ভুরিভোজ তো খাচ্ছেন, জামাই ষষ্ঠীর ইতিহাসটা জানা আছে তো? জেনে নিন জামাই ষষ্ঠীর কথা

ভুরিভোজ তো খাচ্ছেন, জামাই ষষ্ঠীর ইতিহাসটা জানা আছে তো? জেনে নিন জামাই ষষ্ঠীর কথা
ডঃ সুমহান বন্দ্যোপাধ্যায়
কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয় প্রকাশিত একটি সংকলনের ‘জামাইষষ্ঠী’ শীর্ষক একটি রচনায় বাঙালীর ব্রতগুলিকে তিন ভাগে ভাগ করা হয়েছে। এগুলি হল- (১) আত্মজন্য, (২) সমাজ জন্য ও (৩) সম্বন্ধ জন্য। এর মধ্যে জামাইষষ্ঠী পড়ে তৃতীয় বর্গে। পার্থিব কামনা-বাসনা, চাহিদার আকাঙ্খা থাকে ব্রতগুলির মধ্যে। আত্মীয় পরিজনের মঙ্গল কামনা ‘সম্বন্ধ জন্য’ ব্রতগুলির মূল লক্ষ্য। সারা বছর ধরেই নানা ষষ্ঠীব্রত প্রচলিত রয়েছে বাঙালী সমাজে। এর মধ্যে অন্যতন জৈষ্ঠ মাসের অরণ্য ষষ্ঠী। এর লোকপ্রিয় আর একটি পরিচয় জামাই ষষ্ঠী নামে। এই সময়ে আমের ভরা মরসুমের কারণে এর আর একটি নাম আম-ষষ্ঠী ব্রত। বর্তমান মাগ্গিগন্ডার বাজারে তৎসহ অতিমারির উৎকট প্রহারে জামাই ষষ্ঠী আর ভুরিভোজের গল্প ক্ষেত্রবিশেষে নিদারুণ ব্যঙ্গের ন্যায় শোনায়। তথাপি, বাংলা ও বাঙালীর সংস্কৃতি এতটা নিরস রিক্ত হয়ে যায়নি যে, এই বিশেষ দিনে অল্পবিস্তর আয়োজনের মধ্যে দিয়ে প্রিয়জনের মঙ্গল কামনায় বিরত হবে সে।
ষষ্ঠী উপাসনার ইঙ্গিত বা উল্লেখ বেদ-পূর্ববর্তী প্রত্নতাত্ত্বিক এবং পরবর্তী প্রাচীন সাহিত্যে ও অন্য রচনায় থাকলেও, আলাদাভাবে জামাই ষষ্ঠীর কথা সে সমস্ত জায়গায় বিবৃত নেই। প্রাচীন বঙ্গে ষষ্ঠী পুজো হত, মধ্যযুগেও তাতে ভাঁটা পড়েনি। নীহাররঞ্জন রায় ও মঙ্গলকাব্যের সাক্ষ্য প্রমাণে তা জানা যায়। ষষ্ঠী পূজা, অরণ্যষষ্ঠীর উপাসনা তাই যতটা প্রাচীন, জামাই ষষ্ঠী ততটা নয়। মধ্যযুগের শেষার্ধে এর লোকপ্রিয়তা অর্জিত হয়েছে বলে অনুমান করতে পারি। আসলে সাল তারিখ চিহ্নিত এর ইতিহাস তো আমরা পাচ্ছি না। মৌখিক কাহিনী ও ব্রতকথা ধরে রেখেছে এর জন্মের কথা।
মহাভারতের অনুষঙ্গ টেনে এমন একটি কাহিনী হল – অর্জুন অরণ্যে নির্বাসিত অবস্থায় থাকাকালীন এই দিনে চিত্রাঙ্গদাকে বিবাহ করেন এবং শ্বশুর বাড়িতে আপ্যায়িত হন। সেই থেকে এই দিনে জামাই ষষ্ঠীর প্রচলন। ব্রত কথায় রয়েছে, এক ছোট বউ এর গল্প। যে মাছ চুরি করে খেয়ে মা ষষ্ঠীর বাহন বিড়ালের নামে দোষ দিত। মা ষষ্ঠীর বিড়াল তাই জন্মের পরপরই তার বাচ্চাদের নিয়ে অরণ্যে চলে যেত। ছ’বার এমন হবার পর মনের দুঃখে বধূটি অরণ্যে গিয়ে হাপুস নয়নে কাঁদতে থাকে। মা ষষ্ঠী তাকে দর্শন দিয়ে অপরাধ কবুল করিয়ে তাঁর পুজো করতে বলেন। পুত্রদের ফিরে পায় বধূটি। সেই থেকে শুরু হয় এই ব্রতের। আর একটি কাহিনী বলছে, শ্বশুর বাড়িতে মেয়েকে গঞ্জনা এবং তাকে বাপের বাড়িতে আসতে না দেওয়ায়, মেয়ের বাবা মা জামাই এর আপ্যায়নের বন্দোবস্ত করে। দু’জনকে নিমন্ত্রণ জানায়। এর থেকেই জামাই ষষ্ঠীর শুরু।
আসলে কারণ যাই হোক, দুর্বা ঘাস, অরণ্য, ষাট এর ব্যঞ্জনা ইত্যাদির মধ্য দিয়ে এই ব্রতের প্রজনন বা বংশবৃদ্ধির প্রার্থনা প্রকাশ পেয়েছে বলে পন্ডিতরা বলেন। অপর দিকে, সন্তানের কামনাই এর মুখ্য উপজীব্য বলেও উল্লেখ করা হয়। কিন্তু, জামাই কেন? এর দ্বারা মেয়েদের কি কোথাও অবনমিত দেখানো হয়েছে? পরিবর্তিত সমাজে এ ধারণা হয়তো অনেকটাই বদলেছে। কিন্তু সব মিলিয়ে একদিকে যেমন আত্মীয়তার উদযাপন হয় এই অনুষ্ঠানে, তেমনই সবকিছুকে ছাপিয়ে উন্মোচিত হয় এক চিরন্তন মাতৃসত্তা।
লেখক – অধ্যাপক, নৃবিজ্ঞান বিভাগ, বিদ্যাসাগর বিশ্ববিদ্যালয়।


