গোরুবাথান ভ্রমণ

গোরুবাথান ভ্রমণ
বৈশাখী নার্গিস
কোলকাতা থেকে ট্রেন ধরার জন্যে সেদিন ছুটতে হয়েছিল। এক তো অফিস তার উপর পুজোর ছুটি পড়েছে। সবার বাড়ি ফেরার তাড়া। সে আমারও ছিল। তাই অফিস থেকে কোনওক্রমে ফিরে ব্যাগ গুছিয়ে স্টেশনে দৌড় লাগালাম। এদিকে বাড়ি থেকে ক্রমাগত ফোনের পর ফোন। কখন ফিরছি। আসলে আমার বাড়ি উত্তরবঙ্গে হলে কি হবে কর্মসূত্রে থাকি কলকাতায়। তাই বাড়ির ডাক উপেক্ষা করি কী করে। অগত্যা ট্রেন ধরলাম কাঞ্চনকন্যা। এমনিতে উত্তরবঙ্গে যাওয়ার অসংখ্য ট্রেন আছে রাতের দিকে। ১২ ঘন্টার ট্রেন জার্নিতে বেশ মজাই হয়। যদি সেই ব্যক্তি ট্রাভেল করতে ভালো বাসে তবেই। বাস, ট্রাম, ভিড়, আলো ঝলমল শহর থেকে খানিক দূরে শান্তিতে থাকার জন্যে। শিয়ালদহ থেকে ট্রেন ছাড়ল ৮ টা বেজে ৩০-এ। জেনারেল কম্পার্টমেন্টে কোনও মতে একটা বসার জায়গা পেয়েই তো মহা খুশী। এরকম সম্ভবত হয় না। এমনিতে বাড়ি ফিরতে হলে সবসময় রিসার্ভেশন করেই আসি। এবার তাড়াহুড়োয় করা হয়ে ওঠেনি। তবে আপনি কিন্তু রিজার্ভেশন করে নেবেন যখন আসতে চান। সেক্ষেত্রে শিয়ালদহ থেকে মাল জংশন কেটে নেবেন যাত্রার আগে। চাইলে ভেঙ্গে ভেঙ্গেও আসতে পারেন। যেমন এনজেপিতে নেমে বাসে কিম্বা লোকাল ট্রেনে। তার চেয়ে একেবারে রিজার্ভেশন করে আসাই ভালো। তা সে যাক গে, জায়গা পেয়েই খানিক ঘুম দিলাম। ঘুম ভাঙ্গল বর্ধমানে। ততক্ষণে বেশ খিদের সঙ্গে চায়ের তেষ্টাও পেয়েছে। প্ল্যাটফর্ম সরগরম যাত্রীদের ওঠা নামা আর ‘এই চায়ে গরমে’র আওয়াজে। নামার প্রশ্নই আসে না। জানালা দিয়েই হাঁক পাড়লাম... এক কাপ চা দিন তো। বুদ্ধি করে ব্যগে বিস্কিট রেখে দিয়েছিলাম। ভারী খাওয়ার নিয়ে আসতে পারিনি কিছুই। তাই চা বিস্কিটই ভরসা। সে সব শেষ করে আর এক প্রস্থ ঘুম দিতেই ভোর হয়ে এলো। এরপর তো আর ঘুম হয় না। তাই জানলা দিয়ে বাইরের প্রকৃতির দৃশ্য দেখতে দেখতে মাটির টান অনুভব করা আর কি। এই এত সবুজ বুকের মধ্যে ভরে নেওয়ার পরই তো কাজে মন বসে। ফিরে পাওয়া যায় মানসিক শক্তি।
ট্রেন আস্তে আস্তে চলছে, তাই দরজার পাশে গিয়ে দাড়ালাম। প্রতিবার ফেরার সময় এটা করি আমি। বেশ মজা লাগে। তবে এত সাহসের কথা বাড়িতে জানলে আর রক্ষে নেই। এটা লুকিয়ে রাখাটাই বাঞ্ছনীয়। যাই হোক এরপরের স্টেশনই এনজেপি। ট্রেন বেশ ভালোই এসেছে। এখান থেকে একটা রাস্তা আমার বাড়ির দিকে গিয়েছে। আর একটা মাল জংশনের দিকে। যেহেতু এবারে আমার গন্তব্য অন্য কোথাও, অন্য কোনও খানে। তাই ট্রেন যেদিকে যাচ্ছে সেদিকেই নিজেকে চলতে দিলাম। এতক্ষণ তো ট্রেন সমতল দিয়ে আসছিল। এবার শুরু হল পাহাড়ি পথ। মাঝে মাঝে পাহাড়ী ঢালের গা ঘেঁষে ট্রেনের এই ছুটে চলা কি যে আনন্দদায়ক, বলে বোঝাতে পারব না। ক্যামেরা যেন কিছুতেই থামতে চাইছিল না। যতটা মুহুর্ত বন্দী করে রাখা যায় আর কি। এক একটা মুহুর্তই তো জিয়ন কাঠি হয়ে রয়ে যায়। একদিকে পাহাড় আর এক দিকে বিস্তৃত জমি। যেখানে ধান চাষ হয়েছে। কোথাও বা নদী বালুচর। মাল জংশন আসার আগে সেভক রোডে খানিকক্ষন দাঁড়ালো ট্রেনটা। হ্যাঁ এটাও একটা ভ্রমণের স্থান। কিন্তু এখন এখানে যাব না। আজ হোটেলে উঠে। কাল থেকে ঘুরতে শুরু করব। গোরুবাথান, ঝান্ডি, গোরুমারা, মূর্তি। একদিনে শেষ করা যাবে না ঘুরে। তবে সঙ্গে যদি বাইক থাকত তাহলে এইসব জায়গা সকাল থেকে ঘোরা যেত একদিনে। সে দেখা যাক। দলবল নিয়ে বন্ধুরাও আসবে আজকে বিকেলে। ওরা সবাই ছোটবেলার বন্ধু।
দেখতে দেখতে বেলা প্রায় এগারটা। মাল জংশন আসতে এখনও মিনিট দশেক লাগবে। তার আগেই বিস্তীর্ণ জঙ্গলের ভেতর দিয়ে ট্রেন তার গতিপথ বদলে নিল। এবার চারদিকে সবুজ গাছের সারি। আর ছোট ছোট নদী, ঝরনা। জঙ্গলের ভেতর দু তিনটে ময়ুরও দেখতে পেলাম। মাঝে মাঝে অজানা পাখির ডাক। ওয়েদার বেশ মনোরম। ঠান্ডা বাতাস মাঝে মাঝে মুখে ঝাপটা মেরে যাচ্ছে। এলোমেলো করে দিচ্ছে চুল। শহুরে আবহাওয়া ছেড়ে এই বন্য পরিবেশে খাপ খাওয়াতে খানিক সময় লাগলেও, এখন উপভোগ করছি ব্যপারটাকে। প্রায় ১২ ঘন্টার জার্নির পর অবশেষে গন্তব্যের কাছাকাছি পৌঁছতে পারলাম। হোটেলে আগেই বলে দেওয়া ছিল। হোটেল তো নয় কটেজ আর কি। এখানে কটেজগুলো বেশ ছিমছাম দেখতে। আগে থেকেই তাই বুক করে নেওয়া ভালো। পিক আওয়ার বলতে যা বোঝায়। সেপ্টেম্বর থেকে মার্চ অবধি দেশ-বিদেশ থেকে পর্যটক আসতে থাকে এখানে। বন্ধুদের যেহেতু বলা ছিল তাই কোনও অসুবিধে হয়নি।কটেজটার নাম রিসর্ট ত্রিমূর্তি। সেখান থেকে গাড়ি পাঠিয়ে দিয়েছিলেন সেখানকার ম্যানেজার। মাল জংশনে নেমে খানিকক্ষন অপেক্ষা করতে হল।
কলেজের গণ্ডি পার হওয়ার অনেক পরে ঘুরতে গেছি। কারণ বাড়ি থেকে সেভাবে অনুমতি মিলত না। তারপর অবশ্য পেশাগত ভাবে ভ্রমণ হয়েছে অনেক বার।প্রেম, পুজা, আর প্রকৃতি। এই হল তিন প্রিয় জিনিস। ঘুরতে গিয়ে সেই সেই প্রেম আর প্রকৃতি দুই যে আত্মার সঙ্গে মিলে রয়েছে। বার বার অনুভূতি হয়েছে। বিশেষ বিশেষ মুহূর্তে স্পার্কও করেছে।
আমার কাছে নানা ভাবে ধরা দিয়েছে রবীন্দ্রনাথের বিভিন্ন গান।‘আমার এই পথ চাওয়াতেই আনন্দ’।বা ‘আমি পথ ভোলা এক পথিক এসেছি’। গন্তব্যের তুলনায় যাত্রাপথের আনন্দ আমার কাছে অনেক বেশি। জটিলেশ্বর মুখোপাধ্যায়ের ভাষায়,গন্তব্যের থেকে জরুরি হলো পথ চলা। বিশেষ করে ট্রেন জার্নি আমার খুব প্রিয়। ট্রেনের গতি যত বাড়ে।তার সঙ্গে পালটায় বাইরের ছবি। এ যেন চলমান চিত্রমালা।
আপাতত গন্তব্যে পৌঁছে গিয়েছি। গাড়িতে করে প্রায় আধ ঘন্টা চলার পর এসে হাজির হলাম কটেজে। উফ সে প্রকৃতির কি যে রূপ। ধোঁয়া ওঠা সকালের শীতল স্পর্শ জড়িয়ে ধরল আমায়। আজ রেস্ট। ১২ ঘন্টা জার্নির পর ঘুম না হলে ঝরঝরে দিনগুলো উপভোগ করতে পারব না। ব্রেকফাস্টের পর ঘুমিয়ে নেওয়ার পর দেখি বন্ধুরা এসে হাজির। সন্ধের মুহুর্তে তখন ঘরে ফিরছে পাখিরা। বাইরে বেড়িয়ে দেখি সূর্য অস্ত গিয়ে আধ খাওয়া চাঁদ এসে হাজির হয়েছে আকাশে। আমরা যেখানে উঠেছিলাম তার পাশেই নদী। নদীর ওপারে বনভূমি। জলদাপাড়ার শুরু এখান থেকেই। রাতে কটেজে রান্না করা চিকেন আর হাত রুটি খেয়ে সকাল সকাল ঘুমিয়ে পড়া শ্রেয় মনে করে সবাই ঘুমিয়ে পড়লাম। ও হ্যাঁ আমাদের দলে মোট ৮ জন মেম্বার।
ভোর চারটেয় দরজায় খটখট আওয়াজে ধরমড়িয়ে উঠে দেখি আলী দাঁড়িয়ে আছে ঘুম ঘুম চোখে। বলল দশ মিনিটের মধ্যে রেডী হতে। এখন বের না হলে ঘোরা সম্ভব নয় সব জায়গা। অগত্যা রেডী হয়ে বের হয়ে লনে দাড়াতেই লছমন গাড়ি নিয়ে হাজির। সে ফাই ফরমাশ খাটে কটেজে আর গাড়িও চালায় মাঝে মাঝে। গাড়িতে খাবার দাবার নিয়ে আমরা উঠে পড়লাম। আমার তো জানলার ধারের সিট না হলে চলে না। তাই সাইডে বসে গেলাম। শুরু হল আমাদের যাত্রা।
জঙ্গলের রাস্তা পেরিয়ে আমরা চালসা হয়ে মাওল বাজারের পথ ধরলাম। আমাদের আজকের লিস্টে আছে গোরুবাথান, ঝান্ডি, নেওড়া ভ্যালি, চেল নদী। যেহেতু আমাদের ট্রিপ খুব ছোট এই যাত্রায়। তাই ডিসাইড করলাম প্রথমে গোরুবাথান যাব। পথে যেতে যেতে দুদিকে চায়ের বাগান দেখতে দেখতে গাড়ি পাহাড়ি রাস্তায় চলে এলো। পথের ধারে বেশ কিছু পুরোনো অ্যাংলো ইন্ডিয়ান গোছের বাড়ি। যেহেতু ইংরেজদের আমলে এখানেই চা বাগানের শুরুয়াত হয়েছিল। সাহেবদের থাকবার জন্যে সেইসব বাংলো আজো রয়ে গেছে। তাই জায়গা গুলো বেশ ছিমছাম গোছানো। এখানকার বেশিরভাগ বাসিন্দাই লেপচা, নেপালী। ফাগু চা বাগানের আকা বাঁকা রাস্তা পেরিয়ে আমাদের গাড়ি এবার জঙ্গলের ভেতর দিয়ে চলতে শুরু করল। পিচ ঢালা রাস্তা, দু ধারে লম্বা লম্বা নাম না জানা গাছের সারি। আকাশও বেশ মনোরম, যেন নীল রঙ গুলে দিয়েছে কেউ। গাড়ি যতই এগোতে লাগল ঠান্ডা বাতাসের হলকা বাড়তে লাগল। আর শিরশিরানি হাওয়ায় শীত করতে শুরু করল এবার। আমরা কেউই গরম পোশাক পড়িনি। যে যা পারল কানে গলায় চাপাতে লাগল। হঠাৎ এক জায়গায় দেখলাম কয়েকটা বাঁদর মারপিট করতে করতে একেবারে রাস্তায়। ড্রাইভার কোনওক্রমে গাড়ি ঘুরিয়ে বাঁচিয়ে দিল বলতে গেলে। এবার পাহাড় আস্তে আস্তে উঁকি দিচ্ছে গাছপালার ফাঁকে ফাঁকে। আর সে দেখেই চিত্ত চঞ্চল হয়ে উঠল। লাভা রোড ধরে এগিয়ে যাচ্ছি আমরা। সামনেই শেরপা গাও। পাহাড়ী এলাকার বাসিন্দারা বেশ নম্র খেয়াল খুশী মতো চলে। আমাদের গাড়ি বস্তি এলাকা দিয়ে যাওয়ার সময়, সবাই কেমন তাকিয়ে ছিল। মনে হচ্ছিল যেন আমরা অন্য গ্রহের বাসিন্দা। সে যাই হোক উচু পাহাড়ী রাস্তার উপর দিয়ে যেতে যেতে কেমন যেন হচ্ছিল। ভার্টিগোর সমস্যা হলে এদিকে আসা উচিতই নয়। এবার শুরু হল খাড়াই পথ। গাড়ি তীর বেগে ছুটছে। আর হাওয়ার তালে আমরা। ওহ সে এক অনন্য অনুভূতি। হঠাৎ গাড়ি পিচ রাস্তা ছেড়ে ঢালুতে নামতে শুরু করল। এক মুহুর্ত গাড়ি যদি পিছলে যায়। খাদে পড়া ছাড়া উপায় নেই। আমরা একেবারে নিঃশ্বাস চেপে ধরে বসে। তারপর সমতলে নেমে এসে একটা কাঠের ব্রিজের ওপর দিয়ে পাহাড়ের কোলে থামল। শহর গ্রাম থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে... এক অদ্ভুত জায়গায় এসে পৌছলাম যেন। গোরুবাথান ব্রিজ ভিউ পয়েন্ট এটা। তিরতিরে পাহাড়ী নদী নেমে এসে প্রবল বেগে ছুটে চলেছে সমতল পেরিয়ে সমুদ্রের দিকে। সে আর এক রূপকথা। নদীর নাম ফাগু। পিকনিকের সময় এখানে বেশ ভিড় থাকে। পাহাড়ে ঘেরা জায়গাটার প্রেমে পড়ে গেলাম আমরা। বন্ধুরা না থাকতে পেরে নেমেই পড়ল জলে। আর আমি পা ভিজিয়ে নিলাম শুধু। জল বরফের মতো ঠান্ডা। অনেকক্ষন জলকেলির পর এখান থেকে আমরা চললাম ফাগু মনেস্ট্রির দিকে। তার আগে টিফিন করে নিলাম সবাই। পাহাড়ের হাওয়া যেন খিদে বাড়ানোর ওষুধ। পাহাড়ের সঙ্গে পায়ে পা মিলিয়ে আমরা আরও চড়াই উঠতে লাগলাম। এবার হালকা মেঘের আনাগোনা চলছে আকাশ জুড়ে। সঙ্গে ঠান্ডা হাওয়া। মনেস্ট্রিতে পৌঁছে মেঘের দল উধাও। ঝকঝকে রোদ্দুর চারদিকে। মনেস্ট্রির গা যেন ঝলমল করছে। বিকেলে হতে চলল প্রায়। কিছুক্ষণের মধ্যে কুয়াশার চাদরে ঢেকে যাবে পাহাড়ী জনপথ... শিহরণে মিশে যাবে বন্য হাওয়ার গতি। বিকেলটা যেন হুঁশ করে পেরিয়ে গেলো। আজকের মতো এই পর্যন্তই। আমরা পাহাড় থেকে নেমে এলাম আবার। জঙ্গল, নদী পেড়িয়ে বাঁকা চাঁদ যখন চকিত হরিনীর মতো আমাদের পিছু নিয়েছে তখন চারদিক নিঝুম।


