ভাণুমতির খেলও হার মানতো এগরার ভানু-বাজির কাছে, বিস্ফোরণ-মৃত্যু-ধরা পড়ার পরেও কিভাবে উত্থান এই বাজি সম্রাটের

ভাণুমতির খেলও হার মানতো এগরার ভানু-বাজির কাছে, বিস্ফোরণ-মৃত্যু-ধরা পড়ার পরেও কিভাবে উত্থান এই বাজি সম্রাটের
আনফোল্ড বাংলা প্রতিবেদন: কৃষ্ণপদ বাগ। কৃষ্ণের চক্রের মতোই আকাশ-বাতাস কাঁপিয়ে মাৎ করতো তাঁর বাজি। রংবেরঙের বাজি বানানোর দক্ষতা ছিল কৃষ্ণপদ বাগ ওরফে ভানুর। তারই জেরে এগরার বাজিকে সুনামের শীর্ষ স্থানে পৌঁছে দিয়েছিলেন তিনি। কারণ, তিনি নাকি সারাক্ষণই বাজি তৈরি নিয়েই ভাবনা চিন্তা করতেন। যে বাজি মানুষকে আনন্দ দেয়। আকাশে উঠে রঙ বেরঙের খেলা দেখায়।
আর সেই আতসবাজি তৈরির পাশাপাশি বেআইনিভাবেই বানাতেন শব্দবাজিও। আকাশ জুড়ে ছড়িয়ে পড়া রঙিন প্যারাডাইস, রংবেরঙের তুবড়ি, গাছবোমা, ছুঁচোবাজি, রংমশাল, হাওয়াইয়ের প্রদর্শনী হলেই মানুষ বাজি কিনতে ছুটে যেতেন ভানুর কাছে। আর এখন তো বাজির জন্য শুধু বছরে একটা বা দু’টি দিন নয়। বছরভর বাজির ব্যবসা। তা বিয়ে বাড়ি হোক বা পুজো, ছেলের অন্নপ্রাশন হোক বা নির্বাচনে জয় – সব ক্ষেত্রেই বাজি ছাড়া এক শ্রেণির মানুষ আনন্দ খুঁজে পান না। তাই এই ব্যবসাও তরতর করে বেড়ে চলছিল।
যার হঠাৎ আপাতত ছেদ পড়লো বিরাট বিস্ফোরণে। কেঁপে উঠলো পূর্ব মেদিনীপুর জেলার এগরা ১ ব্লকের সাহারা গ্রাম পঞ্চায়েতের খাদিকুল গ্রাম। প্রাণ গেল ৯ জন মানুষের। তারপরই মুখ্যমন্ত্রীও ঘোষণা করলেন যে, ওই বাজি কারখানা ছিল বেআইনি। পুলিশ কেন খোঁজ রাখেনি? সে প্রশ্নও তুললেন তিনি।
কিন্তু এই কৃষ্ণপদ বাগ ওরফে ভানুর কারখানায় কী এটাই প্রথম বিস্ফোরণ? উত্তরটা, নিশ্চয় না। কারণ, স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলে জানা গিয়েছে, প্রায় ৩০ বছরের ব্যবসা ভানুর। আগেও বিস্ফোরণ ঘটেছিল। যখন তিনি নিজের বাড়িতে কারখানা চালাতেন। তখন নিজের ভাই ও স্ত্রীরও মৃত্যু হয়েছিল বাজি কারখানার বিস্ফোরণে। ঘটনার পর গা ঢাকা দেন ভানু। কিছুদিন পর ফের স্বমহিমায় ফিরে বাড়ি থেকে কিছুটা দূরে ফাঁকা জায়গায় কারখানা বানান। যখন বেআইনি বাজি নিয়ে রাজ্যজুড়ে তোলপাড় হচ্ছিল, পুলিশ তল্লাশি চালচ্ছিল, তখনও কারখানার হদিশ জানা যায়। পুলিশ বেআইনি বাজি উদ্ধার করে এবং ভানুকে গ্রেফতারও করে ২০২২ সালে। তারপর আদালতে পেশ। আদালত থেকে জামিনে মুক্ত। ফের ব্যবসা শুরু।
কিন্তু প্রশ্ন হল, বারবার বিস্ফোরণ, ধরা পড়ার পরেও কিভাবে ব্যবসা শুরু? স্থানীয় সূত্রে জানা গিয়েছে, বাজি কারখানার সুবাদে ব্যবসায়ী মহলে বেশ নাম করেছিলেন ভানু বাবু। অর্থও রোজগার করেছিলেন বিস্তর। তবে না গ্রাম থেকে অদূরে ফাঁকা জায়গায় কারখানা বানাতে পারেন। সেই ফাঁকা মাঠে কারখানায় যাতায়াতের জন্য পাকা রাস্তা পর্যন্ত বানিয়ে নেন। রাজনৈতিক ব্যক্তিদের সঙ্গেও ওঠাবসা ছিল। তবে রাজনৈতিক নেতা হওয়ার শখ ছিল না। তাই প্রয়োজনটুকু বাদে রাজনীতির অলিন্দে ঘোরাফেরা করতে দেখা যায়নি তাঁকে। কারণ, তাঁর শখ ছিল বাজিসম্রাট হওয়ার।
তৃণমূল সাফ জানিয়ে দিয়েছে, ওই এলাকাটা এক সময় তৃণমূল দখল করলেও পরে নির্দলকে সঙ্গে নিয়ে বিজেপি পঞ্চায়েত দখল করেছে। ফলে বিজেপির দখলে থাকা পঞ্চায়েতের নজরে রাখা উচিত ছিল। বিজেপি পাল্টা এনআইএ তদন্তের দাবি জানিয়েছে। মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ও অবশ্য এনআইএ তদন্তে আপত্তি নেই বলেই জানিয়েছেন। যদিও তড়িঘড়ি সিআইডি তদন্তেরও নির্দেশ দিয়েছিন মুখ্যমন্ত্রী। এখন দেখার এতগুলো প্রাণের বিনিময়ে বেআইনি বাজি কারখানা নিয়ে কী পদক্ষেপ নেয় সরকার। কোন পথে এগোয় তদন্ত। অনেকের প্রশ্ন, অন্যান্য ঘটনার মতো প্রথমে হৈহৈ হবে, ফের সব ভুলে যাবে মানুষ। নাহলে বিস্ফোরণ ও ধরা পড়ার পরেও ৩০-৩২ জন কর্মী নিয়ে কিভাবে পুণরায় কারখানা চালু করতে পারেন ভানু? ভাগ্যিস বিস্ফোরণের সময় সব কর্মী ছিল না। নাহলে তো আরও বহু মানুষের প্রাণও যেতে পারতো? তদন্ত শেষেই সব পরিষ্কার হবে।


