উড়িষ্যার ময়ূরভঞ্জের ব্রাহ্মণকুণ্ড জলপ্রপাত

উড়িষ্যার ময়ূরভঞ্জের ব্রাহ্মণকুণ্ড জলপ্রপাত
14 May 2023, 01:20 PM

উড়িষ্যার ময়ূরভঞ্জের ব্রাহ্মণকুণ্ড জলপ্রপাত

 

ডঃ সুবীর মণ্ডল

 

সীমান্ত বাংলার জঙ্গলমহলের কাছে উড়িষ্যার ময়ূরভঞ্জ জেলার একটা ছোট জনপদ হলো বাংরিপোসি। অসাধারণ প্রাকৃতিক সৌন্দর্যমণ্ডিত এই আদিবাসী জনগোষ্ঠীর স্বপ্নের জনপদ। কৈশোরে জায়গাটির সাথে পরিচিতি ঘটে বুদ্ধদেব গুহ'র "বাংরিপোসির দু' রাত্তির" উপন্যাসের হাত ধ'রে। পাহাড় আর জঙ্গলে ঘেরা ছোট্ট শান্ত নিরিবিলি একটুকরো বসতির ছবি মনে মনে কল্পনা করে গতবছর বর্ষার শুরুতে খুব ভোরেই মহকুমা শহর খাতড়া থেকে গাড়ি করে প্রথমে রাইপুর - শিলদা --বেলপাহাড়ীর ইন্দিরাচক হয়ে ঝাড়খণ্ডের বহড়াগড়াতে পৌঁছলাম, আলো-অন্ধকারের মধ্যেই বোম্বে হাইওয়েতে  উঠলাম। পথে চায়ের স্বল্প বিরতি।ভোরের মায়াবী আলোতে দেখা হল সুবর্ণরেখার নদীর  সঙ্গে। রাস্তা দুদিকে চলে গেছে--(১) বালাসোর- বারিপদা (২) ময়ূরভঞ্জ- যশিপুর--কেওয়নঝড়। গাড়িতেই বহড়াগড়াতে টিফিন পর্বশেষ করেই চলতে শুরু করলাম। গাড়িতে বাংরিপোসি পৌঁছে গেলাম মাত্র সাড়ে দেড় ঘণ্টায়। সূর্য তখন উঠতে শুরু করেছে। এ-এক অন্যভুবন। শুধু মুগ্ধতার আবেশ। শহরের কোলাহল থেকে দূরে, বিশুদ্ধ অক্সিজেনের ভান্ডার এই ময়ূরভঞ্জের উপত্যকা। একটুও সময় নষ্ট না ক'রে  গাড়ি নিয়ে বেড়িয়ে পড়লাম কাছাকাছির মধ্যে একটা জলপ্রপাত দেখতে।ঘড়িতে তখন সময় সম্ভবত ছটা।

বাংরিপোসি থেকে মাত্র ১৮ কিলোমিটার দূরে অরণ্য অধ্যুষিত বুড়িবালাম নদী পেরিয়ে দিগন্ত বিস্তৃত সবুজ ধানজমি দেখতে দেখতে মেঠো পথ ধরে এগিয়েই পেলাম ব্রাহ্মণকুণ্ড জলধারা। আদিবাসীদের স্বপ্নের ছোট্ট ছোট্ট গ্রাম।যেন শিল্পীর পটে আঁকা অপরূপ ছবি। প্রকৃতি-প্রেমিকদের কাছে যেন এক অনাঘ্রাত রত্নখনি। পাহাড়ের গা ঘেঁষে একটা বাঁক পেরোতেই মনে হয় এ কোন অপার্থিব জায়গায় এসে পড়লাম! পথের সাথী বুড়িবালাম। চারিদিকের উঁচু উঁচু পাথরের দেওয়াল আর তারও ওপরের প্রাচীন গাছগুলো জায়গাটার আদিমতা বজায় রেখেছে এখনও। তারই মাঝে এই ব্রাহ্মণকুণ্ড জলপ্রপাত যেন সেই আদিম যুগের কোনো এক গুহামানবী - লাজুক ষোড়শী; পাহাড়ের কোনো খাঁজে লুকিয়ে থাকবে, আবার কিঙ্কিনি ধ্বনিতে নিজেকে ধরাও দিতে চাইবে। ব্রাহ্মণকুণ্ডর কলকল জলধ্বনিও সকল পর্যটকের কর্ণগোচর হয় বহুদূর থেকে আর অদ্ভুত এক মোহাবিষ্ট হয়ে এগিয়ে যেতে হয় সেই ধ্বনি অনুসরণ করে।

ছোট্ট প্রাণোচ্ছল জলপ্রপাত আর আশেপাশের উঁচু উঁচু পাথরের দেওয়ালের গাম্ভীর্য - এই দুইয়ের বৈপরীত্যটাই এই জায়গার আসল সৌন্দর্য । অনেকটা সময় কাটিয়ে দেওয়া যায় জলের মধ্যে বিরাট বড় বড় মাছগুলোর খেলা দেখে অথবা কোনো পাথরের গায়ে হেলান দিয়ে পছন্দের বই পড়ে অথবা নিছকই জলের ধারে পাথরের ওপর চুপ করে বসে জায়গাটার আদিমতা অনুভব ক'রে।

এখানে এতদিন কেন আসিনি তা ভেবে কিছুটা সময় কেটে গেল..। কোনো জায়গা এত সুন্দরও হতে পারে...! কেউ কাউকে এত সুন্দর করেও সাজিয়ে রাখতে জানে? প্রতিদিন সকালে ঘুম থেকে উঠেই সদ্যস্নাতা মায়ের ভিজে চুলের মাঝে সিঁদুরের লাল টিপটা যেমন মায়াবী লাগে...এখানকার সূর্যোদয় তেমন ভাবেই চোখে নেশা ধরায়...যা হাজারবার দেখলেও পুরনো হয় না।

বাংরিপোসির  ব্রাহ্মণকুণ্ডের বুকে সূর্যোদয় দেখার সময় মায়ের মুখ মনে ভেসে এলেও এখানে কিন্তু ব্রাহ্মণকুণ্ড ষোড়শী প্রেমিকা..। তবে  কয়েক ঘণ্টা  থেকেও কিছুতেই উপলব্ধি  করতে পারলাম না যে সে কার প্রেমিকা..! কখনো মনে হয় বুড়িবালাম নদীর সাথে তার অন্তহীন অমলিন ভালোবাসার  সখ্যতা; নদীর ঢেউয়ের সাথে দিনভর সে যেন ফিস ফিস করে  কথা কয়ে চলেছে, নদীর অফুরন্ত প্রাণশক্তিতে সে বুঁদ হয়ে সব রূপ-রস-গন্ধের ধারক ও বাহক হয়ে প্রকৃতির মাঝে নিজেকে মেলে ধরেছে। কিন্তু আঁধার নামলেই পাহাড়ের বিশালত্বের কাছে আছড়ে পড়া ব্রাহ্মণকুণ্ডের থমথমে মুখ দেখে মনে হয় সে বুঝি পাহাড়কেই...কি জানি..! মহাকাব্যের নায়িকার মতোই সে  বড় ছলনাময়ী-   কিছুটা হলেও রহস্যময়ী। রহস্যের বুননে তৈরি মায়াজালে পথিককে আটকে দেয় অনন্তকালের মতো। বলা বাহুল্য আমিও বাঁধা পড়েছি এই অনন্য ভালোবাসার  মায়াকুহকে...হয়তো কিছুটা ইচ্ছা করেই--

এই অঞ্চলটি ভূমিজ, মুন্ডা এবং খেরিয়া প্রভৃতি আদিবাসী  সম্প্রদায়ের  আবাসভূমি। সহজ- সরল মানুষগুলো। বড় ধরনের  স্বপ্ন দেখে না বলে মনে হয়। ছোট্ট  স্বপ্ন দেখে'  আমার  সন্তান যেন থাকে দুধে ভাতে'। সীমাহীন অসহায়তার চালচিত্রের কোন পরিবর্তন হয়নি আজও। অভাবের মধ্যেও  হৃদয় নিংড়ানো ভালোবাসা। এইসব  দেখতে মনটা খারাপ হয়ে গেল।    সন্ধ্যের দিকে স্থানীয় আদিবাসিদের ঘর থেকে মাদলের সাথে লোকগীতির মৃদু আওয়াজ মনকে বড়ই উদাসীন করে দেয়। বছর চারেক আগে  পূর্ণিমার রাতে বাংরিপোসির কোলে হোটেলে শুয়ে চাঁদ দেখার সময় রবি ঠাকুরের কয়েকটা লাইন আপনমনেই আওড়াচ্ছিলাম- "আমার প্রজাপতির পাখা/ আমার আকাশ-চাওয়া মুগ্ধ চোখের রঙিন-স্বপন-মাখা। তোমার চাঁদের আলোয়/ মিলায় আমার দুঃখসুখের সকল অবসান। বর্ষা মুখরদিনে ব্রাহ্মণকুণ্ডকে  দেখে  মন গুনগুনিয়ে উঠল। বাংলা চলচ্চিত্রের একটি অসাধারণ গান মনে পড়ে গেল-- "বৃষ্টি বৃষ্টি বৃষ্টি, এ কোন অপরুপ সৃষ্টি :

সত্যি যত দেখছিলাম ততই যেন মনের মধ্যে সেই একটা উথালপাতাল ভাব...! পার্থিব সব ভাবনা কর্পূরের মতো উবে যাওয়ার সাথে সাথে হাড়-মাংস-রক্তের মধ্যে আটকে থাকা উড়ুক মনটাকে সামলাতে বড্ড বেগ পেতে হচ্ছিল...! কাঁচা  সূর্যের  আলোর আদরে মাখা ব্রাহ্মণকুণ্ডর বন্য পাখির   কলকাকলিতে আমি নেশাতুর হয়ে পড়ছিলাম। পৃথিবীর সবচেয়ে কড়া মদ খেলেও বোধহয় এই নেশায় আচ্ছন্ন হওয়া যাবে না। আমরা যারা প্রকৃতিপ্রেমী, তাদের কাছে এই জায়গা স্বর্গ। স্বর্গের দুয়ার খুলেই যেন এই ষোড়শী কন্যা দুহাত বাড়িয়ে রেখে আমন্ত্রণ জানায় পথিককে।

ধীরে ধীরে সূর্য নামে পাটে... হিমেল হাওয়ার একটা আমেজ ক্রমশ জড়িয়ে ধরে শরীরকে... নাকে আসে বুনো ফুলের গন্ধ... কুলকুল করে ব্রাহ্মণকুণ্ডের জলধারা বয়ে চলে নুড়ি পাথরের সাথে এক্কা দোক্কা খেলতে খেলতে... দিনের শেষ সূর্যরশ্মির রক্তিম আভা আলতো করে ছুঁয়ে যায় সেই জলরাশির স্রোত। একবুক জঙ্গুলে ঘ্রাণ আর অপার্থিব এই মুহূর্ত গুলোই অতি যত্নে মুঠো করে নিয়ে আসি দামী মণি-মানিক্যের মতো।

কিভাবে যাবেন: হাওড়া থেকে ভোরের যেকোন এক্সপ্রেস ট্রেনে ঘাটশিলা। ঘাটশিলা অথবা টাটানগর থেকে গাড়িতে দেড়-দুই ঘন্টার রাস্তা পেড়িয়ে বাংরিপোসি পৌঁছে যাওয়া যায়। এছাড়াও আরও অনেকগুলো ট্রেন আছে যেগুলি ঘাটসিলা যায়। কলকাতা থেকে সরাসরি নিজস্ব গাড়িতে বাংরিপোসি আসা সবচেয়ে ভাল। দূরত্ব মাত্র 225 কিলোমিটার।

কোথায় থাকবেন: খাইরী রিসর্টে। একদম জাতীয় সড়ক ৬ এর ধারেই। জাতীয় সড়কের পাশে কাছাকাছির মধ্যে  আর একটি রিসর্টও চোখে পড়ল - সিমলিপাল রিসর্ট।

লেখক: শিক্ষক, খাতড়া হাইস্কুল, বাঁকুড়া

Mailing List