শিশু শ্রমিক থেকে পতিতালয়ে! নারী পাচার যুগে যুগে: পর্ব – ৭, এক অনন্য কাহিনী লিখছেন সুখেন্দু হীরা

শিশু শ্রমিক থেকে পতিতালয়ে! নারী পাচার যুগে যুগে: পর্ব – ৭, এক অনন্য কাহিনী লিখছেন সুখেন্দু হীরা
সুখেন্দু হীরা
চলে যাব- তবু আজ যতক্ষণ দেহে আছে প্রাণ
প্রাণপণে পৃথিবীর সরাব জঞ্জাল,
এ বিশ্বকে এ শিশুর বাসযোগ্য ক’রে যাব আমি
নবজাতকের কাছে এ আমার দৃঢ় অঙ্গীকার।
- সুকান্ত ভট্টাচার্য (ছাড়পত্র)
৭৫ বছর আগে সুকান্ত ভট্টাচার্য (১৯২৬ - ১৯৪৭ খ্রিস্টাব্দ) যতই আমাদের অঙ্গীকার করতে বলুক না কেন, আমরা কিন্তু বর্তমান পৃথিবীকে শিশুর বাসযোগ্য করে তুলতে পারিনি। তার প্রকৃত উদাহরণ পথশিশু, শিশুভিখারি, শিশুশ্রমিক। 'দারিদ্র' শিশুভিখারির প্রধান কারণ নয়। শিশুদের দিয়ে ভিক্ষা করালে সহজে বেশি আয় হবে বলে, শিশুটির অভিভাবক শিশুটিকে দিয়ে ভিক্ষা করায়।
পথশিশুদের বেশিরভাগ অংশ ভিক্ষাবৃত্তিতে যুক্ত। শিশুদের আয়ের একটা অংশ যায় তাদের নেশা করতে। রেল স্টেশন চত্বরের পথশিশুরা প্রায় সকলেই ডেনরাইট বা অন্যান্য নেশায় আসক্ত। সব শিশু ভিক্ষাবৃত্তি করে তা নয়, অনেকে শ্রম বিক্রি করে। একটা ট্রেন ঝাড়ু দিলে একটি শিশুর প্রায় ৩০০ টাকা আয় হয়। দিনে একাধিক ট্রেন ঝাড়ু দেয়, তাহলে আয়ের বহরটা বোঝা যাচ্ছে। তবুও তাদের আর্থিক অবস্থা উন্নতি হয় না। কারণ ভিক্ষুক, পকেটমার এইসব গোষ্ঠীর পিছনে বিভিন্ন চক্র কাজ করে।
শিশুশ্রমিক সব দিন জনপ্রিয় ছিল। শ্রমিক শিশু 'খায়' কম, আর্থিক 'দায়' অধিক নয়, বেশি 'গান গায়'না অর্থাৎ বেশি দাবিদাওয়া করে না। আইন করে আজ শিশু শ্রমিক নিষিদ্ধ। তা না হলে শিশুশ্রম কী জায়গায় পৌঁছত কল্পনাতীত। সুলভ শিশুশ্রমের লোভে প্রচুর শিশু পাচার হত। এখনও হয়, তবে আইনের চোখের আড়ালে। শিশুরা যেত কার্পেট শিল্পে, রেস্তোরাঁ-হোটেল-চায়ের দোকানে, আরবদেশে উটের দৌড়ে, আর কিছু যৌন পর্যটন শিল্পে। সেখানে পুরুষ শিশুর ব্যাপক চাহিদা। শিশুরা যে শিল্পক্ষেত্রে কাজ করত বা করে সেখানে তার থেকে বয়সে বড় শ্রমিক, ম্যানেজার প্রভৃতির কাছে যৌন নিগ্রহ হতে দেখা গেছে।
গৃহস্থ বাড়িতে ঘরের কাজে শিশু পরিচারক বা পরিচারিকা দূরেরই ভীষণ চাহিদা ছিল। এমনই এক শিশু পরিচারক 'পালান'-এর গল্প লিখেছেন রামপদ চৌধুরী খারিজ উপন্যাসে। সেই কাহিনী নিয়ে মৃণাল সেন একই নামে চলচ্চিত্র নির্মাণ করেছেন। গৃহস্থ বাড়িতে এখন আর শিশুদের পরিচারকের কাজে দেখা যায় না। আইনের জুজুর ভয়ে। তবে অনেক বাড়িতে শিশুদের রাখা হয় 'আশ্রয় প্রার্থী' হিসাবে। তাঁরা ঘরের সমস্ত কাজ করে, তাঁর বিনিময়ে দুবেলা খেতে, পরতে পায়। শিশুটির বাবা-মা'র হাতে কিছু টাকা হাতে তুলে দেওয়া হয়। প্রশাসন থেকে জানতে চাইলে বলা হয়, শিশুটির বাবা-মা খুব গরিব, তাই আমাদের বাড়িতেই রেখে গেছে বা শিশুটি আমাদের দূর সম্পর্কের আত্মীয়।
শিশুটি যদি মেয়ে হয়, তবে অনেক ক্ষেত্রে সে আশ্রয়দাতা বাড়ির কর্তার বা অন্যান্য পুরুষদের ভোগ্য হয়ে ওঠে। কিছুদিন আগে বর্ধমানে একটি কেস চাইল্ড লাইনের নজরে এসেছিল, এরকম একটি নাবালিকা দূরসম্পর্কের আত্মীয়ের বাড়িতে আশ্রয়ে থাকত। বাড়ির পুরুষটিকে সে মামা বলত। মামার লোভের শিকার হয়ে মেয়েটি সেই ঘরছেড়ে পালিয়ে আসে। মামার স্ত্রী ব্যাপারটি জানলেও নীরব ছিলেন, কারণ তার ঘরের কাজকর্মের সুবিধা হচ্ছিল। পরে অবশ্য সরব হন।
যে শিশুটিকে গৃহকর্মে সাহায্য করার জন্য বা আশ্রয় পাওয়ার জন্য অন্যের বাড়িতে থাকতে হয়। তাকে অনেক লাঞ্ছনা, গঞ্জনা সহ্য করতে হয়। সে বাড়ি ফিরে যেতে চায়, মা-বাবা দারিদ্র্যের দোহাই দিয়ে ফেরত নেয় না। নিজের বাবা-মা'র কাছে উপেক্ষিত হয়ে, আশ্রয় দাতার বাড়িতে অত্যাচারিত হয়ে শিশুটি পালিয়ে যায়। ফলে সহজেই সে পাচারকারীর খপ্পরে পড়ে। যদি সে নাবালিকা হয়, তাকে ফুঁসলে নিয়ে যাওয়া খুব সহজ। কারণ সে এতটাই অত্যাচারিত কোনও ছেলের মিথ্যা আশ্বাসে সহজে ভুলে যায়। তা সে বিবাহের আশ্বাস হোক বা কোনও ভালো কাজ পাইয়ে দেওয়ার আশ্বাস। অবশেষে তার ঠাঁই হয় শহরের কোনও পতিতাপল্লীতে।
জলপাইগুড়িতে থাকাকালীন এরকম একটি কেস আমি দেখছিলাম। গরীব মেয়েটিকে এক প্রতিবেশী কাজের ব্যবস্থা করে দেয় উত্তর চব্বিশ পরগণার ব্যারাকপুরে তাঁর এক আত্মীয়ের বাড়িতে। মেয়েটিকে সেখানে কেমন ছিল তার রিপোর্ট আমাদের কাছে ছিল না। কিন্তু মেয়েটি সেখান থেকে একদিন উধাও হয়ে যায়। তদন্তে জানা যায় নাবালিকা মেয়েটি ব্যারাকপুরের কোনও ছেলের সঙ্গে প্রেমের সম্পর্কে জড়িয়ে পড়ে। ছেলেটির পরিচয় ব্যারাকপুরের গৃহস্বামী জানেন না। মেয়েটির বাবার অভিযোগের ভিত্তিতে সেই প্রতিবেশী, প্রতিবেশীর আত্মীয় গ্রেফতার হলেও নাবালিকা তখনও পর্যন্ত উদ্ধার হয়নি। এভাবে কত মেয়ে চিরকালের জন্য নিখোঁজ হয়ে যায়।
এই শিশুশ্রমিক প্রথা, শিশুদের বেড়ে ওঠার সুস্থ পরিবেশ না থাকার কারণে নারী ও শিশু পাচারের ধারা বন্ধ হয় না।
(চলবে..)


