‘প্রেমের ফাঁদ পাতা ভুবনে’ টোপ ফর্সা ছিপছিপে চেহারার ছেলেরা, নারীপাচার যুগে যুগে: পর্ব – ৯ লিখছেন সুখেন্দু হীরা

‘প্রেমের ফাঁদ পাতা ভুবনে’ টোপ ফর্সা ছিপছিপে চেহারার ছেলেরা, নারীপাচার যুগে যুগে: পর্ব – ৯ লিখছেন সুখেন্দু হীরা
সুখেন্দু হীরা
প্রেমের ফাঁদ পাতা ভুবনে,
কে কোথা ধরা পড়ে, কে জানে।
— রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর।
বিশ্বব্যাপী প্রেমের এমন মোহময় ও বিশাল ফাঁদ, তাই এর ব্যবহার পাচারকারীরা অন্তত কৌশলের সঙ্গে করেছে। পশ্চিমবঙ্গে সবচেয়ে বেশি নারী পাচার হয় প্রেমের ফাঁদে ফেলে। এটা সবচেয়ে মারাত্মক এবং মহামারীর মতো এর প্রসার।
প্রেমের ফাঁদে ফেলার নানা জাল থাকে। এক্ষেত্রে একটা 'জিনিস' সর্বত্র মিল থাকে, তা হল একটি সুন্দর ছেলের উপস্থিতি। সাধারণত ছিপছিপে, ফর্সা, অল্পবয়স, চোখ আটকে থাকা চেহারার ছেলেরা এক্ষেত্রে আদর্শ টোপ। পাচারকারীরা এরকম ছেলেদের ব্যবহার করে।
প্রেম অন্ধ। মানুষ যখন প্রেমে পড়ে, তখন জগতের আর সব কিছু মিছা। প্রেমিক বা প্রেমিকার বিরুদ্ধে যে কথা বলবে, সে হল সবচেয়ে বড় বড় শত্রু। নাবালিকা মেয়েদের বৈষয়িক বুদ্ধি কম থাকে। তাঁর মাথায় এক বারের জন্য আসেনা, প্রেমিক সম্পর্কে বিশদভাবে খবর নেওয়া উচিত। যে কাজটি বাড়ির অভিভাবকরা ভালো ভাবে পারবে। প্রেম শুধু অন্ধ নয়, প্রেম জড়ভরতও বটে। আর ছেলেটি যদি সুন্দর মুখের হয়, তাহলে তার মুখের কথা অবিশ্বাস করতেও ইচ্ছা করে না।
এ রকম ছেলেদের সঙ্গে কিশোরী মেয়েদের প্রেম হয় বিভিন্ন ভাবে। কখনও মোবাইলের 'মিসকল' থেকে, কখনও মেলায় বা কোন অনুষ্ঠানে ঘুরতে গিয়ে, কখনও আত্মীয় স্বজনের বাড়িতে বেড়াতে গিয়ে পাশের বাড়িতে ভাড়া থাকা ছেলে অথবা ভাড়াটিয়ার যুবক / কিশোর আত্মীয়ের সঙ্গে চোখাচোখি হতে হতে। এখন এর সঙ্গে যোগ হয়েছে ফেসবুক-এ বন্ধুত্ব। এছাড়া নানা সামাজিক মাধ্যম (Social Media) তো আছেই।
দক্ষিণ ২৪ পরগনার বারুইপুর মহকুমার একটি ছেলেকে নারী পাচার কেসে অ্যারেস্ট করা হয়েছিল। সে প্রেমের অভিনয় করে অনেক মেয়ে পাচার করেছিল। সে জিজ্ঞাসাবাদের সময় জানিয়েছিল, একবার সে একসঙ্গে দুটো মেয়েকে পাচার করেছিল। একটি তার প্রেমিকা, অপরটি প্রেমিকার বান্ধবী। প্রেমিকার বাড়িতে প্রেমের কথা জানাজানি হবার পর অশান্তি। ছেলেটি বলে চলো আমর কাজের জায়গা 'পুনে' থেকে ঘুরে আসি। তোমার মন ঠিক হয়ে যাবে, তোমাকে খুঁজে না পেয়ে তোমার বাবা-মা একটু টাইট হবে। কদিন বাদে ফিরে এলে তোমার মা-বাবা তোমাকে বেশি খাঁটাবে না। মেয়েটি এই প্রস্তাবে এক কথায় রাজি, কারণ এক ঢিল দুই পাখি। এক, প্রেমিকের সঙ্গে সময় কাটানো যাবে; আর দুই, মা-বাবাও বশে থাকবে।
মেয়েটি ওর এক বান্ধবী কে জোগাড় করে; তারও বাড়িতে একই রকম সমস্যা। এখানে রাজু দেখল ওর কব্জায় দুই পাখি। হাওড়া থেকে পুনা যাওয়ার ট্রেন। ট্রেনে হাসি ঠাট্টা মস্করা করতে করতে চলে গেলো। পুনাতে নেমে তারা দেখে রাজুর মাসি স্টেশনে তাদের 'রিসিভ' করতে এসেছে। সেখানে একটি অটোতে তিনজন করে চড়তে হয়। মাসি ও দুই বান্ধবী একটি অটোতে চেপে বসে। রাজু বলে পরের অটোতে আমি আসছি। রাজু অবশ্য পরের অটো নয়, পরের ট্রেন ধরেছিল। আবার পরের পাখি ধরতে সুন্দরবনে।
এই প্রসঙ্গে আর একটি ঘটনার কথা উল্লেখ করি। একটি সুন্দরবনের কিশোরী তার দিদির বাড়ি সোনারপুরে বেড়াতে এসেছে। জামাইবাবু কলকাতার কোথাও কাজ করে তাই সোনারপুরে ভাড়া থাকেন। প্রতিবেশী বাড়িতে এক মহিলা ভাড়াটিয়া থাকেন, তার ভাইও বেড়াতে এসেছে। ভাই কাজ করে বাংলার বাইরে। ভাইয়ের জন্য মেয়ে দেখা চলছে। ভাইয়ের চেহারা ‘নজর কাড়া’। এসব ক্ষেত্রে ছেলেদের একই রকম নাম থাকে রাজু বা রাহুল। তারও এরকম নাম। এত সুন্দর ছেলে হাতছাড়া করা নয়। তারপর প্রেম, কাজের জায়গা মুম্বাই বেড়াতে নিয়ে যাওয়া। বোন ফিরে আসেনা এবং রাজুরও খবর নেই। ভাড়াটে দিদিও একদিন রাতের বেলা ভাড়া বাড়ি ছেড়ে পগার পার।
এই পাচার-প্রেমের ফাঁদ থেকে মেয়েদের বাঁচানোর একটাই রাস্তা। কিশোরীদের ও তাঁদের অভিভাবকদের সচেতন করা। এ ক্ষেত্রে মা-বাবা বা অভিবাবকরা যদি একটু সচেতন হন, তাহলে এই পাচারের ঘটনা অনেকাংশে রোধ করা যেতে পারে। কিশোরীদের স্কুলের মাধ্যমে সচেতন করা যেতে পারে। করাও হয়।
আসলে কিশোর বয়সে সবার চোখে এত রঙিন স্বপ্ন থাকে, ভালো মন্দ তলিয়ে দেখতে মন চায় না। তার ওপর এ যুগের ছেলে-মেয়েরা মা-বাবার কথা শুনতে চায় না। সেইজন্য মা, বাবা, অভিবাবকদের সাবধানে ছেলে মেয়েকে পরিচালনা করতে হয়।
অভিবাবকরা যদি একটু চোখ-কান খোলা রাখেন, ছেলে বা মেয়ে কার সঙ্গে মিশছে, কীভাবে সময় কাটাচ্ছে। যদি দেখা যায় কোনও ছেলে বা মেয়ের সাথে মেলামেশা করছে, তাহলে তার সম্বন্ধে বিশদে খবর নেওয়া এবং তা ছেলে বা মেয়েকে ওয়াকিবহাল করা; এসব করলে আশা করা যায় এ ধরনের ঘটনা এড়ানো যাবে।
তথ্য সূত্র: দক্ষিণ ২৪ পরগনা জেলার বিভিন্ন থানার নথিবদ্ধ ঘটনা।


