হাতির হামলায় প্রায় প্রতিদিন প্রাণহানি, দলমার দামালদের স্থায়ী ঠিকানা এখন জঙ্গল মহল, কেন? লিখছেন ড. প্রভাতকুমার শীট / প্রথম কিস্তি

হাতির হামলায় প্রায় প্রতিদিন প্রাণহানি, দলমার দামালদের স্থায়ী ঠিকানা এখন জঙ্গল মহল, কেন? লিখছেন ড. প্রভাতকুমার শীট / প্রথম কিস্তি
ড. প্রভাতকুমার শীট
জাতি ধর্ম বর্ণ নির্বিশেষে হাতি শুধু আর পাঁচটি প্রাণীর মতো প্রাণী নয়। তার উত্তরণ ঠাকুর হিসেবে। অর্থাৎ মাঙ্গলিক। শুধুমাত্র বাংলা নয় ওড়িশা, বিহার, আসাম রাজ্যেও হাতি একইভাবে সমাদৃত।
ছোটনাগপুর মালভূমির দলমা পাহাড় থেকে প্রতিবছর হাতির দল ঢোকে দক্ষিণবঙ্গের জেলাগুলিতে। বেলপাহাড়ি, ঝিলিমিলি, কাঁকড়াঝোর, কুইল্যাপাল প্রভৃতি এলাকাগুলি দলমার বন্য হাতিদের আরণ্যক পরিযায়ী পথ। ১৯৮০-র দশকের প্রথম দিকে দলমার হাতি যাতায়াত করে এই রাজ্যে। সেই সময় প্রতি বছর ধান পাকার মরশুমে ৬-৮ টি হাতির ছোট দল লাকাইসিনির পাহাড়ি পথ ধরে নেমে আসত কাঁকড়াঝোর উপত্যকায়। তারপর দুলকি, ঘুরপাহাড়ি পথ পার হয়ে নেস্তরিয়া, বাঁশপাহাড়ির ঢালু পথ ধরে তারা পৌঁছে যেত লালজলার ভ্যালিতে। এরপর একটা লম্বা সময় ঘুরপাক খেতে খেতে ওরা পৌঁছে যেত ভুলাভেদা, তামাজুড়ির জঙ্গলে।
১৯৮৩-৮৪ সাল নাগাদ পরিযায়ী হাতিদের পথ লম্বা হয়। ক্রমাগত বেলপাহাড়ি, নারাণপুর, শিলদা, কেচন্দা পর্যন্ত। ১৯৮৫-৮৬ সাল নাগাদ হাতির দলগুলি তারাফেনি, ভৈরববাঁকি ও কাঁসাই নদী পার হয়ে রাতের অন্ধকারে ঢুকে পড়েছিল গোয়ালতোড়, লালগড়, ভীমপুর, রামগড়, ধেড়ুয়ার জঙ্গলে। পরে পরে আরও এগিয়ে ওরা ১৯৯০ এর মধ্যেই পৌঁছে যায় চন্দ্রকোনা, গড়বেতা, পিয়ারডোবা, ধাদিকা, গনগনির শালবন পার হয়ে বাঁকুড়ার বিষ্ণুপুর, জয়পুর এমনকি সোনামুখীর জঙ্গলেও। ২০০০ সাল থেকে দলমার হাতিরা তাদের ঘাঁটি এলাকা ও বিচরণভূমি গড়ে নিয়েছে - গোয়ালতোড়, লালগড়, ভীমপুর, কাঁটাপাহাড়ি, শালবনি, গড়বেতা, পিয়ারডোবা, ধাধিকা, বিষ্ণুপুর, জয়পুরের অরণ্যভূমিতে।
এই হাতিগুলি ছিল বিহারের দলমা অভয়ারণ্যের স্থায়ী বাসিন্দা। প্রতি শীতেই এরা নিয়ম মেনে বাংলার দক্ষিণ পশ্চিমের বনাঞ্চলে চলে আসতো নভেম্বরের মাঝামাঝি সময়ে। আবার ফেব্রুয়ারির মাঝামাঝি এরা নিজভূমি দলমা অভয়ারণ্যে ফিরে যায়। প্রধানতঃ উষ্ণ-আর্দ্র জলবায়ু, তরঙ্গায়িত রাঢ়ভূমি, ঘনসন্নিবিষ্ট জঙ্গল, পর্যাপ্ত পানীয় জলের যোগান এবং চারপাশে পাকা ধানের সুগন্ধ হাতিগুলিকে আকৃষ্ট করেছে।
সেই ১৯৮০ সালের শেষ দিকে দলমা এলাকায় নতুন করে একটি তামার খনির কাজ শুরু হয়। আকরিক তুলতে যেখানে প্রতিনিয়ত চলত ডিনামাইট ব্লাস্টিং। সঙ্গে চালু হলো বিহার সীমান্তে সুবর্ণরেখা প্রকল্পের কাজ। সিংভূমের ঠিকাদার, মাফিয়া, সরকারি আমলা এবং রাজনৈতিক নেতা, ফড়ে, দালাল একজোট হয়ে মাত্র ছয় মাসের মধ্যে নিশ্চিহ্ন করে দিলো সুবর্ণরেখা ভ্যালির প্রায় ৪০০ মাইল শাল-বন। ১৯৮৭-৯২ এর মধ্যে অবিভক্ত মেদিনীপুর জেলার পশ্চিমাংশে একটি অস্থির রাজনৈতিক অশান্তিও শুরু হয়। ক্ষমতা দখল করেই শুরু হয় জঙ্গল নিধন। কারণ, জঙ্গল বেচলেই নগদ টাকা। ভুলাভেদা, তামাজুড়ি, কাঁকড়াঝোর থেকে জঙ্গল লুট হয়ে যায়। ঠাকুরান পাহাড়, গাড়রাসিনি, ওদোলচুয়া, বেতাই, ভাঁড়ারু এলাকার পাহাড় প্রায় ন্যাড়া হয়ে গেল। ডুলুং আর তারাফেনি অববাহিকায় শাল, পিয়াল, কেঁদ, বহেড়ার সারি মুখ থুবড়ে পড়ল অতি দ্রুত। সেই সময় চোরা শিকারিদের হাতে প্রায় ৮ টি চিতারও মৃত্যু ঘটে। ১৯৯২ সাল নাগাদ অবস্থা এতটাই করুন হয় যে, জঙ্গল প্রায় নিশ্চিহ্ন হয়ে পাহাড়গুলি ন্যাড়া হয়ে যায়। তখন তিন-চার কিলোমিটার দূরে ছাগল, গরু চরলেও খালি চোখে দেখা যেত। সেই সময় দিনরাত পাথর ফাটাচ্ছে ডিনামাইটে। পাহাড় জঙ্গল দাপিয়ে বেড়াত ঠিকাদারদের বুলডোজার। বনের হাতিরা হয়ে পড়ল আশ্রয়হীন। জঙ্গলে তাদের খাবারের ভাঁড়ারও শূন্য। ঝর্ণা ও প্রাকৃতিক জলের উৎস গুলি যাচ্ছিলো শুকিয়ে। সুবর্ণরেখার জলে তীব্রতর গতিতে চলছিল শিল্প দূষণ। তার পেট চিরে পাহাড় ফাটিয়ে গড়ে উঠেছিল বাঁধ, জলধারা। যেটুকু জল গড়িয়ে আসছিল তাতে মিশছিলো সিংভূমের কারখানাগুলির রাসায়নিক বর্জ্য।
ফলে দলমার মূল অভয়ারণ্য ছেড়ে হাতির বড় দলগুলি ঢুকতে শুরু করলো এ রাজ্যের জঙ্গলে। ১৯৯০ তে হাতির বড় দলদুটি যারা তখন রাঁচির দিক থেকে চান্ডিল পেরিয়ে মূল দলমায় এসেছিলো মরশুমি ভ্রমণে তারা আর চান্ডিলের ওপারে ফিরে যেতে পারল না। কারণ, তত দিনে পাহাড় কেটে বানানো হয়ে গেছে গভীর সেচ খাল। সেই গভীর খাল পার হয়ে ওরা যেতে অপরাগ। এর আগে এই বড় দল দুটি শুধুমাত্র শীতের তিনমাস অনিয়মিত ভাবে এ রাজ্যে সাময়িক ভাবে হানা দিত। এবার ওদের তাড়া খেয়ে সীমান্ত দলমার ছোট দলগুলি নিজ নিজ এলাকা ছেড়ে পালিয়ে আসতে থাকল দুলকি সুর পাহাড়ির পথ ধরে পশ্চিমবঙ্গের জঙ্গলে। তা ১৯৯০ দশকের পর থেকে পাকাপাকি ভাবে বসবাস করতে লাগল। বর্তমানে, চিচিড়া, কুঁটিয়া, জামবনি, কেন্দুয়া, মানিকপাড়া, বিনপুর, মালাবতী, ধেড়ুয়া, গুরগুড়িপাল, শালবনি, গড়বেতা ও নয়াগ্রামের জঙ্গলে বসবাস করে। এই সমস্ত এলাকায় ল্যাটেরাইট মাটিতে জঙ্গলগুলি যথেষ্ট ঘন ও সন্নিবিষ্ট। এখানকার খণ্ডিত জঙ্গলগুলিতে বিভিন্ন স্থানে পানীয় জলের যোগান আছে। কিন্তু স্থানীয়ভাবে এসব এলাকাগুলি প্রবল জনবহুল। এর চারপাশে পাকা ধানের ভান্ডার ও শস্য খামার সমৃদ্ধ। হাতিরা এখানে দিনের বেলায় ঘন জঙ্গলে লুকিয়ে বিশ্রাম নেয়। এবং সন্ধ্যা থেকে মধ্যরাত্রি পর্যন্ত সবজি ও ধান জমিতে নিয়মিত হানাদারি চালায়।
চলবে..
লেখক- অধ্যাপক, ভূগোল বিভাগ, রাজা নরেন্দ্রলাল খান মহিলা মহাবিদ্যালয়, মেদিনীপুর।


