গান্ধীজি-রবীন্দ্রনাথ মতানৈক্য, পরমতসহিষ্ণুতার এক শিক্ষণীয় ও বিরল দৃষ্টান্ত

গান্ধীজি-রবীন্দ্রনাথ মতানৈক্য, পরমতসহিষ্ণুতার এক শিক্ষণীয় ও বিরল দৃষ্টান্ত
01 Oct 2023, 11:15 AM

গান্ধীজি-রবীন্দ্রনাথ মতানৈক্য, পরমতসহিষ্ণুতার এক শিক্ষণীয় ও বিরল দৃষ্টান্ত

 

সত্যব্ৰত দোলই

 

‘মহাত্মা' গান্ধী ও ‘গুরুদেব' রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর- পৃথিবীর ইতিহাসে ক্রান্তদর্শী দুই মহান ব্যক্তিত্ব। দুজনেরই জন্ম উনিশ শতকের ছয়ের দশকে। দুজনের পারস্পরিক সম্পর্ক মানব সভ্যতার ইতিহাসে এক বিরল, শিক্ষণীয় এবং অবশ্যই উপভোগ্য নিদর্শন। গান্ধীজির জীবনীকার লুই ফিশার বলেছিলেন, দু'জনের প্রকৃতির মধ্যে বৈপরীত্য রয়েছে। তাঁর মতে, 'গান্ধী হলেন গম ক্ষেত আর ঠাকুর হলেন ফুলের বাগান। উভয়েই দেশের মঙ্গলের জন্য নিবেদিত ছিলেন। রবীন্দ্রনাথ কল্পচিন্তক আর গান্ধীজি অনুচিন্তক। দুজনেই ছিলেন সত্য, শিব ও সুন্দরের পুজারী। রবীন্দ্রনাথ বিশ্বজনীনতা ও মানবতার জন্য উৎসারিত সংগীতের জন্য পরিচিত ছিলেন। যে সংগীত স্বদেশী আন্দোলনকে উদ্বুদ্ধ করেছিল। গান্ধীজিও সেইসব সংগীত শুনে অনুপ্রাণিত হয়েছিলেন।

ভারতের স্বাধীনতা ও সমাজ সংস্কারের বিষয়ে রবীন্দ্রনাথ ও গান্ধীজি একই বিন্দুতে অবস্থান করতেন। দুজনেরই ধ্যান-ধারণা ছিল স্বদেশের মুক্তি ও অগ্রগতি। জন্মগত ভাবে দুজনেই ছিলেন মুক্ত চিন্তা-চেতনার প্রবক্তা এবং স্পষ্টভাষী। নিজস্ব মত ও পথে অবিচল। ব্যক্তিগত ঘনিষ্ঠতা থাকলেও ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনের অবসানের লক্ষ্যে গান্ধীজির রাজনৈতিক ও সামাজিক দর্শনের সাথে রবীন্দ্রনাথের স্পষ্ট মতবিরোধ ছিল। তর্ক-বিতর্কে এই দুই মহান ব্যক্তিত্ব মুক্তি, পাল্টা যুক্তি দিয়ে নিজেদের মতামত প্রকাশ করেছেন। তবে সেইসব বিতর্কগুলি ছিল সহনশীল, শ্রদ্ধাপূর্ণ ও সৌজন্যমূলক। মতানৈক্য নিয়ে স্বচ্ছ ধারণা রাখতেন বলেই তাঁরা ছিলেন পরমতসহিষ্ণু। এমন উদাহরণ উপমহাদেশের ইতিহাসে বিরল। মহান দার্শনিক ও ঔপন্যাসিক রোমা রল্যা গান্ধীজি ও রবীন্দ্রনাথের মত-পার্থক্যকে "নোবল ডিবেট' বলে উল্লেখ করে ১৯২৩ সালে রবীন্দ্রনাথকে একটি চিঠিতে লিখেছিলেন, “ইট এমব্রেসেস দ্য হোল আর্থ, অ্যাণ্ড দ্য হোল হিউম্যানিটি জয়েনস ইন দিস অগাস্ট ডিসপিউট।"

১৯১৯-এর ১৩ এপ্রিল পঞ্জাবের অমৃতসরে জালিয়ানওয়ালাবাগে এক জমায়েতে নিরস্ত্র ভারতীয়দের উপর ব্রিটিশ পুলিশের ব্রিগেডিয়ার জেনারেল রেজিনাল্ড ডায়ারের নির্দেশে গুলিবর্ষণ করা হয়। গুলিবর্ষণে অসংখ্য মানুষ নিহত এবং আহত হয়। আকস্মিক এই ঘটনার ভয়াবহতায় গান্ধীজি ব্রিটিশ সরকারকে যে কোন রকম সহযোগিতা করাকেই 'মহাপাপ' বলে ঘোষণা করেন এবং দেশব্যাপী অহিংস অসহযোগ আন্দোলনের ডাক দেন। এই আন্দোলনের মধ্য দিয়ে 'স্বরাজ' প্রতিষ্ঠা করার প্রধান অস্ত্র ছিল বিদেশী পণ্য বিশেষত বিলাতি বঙ্গ বর্জন করে চরকায় বোনা খদ্দরের পোশাক ব্যবহার করা। 'খদ্দর' কে গান্ধীজি এই 'স্বদেশী' কর্মসূচির প্রধানতম রূপ বলে মত প্রকাশ করেন এবং বলেন চরকা এবং বন্দর ছাড়া 'স্বরাজ' সম্ভব নয়।

স্বদেশী কর্মসূচির অঙ্গ হিসাবে বিলাতি কাপড় পোড়ানো এবং চরকার মাধ্যমে দেশী কাপড় তৈরি করা গান্ধীজির এই সিদ্ধান্তকে রবীন্দ্রনাথ সমালোচনা করেছিলেন। রবীন্দ্রনাথ চেয়েছিলেন, দেশবাসীর জন্য গান্ধীজির মুক্তির ডাক হবে জ্ঞান-বিজ্ঞান, শিল্প-সাহিত্য, রাজনীতি, কৃষি-বাণিজ্য সহ সবক্ষেত্রে। ১৯২১-এর ২৯ আগষ্ট 'মর্ডান রিভিউ' পত্রিকায় প্রকাশিত 'দ্য কল অব ট্রুথ' নামক প্রবন্ধে রবীন্দ্রনাথ লেখেন, “স্বরাজ মানে কেবল স্বদেশী কাপড় নির্মাণে স্বয়ংসম্পূর্ণ হওয়া নয়। এর সত্যিকারের অবস্থান আমাদের হৃদয়ে, বহুগামী শক্তিসম্পন্ন মন, এর নিজের জন্য স্বরাজ নির্মাণ করতে থাকে।” রবীন্দ্রনাথের দৃষ্টিতে গান্ধীজির স্বদেশী আন্দোলনে চরকার সীমাহীন প্রাধান্য রাজনৈতিক দৃষ্টির সঙ্কীর্ণতা। তিনি বলেন, “আজ আমাদের দেশে চরকা লাঞ্ছনা পতাকা উড়িয়েছে। এ যে সঙ্কীর্ণ জড়শক্তির পতাকা, অপরিণত যন্ত্র শক্তির পতাকা, স্বল্পবল পণ্যশক্তির পতাকা এতে চিত্তশক্তির আহ্বান নেই।” রবীন্দ্রনাথের দৃষ্টিতে চরকা ছিল ব্যক্তিবিশেষের যুক্তিহীন ঝোঁক এবং দেশবাসীর উপর গান্ধীজির প্রবল ব্যক্তিত্বের প্রভাব ছাড়া আর কিছুই নয়। তিনি বলেন, “এই জন্য স্বীকার করতে লজ্জা হচ্ছে না (যদিও লোকভয় যথেষ্ট আছে যে, এ পর্যন্ত চরকা আন্দোলনে আমার মন ভিতর থেকে দোল খায়নি।"

কবিগুরুর 'দ্য কল অব টুথ'-এর জবাবে গান্ধীজির এ গ্রেট সেন্টিনেল' নামে একটি প্রবন্ধ প্রকাশিত হয় 'ইয়ং 'ইণ্ডিয়া' পত্রিকায় (১৯২১-এর ১৩ অক্টোবর)। কবিগুরুর চরকা সম্পর্কিত সমালোচনার প্রশংসা করে অত্যন্ত সংগত ভাষায় গান্ধীজি এই প্রবন্ধে লেখেন, “কবির ভাবনা চরকা জাতির জন্য এক মৃত্যুবাণ। প্রকৃত সত্য হল চরকা আমাকে অপরিহার্য ভাবে একজন রাজপুত্রের মহিমায় অভিষিক্ত করেছে। একজন চাষী এবং রাজপুত্রের মধ্যে কোনো তফাত নেই। চরকা আমাকে শ্রমের মর্যাদা দান করেছে।” গান্ধীজি ঐ প্রবন্ধে আরও লিখেছেন, “বিলাতি কাপড় পরাকে আমি পাপ বলে বিবেচনা করি। আমি অবশ্যই স্বীকার করি যে, আমি অর্থনীতি ও নৈতিকতার মধ্যে কোনো বিভেদরেখা টানিনা। কিন্তু আমি এটাই মনে করি, যে অর্থনীতি ব্যক্তি বা জাতির নৈতিক কল্যাণকে বাধা দেয়, সেটা নীতিবোধহীন অর্থনীতি এবং এই কারণে তা অকল্যাণকর।"

গান্ধীজি যখন অসহযোগ আন্দোলন শুরু করেন, রবীন্দ্রনাথ তখন আমেরিকা সফরে ছিলেন। ভারতে ফিরে এসে তিনি 'দ্য কল অব টুথ'-এ অসহযোগ আন্দোলনকে রাজনৈতিক সন্ন্যাস বলে পরিহাস করে লেখেন, “এতদিন পরে আমার দেশে সেই আনন্দময় মুক্তির হাওয়া বইছে, এটাই আমি কল্পনা করে এসেছিলুম। এসে একটা জিনিস দেখে আমি হতাশ হয়েছি। দেখেছি, দেশের মনের উপর বিষম একটা চাপ। বাইরে থেকে কিসের তাড়নায় সবাইকে এক কথা বলাতে, এক কাজ করাতে ভয়ংকর তাগিদ দিচ্ছে।.... কথা উঠেছে সমস্ত দেশের বুদ্ধিকে চাপা দিতে হবে. বিদ্যাকেও। কেবল বাধ্যতাকে আঁকড়ে ধরে থাকতে হবে। কার কাছে বাধ্যতা ? মন্ত্রের কাছে, অন্ধ বিশ্বাসের কাছে ?” অসহযোগ আন্দোলন পাশ্চাত্য এবং প্রাচ্যের মধ্যে সম্পর্ক নষ্ট করবে মন্তব্য করে সি.এফ.এভুজকে এক চিঠিতে রবীন্দ্রনাথ লেখেন, “আমাদের সমগ্র হৃদয়-মনকে পাশ্চাত্যের প্রতি বিদ্বিষ্ট করে তুলবার এই যে বর্তমান সংগ্রাম এটা একটা আধ্যামিক আত্মঘাতের চেষ্টা মাত্র।

ব্যক্তিগত, সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় পর্যায়ের সব সমস্যা সমাধানে অহিংসা এবং মৈত্রীতে বিশ্বাসী গান্ধীজি বলতেন, “অহিংসার অর্থ অন্যায়কারীর নিকট নতি স্বীকার নয়। অহিংসার অর্থ স্বৈরাচারী ইচ্ছাশক্তির বিরুদ্ধে নির্যাতিতের সমগ্র আমার বোধকে উত্থিত করা।” এই অহিংসার বাণীকে রবীন্দ্রনাথ শ্রদ্ধা ও সমর্থন করলেও অসহযোগ আন্দোলনে এর প্রয়োগ নিয়ে তিনি দ্বিমত পোষণ করতেন। রাজনৈতিক লক্ষ্য অর্জনে অহিংসার প্রয়োগ কতটা বাস্তবসম্মত এ বিষয়টি নিয়ে শঙ্কিত রবীন্দ্রনাথ গুজরাটের বিখ্যাত কবি ও সাহিত্যিক নানা লাল দলপতরামকে এক চিঠিতে লেখেন, "জগতের মহাপুরুষগণ প্রেম, ক্ষমা ও অহিংসার বাণী প্রচার করে গেছেন; কিন্তু তারা এটা করেছেন মুখ্যতঃ অধ্যাম পরিপূর্ণতা লাভের জন্য; কোনও রাজনৈতিক উদ্দেশ্য সিদ্ধির জন্য অথবা জীবনের সমজাতীয় ক্ষেত্রের কোনও উদ্দেশ্য সাধনের জন্য প্রচার করেননি।" এ বিষয়ে গান্ধীজির মত ও বিশ্বাস ছিল আলাদা। তিনি বলেছেন-অহিংসাকে যদি আত্মিক শক্তি বলে স্বীকার করা যায় এবং সে শক্তিকে যদি সর্বশ্রেষ্ঠ শক্তি বলে স্বীকার করা যায়, তবে তার প্রয়োগক্ষেত্রকে সীমাবদ্ধ রাখবো কেন ? জীবনের সকল ক্ষেত্রে প্রয়োগ করে তবেই তো তার সত্যের প্রতিষ্ঠা। জাতীয়তাবাদ ও আন্তর্জাতিকতাবাদের মধ্যে দূরত্ব সম্বন্ধে রবীন্দ্রনাথের বক্তব্য ছিল-জাতীয়তাবাদীরা সবসময় আত্মকেন্দ্রিক হয়ে নীতিভ্রষ্টতার পথে চলেন। বিদেশী কাপড় পোড়ানো আত্মকেন্দ্রিক জাতীয়তাবাদ। গান্ধীজি এর উত্তরে বলেন-জাতীয়তাবাদী না হলে কেউ আন্তর্জাতিকতাবাদী হতে পারেন না।

হিন্দু-মুসলিম জাতিগত দ্বন্দ্বে তৃতীয় পক্ষের অস্তিত্ত্বে গান্ধীজির বিশ্বাস এবং এই সমস্যার সমাধানে তাঁর ভূমিকা রবীন্দ্রনাথের অপছন্দ ছিল। রবীন্দ্রনাথের বিশ্বাস ছিল যে, হিন্দু-মুসলিম জাতিগত দ্বন্দ্বের বীজ পোঁতা আছে প্রচলিত সমাজ জীবনের মধ্যেই।

অসহযোগ আন্দোলন রবীন্দ্রনাথের কাছে ছিল নিছক একটি নেতিবাচক কর্মসূচি। রবীন্দ্রনাথের উৎকণ্ঠা আরও বেড়ে যায় যখন অসহযোগ আন্দোলনে যোগ দিতে দলে দলে শিক্ষার্থীরা সরকারি বিদ্যালয় ছাড়তে থাকে। এই আন্দোলন অজ্ঞানতাকে প্রশ্রয় দিয়ে দেশকে সংকীর্ণতার দিকে, চিন্তায় জড়তের দিকে টেনে নিয়ে যাবে ভেবে ভীত- ক্ষুব্ধ রবীন্দ্রনাথ গান্ধীজির কঠোর সমালোচনা করেন।

অসহযোগ আন্দোলনের সমালোচনা করে কবিগুরু যে তিনটি প্রবন্ধ 'মর্ডান রিভিউ' পত্রিকায় লিখেছিলেন, গান্ধীজি তার জবাব দেন ১৯২১-এর ১ জুনের 'ইয়ং ইণ্ডিয়া' পত্রিকায়। গুরুদেবের সমালোচনার প্রতি সম্মান রেখেই

'দ্য পোয়েট'স অ্যাংজাইটি' শীর্ষক প্রবন্ধে গান্ধীজি লেখেন, “আমি কবিকে এবং ভারতবর্ষকে এই নিশ্চিত আশ্বাস দিচ্ছি, তিনি অসহযোগের ধারণা সম্বন্ধে যে-সব আশঙ্কা পোষণ করছেন, অসহযোগ তার কিছুই নয়, এবং দেশ অসহযোগ গ্রহণ করেছে বলে তাঁর লজ্জিত হবার কোন কারণ নেই।.... কিন্তু ভারতবর্ষের পক্ষে হিংসা অথবা অসহযোগ-এই দুটির কোনও একটি ছাড়া আর অন্য কিছু নির্বাচন করবার নেই। ভারতবর্ষ এবং পাশ্চাত্যের মধ্যে একটি চীনের প্রাচীর গড়ে দেওয়ার জন্যই অসহযোগের উদ্ভাবন, কবির পক্ষে এরূপ আশঙ্কাও নিষ্প্রয়োজন। বরঞ্চ পারস্পরিক শ্রদ্ধা ও বিশ্বাসের উপরে প্রতিষ্ঠিত সত্যিকারের এবং সম্মানজনক ও স্বেচ্ছাপ্রণোদিত সহযোগিতার পথ গড়ে তুলবার উদ্দেশ্যই হল এই অসহযোগের। বর্তমানের যে সংগ্রাম এ সংগ্রাম হল বাধ্যতামূলক সহযোগিতার বিরুদ্ধে, এক তরফা মিলনের বিরুদ্ধে। সভ্যতার নামে একটি ছদ্মবেশে শোষণের সব আধুনিক পন্থা প্রয়োগের যে সশস্ত্র চেষ্টা তারই বিরুদ্ধে।.... অসহযোগ হল নিজেদের অজ্ঞাতে এবং নিজেদের অনিচ্ছায় যে অন্যায়ের অংশগ্রহণ তার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ।” ছেলেমেয়েদের সরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বর্জনের ডাক সমর্থন করে গান্ধীজি লেখেন, “সরকারি শিক্ষাব্যবস্থা আমাদের মনুষ্যতকে অবদলিত করছে... আমাদের যা করার তাই করছে কেরানি আর দোভাষী। আপাতদৃষ্টিতে শাসিতের স্বেচ্ছায় সহযোগিতা করা যদি অন্যায় বলে মনে করি, তবে সেই সব প্রতিষ্ঠানই আমাদের সবার আগে ধরা দরকার, যেখানে আমাদের সংযোগ মনে হয় সবচেয়ে স্বতঃস্ফূর্ত। যুবশক্তি একটি দেশের আশা-ভরসা। যে মুহূর্তে আমরা বুঝতে পেরেছি যে, এই শাসনব্যবস্থা পুরোপুরি অথবা প্রধানত অমঙ্গলের প্রতিত্ব, তখনই আমি মনে করি আমাদের ছেলেমেয়েদের তার সঙ্গে যুক্ত করার যে কোন প্রচেষ্টাই হবে পাপ।”

অসহযোগ নেতিবাচক, রবীন্দ্রনাথের এই অভিযোগের জবাবে বলেন, অসহযোগের নেতিবাচক দিক নিয়ে অহেতুক উদ্বিগ্ন হয়ে পড়ছেন। আমরা 'না' বলার ক্ষমতা হারিয়ে ফেলেছিলাম। সরকারের মুখের উপর 'না' বলাটা মনে করা হত আনুগত্যহীনতা, এক অপবিত্র অপকর্ম ।... অসহযোগ প্রকৃতপক্ষে সরকারের কাছে জাতির দেওয়া শর্ত মেনে সহযোগিতারই আহ্বান। ঐ শর্ত প্রতিটি জাতির স্বাভাবিক অধিকার এবং সেটা মানা প্রতিটি সুশাসকের অবশ্য কর্তব্য।"

'এ গ্রেট সেন্টিনেল' প্রবন্ধে সত্য ও যুক্তির পক্ষে দাঁড়ানোর জন্য গান্ধীজি কবিগুরুকে আন্তরিক কৃতজ্ঞতা জানান । অসহযোগকে 'সাময়িক নিজেদের মধ্যে ফিরে আসা' উল্লেখ করে গান্ধীজি বলেন, “আমরা নিজেদের মধ্যে নিজেরা অত্যন্ত দুর্বল হয়ে পড়েছি। এত দুর্বল হয়েছি যে, অপরের সঙ্গে আমাদের সহযোগিতার অর্থ দাসত্ব বরণ করে নেওয়া ছাড়া আর কিছুই না-শারীরিক, মানসিক, আধ্যাত্মিক সব রকমের দাসত। নিজেদের মধ্যে নিজেরা কিছুদিন ফিরে এসে দৃঢ় ভিত্তিতে নিজেদের গড়ে তুলতে হবে তাতে আমরা সমগ্র মানবজাতির সেবা করবার জন্য দেহে ও মনে যথেষ্ট শক্তি সঞ্চয় করে নিতে পারি।... আমি চাই সব দেশের সংস্কৃতি আমার ঘরে যতটা সম্ভব সচ্ছন্দে আসুক । ..... কিন্তু তার কোনোটা এসে আমাকে উড়িয়ে নিয়ে যাক, তা আমি চাই না। বন্দীশালার ধর্ম আমার ধর্ম নয়। আমার ঘরে ভগবানের সৃষ্ট জীবের মধ্যে ক্ষুদ্রতম জীবের জন্যও স্থান আছে, কিন্তু আমার ঘরকে আমি জাতি-ধর্ম-বর্ণ নিয়ে উচ্চত অপমানকর দত্তের বিরুদ্ধে দুর্ভেদ্য করে তুলতে চাই। "

রক্ষণশীলতা, বিজ্ঞান এবং প্রযুক্তি বিষয়েও গান্ধীজি ও রবীন্দ্রনাথ নানা প্রবন্ধ, বক্তৃতা ও আলোচনায় তাদের ব্যক্তিগত মতামত প্রকাশ করেছেন। তারা দুজনেই ছিলেন বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির সপক্ষে। কিন্তু কয়েকটি প্রেক্ষাপটে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি এবং ধর্ম ও রক্ষণশীলতা বিষয়ে তাঁদের দুজনের মানসিক কাঠামোর মৌলিক পার্থক্য স্পষ্ট হয়ে উঠেছিল। ১৯৩৪-এর ১৫ জানুয়ারি ভয়াবহ ভূমিকম্পে পাটনা-বিহার বিশ্বস্ত হয়। দক্ষিণ ভারত সফররত গান্ধীজি 'হরিজন' পত্রিকায় পাঠানো তাঁর প্রেস বিবৃতিতে বলেন- বিহারের বর্ণ-হিন্দুদের অস্পৃশ্যতা ও পাপই ঐ ধ্বংসলীলার মূল কারণ। রুদ্র-বিধাতার কাছ থেকেই পাপের শাস্তি রূপেই মুংসের কঠোর শাস্তি নেমে এসেছে। মহাজাগতিক ঘটনাকে নীতি-নৈতিকতার সাথে জুড়ে দেওয়ার গান্ধীজির এই অবৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গিতে কবিগুরু বিস্মিত হয়ে যান। উদিগ্ন রবীন্দ্রনাথ ইউনাইটেড প্রেসে পাল্টা বিবৃতি দেন- "প্রকৃতির জড় ঘটনাসমূহের একটি বিশেষ সমবায়ই হল প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের অনিবার্য এবং একমাত্র কারণ। বিশ্ব-বিধান সমূহ অলখ্য এই বিধানগুলির কাজে ঈশ্বর নিজেও কোনদিন হস্তক্ষেপ করেন না। যদি করতেন, তবে তিনি নিজেই তাঁর সৃষ্টির সামগ্রিক সততা নষ্ট করে দিতেন। ... আমাদের দিক থেকে এই বিশ্বাসেই আমরা নিজেদেরকে সম্পূর্ণ নিরাপদ মনে করছি যে, আমাদের পাপ এবং ভুলভ্রান্তি যত বিশালই হোক, তা এত শক্তিশালী কখনই নয় যে সৃষ্টির কাঠামোটিকে নিচে নামিয়ে একেবারে ধ্বংস করে দিতে পারে।” রবীন্দ্রনাথ আরও লেখেন, “মহামাজি তাঁর বিস্ময়কর প্রেরণা দ্বারা দেশবাসীর মনে যে ভয় ও ভীরুতা সঞ্চিত ছিল তা থেকে সবাইকে মুক্তির জন্য উদ্বুদ্ধ করতে পেরেছেন। এ জন্য তাঁর কাছে আমরা যারা বিশেষভাবে কৃতজ্ঞ তারাই আবার মনে কষ্ট পাই যখন দেখি যে, মহাত্মার মুখ থেকে এমন বাণী নিঃসৃত হচ্ছে মা দেশবাসীর মনে অযুক্তির উপাদানগুলোকে বড় করে তুলতে পারে। এই অযুক্তিই হল সমস্ত অক্ষশক্তির আকর যা আমাদের জোর করে স্বাধীনতা ও আত্মসম্মানের পথ থেকে দূরে সরিয়ে দিতে পারে। "

ঈশ্বরের অস্তিত্ব প্রমাণ করা যেমন কঠিন, তেমনি ভূমিকম্প এবং অস্পৃশ্যতার মধ্যে যুক্তি নির্ভর ব্যাখ্যা দেওয়া অসম্ভব জানিয়ে গান্ধীজি ১৯৩৪-এর ১৬ ফেব্রুয়ারি 'হরিজন' পত্রিকায় লেখেন, “তিন্নেভেলিতে বসে আমি বিহারের প্রাকৃতিক বিপর্যয়কে অস্পৃশ্যতার কারণ বলেছিলাম যথেষ্ট চিন্তা-ভাবনা করেই এবং এই ভাবনাটি আমার অন্তর থেকেই এসেছিল। আমি যা বিশ্বাস করি সেটাই বলেছি।” রবীন্দ্রনাথের তীব্র সমালোচনা সত্ত্বেও গান্ধীজি তাঁর বিশ্বাসে অবিচল থেকে লেখেন, “গুরুদেবের সাথে আমি এ কথায় একমত নই যে, আমাদের পাপ, ভুলভ্রান্তি যত বড়ই হোক না কেন সেগুলি এত শক্তিশালী কখনই নয় যে সৃষ্টির কাঠামোকে ধ্বংস করে দিতে পারে। বরং আমার বিশ্বাস, অন্য কোন প্রাকৃতিক শক্তির চেয়ে আমাদের নিজেদের পাপ সমূহ এই কাঠামোকে ধ্বংস করে দিতে অনেক বেশি শক্তিশালী।”

শান্তিনিকেতন এবং বিশ্বভারতীর পরিচালনার খরচ মেটাতে শান্তিনিকেতনের শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের নিয়ে রবীন্দ্রনাথ দেশের বিভিন্ন স্থানে সংগীত, নৃত্য, নাট্যাভিনয়ের আয়োজন করতেন। গান্ধীজি মনে করতেন বিষয়টি রবীন্দ্রনাথের ব্যক্তিত্বের সাথে বেমানান। রবীন্দ্রনাথ বৃদ্ধ বয়সে একবার অর্থ সংগ্রহের জন্য উত্তর ভারত সফরে বের হলে গান্ধীজি বাধিত হলেন। কবিগুরুর সাথে দিল্লীতে দেখা করে গান্ধীজি তাকে শান্তিনিকেতনে চলে যেতে অনুরোধ করেন। ১৯৩৫-এর ১৩ অক্টোবর গান্ধীজি ওয়ার্দা থেকে রবীন্দ্রনাথকে একটি চিঠিতে লেখেন, “এ-কথা আমার কাছে ভাবনার অতীত যে, এই বয়সে আপনাকে ভিক্ষার জন্য বাইরে যেতে হবে। আপনাকে শান্তিনিকেতনের বাইরে যেতে হবে না, অর্থ আপনার কাছে এমনিই পৌঁছে যাবে।” গান্ধীজির অনুরোধে ব্যবসায়ীরা কবিগুরুর কাছে ৬০ হাজার টাকা পৌঁছে দিলেন, সেই টাকায় শান্তিনিকেতনের বেশ কিছুটা ঋণ পরিশোধ হয়। কিন্তু গান্ধীজি তাঁর চিঠিতে রবীন্দ্রনাথের সংগীত-নৃত্যনাট্যাভিনয়ের দলীয় সফরকে 'বেগিং মিশন' (অর্থ ভিক্ষার অভিযান) বলায় কবিগুরু ভীষণ কষ্ট পেয়েছিলেন। রবীন্দ্রনাথের কাছে তাঁর সফর ও অর্থ সংগ্রহের জন্য ছিল না। এই সফরগুলিতে সাংস্কৃতিক কর্মসূচির মধ্য দিয়ে নিজের সৃষ্টির রূপায়ণ দেখেও তিনি আনন্দিত হতেন।

শেষ বয়সে রবীন্দ্রনাথ ব্যক্তিগত সিদ্ধান্তে যোগ্য পথ নির্দেশক হিসেবে গান্ধীজিকে বিশ্বভারতীর একজন আজীবন ট্রাস্টি হিসেবে মনোনিত করেছিলেন। এ ব্যাপারে রবীন্দ্রনাথ ১৯৩৭-এর ১০ ফেব্রুয়ারি একটি চিঠিতে গান্ধীজিকে লেখেন- “আমি আপনাকে আমাদের বিশ্বভারতীর একজন আজীবন ট্রাস্টি মনোনীত করবার স্বাধীনতা গ্রহণ করেছি। আমার জীবনের এই ভাঙা শেষ বয়সে জানতে পারলাম, যে প্রতিষ্ঠানের জন্য আমি আমার জীবনের শ্রেষ্ঠ অংশ এবং শ্রেষ্ঠ সামর্থ্য নিয়োজিত করেছি, সেই প্রতিষ্ঠান আপনাকে একজন অভিভাবক রূপে পাবে।” এই চিঠির উত্তরে গান্ধীজি ট্রাস্টি মনোনয়নের পেছনে কোনও ভাবে আর্থিক প্রনোদনার বিষয়টি যুক্ত আছে বলে সন্দেহ প্রকাশ করেছিলেন। বলাবাহুল্য এতে কবিগুরু মনঃক্ষুণ্ণ হয়েছিলেন।

 

জালিয়ানওয়ালাবাগের হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদে রবীন্দ্রনাথ 'নাইটহুড' এবং গান্ধীজি 'কাইজার-ই-হিন্দ' উপাধি ত্যাগ করেছিলেন। দুটিই ছিল পরাধীন মানবাত্মার আহত বিবেকের মর্যাদাদীপ্ত সাহসী উদ্ভাসন। রবীন্দ্রনাথ এবং গান্ধীজির মধ্যে আদর্শগত এবং মৌলিক বিষয়ে মিল এবং অমিল দুটোই ছিল। বিভিন্ন বিষয়ে মতৈক্য না থাকায় তাঁরা ভিন্ন পথ অবলম্বন করেছেন। কিন্তু তাদের পারস্পরিক সম্পর্কে বা শ্রদ্ধাবোধে এর প্রভাব পড়তে দেননি। এ বিষয়ে রবীন্দ্রনাথ বলেছেন, “আমি নিজের সম্বন্ধে এ কথা স্বীকার করি যে, মহাত্মার সঙ্গে সব বিষয়ে আমার মতের মিল নেই। অর্থাৎ আমি যদি তাঁর মতো চরিত্র প্রভাব সম্পন্ন মানুষ হতাম তা হলে অন্যরকম প্রণালীতে কাজ করতাম। কী সে প্রণালী আমার অনেক পুরানো লেখায় তার বিবরণ দিয়েছি। আমার মননশক্তি যদি বা থাকে কিন্তু আমার প্রভাব নেই। সেই প্রভাব আছে জগতের কম লোকের। দেশের সৌভাগ্যক্রমে দৈবাৎ যদি সে-রকম শক্তিসম্পন্ন পুরুষের আবির্ভাব হয়, তবে তাকে তাঁর পথ ছেড়ে দিতেই হবে। তার কর্মধারাকে বিক্ষিপ্ত করতে পারব না।"

১৯১৫ সালে দক্ষিণ আফ্রিকা থেকে ফিরে গান্ধীজি শান্তিনিকেতনে যান এবং আশ্রমে বেশ কিছুদিন ছিলেন। গান্ধীজির সঙ্গে তাঁর স্ত্রী কস্তুরবা, পুত্র দেবদাস এবং ফিনিক্স বিদ্যালয়ের ছাত্র-কর্মীরাও শান্তিনিকেতনে গিয়েছিলেন। রবীন্দ্রনাথ তখন উত্তরভারতে ভ্রমণ করছেন। তিনি গান্ধীজিকে একটি চিঠিতে লিখলেন, "আপনার ফিনিক্স বিদ্যালয়ের ছাত্রদের জন্য ভারতে একমাত্র শান্তিনিকেতনকেই যে আপনি উপযুক্ত এবং সম্ভাব্য স্থান বলে বিবেচনা করেছেন, এটা আমাকে খুব আপ্লুত করেছে।... আপনি যে ফিনিক্সের ছাত্রদের শান্তিনিকেতনের ছাত্র হয়ে উঠবার সুযোগ করে দিয়েছেন এবং এইভাবে আপনার ও আমার সাধনার মধ্যে একটা জীবন্ত যোগসূত্র গড়ে উঠবার সুযোগ করে নিয়েছেন, এজন্য আমি আপনাকে ধন্যবাদ জানাচ্ছি।”

রবীন্দ্রনাথ গভীর শ্রদ্ধাবোধ থেকে গান্ধীজির প্রতিটি বিষয়ে অত্যন্ত সতর্ক দৃষ্টি রাখতেন। দেশকে নেতৃত্ব দিতে গিয়ে গান্ধীজির কথা ও আচরণের মধ্যে কখনও কোনও আপত্তিকর কিছু লক্ষ্য করলেই তিনি নিঃসঙ্কোচে তা ব্যক্তিগত চিঠির মাধ্যমে অথবা প্রকাশ্যে বিবৃতি দিয়ে গান্ধীজির গোচরে আনার চেষ্টা করতেন। বলা যায়, কবিগুরুর সমালোচনা ছিল গান্ধীজিকে আরও সচেতন করার হাতিয়ার। এ কথা স্বীকার করে এ গ্রেট সেন্টিনেল' প্রবন্ধে গান্ধীজি লিখেছেন, “যারা আমাদের সঙ্গে একমত নন, তাদের বিরুদ্ধে আমরা যারা অধৈর্য হয়ে অসহিষ্ণু, এমনকি হিংসাপরায়ণ হয়ে উঠি, তাদের জন্য তাঁর (রবীন্দ্রনাথের) প্রবন্ধ এক যথার্থ সতর্কবাণী। আমি মনে করি, কবি আমাদের এমনই একজন প্রহরী, যিনি ধর্মীয় গোঁড়ামি, আলস্য, অসহিষ্ণুতা, অম্লতা, জড়তা প্রভৃতি শত্রুদের বিষয়ে সর্বদা সাবধান করে দেন।”

ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনের প্রেক্ষাপটে ভারতে গান্ধীজির ব্যাপক সমালোচনা ও নিন্দা শুরু হলে রবীন্দ্রনাথ দুঃখ ভারাক্রান্ত হৃদয়ে ১৯৩৪-এর ৬ ফেব্রুয়ারি সংবাদপত্রে একটি বিবৃতি দিলেন: “মহামাজিই হলেন একমাত্র লোক যিনি জনগণকে নৈরাশ্যের শোচনীয় অবস্থা এবং আত্ম অপমানকর দাসত্বের গ্লানি থেকে জাগিয়ে তুলতে সর্বাপেক্ষা বেশি উৎসাহিত করেছেন। তাঁর আশা ও বিশ্বাসের বাণী রাতারাতিই সমগ্র দৃষ্টিভঙ্গিকে পরিবর্তন করে দিয়েছে। যে-সব মানুষ শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে নিজেদের মাথায় অপমানের বোঝাকে নিত্যকালের বলে বিশ্বাস করে এসেছে- সেইসব মানুষের হৃদয়ে তিনি সাহস ও আত্মসম্মানবোধ জাগ্রত করেছেন। যিনি এই অলৌকিক ঘটনাকে সম্ভব করে তুলেছেন, আমরা তাঁর প্রতি সবিস্ময় শ্রদ্ধার্ঘ অর্পণ না করে পারি না।"

গান্ধীজি নানা উপলক্ষে বা নানা ঘটনার প্রেক্ষিতে অনশন ও উপবাস করতেন। সেই সময় তিনি রবীন্দ্রনাথের আশীর্বাদ চাইতেন। নীতিগতভাবে রবীন্দ্রনাথ অনশন বা উপবাস সমর্থন না করলেও গান্ধীজির উপবাস তাকে ভীষণ ভাবে উদ্বিগ্ন করত। রবীন্দ্রনাথ গান্ধীজিকে আশীর্বাদ পাঠানোর পাশাপাশি সংশ্লিষ্ট কর্তা-ব্যক্তিদের সাথে যোগাযোগ করতেন, চিঠিপত্র লিখতেন, পত্রিকায় বিবৃতি দিতেন, আবেদন জানাতেন। শেষবার তো রবীন্দ্রনাথ অসুস্থ শরীরে পুণার যারবেনা জেলে অনশনরত গান্ধীজির পাশে গিয়ে হাজির হয়েছিলেন। ১৯৩৩-এ গান্ধীজি যখন অনশনের সক্ষম নেন তখন রবীন্দ্রনাথ দার্জিলিং থেকে তাকে পরপর দুটি চিঠি লেখেন। চিঠি দুটিতে তিনি গান্ধীজিকে ঠিক অভিভাবকের মতো পরামর্শ দিয়েছিলেন। রবীন্দ্রনাথের চিঠিগুলিতে স্পষ্টতই উল্লেখ ছিল পারিপার্শ্বিক চাপ, হতাশা কিংবা ব্যর্থতায় উপবাসের মধ্য দিয়ে আত্মবিসর্জনের বদলে নিজের আদর্শে বলীয়ান হয়ে বাধা-বিপত্তিকে পিছনে ফেলে এগিয়ে যাওয়াই বীরের ধর্ম। অবসাদগ্রস্থ হয়ে মর্মবেদনায় নিজের অবস্থান ত্যাগ করে দূরে চলে যাওয়া আঘাতী সিদ্ধান্ত। উপবাসের কারণে শারীরিক এবং মানসিক উদ্দীপনা তৈরির গুরুত্বকে স্বীকার করলেও আত্মবিসর্জনের সঙ্কল্পকে সাধু সন্ন বলে মনে করতেন না কবিগুরু। গান্ধীজি এ ক্ষেত্রে উত্তর দিয়েছেন- হতাশা এবং বিরক্তি আছে, তবে আত্মঘাতি হওয়ার ইচ্ছাতে তার উপবাস নয়। উপবাস ছিল মহামাজির কাছে আমওরি মধ্য নিয়ে অজের অধ্যাত্ম-শক্তিলাভের যথার্থ উপায় ।

১৯৩৭-এর সেপ্টেম্বরে রবীন্দ্রনাথ হঠাৎ অজ্ঞান হয়ে যান। উদ্বিগ্ন গান্ধীজি তাকে প্রীতিপূর্ণ বার্তা পাঠালেন। বার্তাটি কবিগুরুকে পুলকিত করেছিল। কিছুটা সুস্থ হয়েই রবীন্দ্রনাথ গান্ধীজিকে চিঠি লিখলেন, "যে সংজ্ঞাহীন কাল আমাকে কাটাতে হয়েছে, তার পরে যে জিনিষটি আমাকে প্রাণের জগতে প্রথম সম্বর্ধনা জানিয়েছে, তা হল আপনার স্নেহময় দুশ্চিন্তার বার্তাটি। যে দীর্ঘস্থায়ী অবিরাম কষ্টভোগের মূল্যে এই চিঠি আমি পেয়েছি, এই চিঠি সেই মূল্যের যোগ্য বলে আমি মনে করি।”

১৯৪০-এর ১৭ ফেব্রুয়ারি রবীন্দ্রনাথের সাথে গান্ধীজির শেষ দেখা হয়েছিল শান্তিনিকেতনে। আম্রকুঞ্জে গান্ধীজিকে সম্বর্থনা জানিয়ে কবিগুরু বলেন- “বর্তমান সময়ে অনেক সমস্যা আছে, আমরা কেউ এগুলির আক্রমণ থেকে মুক্ত নই। একটি মুহুর্তের জন্য আজ আমরা এই সব কল-কোলাহলের এবং ধূলার আঁধির উর্দ্ধে উঠতে চাই। বর্তমান সময়ের অস্থির রাজনৈতিক আবর্ত থেকে বেরিয়ে সমস্ত রাজনৈতিক গোলযোগ যখন শান্ত হয়ে যাবে এবং আমাদের সব সাধনার শাশ্বত মূল্য যেদিন প্রকাশিত হবে, আজকের মিলনের এই স্মৃতি সেদিন জাগ্রত থাকবে। "

 

১৯৪০-এর সেপ্টেম্বরে কালিম্পং সফরে গিয়ে রবীন্দ্রনাথ হঠাৎ গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়লে তাঁকে কলকাতায় আনা হয়। ১ অক্টোবর গান্ধীজি কবিগুরুকে লিখলেন, “আপনাকে আরও কিছুদিন থাকতে হবে। মানুষের আপনাকে প্রয়োজন। আপনি ভাল আছেন জেনে আমি অপরিসীম আনন্দ পেয়েছি।" প্রত্যুত্তরে কবিগুরু লিখলেন, "আপনার নিরন্তর শুভেচ্ছা আমাকে অন্ধকারের দেশ থেকে আবার আলোক এবং জীবনের দেশে ফিরিয়ে এনেছে, আমার ধন্যবাদের প্রথম অর্থ আপনার প্রতি।” সুস্থ হয়ে কবিগুরু একটি গান লিখে পাঠান গান্ধীজিকে। গান্ধীজি ১৯৪১-এর ১৩ এপ্রিল রবীন্দ্রনাথকে টেলিগ্রাম করে জন্মদিনের শুভেচ্ছা পাঠান-“চারকুড়ি যথেষ্ট নয়, পাঁচকুড়ি যেন শেষ করতে পারেন। ভালোবাসা।” রবীন্দ্রনাথ উত্তরে লিখলেন- "আপনার শুভেচ্ছার জন্য ধন্যবাদ। কিন্তু চারকুড়িই ধৃষ্টতা, পাঁচকুড়ি অসহ্য। "

১৯৪১-এর ৭ আগস্ট রবীন্দ্রনাথের মৃত্যু সংবাদ পেয়ে গান্ধীজি কবি-পুত্র রথীন্দ্রনাথকে টেলিগ্রাম পাঠান- “তুমি যা হারালে, আমিও তাই হারালাম, সমগ্র জাতি, জাতি কেন, সমস্ত জগৎ তা হারাল। গুরুদের একটি প্রতিষ্ঠানের রূপ গ্রহণ করেছেন, আমরা আমাদের কাজের দ্বারা যেন গুরুদেবের উপযুক্ত উত্তরসাধক হয়ে উঠতে পারি।" কবিগুরুর "যদি তোর ডাক শুনে কেউ না আসে... .' গানটি শেষ বয়সে গান্ধীজি দৈনন্দিন জপ-মন্ত্ররূপে গ্রহণ করেছিলেন। এছাড়া কবিগুরুর রচিত আর একটি গান 'জীবন যখন ওকায়ে যায় করুণা ধারায় এসো.... গান্ধীজির ক্ষুর প্রান্ত মনে সর্বদাই অনুপ্রেরণা জোগাত।

'মহাত্মাজির পুণ্যব্রত' (প্রবাসী, কার্তিক ১৩৩৯ বঙ্গাব্দ) প্রবন্ধে গান্ধীজি সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন- “মহাত্মা অনেককেই বলা হয়, তার কোনো মানে নেই। কিন্তু এই মহাপুরুষকে যে মহাত্মা বলা হয়েছে, তার মানে আছে। যার আত্মা বড়ো, তিনিই মহাত্মা। ... মহাত্মা তিনিই, সকলের সুখ দুঃখ যিনি আপনার করে নিয়েছেন, সকলের ভালোকে যিনি আপনার ভালো বলে জানেন। কেননা, সকলের হৃদয়ে তাঁর স্থান, তাঁর হৃদয়ে সকলের স্থান । আমাদের শাস্ত্রে ঈশ্বরকে বলে মহাত্মা, মর্তলোকে সেই দিব্য ভালোবাসা সেই প্রেমের ঐশ্বর্য দৈবাৎ মেলে। সেই প্রেম যাঁর মধ্যে প্রকাশ পেয়েছে তাঁকে আমরা মোটের উপর এই বলে বুঝেছি যে, তিনি হৃদয় দিয়ে সকলকে ভালোবেসেছিলেন।” একই প্রবন্ধে কবিগুরু লিখেছেন- “তাঁর ভালোবাসায় উচ্চ-নীচের ভেদ নেই, মূর্খ-বিদ্বানের ভেদ নেই, ধনী-দরিদ্রের ভেদ নেই। তিনি বিতরণ করেছেন সকলের মধ্যে সমানভাবে তাঁর ভালোবাসা। ... কত পীড়া, কত অপমান তিনি সয়েছেন। তাঁর জীবনের ইতিহাস দুঃখের ইতিহাস। দুঃখ, অপমান ভোগ করেছেন কেবল ভারতবর্ষে নয়, দক্ষিণ আফ্রিকায় কত বার তাকে মৃত্যুর ধারে এনে ফেলেছে, তাঁর দুঃখ নিজের বিষয় সুখের জন্য নয়, স্বার্থের জন্যে নয়, সকলের ভালোর জন্যে। এই যে এত মার খেয়েছেন, উল্টে কিছু বলেননি কখনও, রাগ করেন নি। সমস্ত আঘাত মাথা পেতে নিয়েছেন। শত্রুরা আশ্চর্য হয়ে গেছে ধৈর্য দেখে, মহত্ত্ব দেখে। তাঁর সংকল্প সিদ্ধ হল, কিন্তু জোর-জবরদস্তিতে নয়। ত্যাগের দ্বারা, দুঃখের দ্বারা, তপস্যার দ্বারা তিনি জয়ী হয়েছেন।"

ব্যক্তিগত, জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক পর্যায়ে বিভিন্ন বিষয়ের কর্ম, পরিকল্পনা ও প্রয়োগ পদ্ধতি নিয়ে রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে গান্ধীজির মতপার্থক্য ছিল দিনের আলোর মত স্পষ্ট। রবীন্দ্রনাথের লক্ষ্য ছিল উচ্চস্তরের, সুদুরপ্রসারী। তাঁর লক্ষ্য সব শ্রেণি, জাতি ও শতাব্দী পেরিয়ে মানবাত্মার উত্তরণ। গান্ধীজির লক্ষ্য ছিল একটা যুগ ও একটা জাতির প্রয়োজন অনুসারে নির্দিষ্ট। একজন কবি এবং একজন কর্মীর মাঝে মানবিক পার্থক্যকে দুজনে অতিক্রম করতে পারলেও থিতু ছিলেন ব্যক্তিসত্ত্বায়, আদর্শ এবং মৌলিকতায়। ব্যক্তি জীবনের লক্ষ্য এবং উদ্দেশ্যের প্রতি উভয়েই ছিলেন নিষ্ঠাবান ও সচেষ্ট। মূলত এই লক্ষ্যই তাঁদের মধ্যে যাবতীয় মতপার্থক্য গড়ে দিয়েছে। তবে মতবিরোধকে মুক্তকণ্ঠে প্রকাশ দুজনের শ্রদ্ধানুরক্তিকে আরও দৃঢ় করেছে। সম্পর্ককে ভেতর থেকে মজবুত করেছে। গান্ধীজিকে স্বদেশ মুক্তির ধ্যানে মগ্ন রাখতে রবীন্দ্রনাথ গান্ধী-বিদ্বেষীদের অহেতুক নিন্দার তীব্র প্রতিবাদ করেছেন এবং পাশাপাশি গান্ধীজির নানা সিদ্ধান্তের তীব্র সমালোচনা করে অলক্ষিত পারিপার্শ্বিক বিষয় সম্বন্ধে নিয়মিত সচেতন করেছেন। গান্ধীজিও কবিগুরুর সমালোচনার প্রশংসা করে সশ্রদ্ধ জবাব দিয়েছেন। বিভিন্ন বিষয়ে যুক্তি দিয়ে নিজের অবস্থান পরিস্কার করেছেন। মতামত বিনিময় করেছেন অথবা সহমত হয়েছেন। রবীন্দ্রনাথের গঠনমূলক সমালোচনা গান্ধীজিকে যুগিয়ে ছিল নানারকম ভাবনার খোরাক যা তাঁর কর্মপরিকল্পনাকে আরও নিখুঁত ও কার্যকর করতে উদ্বুদ্ধ করেছে। এমন পরমতসহিষ্ণু মনোভাবের কারণে এই দুই মহৎ হৃদয় যে শুধুই প্রশংসিত ও সম্মানিত হয়েছেন, জাতি-ধর্ম-বর্ণ-নির্বিশেষে শ্রদ্ধার পাত্র হিসেবে কালজয়ী হয়েছেন, তা কিন্তু নয়। তাঁদের পারস্পরিক মতানৈক্য বিভিন্নভাবে ভারতের স্বাধীনতা ও সমাজ সংস্কারের কার্যক্রমকে গতিশীল করেছে। মতপার্থক্য ও বিরোধে পরমতসহিষ্ণুতার এমন শিক্ষণীয় উদাহরণ বর্তমান সমাজে বিরল।

লেখক: অধ্যক্ষ, রয়্যাল অ্যাকাডেমি, মেদিনীপুর।

 

Mailing List