পুরুলিয়ার পুঁথিদাদুকে চেনেন? অজানা কাহিনী লিখছেন ড. সমরেন্দ্র নাথ খাঁড়া                                  

 পুরুলিয়ার পুঁথিদাদুকে চেনেন? অজানা কাহিনী লিখছেন ড. সমরেন্দ্র নাথ খাঁড়া                                   
11 Sep 2023, 10:30 AM

 পুরুলিয়ার পুঁথিদাদুকে চেনেন? অজানা কাহিনী লিখছেন ড. সমরেন্দ্র নাথ খাঁড়া

                                 

ড. সমরেন্দ্র নাথ খাঁড়া

       

পুরুলিয়ার এক মহান মানুষ হলেন পুঁথিদাদু। জন্ম ১৯৩৭ সালের ৩০ সেপ্টেম্বর বাগমুন্ডি ব্লকের বুরদা গ্রামে। কেউ তাঁর খোঁজ রাখেন না। তিনি অন্তরালেই রয়ে গেছেন। তবে তিনি একইভাবে চারপাশের গ্রামের গরিব শিক্ষার্থীদের কাছে নয়নের মণি হয়েই আছেন।

  আশপাশের গ্রামের আট থেকে আশি সবার কাছে তিনি  'পুঁথি দাদু' নামে পরিচিত! কিন্তু তাঁর আসল নাম গুরুচরণ গড়াই। মা ফুটিবালা গড়াই নিরক্ষর ছিলেন কিন্তু পড়াশুনা ও বইয়ের কদর দিতেন। গুরুচরণবাবুর বয়স যখন মাত্র এগারো বছর তখনই বাবাকে হারান।অল্প বয়সেই সংসারের জোয়াল তাঁর কাঁধে এসে পড়ে। মাঠে লাঙল দিতে ও ধান রোয়া করতে গিয়েও সেই বইয়ের গল্পের পাতায় মন পড়ে থাকতো। ধান বিক্রি করে তিনি নতুন বই কিনতেন। প্রায় ১৪ - ১৫ বছর বয়সে বইয়ের পড়ার নেশায় মশগুল হয়ে থাকতেন। মানুষটির পড়াশোনা কিন্তু সপ্তম শ্রেণি অবধি; স্কুলের গণ্ডিও পার হননি।অবাক করার বিষয় হলো তিনি কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়ুয়াদের পড়াতেন।পুঁথিদাদু পেশায় কৃষক হলেও তার কাছে স্নাতক ও স্নাতকোত্তরের ছাত্রছাত্রীরা পড়তে আসত।প্রথাগত ডিগ্রি না থাকা সত্বেও ছাত্রছাত্রীদের অনায়াস দক্ষতায় পড়াশোনায় সাহায্য করতেন।

কেউ বলে তিনি 'পুঁথিদাদু' আবার কারো কাছে তিনি 'চলমান এনসাইক্লোপিডিয়া'৷ তবে নিন্দুকেরা তাঁকে 'বইপাগল ' বলেন!

 একমুখ খোঁচা খোঁচা দাঁড়ি। পরনে আধময়লা সাদা ধুতি৷ নিতান্তই সাধারণ চেহারার মানুষটা যে এমন অসাধারণ সাধনায় মেতে থাকতেন, তা নিয়ে গর্বিত প্রতিবেশীরাও৷ 'বুড়দা' গ্রামের বাসিন্দা 'পুঁথিদাদু ' ও তাঁর লাইব্রেরি না থাকলে এলাকায় শিক্ষার প্রসার এমন ঘটত না৷ পড়াশোনায় পুঁথিদাদুর সাহায্য পায় নি এখানে এমন কেউ নেই।অথচ কেন যে সরকারী সহায়তা পাননি,তা সবাইকে অবাক করে৷ ২০১৩ সালে বিশ্ব বই দিবসে এক বইমেলা কমিটির বিশেষ সম্মাননা জানিয়েছেন। শিকড়ের সন্ধানে আর এক সংস্থা বিশেষ সম্মাননা জানিয়েছেন। 'চৈতন্য গ্রন্থাগারে' বিদ্যুত্‍‌ সংযোগ ছিল না৷ বইপাগল গুরুচরণ খরচ জোটাতে পারেননি। অন্ধকার নামলেই ,লাইব্রেরিতে জ্বলে ওঠতো কুপি৷ ‘পুঁথিদাদু’ কালো অক্ষরে ডুবে যেতেন।

   না পাওয়ার কোনও ক্ষোভ তার ছিল না৷ অন্ধকার লাইব্রেরিতে বসে তার ভাবনা ছিল " কিছু না পাই;জ্ঞানের আলো তো ছড়িয়ে দিতে পেরেছি৷"

 

     পুরুলিয়ার বাঘমুণ্ডি থানার বুড়দা গ্রামের এই মানুষটাকে ব্লকের প্রায় সকলেই 'পুঁথিদাদু' নামে এক ডাকে চেনে।সাহিত্য হোক বা ব্যাকরণ, দর্শন হোক অথবা সাধারণ জ্ঞান - সব বিষয়েই তিনি পণ্ডিত। তাই পড়ুয়াদের মুশকিল আসান 'পুঁথিদাদু ও তাঁর গ্রন্থাগার'! সাহিত্য তাঁর শিরা উপশিরায়। তিনি 'কবিতা কোরক ' বই লিখেছেন।

  ছোটবেলা থেকেই তিনি নতুন বইয়ের গন্ধে পাগল হয়ে যেতেন। কিন্তু বেশি বই কেনার পয়সা ছিল না।স্কুলে পড়ার সময় গ্রামে কারো নতুন বই এসেছে শুনলেই ছুটে যেতেন।

      জন্মের পর কোনদিন নিজের দাদুকে দেখেননি। কিন্তু 'পুঁথিদাদু'র তাঁর লেখা পড়েই সাহিত্য ও পড়াশুনার প্রবল আগ্রহ জন্মায়।তাঁর দাদু ছিলেন গদাধর গড়াই। তিনিও ছোট গল্প লিখতেন।যদিও সেই লেখাগুলো ছাপার অক্ষরে প্রকাশিত হয়নি কোনোদিনও। তবু এই বইগুলো ছিল তাঁর প্রেরণা।ঠিক করেন বিভিন্ন বই জোগাড় করে গ্রামের মানুষদের জন্য লাইব্রেরি বানাবেন। সম্পূর্ণ নিজের উদ্যোগে গড়ে তুলেছিলেন ‘চৈতন্য গ্রন্থাগার’৷ শুরু করলেন ১০০ টি বই নিয়ে,তারপর বেশ কয়েক বছরেই বইয়ের সংখ্যা এক হাজারেরও বেশি হয়ে দাঁড়ালো !কিন্তু বই রাখার কোনো জায়গা ছিল না,তাই জ্যেঠুর কাপড়ের দোকান থেকে আলমারি কিনে বই রাখতে শুরু করেন।

 সেখানে গেলেই সম্পূর্ণ বিনা মূল্যে বই পড়তে পাওয়া যায়। পড়াশোনায় সাহায্যের জন্য 'পুঁথিদাদু' সবসময় প্রস্তুত  থাকতেন। কোন বইয়ের কোন পাতায় কী লেখা রয়েছে, সবই নখদর্পণে তাঁর! টিউশনের পয়সা পুরোটাই প্রায় খরচ করতেন গ্রন্থাগারের উন্নয়নের জন্য৷সংগ্রামের সেই শুরু। কিন্তু বইপ্রীতিতে কখনোই ভাঁটা পড়েনি। পয়সার অভাবে স্কুলে যাওয়া বন্ধ হয়ে যায়। অপরের কাছ থেকে চেয়ে চিন্তে বই আনতেন গুরুচরণ। হতদরিদ্র পরিবারে ধান বিক্রির টাকায় কেনা হত বই৷ ১৯৫০ সালে স্কুলে যাওয়া বন্ধ হওয়ার বছর তিনেক পর ১৯৫৩ সালে নিজের বাড়িতে গ্রন্থাগার গড়ে তোলেন গুরুচরণ,তিনি নিজেই নাম দেন 'চৈতন্য গ্রন্থাগার' ! চাষের কাজের পাশাপাশি চলতে থাকে বই সংগ্রহের কাজ৷ সেই সঙ্গে পড়াশোনা৷ একটু স্বাচ্ছন্দ্যের আশায় ছাত্রছাত্রীদের পড়াতে শুরু করেন৷ লোকমুখে খ্যাতি ছড়িয়ে পড়তে বেশি সময় লাগেনি৷     

      গুরুচরণের দুই ছেলেও চাষবাস করেই সংসার চালান৷ সংসারে টানাটানি থাকলে কি হবে,বাবাকে তাঁরাও উত্‍সাহ জোগাতেন। 'পুঁথিদাদু'র বড় ছেলে শিবরাম গড়াই জানালেন, 'যতই দারিদ্র থাকুক, বাবাকে বাধা দেওয়ার কোনও প্রশ্নই নেই৷'

       'পুঁথিদাদু'র ছোট ছেলে হরেরামবাবু দেখালেন, আর্যশাস্ত্র মহাভারতের চারটা পাতা ইঁদুরে কেটে দেওয়ার পরেও কীভাবে পুঁথিদাদু সেই পাতাগুলো নিজের হাতের লেখা দিয়ে মিলিয়ে দিয়েছেন।অন্য আরও বেশ কয়েকটি বইয়ের নষ্ট হয়ে যাওয়া পাতা তিনি নিজে লিখেছিলেন। 'পুঁথিদাদু'র লাইব্রেরিতে পুরোনো নানা দুর্লভ বই রয়েছে।তাঁর লাইব্রেরিতে সবচেয়ে পুরানো বই 'চৈতন্য চরিতামৃত'। রয়েছে রামায়ণ, মহাভারত, প্রায় তিরিশ রকমের গীতা, বাইবেল, নানা লেখকের বই রয়েছে। এছাড়াও সংস্কৃত, ইতিহাস, বাংলা ব্যাকরণ, রবীন্দ্র সমালোচনার নানা গ্রন্থ রয়েছে।

       'জ্ঞান' যে প্রথাগত শিক্ষার ধার ধারে না,বোধহয় 'পুঁথিদাদু' এক জলজ্যান্ত উদাহরণ! আসল 'রত্ন 'গ্রামের কোন গভীরে লুকিয়ে থাকা এই 'পুঁথিদাদু'র মৃত্যু হয় ১৯ ফেব্রুয়ারী ২০১৭। 'পুঁথিদাদু' কে চাক্ষুষ না দেখতে পাওয়ার আপসোস রয়ে গেলো।

লেখক: উপ-উদ্যানপালন অধিকর্তা, পশ্চিমবঙ্গ সরকার।

                       ....................

Mailing List