বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের আরণ্যক উপন্যাসের 'গাছ-পাগল' যুগল প্রসাদই বাঘমুণ্ডির দুখু মাঝি, অজানা কাহিনী লিখছেন ড. সমরেন্দ্র নাথ খাঁড়া

বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের আরণ্যক উপন্যাসের 'গাছ-পাগল' যুগল প্রসাদই বাঘমুণ্ডির দুখু মাঝি, অজানা কাহিনী লিখছেন ড. সমরেন্দ্র নাথ খাঁড়া
ড. সমরেন্দ্র নাথ খাঁড়া
পুরুলিয়া জেলার গর্ব গাছবাবা দুখু মাঝি। পুরুলিয়া জেলার বাগমুন্ডীর সিন্দরী গ্রামের দুখু মাঝি। একটি কুঁড়ে ঘরে থাকেন। এখন বয়স প্রায় সত্তর বছরের বেশি। বিনয়ী, আপন প্রকৃতি খেয়ালী। কোনদিন পড়াশোনা করে নি। কিন্তু গাছ লাগানোর নেশা ছোটবেলায় এক সাহেবের মুখে শুনেছিলেন যে গাছ অক্সিজেন দেয় বলেই শ্বাস নেওয়া যায় এবং মানুষ বেঁচে আছে। নিরক্ষর দুখু তখন ব্যাপারটা ভালভাবে বুঝতে পারে নি।কিন্তু এটা বুঝতে পেরেছিলেন যে, সুস্থভাবে বেঁচে থাকতে গেলে গাছের প্রয়োজনীয়তা রয়েছে। কিশোর বয়সে দুখু শখ করে একটা জোর (অশ্বত্থ) গাছের চারা রাস্তার ধারে লাগিয়ে ছিলো।চোখের সামনে ছোট্ট চারা থেকে বৃক্ষে পরিনত হওয়া দেখলো।তারপর বেশ গরমে ছায়া দিচ্ছে।সুন্দর বাতাস দিচ্ছে।সেই অশ্বত্থের গাছ বসানোর নেশা লাগা শুরু। ফাঁকা জায়গায়, মাঠে, ঘাটে, হাটে সর্বত্র একের পর এক কুসুম, শাল, বট, মহুল,পলাশের চারা লাগাতে লাগলো। স্ত্রী ফুনগি মাঝানের কথায়, “ভাল কাজ বলে স্বামীকে বাধা দিই না।”
আম, জাম, মহূল, কুসুম, পলাশ ও জংলী গাছের বীজ কুড়িয়ে গাছের কোটরে বা ইঁটের পাঁজায় রেখে দিতেন। তারপর বর্ষা নামলে অযোধ্যা পাহাড়ে তখন বীজ থেকে নরম অঙ্কুরিত চারা বের হয়। তাছাড়া বট,অশ্বত্থের চারা ও সংগৃহিত বীজ থেকে অঙ্কুরিত চারা দুখু বর্ষার ভেজা পাথুরে মাটিতে লাগিয়ে দেয়। চারাগুলিকে রক্ষা করার জন্য বেড়া দিতেন।গাছের ডাল,লতা পাতা দিয়ে বেড়া দিতেন। কিন্তু লোকজন জ্বালানির জন্য সেইসব বেড়া ভেঙে নিয়ে চলে যায়।দুখু কাউকেই কিছু বলেন না।মাথায় নতুন বুদ্ধি খাটালেন। সৎকারের পর শ্মশানে পড়ে থাকা খাটিয়া,কাঠ,কাপড়,মশারি,ধুতি,বিছানার চাদর দিয়ে বেড়া দিতে শুরু করলেন।ভয়ে সেইসব আর কেউই নেয় না, বেড়া ভাঙে না।
হাজার পাঁচেক গাছ লাগিয়েছেন।এখনও গাছ লাগাবেন।মনে আত্মপ্রচারের বাসনা নেই,নেই অভিযোগ, নেই কিছু পাওয়ার বাসনা ! বট, অশ্বত্থ বড় হয়ে প্রচুর ছায়া দেবে, কত কত পাখি বাসা বাঁধবে, এটা দেখতে ভীষন ভালো লাগে তাঁর।
সিন্দরী, বাগমুন্ডী, বীরগ্রাম সহ সমস্ত এলাকায় দুখুর গাছ বড় হচ্ছে ! যত্রতত্র দেখতে পাবেন চিতাকাঠ, মৃতের ধুতি, শাড়ি দিয়ে বেড়া দেওয়া বট, অশ্বত্থ, আম, জাম ! ওগুলো সবই দুখুর লাগানো !
বাগমুন্ডী ফরেস্ট অফিস থেকে দুখুকে পুরষ্কার দেওয়া হয়েছে।এই কথা গর্ব করে বলে বড়ই আনন্দ পান। কেউ তাঁর গাছ ভেঙে দিলে খুব দুঃখ পান। পরে আবার সেইখানেই লাগান। দুখুকে সবাই চেনেন। স্থানীয় স্কুলের বাইরে প্রচুর গাছ লাগিয়েছেন দুখু ; আশেপাশের গ্রামের লোক বট,অশ্বত্থের চারা পেলেই খোঁজ দেন দুখুকে। শীত, গ্রীষ্ম, বর্ষা যাই হোক না কেন,এই সরল হাসিমুখ মানুষটিকে প্রতিদিন দেখা যায় খাটো ধুতি পরে গ্রামের রাস্তায় তাঁর লাগানো গাছগুলোর পরিচর্যা করছেন।গোটা দুপুর ঘুরে ঘুরে তাঁর গাছ দেখেন দুখু। শ্মশান থেকে পিচরোডের ধারে,ফাঁকা মাঠ থেকে স্কুলের আঙিনায় ও বাইরে,নদীর পাড় বা মন্দির প্রাঙ্গন সর্বত্র অসংখ্য গাছ লাগিয়েছেন।
শেষ বিকেলের মেঠো পথ ধরে দীর্ঘ ছায়া ফেলে প্রৌঢ় মানুষটি একাকী হেঁটে চলেন।মনে হয় বট, অশ্বত্থ,মহুল, কেঁদ, পলাশের আন্দোলিত পাতাগুলো মানুষটিকে অভিবাদন জানাচ্ছে!
বিভূতিভূষন বন্দ্যোপাধ্যায়ের 'আরণ্যক ' এর একটি চরিত্র ছিল যুগল প্রসাদ। নিঃস্বার্থ প্রকৃতিপ্রেমিক। যুগলপ্রসাদ গাছ লাগিয়ে বেড়াতেন, এটাই তাঁর নেশা ও ভালোলাগা ছিল।
বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের আরণ্যক উপন্যাসের সেই 'গাছ-পাগল' যুগল প্রসাদ হলেন বাঘমুণ্ডির দুখু মাঝি। যুগলের মতোই দুখু ঘুরে ঘুরে পুরুলিয়ার জঙ্গলমহল বাঘমুণ্ডি জুড়ে বট,অশ্বত্থ,মহুল,কেঁদ,আম, জাম, কাঁঠাল,পলাশের চারা বসিয়ে আসছেন।শুধু বৃক্ষরোপণ বা চারাগাছের পরিচর্যাই নয়,বড় গাছের গাছপালা কেউ কাটছেন কি না, সে দিকেও তাঁর সতর্ক নজর। দুখুর কথায়, “এ পর্যন্ত পাঁচ হাজার গাছ বসিয়েছি। গাছেরা মাথা তুললেই আমার মনটা খুশিতে ভরে যায়।আমার বসানো গাছের ছায়ায় ক্লান্ত পথিককে জিরোতে দেখলে মনটা ভালো লাগে খুশী হয়।"
বাঘমুণ্ডির সিদরি গ্রামের একচিলতে ভাঙাচোরা বাড়িতে স্ত্রী, দুই ছেলেকে নিয়ে দুখুর বাস।সামান্য জমি থাকলেও বড় ছেলের দিনমজুরির আয় আর স্বামী-স্ত্রীর বার্ধক্যভাতাই তাঁদের ভরসা। ছোট ছেলে দীর্ঘদিন শয্যাশায়ী।কিন্তু পারিবারিক সমস্যা যেন দুখুকে ছোঁয় না। প্রতিদিন সকালে নিজের বসানো গাছে দুখু বন দফতরের দেওয়া সাইকেলে চারা, জলের পাত্র,মাটি খোঁড়ার যন্ত্র ও বোতল নিয়ে বেরিয়ে পড়েন। গ্রামের পর গ্রাম ঘুরে গাছ বসান। খোঁজ নেন,আগে বসানো চারাগাছগুলো কেমন আছে। বড় গাছের ডালপালা কেউ ভেঙেছে কি না,ঘুরে ঘুরে তা-ও দেখেন।তাই লোকমুখে হয়ে উঠেছেন ‘গাছবাবা’।খুশিতে তাঁর মন ভরে যায়।
"জঙ্গলমহল জুড়ে উঠছে দাবি,
গাছবাবাকে দিতে হবে পদ্মশ্রী।"
দুখুদের মতো মানুষ দিন দিন কমে যাচ্ছে।তাঁর
জন্য ‘পদ্ম সম্মান’ দেওয়া উচিত।দুখুদের মতো কিছু মানুষ আছে বলেই পৃথিবী এত সবুজ।বন দফতর ২০১৯ সালে বনমহোৎসবে দুখুকে সংবর্ধনা ও পুরস্কার দিয়েছে।
সবাই পারে না,একমাত্র দুখুই বুক ঠুকে বলতে পারে "এ বিশ্বকে এ শিশুর বাসযোগ্য করে আমি ..."
..............................


