পরিবর্তনশীল বিশ্ব রাজনীতি ও বাংলাদেশ

পরিবর্তনশীল বিশ্ব রাজনীতি ও বাংলাদেশ
শেখর দত্ত
স্বাধীনতার রজতজয়ন্তী উৎসব অতিক্রমের দিনগুলোতে মুক্তিযুদ্ধের সময়কার বিশ্ব রাজনীতি-কূটনীতির সাথে এখনকার পরিবর্তন বিবেচনায় নিলে বিস্ময়াভূত হতে হয়। এটা ঠিক পরিবর্তনই জীবনের অঙ্গ। কিন্তু মত-পথ-চিন্তা-অবস্থানের এতটা পরিবর্তন হয়ে যাবে, তা তখন বিশ্বের সেরা সমাজবিজ্ঞানীরা কেন ত্রিকালদর্শী ভবিষ্যৎবক্তাও কল্পনা করতে পারতেন না। সোভিয়েত ইউনিয়ন ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ঠান্ডাযুদ্ধ যুগের পরিসমাপ্তি ঘটেছেই কেবল নয়, সমাজতান্ত্রিক বিশ্ব, পূজিবাদী বিশ্ব, তৃতীয় বিশ্ব এখন নেই। আমাদের দুর্দিনের সাথী বন্ধুরাষ্ট্র সোভিয়েত ইউনিয়নসহ পূর্ব ইউরোপের মানচিত্র গেছে পাল্টে। স্টার ওয়ার, শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান প্রভৃতি কথাগুলো যেন হাওয়ায় মিলিয়ে গেছে।
প্রসঙ্গত, দ্বিতীয় বিশ্ব যুদ্ধের পর ঔপনিবেশিক বিশ্ব ভেঙ্গে গিয়ে নতুন নতুন রাষ্ট্রের জন্মের পর ঠান্ডা যুদ্ধ যুগে সেইসব দেশগুলো নিজেদের অস্তিত্ব রক্ষা কিংবা মাথা তুলে দাঁড়ানোর জন্য হয় সোভিয়েত ইউনিয়ন নয়তো আমেরিকার রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক-সামরিক ছত্রছায়ায় যেতে বাধ্য হতো। উন্নয়নের পথ সমাজতন্ত্র না পূঁজিবাদ এ নিয়ে ছিল বিতর্ক। সোভিয়েত ইউনিয়ন শান্তি-স্বাধীনতা-সমাজতন্ত্রের স্লোগান তুলে তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোকে আকর্ষণ করতো। গড়ে উঠেছিল সোভিয়েত প্রাভাবিত তৃতীয় বিশ্ব। বিশ্ব শন্তির আন্দোলন। জোট নিরপেক্ষ আন্দোলন তখন মুক্তির পথ দেখাতো। উল্টোদিকে আমেরিকা গণতান্ত্রিক বিশ্ব, মুক্তবিশ্ব প্রভৃতি শ্লোগান সামনে আনতো। একদিকে গণআন্দোলন, গণসংগ্রাম আর অন্যদিকে সামরিক ক্যুয়ের প্রতিযোগিতা চলতো।
সোভিয়েত ইউনিয়ন পতনের পর মনে হতো আমেরিকার নেতৃত্বে এককেন্দ্রিক বিশ্ব পৃথিবী শাসন করবে। কিন্তু তাও এখন উবে যচ্ছে। আন্তর্জাতিক নিয়মনীতি উপেক্ষা করে আণবিক শক্তিধর রাষ্ট্রের সংখ্যা ক্রমে বাড়ছে। উপমহাদেশে ভারত ও পাকিস্তান, এশিয়ায় উত্তর কোরিয়া এখন আণবিক শক্তিধর রাষ্ট্র। তখন যদি পাকিস্তানের আণবিক বোমা থাকতো তবে মুক্তিযুদ্ধের পরিণতি কি হতো কে জনে! কয়েকদিন আগে জানলাম, ২০১৫ সালের চুক্তি ও পরে অবরোধের প্রতি বুড়ো আঙ্গুল দেখিয়ে মধ্যপ্রাচ্যের শক্তিধর রাষ্ট্র ইরান ইউরেনিয়াম ধাতব বা সিলিকন ফুয়েল প্লেট তৈরি করেছে এবং বোমার কাছাকাছি এসে গেছে সেই দেশ। আন্তর্জাতিক আণবিক সংস্থা এর নিন্দা করেছে; আমেরিকা, ইউরোপীয় ইউনিয়ন হুঁশিয়ারি দিয়েছে। কিন্তু কে শুনে কার কথা। ইরান পাল্টা হুমকি দিয়েছে ইউরেনিয়াম মজুদ বাড়াবে।
প্রকৃত বিচারে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর জন্ম নেওয়া শিশু রাষ্ট্রগুলো সবাই এখন সাবালকত্ব পেয়ে সামরিক শক্তি সঞ্চয়ে উদ্রীব হয়ে আছে। কোনো রাষ্ট্রই এখন পদাণত বা নিয়ন্ত্রিত থাকতে চাইছে না। যে দেশ অর্থনৈতিকভাবে পারবে, সে দেশই যে আণবিক শক্তিধর হতে চাইবে কিংবা সামরিক শক্তিধর হয়ে পার্শ্ববর্তী দেশগুলোকে প্রভাবিত বা নিয়ন্ত্রণে আনতে চাইবে তা অবস্থাদৃষ্টে ধারনা করা চলে। তাই আন্তর্জাতিক নিয়ম-কানুন, চুক্তি-সমঝোতা, বন্ধু-শত্রু সব সময়ের গতিপথে পরিবর্তনের মধ্যে পড়ে গেছে। হিসাব- নিকাশ পাল্টে গেছে বা যাচ্ছে। প্রসঙ্গত, রাশিয়া এখনও সামরিক শক্তিধর রাষ্ট্র হলেও মূলত অর্থনৈতিক কারণে বিশ্ব রাজনীতির রঙ্গমঞ্চে নেই, নিজ সীমান্তে প্রভাব আধিপত্য বজায় রাখতে হিমসিম খাচ্ছে। এদিকে বিশ্ব প্রেক্ষাপটে সবচেয়ে বড় পরিবর্তন ঘটেছে চীনের শক্তি ও অবস্থানে। চীন এখন মহাপরাক্রমশালী হয়ে উঠে অথর্নৈতিক-রাজনৈতিক-সামরিক প্রভৃতি সবদিক থেকে আমেরিকাকে পাল্লা দিতে উদ্যত।
একটু খেয়াল করলেই দেখা যাবে, ঠান্ডাযুদ্ধ যুগে সোভিয়েত ইউনিয়নের অর্থ সামর্থ্য কিন্তু এখনকার চীনের মতো শক্ত ছিল না। তারা সামনে রাখতো রাজনৈতিক তত্ত্ব-মত। জনমতই শক্তি বলে সেই দেশ সমাজতন্ত্রই মুক্তি পথ তত্ত্ব সামনে আনতো। তাতেই সদ্য স্বাধীনতাপ্রাপ্ত দেশগুলো তথা তৃতীয় বিশ্বের মানুষ বিশেষত শ্রমিক-কৃষক-ছাত্র আন্দোলিত হতো। চীন এখন তত্ত্ব-মতের আপ্তবাক্যের মধ্যে নেই। টাকা ও পণ্য হচ্ছে তার কূটনীতির বাহন। আন্তর্জাতিক অঙ্গনে সমাজতন্ত্রে কথা বলে না। নগদ প্রাপ্তি হচ্ছে চীনের কূটনীতির মূলমন্ত্র। আমেরিকার প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প যখন দেশের অর্থনীতির দিকে তাকিয়ে ‘আমেরিকা ফাস্ট’ স্লোগান দিয়ে দেশমুখী হয়েছে, তখন চীন এক্ষেত্রে সুকৌশলে এগিয়ে গেছে। রফতনি বাণিজ্য ও বিনিয়োগে কেবল তৃতীয় বিশ্বের দেশ নয়, ইউরোপে তার প্রভাব ক্রমাগত বাড়াচ্ছে। বিগত ১৭ ফেব্রুয়ারি বিবিসির নিউজ থেকে জানা যায়, ইউরোপীয় ইউনিয়নের সবচেয়ে বড় বাণিজ্যিক অংশীদার হিসাবে আমেরিকাকে টপকে গেছে চীন। গত বছর বাণিজ্যের পরিমাণ পৌছেছে ৭০ হাজর ৯শ কোটি ডলার, আমেরিকার ৬৭ হাজার কোটি ডলার।
লেখাটি যখন লিখছি, তখন নিকট এক বন্ধু টাইমস অব ইন্ডিয়ায় ২০ জুলাই ২০২১ প্রকাশিত একটি ভিডিও নিউজ লিংক পাঠায়। হেডিং হচ্ছে: ‘চায়না থ্রেটেনস টু নিউক জাপান ওভার পসিবল তাইওয়ান থ্রেট।’ সেই সংবাদ থেকে জানা যায়, চাইনিজ কমিউনিস্ট পার্টি তাইওয়ান ইস্যুতে জাপানের বিরুদ্ধে একটি ভিডিও প্রচার করেছে, যাতে, জাপানকে হুঁশিয়ারি দিয়ে বলা হয়েছে যে, যদি তাইওয়ানে নাক গালানো বন্ধু না করা হয়, তবে ‘সর্বাত্মক আনবিক যুদ্ধ’ (ফুল স্কেল ওয়ার) হবে। ‘বলা হয়েছে‘ আমরা প্রথমে আণবিক বোমা ব্যবহার করবো, ব্যবহার ধারাবহিকভাবে করতেই থাকবো। ততক্ষণ করতে থাকবো যতক্ষন না জাপান নিঃশর্ত আত্মসমর্পন করে বলবে, দ্বিতীয়বার নাক গলবে না।’ ২০ লাখ মানুষ এই ভিডিও বার্তা দেখে এবং পরে তা নাকি মুছে ফেলা হয়েছে। আপলোড হয়ে যাওয়ায় তা প্রচারে এসেছে।
এদিকে পিকিং-এর সঙ্গে সম্পর্কের ক্ষেত্রে ওয়াশিংটন ‘শক্তিমত্তার’ অবস্থান থেকে কথা বলবে। বক্তব্যের জবাবে ২৬ জুলাই চীনের দৈনিক গ্লোবাল টাইমসে চীনা পররাষ্ট্রমন্ত্রী নতুন হুঁশিয়ারি দিয়ে বলেছেন, যুক্তরাষ্ট্রকে শিখতে হবে অপরের সঙ্গে কেমন ব্যবহার করতে হয়। তা যদি যুক্তরাষ্ট্র এখনও না শিখে থাকে,তাহলে আন্তর্জাতিক সঙ্গীদের নিয়ে আমরা সেটা শিখিয়ে দেবো। বিশ্বের কোনো দেশের ওপর এখন আর অন্য কোনো দেশের শ্রেষ্ঠত্ব নেই এবং চীন কখনও তার সঙ্গে অন্য কোনো দেশকে সেরকম আচরণ করার অনুমতি দেবে না। এমন পাল্টাপাল্টি অবস্থানে নতুন উত্তেজনা সৃষ্টি হয়েছে। মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগ, বাণিজ্য অবরোধ, সাইবার নিষেধাজ্ঞা প্রভৃতির মধ্যেও চীন নিজের শক্তিমত্তা প্রদর্শন করে আমেরিকার সঙ্গে লড়ে যচ্ছে।
সামরিক ক্ষেত্রের এই উত্তেজনার মধ্যে চলছে অর্থনৈতিক ক্ষেত্রেও তীব্র প্রতিদ্বন্দ্বিতা ও পাল্টাপাল্টি। এক্ষেত্রে বিগত জুন মাসে ইংল্যান্ডের অনুষ্ঠিত জি সেভেন বৈঠকের কথা স্মরণ করা যেতে পারে। জি সেভেন বৈঠকে বিশ্বব্যাপী অবকাঠামো নির্মাণ, জলবায়ু পরিবর্তন প্রভৃতির ওপর গুরত্ব দিয়ে ‘বিল্ড বেটার ওয়াল্ড’ স্লোগান সামনে আনা হয়। তাতে রেলপথ, সড়ক পথ ও বন্দর নির্মণে বিভিন্ন দেশকে সাহায্য দেওয়া হবে। চীনের ‘বেল্ট এন্ড রোড ইনিশিয়েটিভ’ পরিকল্পনায় অবকাঠামো উন্নয়নে কোটি কোটি ডলার বিনিয়োগ পরিকল্পনা শুরুর বিপরীতে এই কর্মসূচি গ্রহণ করা হয়। চীনা ঋণের বোঝা বা জালে আটকে যাওয়ার অভিজ্ঞতা সামনে এনে বলা হয়, অবকাঠামো উন্নয়নের জন্য জি সেভেন মূল্যবোধ দ্বারা চালিত, উচ্চমানের এবং স্বচ্ছ অংশীদারিত্বের প্রস্তাব দেবে। মার্কিন প্রেসিডেন্ট বাইডেন আহ্বান জানান, ‘পশ্চিমা মূল্যবোধের শ্রেষ্ঠত্ব তুলে ধরতে হবে।’
স্বভাবতই বৈঠকে প্রশ্ন ওঠে, বেটার ওয়াল্ড গড়ার অর্থ আসবে কোথা থেকে। জার্মান চ্যান্সেলর এ্যাঞ্জেলা মার্কেল বলেন, ইউরোপীয় ইউনিয়ন অর্থ ছাড় দেওয়ার মতো অবস্থায় আসেনি। লক্ষ্যণীয় হলো, বিশেষভাবে জার্মানি ও ইতালির সঙ্গে চীনের বাণিজ্যের এখন বাড়বাড়ন্ত। মজার ব্যাপার হলো, প্রেসিডেন্ট বাইডেন করোনা ভাইরাস মহামারি -পরবর্তী বিশ্বকে গণতন্ত্র ও স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে সংগ্রামের জন্য আহ্বান জানান। কিভাবে যে পাল্টে গেল দান! গণতন্ত্রের জন্য সংগ্রামের কথা বলছে আমেরিকা! আইয়ুব -ইয়াহিয়াকে হয়ত আমেরিকার প্রেসিডেন্ট এখন মনে করতে পারছেন না। করোনা ভাইরাসের বিরুদ্ধে লড়াই করা ছাড়াও দেশটি এখন কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা, কোয়ান্টাম কম্পিউটিং, সিমিকন্ডেকটার প্রভৃতি বিষয়ে সাহায্য সহযোগিতা করবে বলে বিশ্ববাসীকে আশ্বাস দিয়েছেন। এদিকে বৈঠক শেষ হতে না হতেই চীন জি সেভেন নেতাদের সতর্ক করে দিয়ে বলেছে, চীনকে হুমকি হিসাবে দেখা বন্ধ করা উচিত। কিছু দেশ বা একটি গোষ্ঠী সারা বিশ্ব নিয়ন্ত্রণ করবে সেই দিন শেষ।
দিন কার কবে শেষ হবে, কার কখন উত্থান ও পতন হবে, তা কে বলতে পারে! আমাদের মুক্তিযুদ্ধের সময় কেউ কি ভাবতো সোভিয়েত রাশিয়ার পতন হবে! কেউ কি ভাবতো চীন- আমেরিকার মিতালি ভেঙ্গে গিয়ে একে অপরের মুখোমুখি দাঁড়াবে! যুক্তরাষ্ট- ভারত নৈকট্য সৃষ্টি হবে। সময়ই সবকিছুর নিয়ন্ত্রক। স্মরণ করা যেতে পারে, মুক্তিযুদ্ধের সময়েই পাকিস্তানকে রক্ষা করা এবং এশিয়াতে রাশিয়া ও ভারতের বিরুদ্ধে চীনকে ব্যবহারের অসৎ উদ্দেশ্য নিয়ে ‘খলনায়ক’ ভুট্টোর দূতালিতে কিসিঞ্জার পিন্ডি থেকে অনেকটাই গোপনে পিকিং যান এবং মাও সে তুং-এর পিংপং রাজনীতিকে পরিপূর্ণতা দেন। উপমহাদেশে আমাদের মুক্তিযুদ্ধের বিরুদ্ধে আমেরিকা-চীন- পাকিস্তান অক্ষশক্তি গড়ে ওঠে। ‘ পেপার টাইগার’ আমেরিকা হয়ে ওঠে চীনের বন্ধু।
এতে একদিকে ৩০ লাখ বাঙালির রক্ত ঝড়ে, ৩/৪ লাখ নারীর ইজ্জত লুণ্ঠিত হয়, চীন-আমেরিকা-পকিস্তানের পরাজয় ঘটে। কিন্তু এরই প্রতিদানে ‘সমাজতান্ত্রিক চীন’ ‘লাল চীন’ হয়ে ওঠে আমেরিকার নিকট বন্ধু, পূজিবাদী দুনিয়ার সাহায্য-সহযোগিতা নিয়ে পরবর্তীতে ‘পৃথিবীর কারাখানা।’ সূচনায় আমাদের রক্তের ভেতর দিয়েই হয় চীনের অর্থনৈতিক উত্থান। একটু খেয়াল করলেই দেখা যাবে, রাশিয়া যখন ছিল আমেরিকার প্রতিদ্বন্দ্বি, তখন ইউরোপ ছাড়াও রাশিয়ার সীমান্তজুরে এশিয়ার মধ্যপ্রাচ্য ছিল বিশ্ব উত্তেজনার রেডস্পট। প্রসঙ্গত, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরই পরাশক্তি হয়ে ওঠা আমেরিকা বুঝতে পারে আগামীতে জ্বালানির উৎস হবে তেল। এক সময় তা পেট্রোডলারে রূপ নেয়। তখন মধ্যপ্রাচ্যে তেল আর প্যালেস্টাইন ইস্যু বিশ্ব রাজনীতির প্রধান ইস্যু হয়ে দাঁড়ায়।
এখন দেখা যচ্ছে জ্বালানি হিসাবে বিকল্প দাঁড়াচ্ছে। নতুন প্রযুক্তি, নতুন জীবাশ্ম এবং এমনকি পাথুরে তেল জ্বালানির উৎস হিসাবে স্থান করে নেবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। তেলের ওপর নির্ভরশীলতা কমতে থাকবে, তেলের মূল্য কমবে, মধ্যপ্রাচ্যের জৌলুস কমবে, মধ্যপ্রাচ্যে ধেয়ে আসছে অর্থনৈতিক সংকট প্রভৃতি অনুমান করা হচ্ছে। দেশগুলের জমাকৃত অর্থ ফুরিয়ে যাবে। ব্যাপক খরচ কমাতে হবে বলে কথা উঠছে। ইত্যাদি ইত্যাদি। ক্রমে অর্থনৈতিক-রাজনৈতিক-সামরিক দিক থেকেই নয়, ‘পাইরেসী’ তথা চুরি করে তথ্যপ্রযুক্তি ও বিজ্ঞান-প্রযুক্তিতেও চীন আগামীতে আমেরিকাকে চ্যলেঞ্জ জানাতে যাচ্ছে।
চতুর্থ, শিল্প তথা বিজ্ঞান-প্রযুক্তিগত বিপ্লবের পটভূমিতে বিশ্ব আধিপত্যের লড়াই তথা যুদ্ধ উন্মাদনার হটস্পট মধ্যপ্রাচ্য থেকে সরে ভারত উপমহাদেশ ও চীন সাগরের দেশগুলোর দিকে ধাবতি হচ্ছে বলেই অবস্থাদৃষ্টে ধারনা করা হচ্ছে। ইসরাইলের সঙ্গে আরব দেশগুলোর নানা সমঝোতা ও চুক্তি তারই ইঙ্গিত দেয়। তবে আমেরিকাকে চ্যালেঞ্জ করতে ওই এলাকায় রশিয়া-চীন ঐক্য যদি হয়, তবে সেই এলাকাও হটস্পষ্ট থাকবে বলে সহজেই ধারনা করা যায়। ইতোমধ্যে এশিয়া ও প্রশান্ত মহাসাগর অঞ্চলে চীনের ‘ বেপোরোয়া’ কর্মকান্ডের বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্র-ভারত-জাপান-অস্ট্রেলিয়া একত্রে কোয়াড বা চতুর্দেশীয় একটি কাঠামোর আওতায় যৌথ সামরিক মহড়া চালিয়ে যাচ্ছে।
এদিকে হোয়াইট হাউস সূত্রে জানা যাচ্ছে, প্রেসিডেন্ট হওয়ার পর বাইডেন যেসব জোটকে অগ্রধিকার দিচ্ছেন তার মধ্যে কোয়াড অগ্রগণ্য। এদিকে আফগানিস্তান থেকে সেনা প্রত্যাহার শুরুর পর তালেবানরা আফগানিস্তানের ৪১৯টির মধ্যে ২১২ টি জেলা দখল করে নিয়েছে। ধারনা করা হচ্ছে, মার্কিন সৈন্য সম্পূর্ণ প্রত্যাহারের পর আফগানিস্তানের রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করা তালিবানদের সময়ের ব্যাপার। উপজাতি গোষ্ঠীতে বিভক্ত তালিবানরা ক্ষমতা দখল করতে কোন্ দিকে যবে তা বুঝতে পারা কঠিন হচ্ছে। বর্তমানে মূলত পাকিস্তান-তালিবান মতভেদ- যোগাযোগ, চীনের উইঘোরে তালিবানের নাক গলানো, রাশিয়ার সীমান্ত সংলগ্ন মুসলিমগুলোতে সম্ভাব্য তালিবান অনুপ্রবেশ, ইরানের শিয়া সরকার আর তালিবানরা সুন্নী বিবেচনায় সীমান্তসংলগ্ন চারদেশ পাকিস্তান, চীন, রাশিয়া, ইরান গভীরভাবে উদ্বিগ্ন। এই অবস্থায় এই চাররাষ্ট্র নিয়ে ‘পাল্টা স্কোয়াড’ গঠিত হচ্ছে বলে জল্পনা কল্পনা হচ্ছে।
এদিকে বিগত ২০ বছর উন্নয়নের অংশীদার হিসাবে ৩৪ টি প্রদেশে ৪ শতাধিক প্রকল্পে ৩ বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করায় সংকটপূর্ণ অর্থনীতির মধ্যে ভারতও আছে বিপাকে। সংকটপূর্ণ অর্থনীতির মধ্যে এতে ভারতও আছে বিপাকে। তালিবানদের নব উত্থানে অনুপ্রবেশ নিয়েও কাশ্মীর নিয়েও ভারত উদ্বিগ্ন। তালিবানরা ক্ষমতা দখল করর পর যদি আমেরিকাবিরোধী অবস্থান হয়, তবে আমেরিকার দশা হবে ভিয়েতনামের পরাজয়ের মতো। এই অবস্থায় তালিবানদের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্র ও ভারতের আলোচনা -সমঝোতা ইত্যাদি নিয়ে নানা গুজব চারদিকে ছড়িয়ে পড়ছে। ২২ জুলাই ভারতের জম্মুতে ফের পাকিস্তানের ড্রোন হামলার প্রচেষ্টা ও তা গুলি করে নামানোর ঘটনা পাক-ভারত সম্পর্ক উত্তেজনাকর হয়ে উঠতে পারে বলে ধারনা করা হচ্ছে। ভারতের লাদাখ ও অরুণাচল নিয়ে চীনের দাবি তো আছেই। অর্থাৎ করোনার দুর্যেগের মধ্যেও ভারত-পাকিস্তান উত্তেজনার পারদ আবর চরমে পৌছাতে পারে যে-কোনে সময়। তাতে একদিকে চীন আর অন্যদিকে যুক্তরাষ্ট্র জড়িয়ে পড়ার সম্ভাবনা থাকবে।
উপমহাদেশ ও এই অঞ্চলের উত্তেজনার নানা টানাপোড়েনের মধ্যে রয়েছে আমাদের প্রিয় মাতৃভূমি বাংলাদেশ। বিশ্বে উদাহরণ সৃষ্টি করে শান্তিপূর্ণভাবে বর্তমান সরকার ভারতের সঙ্গে সীমান্ত সমস্যা, ভারত ও মিয়ানমারের সঙ্গে সমুদ্র সীমা সমস্যা মেটাতে সক্ষম হয়েছে। মায়ানমারের সঙ্গে রোহিঙ্গা সমস্যাও আলোচনার মধ্য দিয়ে শান্তিপূর্ণভাবে মেটাতে চাইছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে পরিচালিত বর্তমানে সরকার আমাদের জন্মলগ্নের অঙ্গীকার বঙ্গবন্ধু সূত্রায়িত ও গৃহীত ‘ কারো সাথে শত্রুতা নয়, সকলের সাথে বন্ধুত্ব’ নীতি নিয়ে ভারসাম্যমূলক অবস্থান বজায় রেখে উন্নয়নের ধারায় চলছে। এরই নিদর্শন হচ্ছে ‘ আম কূটনীতি’ বা ‘ ম্যাঙ্গো ডিপ্লোমেসি’। কিন্তু দেখা যাচ্ছে একটু এদিক সেদিক হলেই বিপত্তি। সম্প্রতি কোয়াডে যোগদান সম্পর্কে বাংলাদেশ সরকারের বক্তব্য ও অবস্থান এবং চীনের তীব্র প্রতিক্রিয়া এখনে স্মরণ করা যেতে পারে। রজত জয়ন্তী পালনকালে করোনা-দুর্যোগের মধ্যে বাংলাদেশের জনগণের তাই একান্ত কামনা, এই এলাকার শান্তি ও স্থিতিশীলতা রক্ষিত হোক, বিশ্বের রাষ্ট্রনায়কদের মধ্যে শুভচিন্তা জাগ্রত ও পরিব্যপ্ত হোক, এই অঞ্চলের জনগণ যুদ্ধ উন্মোদনার বিরুদ্ধে শান্তির পক্ষে এবং করোনা-দুর্যোগ ঠেকাতে ঐকবদ্ধ হোক। আওয়াজ তুলুক করোনা নিপাত যাক। বিশ্ব শান্তি জিন্দাবাদ।


