ভয়, হ্যাঁ মৃত্যুভয়

ভয়, হ্যাঁ মৃত্যুভয়
24 Mar 2020, 10:18 AM

ভয়, হ্যাঁ মৃত্যুভয়

সুমন ঘোষ

হঠাৎ বুকে চাপ লাগতে শুরু করল। শ্বাস নিতে যেন কষ্ট হচ্ছে। দু’বার একটু জোরে শ্বাস নিয়ে দেখলাম। হাত দুটো কী অবশ হয়ে আসছে। মনে হচ্ছে শক্তি হারাচ্ছি যেন!

একটু জানালার ধারে গেলাম। ফাগুনের আকাশেও এক ঝলক ঠান্ডা বাতাস। একটু মনটা ভালো লাগল। কপালে হাত ঠেকালাম। জ্বর জ্বর মনে হচ্ছে কী? কৈ না তো। মন একটু নিশ্চিন্ত হল।

আচ্ছা, আমার এই শ্বাসকষ্ট হওয়ার বিষয়টা কেউ দেখে ফেলেনি তো। স্ত্রী, পুত্র বা পাশের বাড়ির কেউ। কেউ কী মুখ টিপে হাসল। কেউ যদি পুলিশে খবর দিয়ে দেয়। অমনি পুলিশ এসে তুলে নিয়ে যায়। পুলিশ গারদে রাখবে না। স্বাস্থ্য কেন্দ্রে নিয়ে যাবে। তবু.....। হ্যাঁ, তবু এত ভয়। ছেলেটার কী হবে। বৌয়ের।

 ভাবতে ভাবতে কখন পৌঁছে গিয়েছি কলকাতা। বাসে, ট্রেনে যাদের সঙ্গে গিয়েছি, সবাই তো ভালোই আছে। যাদের সঙ্গে কাজ করেছি? তাঁরাও বহাল তবিয়তে। তবু কেন এত ভয়? যদি আলাদা কোনও সূত্র কাজ করে। কে জানে চায়ের দোকানে চা খাওয়ার সময় কোনও করোনা আক্রান্ত এসেছিল কিনা। সেও তো তখন জানত না, সে আক্রান্ত। আবার বুকে চাপ লাগতে শুরু করে। না, বারো হাত বাই দশ হাত ঘরটাও কী ছোট হয়ে গেল। এত কম অক্সিজেন। না, একবার অন্তত বেরোনো দরকার। অনেক, অনেক অক্সিজেন চাই। হুড়মুড়িয়ে বাড়ি থেকে বেরিয়ে পড়লাম। কিন্তু কোথায় যাব? সবাই তো ভয়ে ঘরেই। আমিও ঘর থেকে এতক্ষণ বেরোয়নি। এক বন্ধুকে ফোন করলাম। সেও জানাল, ঘরেই থাকতে। সঙ্গে পরামর্শ, ঘুরে বেড়ানো অভ্যেস তো। তাই প্রথম দু’একদিন এমন হবে। তারপর ঠিক হয়ে যাবে। কিন্তু ঘর থেকে বেরোনো যাবে না। তাতে ক্ষতিই বেশি। শুধু নিজের নয়। সকলের।

ফলে আবার ঢুকে পড়লাম ঘরে। ঘরে বসেই চারদিকের খবর পাচ্ছি। ইতালি, চীন, পাকিস্তান…। ভারত তো বটেই। পশ্চিমবঙ্গেও যে বাড়ছে। এলিট শ্রেণির হাত ধরে আসা এই মারণ আর কত দূর এগোতে পারে। না, ভাবতে পারছি না। নানা মৃত্যু ভয় শুনেছি। তবে সে সবই অন্যের কাহিনী। বই ওল্টাতে গিয়ে দেখেছি, কোন কোন দেশে কোন সালে মহামারি হয়েছিল। মিলিয়ন মিলিয়ন মানুষের মৃত্যু মিছিল। কিন্তু নিজেকে কখনও এমন মৃত্যু ভয়ের মধ্যে দিয়ে যেতে হয়নি। শুধু নিজে কেন, ইদানিং কালে আমার আশপাশে থাকা মানুষ, সমাজ বা রাজ্যকেই কী যেতে হয়েছে? কিছু রাজনৈতিক ইস্যু নিয়ে নানা সময়ে নানা কথা শোনা গিয়েছে, এই পর্যন্তই। কিন্তু এক করোনা যে সকলকে রাজনৈতিক, সামাজিক মঞ্চ ছাড়িয়ে ঘরে ঢুকিয়ে দেবে, তা দেখিনি। ভাবতে ভাবতে হঠাৎ ঘুমের দেশে চলে যায়। সকালে উঠে দেখি, না ঠিকই আছি। আর বুকে চাপ নেই। শ্বাস নিতেও কষ্ট হয়নি। জানালা দিয়ে বাইরে তাকাতেই দেখি, সূর্যটা আগের মতোই উঠেছে।

কিন্তু কোথাও যেন শৃঙ্খলাটা ভাঙছে। এখনও কিছু মানুষ রাস্তায় ঘুরে বেড়াচ্ছে। জানি না, সত্যিই তাদের কতটা জরুরি প্রয়োজন। কষ্ট হলেও এই ক’দিন যে বুকে হাত চেপে ঘরের মধ্যেই কাটানো ভালো। নতুবা যে ভয়টা মনে ঢুকছে, সেটা বাস্তবে নিজের সামনে হাজির করবেন স্বয়ং যমদূত। তখন শুধু নিজে নয়, সবাইকে পুড়িয়ে মারবে সেই আগুনে। এই ভাবনাটা এখনও অনেকের মধ্যে কেন যে আসেনি, তা কিছুতেই বোধগম্য হচ্ছে না।

Mailing List