‘ঘনিষ্ট আত্মীয়ও পাচারকারী, জামাইবাবু, তুতো দাদা, এমনকি নিজের বাবাও’! নারীপাচার যুগে যুগে: পর্ব – ১০, লিখছেন সুখেন্দু হীরা  

‘ঘনিষ্ট আত্মীয়ও পাচারকারী, জামাইবাবু, তুতো দাদা, এমনকি নিজের বাবাও’! নারীপাচার যুগে যুগে: পর্ব – ১০, লিখছেন সুখেন্দু হীরা   
26 Aug 2023, 11:15 AM

ঘনিষ্ট আত্মীয়ও পাচারকারী, জামাইবাবু, তুতো দাদা, এমনকি নিজের বাবাও’! নারীপাচার যুগে যুগে: পর্ব ১০, লিখছেন সুখেন্দু হীরা

 

সুখেন্দু হীরা

                         

 উমরাওজানের গল্প সবার জানা। লখনউয়ের বিখ্যাত তবায়েফ অর্থাৎ বারাঙ্গনা উমরাহজানের জীবনের কাহিনী নিয়ে মির্জা মহম্মদ রুশোয়া রচিত উপন্যাস 'উমরাওজান আদা'। যার উপর ভিত্তি করে ভারত, পাকিস্তান উভয় দেশেই চলচ্চিত্রে নির্মিত হয়েছে। ১৯৮১ খ্রিস্টাব্দে ভারতে নির্মিত হিন্দি ছবিতে নাম ভূমিকায় অভিনয় করেছিলেন বিখ্যাত অভিনেত্রী 'রেখা'। এই উমরাওজানের পূর্ব নাম ছিল আমীরন। ফৈজাবাদের আমীরণকে তাঁর প্রতিবেশী প্রতিহিংসা বসত অপহরণ করে লখনউতে এনে বিক্রি করে দেয়।

 

  আমরা আগেই বলেছি নারীপাচার সাধারণত তিন ভাবে হয়। প্রথম হচ্ছে কাজ দেওয়ার নাম করে বাইরে নিয়ে গিয়ে বিক্রি করে দেওয়া।  দ্বিতীয়ত হচ্ছে বিয়ের নাম করে পাচার। তৃতীয় হচ্ছে প্রেমের ফাঁদে ফেলে পাচার। এছাড়া অন্যান্য অনেক ভাবে পাচার হয়ে থাকে। কারণ হিসেবে থাকতে পারে দারিদ্র, লোভ, প্রতিহিংসা ইত্যাদি। প্রতিহিংসার একটি উদাহরণ প্রথমেই দেওয়া হয়েছে।

 

অনেক সময় দেখা যায় নিজের ঘনিষ্ট আত্মীয় পাচারকারী; জামাইবাবু, তুতো দাদা, এমনকি নিজের বাবা। গত ৮ ই আগস্ট, ২০২৩ মানব পাচার রুখতে সচেতনতা বাড়াতে এক বিশেষ অনুষ্ঠান আয়োজন করেছিল 'কলকাতা পুলিশ' বডিগার্ড পুলিশ লাইনসে। সেখানে পরিসংখ্যান দিয়ে বলা হয় পরিচিতরাই পাচারের কাজে সহায়তা করছে মূল পাচারকারীকে। দেখা যাচ্ছে অভিযুক্তদের মধ্যে ৯৫% কোনও না কোনওভাবে পাচার হওয়া নারী ও শিশুর পরিচিত। কোনও কোনও ক্ষেত্রে মেয়ে রাগ করে বাড়ি ছেড়ে চলে গেলে বা হারিয়ে গেলে সহজেই পাচার হয়ে যায়।         

 

 পুনরায় পাচার হতেও দেখা যায়। অনেক সময় উদ্ধার হওয়া মেয়েরা আর বাড়িতে থাকতে চায় না। কারণ ঐ অন্ধকার জগতে যেটুকু স্বাচ্ছন্দ, নাগরিক সুখ পেত, গ্রামে ফিরে সেটা সে আর পায় না। সে এবার স্বেচ্ছায় পালায়, সঙ্গে নিয়ে যায় কোনও অসহায় মেয়েকে। কখনও কখনও কোন মেয়ে উদ্ধার হয়ে ফিরলে দেখা যায় মেয়েটি এইডস্‌ রোগাক্রান্ত।

 

  পুনা এলাকার যৌনপল্লী থেকে মাঝে মাঝে পাচার হওয়া মেয়েরা উদ্ধার হয়। অনেক ক্ষেত্রে দেখা যায় তাঁরা এইডস্ রোগাক্রান্ত। স্বেচ্ছাসেবী সংস্থাগুলো এরকম অভিযোগ করেন, এইসব মেয়েরা যখন এইডস রোগাক্রান্ত হয়, বা যৌনপল্লীর মেয়েদের বয়স বেশি হয়ে গেলে অর্থাৎ যাদের দিয়ে কোনও আর ব্যবসা করানো যাবে না, তখন তাদের স্থানীয় পুলিশের সহায়তায় এই উদ্ধারের নাটক করে থাকে। যৌনপল্লী থেকে এসব বহিষ্কৃত মেয়েদের এভাবে বোঝানো হয়, 'তোরা তো আর আয় করতে পারবি না, তার থেকে প্রশাসনের মাধ্যমে ঘরে ফিরে যা, কিছু সরকারি সাহায্য পাবি।

 

    ২০১৯ সালে বিধাননগর পুলিশ কমিশনারেট নিউটাউনে এক আবাসনের মধুচক্র থেকে উদ্ধার করেছিল একটি ১৬ বছরের নাবালিকাকে। মেয়েটির বাবা ও মায়ের মধ্যে বিচ্ছেদের ফলে সে দাদুর কাছে থাকত। সংসারে আর্থিক দুর্বস্থার কারণে সে এই আবাসনে আসে কাজের সন্ধানে। তারপর জড়িয়ে পড়ে এই যৌন পেশায়।

 

  বর্তমানে পরিবারের অস্থিরতা, পারিবারিক অশান্তি মেয়েদের দেহ ব্যবসা অন্ধকার জগতে ঠেলে দিচ্ছে। বর্তমান আর্থ-সামাজিক পরিস্থিতি এবং অর্থনৈতিক স্বাধীনতার চাহিদা মেয়েদের বাড়ির বাইরে নানা কাজে উৎসাহিত করছে। মেয়েদের করতে হচ্ছে নানা অসংগঠিত কর্মক্ষেত্রে। যেমন ম্যাসাজ সেন্টার, বিউটি পার্লার ইত্যাদি। সেখানে মেয়েদের প্ররোচিত করা হচ্ছে যৌনপেশা বেছে নিতে। অভিনয়ে বা কোনও 'রিয়ালিটি শো'-এ সুযোগ পাইয়ে দেওয়ার নাম করে মধুচক্রে যোগদানে বাধ্য করা হচ্ছে মেয়েদের।

 

 সাধারণত নারীপাচারীরা হল বিশেষ অপরাধী গোষ্ঠী। যাদের জাল ভুবনব্যাপী ছড়ানো। এছাড়া যারা অন্য অপরাধের সঙ্গে যুক্ত তারাও পার্ট-টাইম অর্থাৎ সুযোগ পেলে নারী পাচার করে বা মূল নারীপাচারকারীদের সাহায্য করে। যেমন বারুইপুরে গোচরণ এলাকায় ব্যাঙ্ক ডাকাতেরা নারী পাচারের সঙ্গে যুক্ত ছিল। এরা অন্তঃসত্ত্বা মহিলাদের পর্যন্ত ছাড়ত না এবং কোলের শিশুসহ মেয়েদের পাচার করে দিত। একটি ঘটনা ঘটেছিল একটি বিবাহিত মেয়ে তাঁর কোলের বাচ্চা সহ পাচার হয়ে গিয়েছিল। মেয়েটিকে পরে পুনা থেকে উদ্ধার করা হয়। কিন্তু তাঁর বাচ্চাটিকে খুঁজে পাওয়া যায় নি। ফিরে এসে সে প্রশাসনের দুয়ারে দুয়ারে ঘুরত, তার হারানো শিশুকে ফিরে পাওয়ার জন্য। যদি পাওয়াও যায়; হায়, এতদিন বাদে সেই শিশুকে কি আর তিনি চিনতে পারবেন! শিশুরা যত বড় হয়, অবয়বও তত পরিবর্তন হয়।

এরকম নানাবিধ সামাজিক সমস্যা নারীপাচারের অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টি করেছে।

 

তথ্য ঋণ:

উমরাওজান: ভাষান্তর সুনীল কুমার বসু (সুবর্ণরেখা)

 

Mailing List