বাংলায় জেলাভাগ জরুরি মানুষের স্বার্থেই, যুক্তি-আবেগ ও কিছু তথ্য

বাংলায় জেলাভাগ জরুরি মানুষের স্বার্থেই, যুক্তি-আবেগ ও কিছু তথ্য
আনফোল্ড বাংলা বিশেষ প্রতিবেদন: জেলা ভাগ মানুষের স্বার্থেই জরুরি। বিশেষত, পশ্চিমবঙ্গের মতো রাজ্যের ক্ষেত্রে। যেখানে এক একটি জেলার আয়তন এবং জনসংখ্যা অনেক বেশি। নতুবা প্রশাসনিক কাজে গতি আনা কঠিন।
ভারতবর্ষ যখন স্বাধীন হয় তখন পশ্চিমবঙ্গে মাত্র ১৪টি জেলা ছিল। সেগুলি হল, কলকাতা, ২৪ পরগনা, হাওড়া, হুগলি, নদিয়া, মুর্শিদাবাদ, মেদিনীপুর, বাঁকুড়া, বর্ধমান, বীরভূম, মালদহ, পশ্চিম দিনাজপুর, দার্জিলিং ও জলপাইগুড়ি।
কোচবিহার তখনও স্বাধীন রাজ্য। ১৯৪৯ সালে কোচবিহার ভারতে যোগ দেয়। ক্ষমতা হস্তান্তর প্রক্রিয়া শেষে ১৯৫০ সালে কোচবিহার পশ্চিমবঙ্গের একটি জেলা হিসাবে আত্মপ্রকাশ করে। স্বাধীনতার পর চন্দননগর ফরাসিদের হাত থেকে ভারতে আসে। ১৯৫৪ সালে হুগলি জেলার সঙ্গে অন্তর্ভুক্ত হয়। আর ১৯৫৬ সালে বিহারের মানভূম জেলার পুরুলিয়া মহকুমাটি পশ্চিমবঙ্গে অন্তর্ভুক্ত হয়ে জেলার মর্যাদা পায়৷ অর্থাৎ তখন আরও দুটি জেলা (পুরুলিয়া ও কোচবিহার) বেড়ে হয় ১৬টি।
এবার একটু পিছিয়ে যাওয়া যাক। ধরা যাক অবিভক্ত মেদিনীপুর জেলার কথা। তখন মেদিনীপুরে ব্লকের সংখ্যা ছিল ৫৪টি। অর্থাৎ একজন জেলাশাসক একটি জেলায় তাঁর দু’বছরের মেয়াদে সব ব্লকে একবার করেও ঘুরতে পারতেন না। কারণ, দূরত্ব এত বেশি ছিল যে, কোনও একটি ব্লক পরিদর্শন করতে গেলে সারাদিন কেটে যেত সেই কাজেই। জেলাশাসকদের নানা গুরুত্বপূর্ণ প্রশাসনিক কাজ থাকে। জেলার বিভিন্ন প্রান্ত থেকে মানুষ তাঁদের সঙ্গে দেখা করতে আসেন। যদি ৫৪টি ব্লক ধরা হয়, একজন জেলাশাসক যদি মাসে দু’দিন ব্লক পরিদর্শনে বেরোন তবু দু’বছরের জেলাশাসকের কার্যকালের মেয়াদে তিনি ৪৮টি ব্লক পরিদর্শন করতে পারতেন। যে সময় অবিভক্ত মেদিনীপুর ভেঙে পূর্ব ও পশ্চিম মেদিনীপুর হল, ২০০২ সালের ১ জানুয়ারি তখন জেলার জনসংখ্যা ছিল প্রায় ৯৭ লক্ষ। অর্থাৎ ১ কোটির কাছাকাছি। যা বিশ্বের অনেক দেশের জনসংখ্যার সমান ছিল।
অর্থাৎ জেলা ভাগ ছাড়া প্রশাসনিক কাজকর্মে গতি অর্থাৎ উন্নয়নের গতি ত্বরান্বিত করা কঠিন। আবার আইনশৃঙ্খলা বজায় রাখাও কঠিন। জেলাভাগ হলে কতগুলি সুবিধে হবে? একজন জেলাশাসক পাবে একটি জেলা। সঙ্গে অতিরিক্ত জেলাশাসক। একজন পুলিশ সুপার। সঙ্গে অতিরিক্ত পুলিশ সুপার। একটি জেলা আদালত। একটি জেলা পরিষদ। একটি জেলা মুখ্য স্বাস্থ্য আধিকারিক। একটি জেলা আবগারি সুপারিনটেনডেন্ট। একজন জেলা কৃষি আধিকারিক, উদ্যানপালন আধিকারিক, জেলা গ্রন্থাগারিক, জেলা স্কুল পরিদর্শক, জেলা তথ্য ও সংস্কৃতি আধিকারিক, পূর্ত, সেচ –সহ একাধিক দফতরের জন্য আলাদা পরিকাঠামো ও ইঞ্জিনিয়ার পাবে। সঙ্গে অবশ্যই মিলবে তাঁদের সহকারী। অর্থাৎ অতিরিক্ত অফিসার বা ইঞ্জিনিয়ার। স্বাভাবিকভাবেই আধিকারিকদের সংখ্যা বাড়লে কাজের গতি বাড়তে বাধ্য। কারণ, সেক্ষেত্রে বাড়বে নজরদারি। সাধারণ মানুষও অনেক সুবিধে পাবেন। একপ্রান্ত থেকে জেলাশাসক, জেলা পুলিশ সুপার বা যে কোনও দফতরের প্রধানের সঙ্গে দেখা করতে যত দূর যেতে হয়, জেলা ভাগ হয়ে সেই দূরত্ব কমবে। আবার সংশ্লিষ্ট আধিকারিকের কাছে দেখা করার জন্য মানুষের সংখ্যাও কমবে। কারণ, জেলা ভাগ হওয়ায় জনসংখ্যাও কমেছে। ফলে আগে একজন জেলার পদস্থ আধিকারিকের কাছে ১০টি অভিযোগ এলে, তখন তা অনেক কমে যাবে। ফলে তিনিও বিষয়টি সময় দিয়ে শুনে পদক্ষেপ করতে পারবেন।
সেই কারণেই কিন্তু ভারতেরও বহু রাজ্যে জেলার সংখ্যা কিন্তু অনেক বেশি। প্রথমেই ধরা যাক পশ্চিমবঙ্গের সীমান্তবর্তী রাজ্যগুলির কথা। তা থেকেই বিষয়টি পরিষ্কার হয়ে যাবে।
পাশের রাজ্য বিহারের জনসংখ্যা প্রায় ১০ কোটি। জেলার সংখ্যা ৩৮।
ঝাড়খণ্ডে জনসংখ্যা প্রায় ৩.২০ কোটি। জেলার সংখ্যা ২৪।
ওড়িশার জনসংখ্যা প্রায় ৪.৫০ কোটি। জেলার সংখ্যা ৩০।
অসমের জনসংখ্যা প্রায় ৩.১০ কোটি। জেলা সংখ্যা ৩৫।
সেখানে পশ্চিমবঙ্গের জনসংখ্যা প্রায় ১১ কোটি। জেলার সংখ্যা এখনও পর্যন্ত মাত্র ২৩ টি। সম্প্রতি আরও সাতটি নতুন জেলার কথা ঘোষণা করেছেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। সেই জেলাগুলি ভাগ হলেও বাংলায় জেলার সংখ্যা দাঁড়াবে ৩০টি। অথচ, জনসংখ্যা কিন্তু প্রায় ১১ কোটি। অর্থাৎ তখনও পাশের রাজ্যগুলি কম জনসংখ্যা নিয়েও অনেক বেশি জেলার অধিকারী থাকবে।
বাংলায় জেলা ভাগের প্রবণতা প্রথম থেকেই কম। প্রথম জেলা ভাগ হয় ১৯৮৬ সালে। চব্বিশ পরগনা জেলাকে ভেঙে উত্তর ও দক্ষিণ চব্বিশ পরগনা জেলা করা হয়। ১৯৯২ সালে পশ্চিম দিনাজপুর ভেঙে হয় উত্তর ও দক্ষিণ দিনাজপুর জেলা। ২০০২ সালে মেদিনীপুর ভেঙে হয় পূর্ব ও পশ্চিম মেদিনীপুর। ২০১৭ সালে পশ্চিম মেদিনীপুর ভেঙে হয় ঝাড়গ্রাম। এবার ফের নতুন করে একবার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। যদিও জেলাভাগের বিপক্ষে তেমন কোনও অভিমত শোনা যায়নি। তবে নাম নিয়ে কিছু আবেগ জড়িয়ে পড়ছে। আশা করা যায়, সেই আবেগ ও যুক্তি মিলিয়ে কাজটি বাস্তবায়িত হতে সমস্যা দেখা দেবে না।


