‘ফলসা’ পশ্চিমবঙ্গের একটি অপ্রচলিত ফল, ক্লান্তি দূর করা থেকে হিট স্ট্রোক থেকে মুক্তি – বহু গুণের সমাহার

‘ফলসা’ পশ্চিমবঙ্গের একটি অপ্রচলিত ফল, ক্লান্তি দূর করা থেকে হিট স্ট্রোক থেকে মুক্তি – বহু গুণের সমাহার
21 May 2023, 11:29 AM

‘ফলসা’ পশ্চিমবঙ্গের একটি অপ্রচলিত ফল, ক্লান্তি দূর করা থেকে হিট স্ট্রোক থেকে মুক্তি – বহু গুণের সমাহার

 

ড. সমরেন্দ্র নাথ খাঁড়া

 

ফলসা পশ্চিমবঙ্গের একটি অপ্রচলিত ফল। এটি প্রধানত দক্ষিণ এশিয়ার ফল। পাকিস্তান থেকে কম্বোডিয়া পর্যন্ত এর দেখা মেলে। অন্যান্য ক্রান্তীয় অঞ্চলেও এর ব্যাপক চাষ হয়। ভারতীয় উপমহাদেশে এই ফলসা পাওয়া যায়। ফলসা ছোট ফল হলেও এটি ভারতের নিজস্ব ফল। কিন্তু নামটা বিদেশি। ফলটি দেখতে খুব আকর্ষণীয় না হলেও ভেষজ গুণে পরিপূর্ণ। খ্রীষ্টপূর্ব প্রাচীন গ্রন্থ সংহিতায় এর পরিচয় পরুষক নামে পাওয়া যায়। ভেষজ গুণের কথা পাওয়া যায় নানা। সেই সূত্র ধরে পরবর্তী সময়ে চরক, সুশ্রত, বাগভট্ট প্রভৃতি গ্রন্থকারগণ বিভিন্ন রোগের ওপর পরীক্ষা নিরীক্ষা করে ফলসার ভেষজ গুণের বহু নতুন তথ্যের উল্লেখ করেছেন ঐসব গ্রন্থে।উদ্যান বিজ্ঞানীদের তথ্যানুযায়ী ফলসার আদি জন্মভূমি এই ভারতবর্ষ।

পরিচিতি ও নামকরণ:

      ফলসা শব্দটি উর্দু ভাষা থেকে এসেছে। বাংলা, হিন্দি, মারাঠি সহ পৃথিবীর বহু ভাষাতে এটি ফলসা নামেই পরিচিত। তবে ফলসা ফলের আঞ্চলিক নাম হলো - পেলা গোটা, ফেলা গোটা, টকরোই। পুরুলিয়ার কিছু জায়গায় একে ভুরসা পাকা বলে। ইংরেজি নাম-  Phalsa, Sherbet Berry, Gromia.সংস্কৃত নাম- মৃদুফল, পরুষক। সংস্কৃত ও বাংলা নাম ফলসা।

বৈজ্ঞানিক নাম- Grewia asiatica.সমনাম- Grewia subinaequalis.Tiliaceae পরিবারভুক্ত।

 চাষের এলাকা :- পূর্ব এশিয়ার বিভিন্ন দেশে ফলসার গাছ জন্মাতে দেখা যায়। এছাড়া পাকিস্তান, আরব প্রভৃতি দেশেও এটি হতে দেখা যায়। ভারতের পাঞ্জাব, হরিয়ানা, রাজস্থান, উত্তরপ্রদেশ, মহারাষ্ট্র, মালাবার, উড়িষ্যা প্রভৃতি এলাকায় ফলসা গাছ পাওয়া যায়। হিমালয়ের পাদদেশে জংলী জাতের ফলসা পাওয়া যায়।

 সারা বিশ্বে ফলসার প্রায় ৬০ টি প্রজাতি পাওয়া যায়। ভারতে পাওয়া যায় প্রায় ৩৬টি প্রজাতি৷ ডলম্বনের মতে ফলটি বৃক্ষজাতীয় গাছে হয়। আবার বহু শাখা যুক্ত শক্ত অথচ লতা আকৃতির কাণ্ডে জন্মায়।আরবের ফলসা গাছ অর্ধ লতার মতো। প্রচুর ফল হয় এবং ভারতীয় ফল অপেক্ষা বড় হয়।

 

কবির ভাষায় -

"ফলসা বনে গাছে গাছে

 ফল ধরে মেঘ ঘনিয়ে আছে।"

গাছের ধরন :

  ফলসা গাছ 'গুল্ম' বা ছোট 'বৃক্ষ', যা আট মিটার পর্যন্ত লম্বা হয়।এর ফুল হলুদ,গুচ্ছাকারে থাকে। ফলসা ফল ড্রুপ জাতীয়, ৫-১২ মিলিমিটার ব্যাস বিশিষ্ট, পাকলে কালো বা গাঢ় বেগুনি রঙের হয়। ফলসা মাঝারি আকৃতির পাতাঝরা গাছ।এগাছ সাধারণত ৫ থেকে ৭ মিটার পর্যন্ত উঁচু হতে পারে।পাতা খসখসে,রোমশ ও কিনারা খাঁজকাটা।হালকা হলদে রঙের ক্ষুদ্রাকৃতির ফুল ফোটে মার্চ-এপ্রিলে। আর ফল পাকতে শুরু করে মে-জুন মাসের দিকে।ফল দেখতে অনেকটা মটর দানার মতো, গোলাকার। ফলের কাঁচা রং সবুজ,তখন স্বাদে টক।পাকা ফলের রং কালচে বাদামি, তখন স্বাদ টক-মিষ্টি ধরনের।মার্চ-এপ্রিল মাসে হালকা হলদে রঙের ছোট ছোট ফুল ধরে গাছে। এরপর ফল মে-জুন মাসে পাকে।কাঁচা অবস্থায় সবুজ রঙের হলেও পাকার পর কালচে বাদামি রঙ ধারণ করে।খেতেও হয় টক মিষ্টি স্বাদের।

উপকারিতা:

   কিন্তু খুব কম মানুষই এই ফলসার উপকারিতা সম্পর্কে জানেন। ছোট্ট ফলটি পুষ্টিতে ভরপুর।স্কোয়াশ ও অন্য নরম পানীয় তৈরিতেও কাজে লাগে। প্রতি ১০০০ গ্রাম ফল থেকে ৭২৪ ক্যালরি শক্তি পাওয়া যায়। মায়ানমারে এ গাছের বাকল সাবানের বিকল্প হিসেবে ব্যবহৃত হয়। তাছাড়া বাকলের আঠাল উপাদান খাদ্যদ্রব্য শোধনেও কাজে লাগে।ভারতীয় বৈদ্যকগণের মতে -

কাঁচা ফলসার রস:- গা কামড়ানী, মাথাধরা, সর্দি, গেঁটে বাত প্রভৃতি রোগের পক্ষে ফলসা অত্যন্ত উপকারী।

পাকা ফলের রসঃ- শোথের জন্য বা অন্য কোন কারণে প্রস্রাব কম হওয়া, ঋতুক্ষরণ,গ্রন্থিবাত, হৃদ দুর্বল্যে, অজীর্ণ, পিত্তজ্বর, পিপাসা, বমি প্রভৃতি রোগের মহৌষধ।

 

ক্লান্তি দূর করতে সাহায্য করে:

অত্যধিক গরমে, প্রখর রোদে ফলসার রস ক্লান্তি দূর করতে সাহায্য করে। এই কারণে ফলসা স্কোয়াশ জাতীয় অন্যান্য পানীয়তে ব্যবহার করা হয়।

হিট স্ট্রোক:

 হিট স্ট্রোক হলে এই ফলের রস খুব ভালো কাজ করে।

গরমে শরীরকে ঠান্ডা রাখতে সাহায্য করে ফলসা:  বিশেষজ্ঞদের মতে, গরমে ফলসার রস খেলে শরীরে জলশূন্যতার সমস্যার হাত থেকে রক্ষা পাওয়া যায়।প্রচণ্ড গরমে ফলসার গুণে ডিহাইড্রেশনের সমস্যা থেকে সহজেই মুক্তি পাবেন।এই ফল শরীরে জলের চাহিদা পূরণ করে।

ডায়াবেটিস মেলিটাস:

ডায়াবেটিস রোগীদের জন্য এই ফলের রস খুবই উপকারি।

ডায়ারিয়া প্রতিরোধ করে:

ডায়ারিয়া প্রতিরোধে ফলসার ফল ও গাছের বাকল অত্যন্ত কার্যকর।

শ্বাস সম্বন্ধীয় সমস্যা ও অ্যাজমা উপশম করে:

ফলসার মধ্যে ফাইটোকেমিক্যালস নামক উপাদান রয়েছে যা শ্বাস সম্বন্ধীয় সমস্যার উপশম করতে সহায়ক।এতে উচ্চমাত্রায় ভিটামিন সি আছে যা অ্যাজমা, ব্রঙ্কাইটিস এবং শ্বাসকষ্ট দূর করতে সাহায্য করে ।

পেটের সমস্যা প্রতিরোধ করে:

 এই ফলের মধ্যে প্রচুর পরিমাণে ফাইবার রয়েছে যা পেটের সমস্যা দূর করে।

হার্টকে ভাল রাখে:

 যাঁরা উচ্চ রক্তচাপের রোগী তাঁরা গরমে ফলসার রসে লেবুর রস ও পুদিনা পাতা যোগ করে  খেলে হৃদরোগের ঝুঁকি সহজেই এড়ানো যাবে।

গাঁটের ব্যথা উপশম করে:

    ফলসার মধ্যে নানা ধরনের অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট রয়েছে যা প্রদাহ কমাতে সাহায্য করে।জয়েন্টে ব্যথা,বাতের ব্যথার মতো সমস্যাগুলোকে দূর করতে সাহায্য করে।ফলসার মধ্যে থাকা ক্যালশিয়াম হাড় মজবুত করে।

গলব্লাডার ক্যান্সার প্রতিরোধ করে:

    ফলসা ফলের রস লিভার এবং গলব্লাডারের চিকিৎসায় ব্যবহার করা হয় ।

উচ্চরক্তচাপ:

   ফলসা রক্ত বিশুদ্ধকরন,রক্তচাপ এবং কোলেস্টেরলের মাত্রা নিয়ন্ত্রন করে ।

সাধরণ সর্দি কাশি:

এটি ঠান্ডা এবং কাশি প্রতিরোধ করতে সাহায্য করে।

প্রাইমারী ইনসমনিয়া:

এটি কর্মক্ষমতা বৃদ্ধি করে এবং বিষন্নতা ও অনিদ্রা দূর করে।

একজিমা:

এই গাছের পাতা অ্যান্টিবায়োটিকের কাজ করে যা ত্বকের ফুসকুরি বা রাশ,অ্যাকজিমা নিয়ন্ত্রনে সাহায্য করে ।

ক্যান্সার:

 ফলসা ফলে রয়েছে অ্যান্থোসায়ানিন নামক ফ্লাভোনয়েডস যা ক্যান্সারের বিরূদ্ধে সুরক্ষা প্রদান করে ।

         কাকেরাই সম্ভবত সবচেয়ে বেশি পছন্দ করে। কারণ ফলসা পাকার মৌসুমে সারাদিনই তাদের আনাগোনা চোখে পড়ে।শুধু ফলের কথা বাদ দিলেও ফলসা গাছ হিসেবেও অনন্য। বড় বড় পাতা সহ ডালপালা ছড়িয়ে ছাতার মতো দাঁড়িয়ে থাকে।এগাছের অন্যতম বৈশিষ্ট্য হলো সারা বছর তামাটে রঙের নতুন নতুন পাতা।

জল হাওয়া:-

       শুকনো থেকে ঠান্ডা প্রায় সব রকমের জলহাওয়াতে ফলসার গাছ জন্মাতে পারে।কিন্তু তুষারপাত সহ্য করতে পারে না। তবে সমুদ্রতীরবর্তী এলাকায় আর্দ্র আবহাওয়াতে এর গাছ হতে দেখা যায়।

জমি :- গভীর মাটি যুক্ত জল জমে না এমন জমিতে এর গাছ ভালো হয়।

মাটি :- প্রায় সব রকমের মাটিতে ফলসা গাছ জন্মাতে পারে। তবে বেলে দোয়াঁশ মাটিতে ভালো হয়।সামান্য অম্ল জাতীয় মাটিতে এর গাছ ভালো হয়।

চারা তৈরি:- আমাদের দেশে সাধারণত বীজ থেকেই চারা তৈরী করা হয়।তবে অন্য অনেক দেশে কলম করেও চারা তৈরী করে থাকে।

জমি তৈরি :- প্রয়োজন মত চাষ ও মই দিয়ে জমি সমতল ও পরিষ্কার করে নির্দিষ্ট দূরত্বে গর্ত করে সার প্রয়োগ করে রাখতে হবে।

দূরত্ব :- গাছ ও সারির দূরত্ব হবে ৩-৪ মিটার।

গর্ত: চারা রোপনের ১ মাস আগে ৬০ সেমিঃ হারে লম্বা, চওড়া ও গভীর গর্ত করে সার মিশ্রিত মাটি দ্বারা গর্ত ভর্তি করে রাখতে হবে।

সার :- প্রতি গর্তের জন্য জৈব সার ১০-১৫ কেজি হাড় গুড়ো ২৫০গ্রাম এবং কাঠের ছাই কেজি।

চারা রোয়ার সময়:- বর্ষার সময় চারা রোপন করা হয়।

সার প্রয়োগ:- ফলন্ত গাছ প্রতি -জৈব সার ১৫-২০ কেজি, ইউরিয়া ২৫০ গ্রাম,সুপার ফসফেট ১ কেজি মিউরেট অফ পটাশ ৫০০ গ্রাম ভালো ভাবে মিশিয়ে গাছের চার ধারে সমান ভাবে ছড়িয়ে দিয়ে কোদাল দিয়ে কুপিয়ে মাটির সাথে মিশিয়ে দিতে হবে।

পরিচর্যা :-

১) প্রতি বছর শীতের শেষ দিকে গাছের ডাল ছাটাই করে দিলে ভালো ফলন পাওয়া যায়। কারণ শীতের শেষে নতুন ডাল ও পাতা গজায়। এ সময় নতুন ডাল থেকে ফুল হয়।তবে গাছ ছাটাই করার জন্য বিশেষ জ্ঞান থাকা দরকার।

২) বাগান সব সময় আগাছা মুক্ত রাখতে হবে।

৩)বর্ষার আগে ও পরে বাগানের মাটি কুপিয়ে আলগা করে দিতে হবে।

সেচ :- মাটির রসের অবস্থা অনুযায়ী প্রয়োজনীয় সেচ দিতে হবে।

ফল সংগ্রহ :- বীজের গাছে ফল ধরতে ৪/৫ বছর সময়  নেয়। আর কলমের গাছে ফল ধরতে প্রায় ১-২ বছর সময় নেয়। তবে পূর্ণ ফলস্ত হতে আরও প্রায় ১-২ বছর সময় দরকার হয়।শীতের শেষে গাছে ফুল আসে এবং মে-জুন মাসে ফল পাকে।এর ফল এক সাথে পাকে না। সম্পূর্ণ সংগ্রহ করতে প্রায় ১ মাস সময় লাগে।

ফলন - একটি পূর্ণ বয়স্ক ফলন্ত গাছ থেকে কত ফল পাওয়া সম্ভব তার সঠিক তথ্য দেখা যায় না। তবে আনুমানিক গাছ প্রতি ১০-৩০ কেজি ফল পাওয়া যেতে পারে।

রোগ, পোকা ও তার প্রতিকার:- ফলসা গাছ রোগ পোকার দ্বারা ক্ষতি হতে দেখা যায় না। তবে পাতায় দাগ বা শুকনো রোগ মাঝে মধ্যে লাগতে দেখা যায়। এর জন্য তামা ঘটিত ওষুধ ,যেমন - ব্লাইটক্স বা ফাইটোলান বা ব্লু কপার ব্যবহার করতে হবে।

পোকার মধ্যে ছাল ছিদ্রকারী পোকার উৎপাত হতে দেখা যায়।এর প্রতিকারের জন্য ক্লোরপাইরিফস ১.৫ গ্রাম প্রতি লিটার জলে গুলে ব্যবহার করতে হবে।

ব্যবসায়িক ভিত্তিতে এর চাষ না হওয়ায় ফলের বাজারে তেমন দেখা মেলে না। তবে ফল হিসাবে একে চাষ না করলেও ভেষজ হিসাবে এর চাষ করা খুবই প্রয়োজন।

লেখক: উপ-উদ্যানপালন অধিকর্তা, পশ্চিমবঙ্গ সরকার।

Mailing List