দূষণমুক্ত জ্বালানি মুখ থুবড়ে পড়লো জঙ্গলমহলে, কারণ খুঁজলেন ড. প্রভাতকুমার শীট  

দূষণমুক্ত জ্বালানি মুখ থুবড়ে পড়লো জঙ্গলমহলে, কারণ খুঁজলেন ড. প্রভাতকুমার শীট   
06 Aug 2023, 01:30 PM

দূষণমুক্ত জ্বালানি মুখ থুবড়ে পড়লো জঙ্গলমহলে, কারণ খুঁজলেন ড. প্রভাতকুমার শীট

 

ড. প্রভাতকুমার শীট

 

দূষণমুক্ত জ্বালানির উত্তরণ ঘটাতে ২০১৬ সালে গরীব মেয়েদের উজ্জ্বলা এলপিজি প্রকল্প এনেছিল কেন্দ্রীয় সরকার। আজও উজ্জ্বলা গ্যাস পরিবারের রান্নার জ্বালানি ব্যবহারের ধরন ও মেয়েদের স্বাস্থ্যের ঝুঁকি কমাতে পারেনি। উপরন্তু  উজ্জ্বলা সুবিধাভোগী পরিবারগুলি এলপিজি ব্যবহার ছেড়ে দিচ্ছে। মূলত পরিবারের আর্থিক অনটন ও এলপিজি ব্যবহারের অসুবিধার পাশাপাশি বনের কাঠের সহজলভ্যতা দূরে ঠেলে দিয়েছে উজ্জ্বলা গ্যাসকে। এমন তথ্য উঠে এসেছে পশ্চিমবঙ্গ সরকারের বিজ্ঞান, প্রযুক্তি ও জৈব প্রযুক্তি বিভাগের আর্থিক সহযোগিতায় জঙ্গলমহলের ঝাড়গ্রাম ও পশ্চিম মেদিনীপুর জেলার ২৪৫ গ্রামের ৩৫১০ পরিবারের ক্ষেত্র সমীক্ষায়। এই সমীক্ষার মূল উদ্দেশ্য ছিল জঙ্গলমহলের বনজ সম্পদের বায়োমাস ও কার্বন স্টকের পরিবর্তনশীলতা এবং সাধারণ মানুষের দৈনন্দিন জীবনে এর প্রভাব।

ভারত সরকার পরিবেশের সুস্থিতি বজায় রাখতে, জলবায়ু পরিবর্তন কমাতে ও মেয়েদের ধোয়াজনিত রোগ থেকে বাঁচতে স্বচ্ছ জ্বালানি হিসেবে উজ্জ্বলা ব্যবহারে জোর দিয়েছিল। কিন্তু তা ফলপ্রসু হয়নি জঙ্গলমহলের গ্রামগুলিতে। ২০১৯ সালের নীতি আয়গের স্বচ্ছ রান্নার জ্বালানি যোগানের এক রোডম্যাপ প্রকাশ করেছে। তাতে সিলিন্ডার কিনতে ভর্তুকি ছেঁটে মেয়েদের ঋণ দেওয়ার কথা সুপারিশ করেছে। কারণ মেয়েদের কাঠ সংগ্রহ করতে দিনে অন্তত তিন থেকে চার ঘন্টা সময় লাগে, ছেলেমেয়েদের সময় দিতে পারেনা, তাছাড়া কাঠ জ্বালানো স্বাস্থ্যের পক্ষেও ক্ষতিকর।

তাই মেয়েদের সচেতন করতে উন্নত স্বচ্ছ জ্বালানি ব্যবহারে জোর দিচ্ছে। কিন্তু শত চেষ্টা সত্ত্বেও গরিব পরিবারের কাছে গ্যাস কেনা যেন বিলাসিত হয়ে দাঁড়িয়েছে। সমীক্ষায় দেখা গেছে ৬৫ শতাংশ উজ্জ্বলার গ্রাহকেরা একটিমাত্র সিলিন্ডার ব্যবহার করে আর নেননি। প্রায় ৩০ শতাংশ গ্রাহকরা বছর থেকে দুই থেকে তিনটি সিলিন্ডার নিচ্ছে মাঝেমধ্যে, যা শহরাঞ্চলের গ্রাহকের থেকে অনেক কম। বিগত তিন বছরে ভর্তুকিহীন রান্নার গ্যাসের দামও বেড়েছে আট থেকে দশ শতাংশ।

মেদিনীপুর জেলার শালবনী ব্লকের আউশবাঁধি গ্রামের বাসিন্দা কল্পনা মান্ডি বলেন বাবুদের গ্যাসে রান্না, আমরা জঙ্গলের কাঠু কুড়িয়ে রান্না করি, গরিবের আবার গ্যাস কী? উজ্জ্বলা গ্যাস একবারই ব্যবহার করেছিলাম। টাকার অভাবে ভর্তি করতে পারিনি আর। গত তিন বছর ধরে ফাঁকা সিলিন্ডার পড়ে আছে বাড়িতে। জঙ্গলমহলের প্রায় ৮৪ শতাংশ পরিবার জঙ্গল থেকে শুকনো কাঠ, ঝাঁটি জ্বালানি কুড়িয়ে রান্না করেন।

অগত্যা ভরসা সেই জঙ্গলের কাঠ। ধোঁয়ায় সারা ঘর কালি, চোখে জল, বাচ্চাদের কাশি লেগেই থাকে। কাঠ বা ঘুঁটের উনুনে দূষণের মাত্রা অনেক বেশি গ্যাসের থেকে। এক কেজি কাঠ পুড়ালে প্রায় ১.৮৩ কেজি কার্বন উৎপন্ন হয়। পরিবার পিছু প্রতিদিন প্রায় ১০ থেকে ১২ কেজি জ্বালানি কাঠ লাগে। আবার এক কেজি কাঠ পুড়ালে কার্বন মনোক্সাইড উৎপন্ন হয় প্রায় ১০-৪৫ পিপিএম, কিন্তু এলপিজি গ্যাস থেকে মাত্র ৬-৭ পিপিএম কার্বন মনোক্সাইড নিঃসরণ হয়। বর্ষাকালে কাঠ ভেজা থাকলে দূষণের মাত্রাও বাড়ে এবং বাতাসে সূক্ষ্ম কণা পদার্থ প্রতি ঘনোমিটারে পিএম ২.৫ মাইক্রোমিটার অনেক বেশি হয়। যা সহজে মেয়েদের বা শিশুদের স্বাস্থ্যের ক্ষতি করে।

বাড়ির মেয়েদের দিনে তিন থেকে চার ঘণ্টা রান্নাঘরে কাটাতে হয়। জঙ্গলমহলে এলপিজি গ্যাসের ব্যবহার মাত্র দুই শতাংশ পরিবারের। প্রায় ৮৪ শতাংশ পরিবার রান্না করতে হয় কাঠের উনুনে। আর কাঠের উনুন এর পাশে বসে রান্না করতে হয় অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে। প্রতিদিন ২৪ ঘন্টায় পিএম ২.৫ সহনশীলতার মান ৩৫। সেখানে কাঠ জ্বালানিতে ১৫০ থেকে ৩৫০ পিপিএম উৎপন্ন হয়।  ফলে চোখ জ্বালা, শ্বাসকষ্ট, ফুসফুসের প্রদাহ, স্বাভাবিক দুর্বল্য ও স্বাস্থ্যের ক্ষতিকরে। জঙ্গলের পাশাপাশি গ্রামের বাসিন্দারা একেবারেই গ্যাস ব্যবহারে অনীহা প্রকাশ করেছে। বিশেষ করে আর্থিক অনটনের কারণে ও চিরাচরিত বায়োমাসের ব্যবহারে চোখের জল ফেলে তিনবেলা হাঁড়ি চড়াতে হচ্ছে জঙ্গলমহলের অধিবাসীদের।

লেখক: রাজা নরেন্দ্রলাল খান মহিলা মহাবিদ্যালয়ের শিক্ষক।

Mailing List