নিজেদের অজান্তেই মেরে ফেলছেন ধানের বন্ধু পোকা, কতটা ক্ষতি হচ্ছে কৃষির, পরামর্শ দিচ্ছেন কৃষি বিশষজ্ঞরা

নিজেদের অজান্তেই মেরে ফেলছেন ধানের বন্ধু পোকা, কতটা ক্ষতি হচ্ছে কৃষির, পরামর্শ দিচ্ছেন কৃষি বিশষজ্ঞরা
ধানের বন্ধু পোকা কতটা কৃষিক্ষেত্রে উপকারী? লিখছেন বিধান চন্দ্র কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের (বর্ধমান শাখা) কৃষি কীটতত্ত্ব বিভাগের গবেষক এবং সহকারী অধ্যাপক সৌরভ সেন, অর্ক মান্না এবং লক্ষ্মণ চন্দ্র প্যাটে।
বর্তমান দিনে ধান চাষে একটা বড় সমস্যা বিভিন্ন পোকা মাকড়ের উপদ্রব। তা সে আউশ হোক বা বোরো কিংবা আমন ধান। চাষীরা উপযুক্ত ব্যবস্থা বলতে শুধু রাসায়নিক ওষুধ প্রয়োগ করা ছাড়া সেরকম অন্য পদ্ধতি অবলম্বন করেন না। অথচ আমাদের প্রকৃতিতে অনেক বন্ধু পোকা রয়েছে। যাদের ভূমিকা অসামান্য। অথচ, সাধারণ ভাবে চাষীরা তাদের চিনতেই পারেন না। এই পোকা গুলোকে বিশেষ ভাবে ধানের জমিতে খুব সহজেই পাওয়া যায়।
ধান চাষীরা ভালোভাবেই ধানের পোকামাকড়কে শনাক্ত করতে পারেন। এবং কোনসময় কি ওষুধ দিতে হবে তাও জানেন। কিন্তু যা জানেন তা নিতান্তই সাধারণ পদ্ধতি। তাই দিনের পর দিন রাসায়নিক ওষুধ প্রয়োগ করেন। ফলে শত্রুপোকার পাশাপাশি ধান জমিতে থাকা অসংখ্য বন্ধু পোকা মাকড়েরও জীবনহানি ঘটে থাকে। ফলে কৃষকের অজান্তেই ক্ষতি হয় বেশ কিছুটা।
এবার জেনে নেওয়া যাক ধানের বন্ধু পোকা বলতে আমরা সাধারণত কি বুঝে থাকি। ধানের বন্ধু পোকা বলতে বোঝায়, আমাদের ধান জমিতে যেমন নানা রকমের শত্রু পোকা থাকে, যা ফসলের ক্ষতি করে, ঠিক তেমনই প্রচুর বন্ধু পোকাও থাকে। যা এইসমস্ত শত্রু পোকাদের খেয়ে ফেলে বা পরোক্ষ ভাবে এদের জীবন চক্রকে সম্পূর্ণ করতে বাধা দেয়। এদেরই আমরা ধানের বন্ধু পোকা বলে থাকি।
কিছু উদাহরণ দিলে পুরো ব্যাপারটা স্পষ্ট হয়ে যাবে। মাজরা পোকা কে আমরা সকলেই জানি। এই মাজরা পোকা ধানের সব থেকে বড় শত্রু। এই পোকা মেরে ফেলার জন্য চাষীরা বিভিন্ন রকমের রাসায়নিক ওষুধ প্রয়োগ করে থাকেন। কিন্তু ধানের জমিতে অসংখ্য বন্ধু পোকা থাকে যেগুলো এই মাজরা পোকার ডিমের মধ্যে ডিম পেড়ে মাজরা পোকার ডিম কে পুরোপুরি নষ্ট করে দেয়। ফলে এইসব নষ্ট হয়ে যাওয়া মাজরা পোকার ডিম থেকে নতুন কোনো লার্ভা বের হতে পারে না। বরং সেখান থেকে ওইসব বন্ধু পোকা পূর্ণাঙ্গ হয়ে বেরিয়ে আসে। যা আমাদের চাষী ভাইদের মাজরা পোকার দমনে অনেক সাহায্য করে কোনোরকম ওষুধ প্রয়োগ ছাড়াই। এরকম কিছু ধানের বন্ধু পোকার জাতের নাম হলো ট্রাইকোগ্ৰামা, টেলিনোমাস এবং ট্রেট্রাস্টিচাস। আমরা গত দুবছরের গবেষণাতে লক্ষ করেছি পূর্ব বর্ধমানের অনেক এলাকার ধান জমিতে মাজরা পোকার ডিমে এরকম বন্ধু পোকা প্রচুর পাওয়া যাচ্ছে। সমস্যা একটাই এইসব বন্ধু পোকাদের খালি চোখে দেখে শনাক্ত করা খুব মুশকিল। তার জন্য অভিজ্ঞ গবেষক বা বিজ্ঞানীর সাহায্য নিতে হবে।
আবার শোষকের ক্ষেত্রেও বেশ কিছু এরকম বন্ধু পোকা আছে যারা সরাসরি শোষক পোকার অপরিণত দশা ও পূর্ণাঙ্গ দশা কে খেয়ে নষ্ট করে দেয়। এরকম একটি বন্ধু পোকার নাম হলো র্কিটোরহিনাস লিভিডিপেনিস। আবার একধরনের বিশেষ মাকড়সা আছে যারা এই বাদামি শোষক পোকাকে খেয়ে ফেলে, যেমন লাইকোসা সিউডোঅ্যানুলোটা। এই বন্ধু পোকা গুলি আকারে বড় হওয়ায় খুব সহজেই এদের খালি চোখে দেখা যায়। সুতরাং এইরকম প্রচুর বন্ধু পোকা কিন্তু ধানের জমিতে বসবাস করে থাকে। আমাদের উচিত এইধরনের পোকামাকড় কে আরো বেশি করে প্রাকৃতিক উপায়ে শত্রু পোকা মারতে ব্যবহার করা। তার জন্য আমাদের চাষী ভাইদের কিছু পদ্ধতি অনুসরণ করা একান্ত ভাবে দরকার।
যেমন ধান জমির আশেপাশে ছোট ছোট ফুল গাছের রোপণ করতে হবে। কারণ বেশ কিছু বন্ধু পোকার পূর্ণাঙ্গ দশা এই সমস্ত ফুল থেকে মধু খেয়ে বেঁচে থাকে। রাসায়নিক সারের বা ওষুধ ব্যাবহার কমাতে হবে। যতটুকু না দিলেই নয় সেই ব্যবস্থা চাষীদের নিতে হবে। একই রাসায়নিক ওষুধ বারবার জমিতে ব্যবহার করা চলবে না। ধান কাটার পর কোনোভাবেই ধানের গোড়া কে পুড়িয়ে ফেলা (নাড়া পোড়ানো) যাবে না। কারণ ওখানে অনেক বন্ধু পোকা আশ্রয় নেয়। সর্বোপরি চাষীদের জৈব চাষের দিকে আগ্রহ বাড়াতে হবে। নইলে কিন্তু আমাদের পরিবেশ আরো কঠিন বিপর্যয়ের মুখে পড়বে। এবং এই ব্যাবস্থা গুলি একটা বৃহত্তর চাষ জমির এলাকা জুড়ে সমস্ত চাষী দের কে সঙ্ঘবদ্ধ ভাবে নিতে হবে।


