ষাটের দশকের চার নেতা, চার ধারা, একটি নিকট মূল্যায়ন

ষাটের দশকের চার নেতা, চার ধারা, একটি নিকট মূল্যায়ন
25 Jun 2023, 03:43 PM

ষাটের দশকের চার নেতা, চার ধারা, একটি নিকট মূল্যায়ন

 

শেখর দত্ত

 

ষাটের দশক আমাদের জাতীয় রাজনীতির সোনালী দশক, যে দশক দেশের স্বাধীনতার জন্য মুক্তিযুদ্ধের ‘ড্রেস রিহার্সেল’ সম্পন্ন করে বিদায় নিয়েছিল; সেই দশকের ছাত্রনেতারা একে একে আমাদের ছেড়ে চলে যাচ্ছেন। জীবিত থাকতে যেমন, তেমনি মৃত্যুর পরও তাঁদের ভূমিকা বিবেচনায় নিয়ে কমবেশি মূল্যায়ন চলছে।

ষাটের দশকের গণজাগরণ ও নেতাদের মূল্যায়ন করতে হলে আওয়ামী লীগ নেতা শেখ মুজিবুর রহমান ও তফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়া এবং কমিউনিস্ট নেতা মণি সিংহ ও খোকা রায়ের গোপনে কয়েকটি আলোচনা বৈঠক ও ছাত্র আন্দোলন বিষয়ে ঐকমত্য হওয়ার বিষয়টি বিবেচনায় রাখতে হবে।

 

উপরোল্লিখিত বৈঠকের সিদ্ধান্ত বাস্তবায়িত করার লক্ষ্য নিয়ে ছাত্র ইউনিয়ন নেতা মোহাম্মদ ফরহাদ এবং ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক শেখ ফজলুল হক মণির তৎপরতায় ৩০ ডিসেম্বর ১৯৬১ ইস্কাটনের এক বাসায় ৩০-৩৫ জন ছাত্র নেতার এক গোপন বৈঠক হয়। সেই বৈঠকই দুই ছাত্র সংগঠনের ঐক্যের ভিত সৃষ্টি করে। ষাটের দশকের গণজাগরনের ইতিহাস এবং নেতাদের মূল্যায়ন করার সময়ে এই ঐতিহাসিক সত্যের প্রতিফলন থাকা জরুরি। যদি তা না করা হয়, তবে ষাটের দশকের ছাত্রনেতাদের প্রতি বাড়তি মূল্যায়েনের পরিবেশ সৃষ্টি হয়।

 

একথা ঐতিহাসিকভাবে সত্য যে, বাষট্টির ছাত্র আন্দোলনে প্রধান চার নেতা ছিলেন ছাত্রলীগের শেখ ফজলুল হক মনি ও সিরাজুল আলম খান এবং ছাত্র ইউনিয়নের মোহাম্মদ ফরহাদ ও কাজী জাফর আহমেদ। মূলত ও প্রধানত এই চারজনই হন পরবর্তীতে স্ব স্ব দল বা ধারার নেতা। মোহাম্মদ ফরহাদ ও কাজী জাফর আহমদ ষাটের দশকের প্রথম ভাগেই রুশ-চীন বিরোধে জড়িয়ে পড়লে দুজনের দুই দল-মত পথ হয়ে যায়। অপরদিকে স্বাধীনতার পর পরই শেখ ফজলুল হক মনি ও সিরাজুল আলম খানের দল-মত-পথ আলাদা হয়।

 

এই চার নেতার মধ্যে শেখ ফজলুল হক মনির জীবন ছিল সবচেয়ে সংক্ষিপ্ত। ষাটের দশকেই বার কয়েক গ্রেফতার এবং বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ভাগ্নে হিসেবে তিনি অবস্থানের দিক থেকে ছিলেন আওয়ামী লীগের ছাত্র-যুবক সকলের সামনে। মুক্তিযুদ্ধের সময় তিনি প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারের সঙ্গে বিরোধে জড়িয়ে পড়েন। তাঁকে মুজিব বাহিনীর ‘প্রধান সেনাপতি’ হিসাবে আখ্যায়িত করা হয়।

 

স্বাধীনতার পর তিনি কোনো সরকারি পদে তিনি অধিষ্ঠিত হন নাই। তবে ক্ষমতাসীন দলের ‘ইনকাবেন্সী ফ্যাক্টর’-এ জড়িয়ে পড়েন। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব-তাজউদ্দিন জুটি ভাঙ্গার পিছনে হাত রয়েছে বলেও তিনি সমালোচিত হন। সমালোচনা সত্ত্বেও তাঁর নাম দেশের রাজনীতির ইতিহাসে জাতীয় বীর ও শহীদ হিসেবে অমোচনীয় কালিতে লিপিবদ্ধ থাকবে।

 

অবিভক্ত ছাত্র ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক (১৯৬২-৬৩) কাজী জাফর আহমেদ অনলবর্ষী বক্তা হিসেবে বাষট্টির ছাত্র আন্দোলন গড়ে তুলতে বলিষ্ট ভূমিকা পালন করেন। দল ভাঙন আর নতুন দল গড়ার মধ্যেই তিনি সারা জীবন কাটান। মুক্তিযুদ্ধের সময় তিনি ‘বাংলাদেশ জাতীয় মুক্তি সংগ্রাম সমন্বয় কমিটি’ গঠন করে বাংলাদেশ সরকারের প্যারালাল শক্তি গড়ে তুলতে উদ্যোগী হন।

 

বঙ্গবন্ধুর আমলে যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশে ‘চাটারদল’র দুর্নীতি ও ‘রাতের বাহিনী’র গোপন উগ্র সন্ত্রাসী তৎপরতার মধ্যে সরকারবিরোধী অবস্থান নিয়ে তিনি শ্রমিকাঞ্চলে মিল ঘোরাও আন্দোলনে নেতৃত্ব দেন। ‘রাতের বাহিনী’র প্রতিও সহানভূতিশীল থাকেন।  সামরিক শাসক জিয়ার জাতীয়তাবাদী ফ্রন্টের অংশী হিসেবে ইউপিপি দল থেকে তিনি মন্ত্রী হন।

 

সেনাশাসক এরশাদ আমলে তিনি জাতীয় পার্টিতে যোগ দিয়ে তিনি এমপি, মন্ত্রী, উপপ্রধানমন্ত্রী ও রাষ্ট্রপতির রাজনৈতিক উপদেষ্টা এবং সবশেষে দেশের ৮ম প্রধানমন্ত্রী হন। মন্ত্রী বিশেষত বাণিজ্য মন্ত্রণায়লয়ের মন্ত্রী হিসেবে চিনি কেলেংকারীতে জড়িয়ে পড়ে তিনি দুর্নাম কামান। ‘ডান-বাম দুই চরম প্রান্ত এক বিন্দুতে মিলিত হয়’ অর্থাৎ মাসতুতভাই মামার বাড়িতে মিলিত হয়, এই প্রবাদ বাক্যকে তিনি সত্যে পরিণত করেন। জাতীয় মূলধারা আন্দোলনের তীব্র বিরোধী, এবং সামরিক স্বৈরশাসকদের সহযোগী হিসাবে তিনি ইতিহাসের কষাঘাতে সমালোচিত হবেন।

 

বাষট্টির আইয়ুববিরোধী আন্দোলনের ‘মস্তিস্ক’ হিসেবে মোহাম্মদ ফরহাদ রাজনীতির জীবনের শুরুতেই নন্দিত হন। তিনি ন্যাপ-কমিউনিস্ট পার্টি-ছাত্র ইউনিয়নের গেরিলা বাহিনীর প্রধান ছিলেন। মৃত্যুকালে তিনি জাতীয় মূলধারা আন্দোলনের অগ্রণী নেতা হিসেবে রাজনৈতিক অঙ্গনের মধ্য গগনে ছিলেন। স্বল্প সময়ের রাজনৈতিক জীবনে কৌশল গ্রহণ নিয়ে তিনি কোনো কোনো সময়ে জাতীয় পর্যায়ে সমালোচিত বা বিতর্কিত হলেও লক্ষ্যের প্রতি ছিলেন অবিচল। সমাজতন্ত্র-ধনতন্ত্র ঠা-া যুদ্ধ ও জাতীয় মুক্তিসংগ্রাম উত্থান যুগে তিনি জাতীয় রাজনীতির যথার্থ আন্দোলক-সংগঠক ছিলেন।

 

স্বাধীনতার পর কমিউনিস্ট পার্টি প্রকাশ্য হলে তাঁর প্রভাবিত সাবেক ছাত্রনেতারা ন্যাপ ও কমিউনিস্ট পার্টি-এই দুই দলে বিভক্ত হয়ে যায়। শেষ পর্যন্ত তিনি তাঁর প্রভাবিত বলয়কে ঐক্যবদ্ধ রাখতে সক্ষম হয়নি। নিজ দলের নেতৃত্ব পর্যায়েও সমালোচিত হয়েছিলেন। ইতিহাসের কষ্টিপাথরে তাঁর রাজনৈতিক কৌশলের সবচেয়ে সমালোচিত হওয়ার ইস্যুটি হলো, জিয়া আমলে হাঁ-না ভোটে অংশগ্রহণ ও খালকাটা।

 

‘ঐক্য ও সংগ্রামের’ নীতি-কৌশল নিয়ে জাতীয় মূলধারার প্রধান দল আওয়ামী লীগের সঙ্গে ঐক্যবদ্ধ আন্দোলন গড়ে তোলার ক্ষেত্রে তিনি যে দক্ষতা-দৃঢ়তা দেখিয়েছেন, সেটা তখনকার বাম-কমিউনিস্ট আন্দোলনকে গৌরবান্বিত করছে এবং এই অবদানের জন্য ইতিহাস তাঁকে স্মরণে রাখবে। নৌকা নিয়ে নির্বাচন করার প্রশ্নে দৃঢ়তা প্রদর্শন করে তিনি বাম-কমিউনিস্টদের জাতীয় রাজনীতির সুউচ্চ পর্যায় সংসদে নিয়ে গিয়েছিলেন।

 

জাতীয় সংসদে তিনি যে ভূমিকা রাখেন এবং ভাষণ দেন তা দেশের সংসদীয় গণতন্ত্রের ইতিহাসের অমূল্য সম্পদ। অতি বাম ও ডান-প্রতিক্রিয়াশীদের তিনি ছিলেন চক্ষুশূল। তাই একদিকে ‘বি-টিম’ আর অন্যদিকে ‘আফগান স্টাইল বিপ্লব’ নিয়ে তাঁকে ঘায়েল করার চেষ্টা করা হয়েছে। তবে মানুষ তো আর শেওড়া গাছে ঢিল মারে না, মারে আম গাছে। দেশের রাজনীতির ইতিহাসে মোহাম্মদ ফরহাদ জাতীয় বীরের মর্যাদা নিয়ে অমোচনীয় কালিতে লিপিবদ্ধ থাকবেন।

 

‘রাজনীতির রহস্য পুরুষ’, ‘প্রতি নায়ক’, ‘সাত নভেম্বর সিপাহী বিদ্রোহের নেপথ্য নায়ক’ প্রভৃতি অবিধায় সুপরিচিত ছাত্রলীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক সিরাজুল আলম খান। মৃত্যুর আগে যেমন তেমনি মৃত্যুর পরও তাঁকে নিয়ে পক্ষে-বিপক্ষে নানাভাবে বিতর্ক হচ্ছে। তাঁর মৃত্যুর পর রাষ্ট্রপতি শাহাবুদ্দিন শোক বিবৃতি দিলেও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবং তিনি যে রাজনৈতিক দলের সঙ্গে যুক্ত হয়ে রাজনীতি করে লাইম লাইটে আসেন, সেই দল শোক বিবৃতি না দেওয়ায় তিনি বিতর্কিত এক রাজনীতিক হিসেবেই ইতিহাসে স্থান করে নেবেন।

 

বাষট্টির আন্দোলনে সিরাজুল আলম খান ছাত্রলীগের মূল নেতৃত্বে ছিলেন না। তবে তাতে যথোপযুক্ত ভূমিকা রেখে তিনি ১৯৬৩-৬৫ সালে ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক হন। অন্য সব ছাত্রনেতারা ছাত্র রাজনীতি শেষ করে হল ত্যাগ করলেও মুক্তিযুদ্ধ শুরু হওয়ার পূর্ব পর্যন্ত তিনি তৎকালিন ইকবাল হলে থেকে যান। ছাত্রলীগকে দেশব্যাপী সংগঠিত করতে তিনি দিনরাত পরিশ্রম করতেন। কখন কোথায় খেতেন, ঘুমাতেন; তাও ছিল রহস্যময়। নিজ অভিজ্ঞতা থেকে বলতে পারি, অন্য দল করলেও তাঁর ব্যবহার ছিল মধুর ও অমায়িক।

 

ছাত্রলীগ-ছাত্র ইউনিয়ন ঐক্য তখন বজায় থাকলেও পরস্পরের প্রতিদ্বন্দ্বি ছিলো। তাই ছাত্র নেতৃত্বে বা ছাত্র না থাকা অবস্থায় হলে থেকে মূলে ভূমিকা পালন করায় আমরা তাঁকে সহ্য করতে পারতাম না। ‘কাপালিক’, ‘দাড়িয়া সিরাজ’ (পাঠকরা মাপ করবেন) প্রভৃতি অবিধা দিয়ে তাঁকে নিয়ে নানা খোসগল্প নিজেদের মধ্যে করতাম। আজ সুদীর্ঘ বছর পর এমনটাও ভাবি যে, সরাসরি থেকে ছাত্রলীগকে গড়ে তুলতে, আন্দোলনকে সর্বোচ্চ পর্যায়ে নিতে তিনি কতটাই না আত্মত্যাগ করেছেন।

 

এটা ঐতিহাসিক সত্য যে, ষাটের দশকে গোপনে  তিনি ছাত্রদের মধ্যে স্বাধীন বাংলা প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে নিউক্লিয়াস ‘স্বাধীন বাংলা বিপ্লবী পরিষদ’ গঠনে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন। তখন স্বাধীনতার লক্ষ্যে কেবল এই গ্রুপই কাজ করে নাই। ইনার গ্রুপ বিএলও ছাড়াও তখন ইস্ট বেঙ্গল লিবরেশন পার্টি, বেঙ্গল লিবারেশন পার্টি, বেঙ্গল লিবারেশন আর্মি, বঙ্গবাহিনী অপূর্ব (অস্থায়ী পূর্ববঙ্গ সরকার) সংসদ বিচ্ছিন্নভাবে ক্ষুদ্র পরিসরে কাজ চালিয়ে যাচ্ছিল।

 

আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার অভিযোগ থেকে জানা যায়, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবও (গোপন নাম পরশ) এসব আন্দোলনের সঙ্গে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে জড়িত ছিলেন। বঙ্গবন্ধু আগরতলা গিয়েছিলেন। লক্ষ্য করার মতো বিষয় হলো এই যাত্রায় ছাত্রলীগের কেউ নন, ছাত্র ইউনিয়নের দুই নেতা মোহাম্মদ ফরহাদের আস্থাভাজন ও সহযোগী রেজা আলী ও মোর্তুজা খান সঙ্গী হন। আমাদের স্বাধীনতার উৎসমুখের ইতিহাস বৈচিত্রময়, তাই নিউক্লিয়াসকে এককভাবে গৌরবান্বিত করার কোনো সুযোগ নেই। তবে ষাটের দশকে বঙ্গবন্ধুর অন্যতম সহযোগী হিসেবে ছাত্র-যুবকদের সংগঠিত ও উদ্দীপ্ত করতে সিরাজুল আলম খানের ভূমিকা ছিল অসামান্য।

 

মুক্তিযুদ্ধের সময় মুজিব বাহিনীর দ্বিতীয় নেতা ছিলেন সিরাজুল আলম খান। তাঁর রাজনৈতিক জীবনের সবচেয়ে ক্ষতিকর ও সমালোচিত দিক হলো, বঙ্গবন্ধু যখন বাম অবস্থান নিয়ে ‘গণতন্ত্রের পথে সমাজতন্ত্র’র কর্মসূচি দিয়ে অগ্রসর হতে চাইছেন, তখন ‘বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রে’র শ্লোগান তুলে ছাত্র-যুবক বড় ও বাম মিলিট্রান্ট অংশকে আওয়ামী লীগ থেকে সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন, উগ্রভাবে তীব্র বিরোধী করা। এমনটাও বলা হয়ে থাকে, সমস্যা জর্জরিত দেশের বিক্ষুব্ধ বামমুখী তরুণদের বিভ্রান্ত এবং তখনকার বাস্তবতায় বাম-কমিউনিস্টদের দিকে ঝুকে পড়তে না পারে, সেজন্য তিনি জাসদ নামে দল গঠন করেছিলেন।

 

আরো লক্ষ্য করার মতো বিষয় হচ্ছে, বঙ্গবন্ধুর আমলেই তিনি গণতান্ত্রিক অধিকার চালু থাকা অবস্থায় সশস্ত্র গণবাহিনী গঠন করেন। যা তখনকার বাস্তবতায় অনিয়মতান্ত্রিক ও ষড়যন্ত্রমূলক বিবেচিত হতে বাধ্য। সরকার ও শাসক দলের ‘চাটার দল’ ও উগ্রবাম ‘রাতের বাহিনীর’ অপতৎপরতার মধ্যে জাসদের উগ্র বাম রাজনীতি সপরিবারে বঙ্গবন্ধু-হত্যার পটভূমি রচনা করে। দেশ পড়ে হত্যা-ক্যু-পাল্টা ক্যু ও প্রত্যক্ষ-পরোক্ষ সামরিক শাসনের মধ্যে রাজনীতির ঘোরপ্যাচে।

 

পঁচাত্তরের হত্যা-ক্যুয়ের রাজনীতির সমালোচনা তিনি করেন নাই। বরং তাঁর সহযোগী গণবাহিনীর নেতা তাহের পনেরোই আগস্ট রক্তাক্ত সকালে স্বঘোষিত খুনিদের সঙ্গে দেখা করেছিলেন। এমনকি তিনি উচ্চাভিলাষী সেনাপ্রধান জিয়ার ঘাড়ে চেপে তথাকথিত ‘বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্র’র বিপ্লব করতে চেয়েছিলেন। ভারতীয় হাইকমিশনার সমর সেনকে জিম্মি করার প্রচেষ্টা ছিল বিস্ময়কর। এসবই কল্পস্বর্গ এবং বাল্যখিল্যতারই নামান্তর; ষড়যন্ত্র বললেও ভুল হবে না। বিপ্লবী বুলি ও কাজের ভেতর দিয়ে তিনি দেশের কোনো লাভ এনে দিতে পারে নাই, বরং জাতীয় চারনীতি সম্বলিত মুক্তিযুদ্ধের মর্মবাণী দেশ থেকে নির্বাসিত হয়েছে।

 

জাসদের সাবেক সহযোদ্ধাদের কেউ কেউ মনে করতেই পারেন যে, বঙ্গবন্ধু হলেন ‘নায়ক’ আর সিরাজুল আলম খান হচ্ছেন ‘বিদ্রোহী নায়ক’, ‘বিকল্প নায়ক’ বা ‘প্রতি নায়ক’। ছাত্রলীগে তিনি বিদ্রোহ ঘটাতে সক্ষম হয়েছিলেন। কিন্তু আওয়ামী লীগে ভাঙন ধরাতে সক্ষম হননি। বঙ্গবন্ধু সরকারকে চ্যালেঞ্জ জানিয়ে কিছু করার মতো ক্ষমতা তাঁর বা দলের ছিল না। জনগণ কেউ মনে করেনি তিনি বিকল্প নায়ক বা প্রতি নায়ক।

 

জাতীয় রাজনীতি বিচারে তিনি তা ছিলেন না। লক্ষ্য করার মতো বিষয় হলো, তাঁর প্রকাশ্য ও গোপন দল বাম দিক থেকে বঙ্গবন্ধুর বাম সরকারকে করেছে আঘাত আর ক্ষমতা দখল করেছে ডান-প্রতিক্রিয়াশীল পাকপন্থীরা। জাতির অবিসংবাদিত নেতা হিসেবে বঙ্গবন্ধু ছিলেন মহানায়ক। মুক্তিযুদ্ধের সময়ে নেতৃত্বদানকারী জাতীয় চার নেতা, উপদেষ্টা পরিষদের সদস্যরা ছিলেন মহানায়কের সহযোগী হিসেবে ঘটনাপ্রবাহের নায়ক।

 

ইতিহাস অবদান রয়েছে এমন কাউকে যেমন মুছে ফেলে না, তেমনি ক্ষমাও করে না। জাতীয় বীরদের যোগ্য সম্মান ও মর্যাদা দেওয়াই ইতিহাসের কাজ। যত দিন অতিক্রান্ত হবে, ইতিহাস ততই জাতীয় বীর যিনি যতটুকু অবদান রেখেছেন, তা উর্ধে তুলে ধরবে আর যিনি যতটুকু ক্ষতি করেছেন তার সমালোচনায় মুখর হবে এবং তাঁদের সেইসব কর্মকান্ডকে আস্তাকূড়ে নিক্ষেপ করবে।

 

লেখক: বাংলাদেশের প্রগতিশীল ও স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলনের একজন অন্যতম সংগঠক ।

Mailing List