বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময় চার লক্ষ নারী ধর্ষিতা হয়েছিল! নারীপাচার যুগে যুগে: পর্ব- ২০ লিখছেন সুখেন্দু হীরা

বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময় চার লক্ষ নারী ধর্ষিতা হয়েছিল! নারীপাচার যুগে যুগে: পর্ব- ২০ লিখছেন সুখেন্দু হীরা
19 Nov 2023, 09:45 AM

বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময় চার লক্ষ নারী ধর্ষিতা হয়েছিল! নারীপাচার যুগে যুগে: পর্ব- ২০ লিখছেন সুখেন্দু হীরা

 

সুখেন্দু হীরা

 

          

পুরুষতান্ত্রিক সমাজে মেয়েদের সম্মানের একমাত্র মাপকাঠি হল যৌন শুদ্ধতা। আর এই সম্মান-এর সঙ্গে তাঁর পরিবারের এবং তাঁর সম্প্রদায়ের সম্মানও জড়িয়ে থাকে। নারীর যৌন আবেদন তাকে অন্যের কাছে যতই কাঙ্ক্ষিত, জনপ্রিয়, পরিচিত করুক না কেন, তাঁর এই যৌন আবেদন তাঁর নিজের কাছেই একটি হুমকি। কারণ তাঁর যৌন আবেদনের জন্য তাকে যৌন আঘাত পেতে হয় এবং যা তাঁর সম্মানহানি ঘটায়। এই কারণে যখন যুদ্ধ বা সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা বাঁধে তখন সহজ লক্ষ্য হয় নারীরা।

 

উপরিউক্ত বক্তব্যের জ্বলন্ত উদাহরণ দেখেছি আমাদের দেশভাগের সময় এবং বিভিন্ন জাতিদাঙ্গাতে। কিন্তু দুঃখের বিষয় এই যে, যেসব মহিলারা এই ঘটনার শিকার  হয়েছিলেন, তাঁদের সমাজ ব্রাত্য করে দিয়েছিল। শুধু তাই নয়, হয় তাঁদের আত্মহত্যা করতে হয়েছিল, নয়তো পতিতাবৃত্তিকে বেছে নিয়েছিল। উদাহরণ স্বরূপ বলা যায় ১৯৭১ খ্রিস্টাব্দে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ঘটনাকে।

 

বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময় চার লক্ষ নারী ধর্ষিতা হয়েছিল। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর এইসব নারীদের নিয়ে বিপাকে পড়ে তাঁদের পরিবারগুলি। এমনকী বিবাহিত নারীদের মধ্যে অনেককেই তাঁদের স্বামীরা গ্রহণ করতে চায়নি। আরও আশ্চর্যের ব্যপার হল, এই স্বামীদের মধ্যে অনেকেই ছিলেন আবার মুক্তিযোদ্ধা। স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিবর রহমান এইসব ধর্ষিতা নারীদের ‘বীরাঙ্গনা’ উপাধি দেন। উল্টে এই ‘বীরাঙ্গনা’ উপাধিটি সামাজিক ভাবে নেতিবাচক হয়ে গিয়েছিল। এইসব নারীরা সম্মানের বদলে পেয়েছিলেন কটূক্তি, বঞ্চনা ও গঞ্জনা।

 

 যুদ্ধে বা দাঙ্গায় নারীরা সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হন। তাঁরা হয়তো বেশি সংখ্যায় নিহত হন না, কিন্তু স্বামীহারা, পুত্রহারা, অভিভাবকহীন হয়ে অসহায় হয়ে পড়েন। এই অসহায়তার সুযোগ অনেকেই নেয়। যেমন মুক্তিযুদ্ধের সময়ে পশ্চিমবঙ্গে বিভিন্ন জায়গায় উদ্বাস্তু শিবির হয়েছিল। এইসব জায়গায় ঘুরে বেড়াত নারী পাচারকারী দালালদের দল। তারা উদ্বাস্তু শিবিরে ক্ষুধার্ত, অসহায় মহিলাদের ফুঁসলিয়ে, মিথ্যা প্রলোভন দিয়ে বিক্রি করে দিত ভারতের নানা পতিতালয় গুলিতে।

 

যুদ্ধের সময় বিভিন্ন দেশে পরাজিত দেশের নারীদের সেনাবাহিনীর ভোগে লাগানো অতি প্রাচীন প্রথা। সুন্দরী ও সম্ভ্রান্ত মহিলাদের অফিসারদের জন্য রেখে বাকিদের সৈন্যদের মাঝে ভাগ করে দেওয়া হয় বা হত। এইসব মেয়েদের বলা হত ‘কমফোর্ট লেডিজ'। রাষ্ট্র সব জেনেশুনেও সৈন্যদের মনোরঞ্জনের জন্য এই ‘অমানবিক প্রথা’ দেখেও দেখেনা।

 

 শুধু তাই নয়, দেশে যুদ্ধ বাঁধলে জমায়েত করা সেনাদের জন্য গণিকাদের পর্যাপ্ত সরবরাহ রাখা হয় বা হত। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পর্যন্ত উত্তর কলকাতায় বিভিন্ন এলাকাতেই সীমাবদ্ধ ছিল গণিকাপল্লী। যেমন সোনাগাছি, রামবাগান, শেঠবাগান, গরাণহাট, চুনাগলি প্রভৃতি। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় শহরে বিদেশি সেনাদের পদার্পণ ঘটে। তাঁদের আরামের জন্য হাড়কাটা গলি, ধুকুরিয়া বাগান, তালতলা, ফ্রি স্কুল স্ট্রিট প্রভূতি জায়গায় গণিকাপল্লী ছড়িয়ে পড়ে। 

 

একদা জমিদার, রাজারা নিজস্ব বাহিনী পাঠিয়ে মেয়েদের তুলে নিয়ে আসত ভোগ করার‌ জন্য। সেই ব্যবস্থাপনা সরাসরি না থাকলেও যুদ্ধ, দাঙ্গা বা রাষ্ট্রের অরাজকতার সময় রাষ্ট্রনেতাদের প্রচ্ছন্ন মদতে সেগুলি এরকমই ভাবে টিকে আছে।

 

রাষ্ট্রীয় অরাজকতায় সবদিনই ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে মহিলারা। অথচ এর জন্য তাঁরা কদাচিৎ দায়ী ছিলেন। সবচেয়ে দুখের কথা রাস্ট্রে স্থিরতা ফিরলে রাষ্ট্র তাদের অবহেলা করে। রাষ্ট্র তথা সমাজের এই অমানবিক ব্যবহার নারীপাচার সুলভ করেছে।

 

তথ্য ঋণ:

১) উদ্বাস্তু নিপীড়নের কেন্দ্রে নারীর যৌনাঙ্গ: ভারত - পাক বিভাজন ১৯৪৭ - দোয়েল দে (গাঙচিল পত্রিকা: শরণার্থী, জুলাই ২০১৭)

২) কলকাতায় বিচিত্র পেশা: রঞ্জন সেন/ কৃষ্ণপ্রিয় দাশগুপ্ত (ধানসিঁড়ি)।

৩) গণিকা দর্শন: অনির্বাণ বন্দ্যোপাধ্যায় (লিইবার ফিয়েরা)

Mailing List