাতরাচ্ছেন উনি আমার বাবা।

- কি আশ্চর্য মিল আমাদের দুজনার। আপনার বাবা আর আমার মা একই পথের পথিক। হাসপাতালের বাগানে যমদূত গাড়ি নিয়ে বসে আছে , তাদের জীবন নেয়ার জন্য। এদিকে হাসপাতালের ডাক্তাররা যমদূতকে ঘুষ দিয়ে তাদের জীবনটাকে এক্সটেনশন করে নিচ্ছে। ক 'দিন এক্সটেন্সানে থাকে, কে জানে !" 

-আমি তো আমার বাবার এরকম কষ্ট দেখে কিছুতেই স্বস্তি পাচ্ছিনা। 

-  আমরা মানুষেরা এর চেয়ে বেশীর কি বা করতে পারি ! এ সময়ে আমাদের মানসিক শক্তির উন্নীত করার চেষ্টা ছাড়া আর কিছুই করার থাকেনা। আমাদের মন অন্যদিকে ছড়িয়ে দিতে হবে। আমাদের এই চরম আবেগকে হাতের মুঠোয় বন্দী করে নিজেকে নানা কাজে ব্যস্ত রাখতে হবে। এর থেকে কোনো মুক্তি নেই।

-  আচ্ছা ,আপনি কি দর্শন শাস্ত্রে লেখা পড়া করেছেন ?

- আপনার প্রশ্নের উত্তর হলো "না ", যা কিছু  জেনেছি, শিখেছি সবই এ জীবনের বিশ্ববিদ্যালয়ের ঘাত প্রতিঘাত থেকে।

- আপনি তো আজব লোক। যদি কিছু না মনে করেন ,জানতে পারি কি আপনি কি করেন ?

- একটা N G O তে কাজ করি। অক্ষম এবং দুর্বল বাচ্চাদের সাথে সময় কাটিয়ে দিই। নিম্নবিত্তের

ঘরে জন্মেছিলাম, লেখাপড়া শিখে মধ্যেবিত্ত হয়েছি,সমাজ তো তাই বলে । ভাবলাম টাকা পয়সা দিয়ে ওই সমস্ত প্রতিবন্ধক ছেলে মেয়েদেরকে নিয়মিত সাহায্য করা আমার জন্য কঠিন হয়ে যাবে, শ্রম দিয়ে যদি ওদের মুখে কিছুটা হাসি  ফুটিয়ে তুলতে পারি তাহলেই আমার জীবন সার্থক।

-ভেরি ইন্টারেষ্টিং !! আপনাদের কাজটা একটু সবিস্তারে বলবেন?

- তাহলে শুনুন। আমাদের মাঝে রয়েছে, অটিজম রোগী (তারা মনে করে পৃথিবীটা হচ্ছে একটা জনাকীর্ণ স্থান যেখানকার লোকজন, ঘটনাবলী --- এ গুলো তারা বুঝে উঠতে পারে না, এর ফলে তারা এক ধরণের উৎকণ্ঠায় ভুগে), সেরিব্রাল পালসী (জন্মের আগে, ভূমিষ্ট হওয়ার কালে বা ভূমিষ্ট হওয়ার পরই কোনো কারনে মস্তিস্ক ক্ষতিগ্রস্ত হলে বা অস্বাভাবিক ধরণে এর বিকাশ ঘটলে এই অবস্থায় পরিণীত হতে পারে), ডাউন সিনড্রোম (এটি যাদের আছে, একই বয়সী অন্য শিশুর মত শিক্ষালাভের সক্ষমতা তাদের থাকেনা। অর্থাৎ তাদের প্রত্যেকেরই কিছু না কিছু মাত্রা শিক্ষার দুর্বলতা থাকে), বুদ্ধিবৃত্তি অথবা বিচারশক্তির দুর্বলতায় ভুগা (এতে যারা ভুগেন, শেখার ব্যাপারে তাদের তুলনামূলক ভাবে অনেক বেশী সময় লাগে। আসলে এটি কোনো মানসিক রোগ না। উপযুক্ত শিক্ষা পেলে তাদের বেশীর ভাগই স্বাধীন জীবন যাপন করতে সক্ষম হতে পারে। )

মোটামুটি এই সমস্ত বাচ্চাদের নিয়েই আমাদের কাজ। 

- সত্যিই, আপনারা সমাজের এক মহৎ কাজ নিয়ে ব্যস্ত রয়েছেন।

-  এই কাজগুলি সম্পূর্ণভাবে আমাদের পৃষ্ঠপোষকদের উদারতায় চলে। যদি কেউ আমাদের এই কর্মধারার সাথে একমত থাকেন, তাহলে তাদের দেয়া চাঁদা আমরা দান হিসাবে গ্রহণ করে থাকি।

 অবশ্য কেউ সাহায্য করার আগে প্রথমে আমাদের কাজ কর্মগুলি পর্যবেক্ষণ করেন তারপর সন্তুষ্ট হলে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেন। এ ভাবেই আমাদের সংস্থাটি চলছে।

- আমি মানে আমরা যদি আপনাদের সংস্থাকে টাকা পয়সা দিয়ে কোনো উপকারে আসতে পারি তাহলে সেটা গ্রহণ করবেন কি?

- তা আর বলতে। নিশ্চয় গ্রহণ করা হবে।

- জানিনা কোন পাপে আমার বাবাকে এই  অমানুষিক  কষ্ট করে যেতে হচ্ছে। আমাদের প্রচুর  স্বয় সম্পত্তি  রয়েছে। আমি একমাত্র ওই সম্পত্তির উত্তরাধিকারী। সেগুলি দান করে যেতে চাই।

কি হবে ওই সমস্ত সম্পত্তি রেখে, যেখানে আমাদের জীবনের কোনো সুখ নেই। দান করে যদি ওই অভাগা বাচ্চাদের জীবনকে উন্নত করা যায়, তাহলে হয়তোবা কিছু সময়ের জন্য নিজেদের মনকে সান্তনা দেয়া যাবে ," অভাগা মানুষদেরকে ভালোবাসতে শিখেছি। ভালোবাসা দিয়েই তো ভালোবাসা পাওয়া যায়, হয়তোবা এভাবেই নরকের যন্ত্রনা থেকে মুক্ত হলেও হওয়া যেতে পারে।

- হয়তোবা! কোথায় স্বর্গ, কোথায় নরক?, আমার তো মনে হয় এ পৃথিবীটাই  হলো পাপ পুণ্যের জায়গা। যে যার ভালো মন্দ কাজের পুরস্কার অথবা  শাস্তি এখানেই ভোগ করবে। এখন এটা নির্ভর করছে যার যার নিজের ব্যক্তিগত বিশ্বাসের উপর।

- " আপনি আমাকে এক নুতন জগতের পথ দেখালেন", মমতার আবেগ মিশ্ৰিত কথা। 

 - " আপনাকে অশেষ ধন্যবাদ", কবিরের কৃতজ্ঞতা প্রকাশ।

মার্কিন ঔপন্যাসিক মার্ক টোয়েনকে এক বন্ধু জিজ্ঞাসা করেছিলেন ," স্বর্গ এবং নরক সম্পর্কে আপনার কি অভিমত? " উত্তরে তিনি বলেছিলেন ," দুদিকেই আমার বন্ধুরা আছেন। তাই এ বিষয়ে আমার মত প্রকাশ করা উচিত হবে না "।

Mailing List