স্বপ্ন কেন দেখি আমরা জানেন?

স্বপ্ন কেন দেখি আমরা জানেন?
আনফোল্ড বাংলা প্রতিবেদন: ঘুমিয়ে পড়লেই আমরা সবাই স্বপ্ন দেখি। কখনো আনন্দের, কখনো বা সেটা ভয়ের। তার মধ্যে কিছু স্বপ্ন বিক্ষিপ্ত, কিছু অর্থহীন। কোনোটা আবার আগে ঘটে যাওয়া কোনো ঘটনার অংশবিশেষ। আমরা স্বপ্ন কেন দেখি,স্বপ্নের মানেই বা কী? প্রাচীনকাল থেকেই মানুষ এসব প্রশ্নের উত্তর খুঁজে আসছে। মস্তিষ্ক ও মনের উপর, মানুষের আত্মা যে যে বিষয়গুলো অধিকার করে তা হচ্ছে- সুখ, দুঃখ, আবেগ-অনুভূতি, উদ্বেগ আর ভয়। এসবের সাথে মন ও আত্মার মিতালি হলেই স্বপ্নের সৃষ্টি হয়। মানুষ ঘুমের মধ্যেই স্বপ্ন দেখেন। ভালো আর মন্দ স্বপ্নের সাথে মানুষের মন ও আত্মার নিবিড়তম সম্পর্ক আছে। স্বপ্ন মানুষের জীবনের অংশ। সৃষ্টিজগতে মানুষই কেবল স্বপ্ন দেখেন। অন্য জীবরা তা দেখে না। স্বপ্নের নানা দিক নিয়ে নানা মনীষীর এবং নানা ধর্মের ভিন্ন-অভিন্ন ব্যাখ্যা আছে।
স্বপ্নের উৎপত্তি, ব্যাখা, গুরুত্ব সম্পর্কে অনেক তত্ত্ব ও ধারণা প্রচলিত। এদের মধ্যে সবার প্রথমে যে তত্ত্বের কথা মাথায় আসে,সেটি হল ফ্রয়েডীয় তত্ত্ব। ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষের দিকে মনোবিজ্ঞানী সিগমান্ড ফ্রয়েড স্বপ্নের উৎপত্তি সম্পর্কে একটি তত্ত্ব প্রদান করেন। তার তত্ত্ব অনুযায়ী স্বপ্ন হল মানুষের অবচেতন মনের প্রতিফলন, অবচেতন মনের সুপ্ত আকাঙ্ক্ষা থেকেই স্বপ্নের উৎপত্তি। কিন্তু সুইডিশ মনোবিজ্ঞানী কার্ল জাং, যাকে বিশ্লেষণমূলক মনোবিজ্ঞানের জনক বলা হয়, ফ্রয়েডের তত্ত্বের অনেক অংশই সেটি প্রত্যাখ্যান করেন। তাঁর মতে স্বপ্ন মানুষের জন্য এক গুরুত্বপূর্ণ বার্তা, যা আমাদের বিভিন্ন সমস্যার সমাধান করতে সাহায্য করে। তিনি বিশ্বাস করতেন, আমরা সারাদিনে যা কিছু দেখি, যেসব ঘটনার মুখোমুখি হই, সেগুলো আমাদের স্বপ্ন দেখায় বা স্বপ্ন তৈরীতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা তৈরি করে।
জার্মান মনোবিদ ফ্রিটজ পার্লস এর মতে, স্বপ্ন হল আমাদের অবদমিত সত্ত্বার বহিঃপ্রকাশ। সচেতন অবস্থায় আমাদের যেসব চিন্তা অবদমিত থাকে, সেগুলোই স্বপ্নে প্রকট হয়ে ওঠে। ১৯৭৬ সালে জে. এলান হবসন এবং রবার্ট ম্যাককার্লি সম্পূর্ণ নতুন এক তত্ত্ব প্রদান করেন, যা স্বপ্ন নিয়ে গবেষণার মোড় অনেকটাই ঘুরিয়ে দেয়। মানুষ বেশিরভাগ স্বপ্নই দেখে ঘুমের REM (Rapid Eye Movement) স্তরে। অন্যান্য স্তরে স্বপ্ন দেখলেও বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই সেই স্বপ্ন গুলো মানুষ ভুলে যায়। REM স্তরে দেখা স্বপ্ন গুলোই দীর্ঘসময় মনে থাকে। হবসনের মতে, মস্তিষ্কের লিম্বিক সিস্টেমের যে অংশগুলো আবেগ, অনুভূতি ও স্মৃতি গঠনের সাথে জড়িত (যেমন এমিগডালা, হিপোক্যাম্পাস), REM স্তরে সেগুলো যখন সক্রিয় হয়ে ওঠে, তখন এক ধরনের সংকেত সৃষ্টি হয়। মস্তিষ্ক তখন এই সংকেত গুলো বিশ্লেষণ করতে থাকে,যার ফল হিসেবে আমরা স্বপ্ন দেখি।
২০০১ সালের এক গবেষণায় দেখা গেছে, স্বপ্ন মূলত আমাদের স্মৃতি গঠনে সাহায্য করে। সজাগ অবস্থায় আমরা যেসব সূক্ষ্ম জিনিস এড়িয়ে যাই, সেসব আমাদের অবচেতন মনে জমা থাকে। ঘুমের মধ্যে মস্তিষ্ক এই সূক্ষ্ম বিষয় গুলো বিশ্লেষণ করে আমাদের বিভিন্ন সমস্যা সমাধানে এবং গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নিতে সাহায্য করে।
স্বপ্নের সাথে মন ও আত্মার সম্পর্ক যেমন, ঠিক তেমনি পরিবেশ-পরিস্থিতি, বয়স, কর্মভেদের সাথেও স্বপ্নের সম্পর্ক আছে। ছোট্ট শিশুরা যেমন স্বপ্ন দেখে, প্রবীণরা তেমন দেখেন না। আবার যুবকরা যে স্বপ্ন দেখে, যুবতীরা একই রকম দেখেন না। মানুষ সম্ভবত কল্পনার থেকেও বেশি স্বপ্ন দেখেন। তাই এ নিয়ে বিজ্ঞানেও সৃষ্টি হয়েছে একটি শাখা। যার নাম ‘স্বপ্নবিজ্ঞান’, ইংরেজিতে বলা হয় ‘Oneirology’।
মজার বিষয় হচ্ছে শুধু মানুষ নয়, সব স্তন্যপায়ী প্রাণীই কিন্তু স্বপ্ন দেখে। এদের মধ্যে ডলফিনের REM স্তরের ব্যাপ্তি সবচেয়ে কম, মানুষের ক্ষেত্রে যা আরেকটু বেশি।
স্বপ্ন নিয়ে গবেষণার ফলে দেখা গেছে মজার সব তথ্য। মানবমস্তিষ্কের এই রহস্য উন্মোচন করতে মনোবিদগণ গবেষণা চালিয়েই যাচ্ছেন সবসময়। স্বপ্ন আমাদের কাজে অনুপ্রেরণা জোগায়- এমন তথ্যও বেরিয়ে এসেছে বিভিন্ন গবেষণায়। আশা যে তাদের গবেষণার ফলাফল স্বপ্ন সম্বন্ধে আমাদের সব কৌতূহল মেটাতে সক্ষম হবেন।


