প্রসঙ্গ ১৬ই অক্টোবর: এক অনন্য রাখিবন্ধন  

প্রসঙ্গ ১৬ই অক্টোবর: এক অনন্য রাখিবন্ধন   
16 Oct 2023, 03:15 PM

প্রসঙ্গ ১৬ই অক্টোবর: এক অনন্য রাখিবন্ধন

 

অনুপ সরকার

 

বাংলার মাটিতে যেমন ভারতের স্বাধীনতা সূর্য অস্তমিত হয়, তেমনি দেশ মুক্তির লড়াইও শুরু হয় প্রথম এই বাংলাতেই। ব্রিটিশ শাসন, শোষণ এবং অত্যাচারের বিরুদ্ধে বাঙালিরাই প্রথম রুখে দাঁড়ায়, শুধু কলমে নয় অস্ত্র হাতেও ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদকে আক্রমণ করার শপথ নিয়ে বাঙালি সমাজ ঝাঁপিয়ে পড়ে। দেশে জাতীয়তাবাদের উত্থানে ও ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনে বঙ্গ সমাজের প্রাধান্যকে দুর্বল করার লক্ষ্যে ব্রিটিশ শাসক বঙ্গীয় আইন পরিষদের বিধি পরিবর্তন ঘটিয়ে বঙ্গ প্রদেশকে দ্বিখণ্ডিত করার চক্রান্তে লিপ্ত থাকে। ধর্মীয় বিভাজন ও সাম্প্রদায়িক উস্কানি ছিল কুচক্রীদের হাতিয়ার; আর নেতৃত্বে চরম ভারত বিদ্বেষী লর্ড কার্জন। ১৯০৩ সালে লর্ড কার্জনের বঙ্গভঙ্গ পরিকল্পনায় সৃষ্টি হয় প্রবল গণ অসন্তোষ। হিন্দু-মুসলিম নির্বিশেষে সকল বাঙালি পরিকল্পনার বিরোধিতা করেন। বাংলাভাষীদের মধ্যে বিভাজন সৃষ্টির উদ্দেশ্যে তিনি বঙ্গ প্রদেশের পূর্বদিকে মুসলিম অধ্যুষিত জেলাগুলিতে গিয়ে বঙ্গভঙ্গের স্বপক্ষে সাম্প্রদায়িক ও ধর্মীয় উস্কানিমূলক বক্তব্যের মাধ্যমে জনমত গঠনে উদ্যোগী হয়েছিলেন। প্রশাসনিক প্রয়োজনের কথা উল্লেখ থাকলেও, ধর্মীয় দুই সম্প্রদায়ের মধ্যে বিভাজনের জঘন্য রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে ১৯০৫ সালে ১৬ই অক্টোবর "আসাম ও পূর্ববঙ্গ' নামে একটি পৃথক প্রদেশ গঠনের মাধ্যমে বাংলাকে বিভক্ত করা হয়।

সমগ্ৰ জনমতকে সম্পূর্ণ তাচ্ছিল্য করে এবং দেশের জাতীয়তাবাদকে ধর্মীয় বিভাজনের মাধ্যমে দুর্বল করার বিরুদ্ধে কবিগুরু লেখেন- ঈশ্বর যে বাঙালিকে বিচ্ছিন্ন করেন নাই তাহাই বিশেষরূপে স্মরণ এবং প্রচার করার জন্য সেই দিনকে আমরা বাঙালিরা রাখিবন্ধনের দিন করিয়া পরস্পরে হাতে হরিদ্রা বর্ণের সূত্র বাঁধিয়া দিব। রাখিবন্ধনের মন্ত্র হবে “ভাই ভাই এক ঠাঁই”। তিনি ঘোষণা করেন, আজ হইতে বাংলাদেশে ঘরের মিলন এবং দেশের মিলন যেন এক উৎসবের মধ্যে আসিয়া সংগত হয়। আজ হইতে প্রতি বৎসর এই দিনকে “আমাদের জাতীয় সম্মিলনের এক মহাদিন বলিয়া গণ্য করিব।’’ সেই দুর্যোগের সময় কবিগুরু বুঝিতে পারেন যে শুধু রাজনৈতিক বা প্রশাসনিক বিচ্ছেদ নয়, সাংস্কৃতিক বিচ্ছেদ ঘটানোও বঙ্গভঙ্গের অন্যতম উদ্দেশ্য। এর দ্বারা সাম্প্রদায়িকতার বিষবৃক্ষ দেশের মাটিতে রোপন করা হচ্ছে। সর্বনাশা ব্রিটিশ ষড়যন্ত্রের প্রতিরোধে জাতি ধর্ম বর্ণ নির্বিশেষে ঐক্যের আহ্বান পৌঁছে দেওয়ার জন্য “বঙ্গচ্ছেদে রাখিবন্ধন” শীর্ষক একটি ইস্তাহার প্রকাশিত হয়। তাতে স্বাক্ষরকারী ছিলেন কবিগুরু নিজে, সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়, রামেন্দ্রসুন্দর ত্রিবেনী, ভূপেন্দ্রনাথ বসু, হীরেন্দ্রনাথ দত্ত ও বিপিনচন্দ্র পাল। শুধু এঁরাই নয়, স্যার আব্দুল হালিম গজনবী, আব্দুল রসুল, বাবা কুয়ার সিং প্রমুখ বহু বিশিষ্ট সংখ্যালঘু নেতা ব্রিটিশরাজের বিরুদ্ধে আন্দোলনে অংশ নিতে আহ্বান জানান। বঙ্গভঙ্গ বিরোধী আন্দোলনের আবহে সর্বপ্রথম স্বরাজের দাবি উত্থাপিত হয়।

১৬ই অক্টোবর – এই দিনটিকে স্মরণ করে কবিগুরু লিখলেন : বাংলার মাটি বাংলার জল/বাংলার বায়ু বাংলার ফল /পূর্ণ হউক পূর্ণ হউক। সৌভ্রাতৃত্বের প্রতীক হিসাবে ও হিন্দু মুসলিম ঐক্য গড়ে তুলতে কবিগুরুর আহ্বানে ওই দিনে সূচিত হলো রাখি বন্ধন। সদলবলে সকালে গঙ্গাস্নান করে গঙ্গাতীরে বিশিষ্ট গণ্যমান্য ব্যক্তি এবং হিন্দু-মুসলমান সহ সকলের হাতে রাখি পরিয়ে দিলেন। তারপর সিক্ত বসনে রাস্তার দু'পাশে সকল মানুষকে রাখি পরাতে পরাতে হাজির হলেন নাখোদা মসজিদে। খবর পেয়ে এলেন ইমাম। একে অপরে আলিঙ্গনে হাতে পরিয়ে দিলেন সম্প্রীতির রাখি। রচিত হল মহামিলনের অপূর্ব দৃশ্য। ব্রিটিশ শাসনের মূলে সপাটে আঘাত করে কাঁপন ধরিয়ে দিয়েছিলেন তিনি। অগণিত মানুষের উৎসাহ ও ভালোবাসা নিয়ে তিনি গড়ে তুললেন এক অনন্য রাখি বন্ধন উৎসব; আহ্বান করলেন- “ঐ দিনকেই প্রতি বৎসর বাঙালির রাখী বন্ধনের দিন বলিয়া স্মরণীয় করিয়া রাখিব। আশা করি বঙ্গের জমিদার সম্প্রদায় প্রজাগণকে, গ্রানের প্রধানের গ্রামবাসীদিগকে, বিদ্যালয়ের ছাত্রগণ তাহাদের প্রতিবাসীদিগকে এই অনুষ্ঠানের তাৎপর্য বুঝাইয়া দিয়া, যাহাতে প্রত্যেক গ্রামে জাতীয় ঐক্যবন্ধনোৎসব সুচারুরূপে সম্পাদিত হয় অবিলম্বে তাহার আয়োজন করিবেন”। ওই দিন কলকাতা জুড়ে একাধিক মিছিল, সভা ও সমাবেশের আয়োজন হয়েছিল। জোড়াসাঁকো থেকে পায়ে হেঁটে রবীন্দ্রনাথ এলেন আপার সার্কুলার রোডে (এপিসি রোড) ফেডারেশন হলের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন অনুষ্ঠানে। সেই দিনের সন্ধ্যায় উপস্থিত হলেন বাগবাজারে পশুপতি নাথের বাড়িতে। পথে চলতে চলতে গাইলেন-“ওদের বাঁধন যতই শক্ত হবে- মোদের ততই বাঁধা টুটবে”। সেদিনের সেই উত্তাল হওয়া মানুষের ঐক্যবদ্ধরূপ ব্রিটিশ সরকারকে বাধ্য করেছিল ১৯১১ সালে বঙ্গভঙ্গ আইন প্রত্যাহারে।

 

বঙ্গভঙ্গকে রোখা সম্ভব হলেও, ১৯৪৭ সালে দেশ ছেড়ে চলে যাওয়ার অন্যতম শর্ত - ধর্মের ভিত্তিতে দেশ বিভাজন ও নতুন ভৌগোলিক অবস্থানে পূর্ববঙ্গ ও পশ্চিমবঙ্গ নামে বঙ্গ বিভাজন মেনে নিতে হয়। পরাধীনতার গ্লানি থেকে মুক্ত হওয়ার আনন্দের মাঝে দেশ ও বঙ্গ প্রদেশ বিভাজনের বিষাদে ভারাক্রান্ত হয়েই পথ চলা শুরু। ব্রিটিশরা ১৯৪৭ সালে এদেশ ছেড়ে গেলেও দেশের জাতীয়তাবাদী চরিত্রকে আঘাত করার জন্য রয়ে গিয়েছে বিভেদপন্থী, সংকীর্ণতাবাদী, সাম্প্রদায়িক শক্তি। জাতিতে জাতিতে, ধর্মের সঙ্গে ধর্মের, ভাষার সঙ্গে ভাষার বিরোধ বাঁধিয়ে নিজেদের লক্ষ্য পূরণে সক্রিয় এই শক্তি। বৈচিত্রের মধ্যে ঐক্য'- যা আমাদের জাতীয়তাবাদের মূল মন্ত্র তাকে আঘাত করার সংস্কৃতিকে লালন পালন করছে স্বদেশী শাসকগণ। ১৯০৫ সালে বঙ্গভঙ্গ আন্দোলনের এখন আর হয়তো কোন প্রাসঙ্গিকতা নেই- সেদিন ছিল সাম্রাজ্যবাদী বিদেশ শাসক, আজ স্বদেশী শাসক দেশের ঐতিহ্যবাহী সংস্কৃতিকে ধ্বংস করে প্রতিষ্ঠা করতে চাইছে উগ্র সংকীর্ণতাবাদী, জাত্যাভিমানে বিকারগ্রস্ত এক সমাজ। স্বাধীনতার ৭৫ বছরে ‘আজাদি অমৃত উৎসব' পালনের আবহে ধর্মীয় সাম্প্রদায়িকতার বিষাক্ত পরিবেশ সমাজে প্রতিষ্ঠা করার লক্ষ্যে পশ্চিমবঙ্গের জন্মদিবস হিসাবে মহামান্য রাজ্যপাল বেছে নিলেন ২০ জুন' দিনটিকে। ১৯৪৭ সালের ২০ জুন বঙ্গীয় আইন সভায় বঙ্গ বিভাজনে প্রস্তাব ব্রিটিশ শাসকদের কৌশলে ও ক্ষমতা লোভী রাজনৈতিক নেতৃত্বের অদূরদর্শিতায় অনুমোদিত হয়। সে এক অন্য ইতিহাস। দীর্ঘ ৭৫ বছর পর পশ্চিমবঙ্গের জন্ম হিসাবে ওই দিনটিকে বাছাই করার পেছনে লুকিয়ে আছে সাম্প্রদায়িক রাজনীতির চিন্তা। আমরা মনে করি পশ্চিমবঙ্গ সর্বদাই ভারত রাষ্ট্রের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ ছিল এবং সেই অবস্থাতেই দেশ স্বাধীন হয়েছে; তাই নতুন করে এই রাজ্যের জন্মদিন পালন আসলে দূরভিসন্ধি মূলক এবং ধর্মীয় জিগির সৃষ্টিকারীদের প্রশ্রয় দেওয়ার নামান্তর।

১৯০৫ সালের সেদিন যে ঐক্যসূত্রের ও সম্প্রীতির সন্ধানে মহান মানবতাবাদী কবি নিজের স্বপ্নচূড়া থেকে, ভাবজগৎ থেকে জনতার মুখরিত সখ্যে নেমে এসেছিলেন, সেই ঐক্য এবং সম্প্রীতি রক্ষার প্রয়োজন সেদিনের চেয়েও আজ আরো বেশি জরুরি হয়ে উঠেছে।

এরই প্রেক্ষাপটে ‘১৬ই অক্টোবর' রাখিবন্ধন উৎসবের প্রাসঙ্গিকতা বিচার করতে হয় আমাদের। আসলে 'রাখি' একটা প্রতীক মাত্র - সম্প্রীতির প্রতীক। কবিগুরুর ঐক্যের আহ্বানে সাড়া দিয়ে একদিন যেমন ঐক্যবদ্ধ বাঙালি জাতি ব্রিটিশ শক্তিকে মাথানত করাতে সক্ষম হয়েছিল, আজ আমরাও তেমনি হৃদয়ের রাখিবন্ধনের মধ্য দিয়ে সমস্ত অপশক্তিকে পরাস্ত করে সম্প্রীতির পরিবেশ গড়ে তুলতে চাই। সাম্প্রদায়িক ধর্মান্ধ শক্তি বিনাশের শপথ গ্রহণের দিন আজ। তাই বাংলার ঘরে ঘরে রাখিবন্ধনকে এক সম্প্রীতির বন্ধনের উৎসব হিসাবে পৌঁছে দিতে সর্বাত্মক প্রয়াস নিয়েছি আমরা। আসুন, আজ ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে সর্বস্তরের মানুষের অংশগ্রহণে সেই সম্প্রীতির বার্তা সর্বত্র ছড়িয়ে দিতে পারি।

 

লেখক: অনুপ সরকার, সাধারণ সম্পাদক, বঙ্গীয় সাক্ষরতা প্রসার সমিতি রাজ্য কমিটি

Mailing List