ত্রাণ থেকে বাদ দল, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় উদ্দেশ্য সফল হলে নজির তৈরি হবে ‘রাজধর্ম’ পালনের

ত্রাণ থেকে বাদ দল, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় উদ্দেশ্য সফল হলে নজির তৈরি হবে ‘রাজধর্ম’ পালনের
সুমন ঘোষ
দল সরকার গঠন করে। দলের নির্বাচিত সদস্যরা সংবিধান মেনে শপথ নেওয়ার পরেই আর শুধু দলের থাকেন। তখন তাঁরা সকলের। দেশের।
এটা নতুন কথা নয়। সকলের জানা। তবু কথাটা ঘুরে ফিরে আসে। কারণ, এটা বোঝার ক্ষেত্রে যতটা জলের মতো সহজ, বাস্তবে করাটা ততটাই কঠিন। যে কারণে, রাজনীতিতে ‘ওরা-আমরা’, ‘স্বজনপোষণ’ শব্দগুলি বারেবারে শোনা যায়। গ্রামের মানুষকে পঞ্চায়েত প্রধানের বাড়ি কোনটা জিগ্যেস করলে উত্তর আসে, গ্রামের মধ্যে যে পাকা বাড়িটা সব থেকে উঁচু, বাড়ির সামনে দামি গাড়ি দাঁড়িয়ে,সেটাই প্রধানের বাড়ি! এমন উত্তর অনেকেরই বহুবার শোনা।
বিরোধী দলে থাকলে এসব উদাহরণ অহরহ আসে। স্বচ্ছতার নিদর্শনও গড়ে তোলা যায়। মানুষের পাশে দাঁড়িয়ে মানুষের সেবাও করা যায় প্রকৃত অর্থে। আবার ক্ষমতায় চলে গেলে সেগুলোই কাঁটার মতো বিঁধতে থাকে। তখন রাজ্য বা দেশ চালাতেই নাকি হিমশিম। মানুষের পাশে দাঁড়িয়ে সেবার সময় কোথায়? ঠিক যেমন দেখা যায় ভোটের সময়। প্রার্থীরা জাত-ধর্ম-গরিব-বড় লোক বাছবিচার করেন না। নোংরা ধূলোমাখা কাউকে দেখলেও জড়িয়ে ধরেন। বাচ্চাদের কোলে তুলে নেন। আবার জেতার পর দেখা মিললেও সেই দৃশ্য কিন্তু উধাও।
তবে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় হয়তো একটু ব্যতিক্রমী। তাই তৃতীয়বার বিপুল জনাদেশ নিয়ে ক্ষমতায় আসার পরেও ভুল শুধরে নিতে পারেন। এক বছর আগের আমফানের ত্রাণ দুর্নীতির কালো দাগ ভাসিয়ে দিতে চান পরের ঘুর্ণিঝড় ‘ইয়াস’ এর স্রোতে। আমফানের ত্রাণ নিয়ে ব্যাপক দুর্নীতির অভিযোগ উঠেছিল। আর তা উঠেছিল তৃণমূলের নেতা-কর্মীদের বিরুদ্ধেই। তারপরই মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় তাকড়া হাতে দমনের চেষ্টাও করেন। যে সমস্ত নেতা-কর্মীরা ক্ষয়ক্ষতি না সত্ত্বেও ক্ষতিপূরণের টাকা নিয়েছিলেন, তাঁদের ফিরিয়ে দিতে নির্দেশ দিয়েছিলেন। অনেকেই তা ফিরিয়েও দিয়েছিলেন, তা নিয়ে সন্দেহের অবকাশ নেই।
এবার আর সেই সূযোগটুকুও দিতে নারাজ তৃতীয়বারের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। এবার ‘ইয়াস’ বিধ্বস্ত রাজ্যে ত্রাণ দিতে চান দূয়ারে। সরকারি আধিকারিকদের মাধ্যমে। ক্ষয়ক্ষতির আবেদনও খতিয়ে দেখতে চান। যাতে প্রকৃত ক্ষতিগ্রস্তরা বঞ্চিত না হন। তাই তড়িঘড়ি নয়। নির্দিষ্ট নিয়ম মেনে সূচীও তৈরি করেছেন।
কী সেই সূচী? আগামী ৩ জুন থেকে ‘দুয়ারে ত্রাণ’ প্রকল্প শুরু হবে। তা চলবে ১৮ জুন পর্যন্ত। গ্রামে গ্রামে ক্যাম্প করবে সরকার। সেখানে গিয়ে সাধারণ মানুষ ক্ষতিপূরণের আবেদন জানাবেন। আবেদন খতিয়ে দেখা হবে ১৯ থেকে ৩০ জুন পর্যন্ত। তারপর ১ জুলাই থেকে সরাসরি ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টে ঢুকে যাবে ক্ষতিপূরণের টাকা।
না, মাঝে আর কেউ নেই। অর্থাৎ ক্ষতিপূরণ পেতে কাউকে অনুরোধ-উপরোধ বা তৈল মর্দনের প্রয়োজন নেই। ক্ষতিপূরণের একটা অংশ কাউকে দেওয়ার প্রয়োজন নেই। যা প্রাপ্য পুরোটাই নিজের। এতে যে, দলের নিচুতলার নেতা-কর্মীদের মনে ক্ষোভ জাগবে না, এমনটা নয়। হয়তো সরাসরি কেউ কিছু বলতে পারবেন না। তবে আড়ালে আবডালে মুখ্যমন্ত্রীর এই সততার প্রতীকের ভাবমূর্তি নিয়ে দলের নেতারাও সমালোচনা করতে পারেন। কিন্তু তাতে কিছু যায় আসে না। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের কাছে ২০২১ সালের নির্বাচন আবারও প্রমাণ করে দিয়েছে, তাঁর জনপ্রিয়তার উচ্চতা ঠিক কতটা। লক্ষ লক্ষ নেতা-কর্মী,জনপ্রিয় নেতা-মন্ত্রীরা দলে ভাঙন ধরিয়ে বিরোধীপক্ষে – অথচ ভোটে আসন বাড়ছে!
তাই প্রত্যয় আর বেশি। তাই শুধু কী ত্রাণ? সেচ দফতর থেকে পূর্ত-অর্থ – সর্বত্রই এবার টাস্ক ফোর্সও তৈরি করছেন। কারণ, স্বচ্ছতা প্রয়োজন। প্রয়োজন উন্নয়নের। কারণ, মানুষ আর কারও কাছে জবাব চাইবেন না। জবাব চাইবেন, নিজের মেয়ের কাছে। সেটা মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বিলকুল বুঝে গিয়েছেন।
আর ওই কাজে সফল হলে, প্রতিষ্ঠা হবে ‘রাজধর্ম’। বাম আমলের দীর্ঘ ৩৪ বছরের দলতন্ত্র ভেঙে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার কথা বলে ক্ষমতায় এসেছিলেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। তৃণমূলের বিগত ১০ বছরে তা কতটা প্রতিষ্ঠা পেয়েছে তা নিয়ে প্রশ্ন থেকেই যায়। কিন্তু এবার যে পদ্ধতিতে মুখ্যমন্ত্রী হাঁটতে চলেছেন, তার বাস্তব রূপয়াণ ঘটলে ‘রাজধর্ম’ পালনের যে নজির তৈরি হবে তা বলার অপেক্ষা রাখে না।


