বাঙালির পুজোর গানের সেকাল-একাল, লিখছেন ডঃ সুবীর মণ্ডল

বাঙালির পুজোর গানের সেকাল-একাল, লিখছেন ডঃ সুবীর মণ্ডল
ডঃ সুবীর মণ্ডল
আমার জন্ম সত্তর দশকের শেষ দিকে।নিজে গান করতে জানতাম না।কিন্ত্ত হৃদয় জুড়ে গান শোনার এক অমোঘ বাসনা ছিল। ভরসা একমাত্র রেডিও। গ্রামীণ জীবনে রেডিও থাকা মানে,বেশ বড় লোক মনে করত মানুষ। কৈশোর জুড়ে গানের প্রতি এক তীব্র আকর্ষণ অনুভব করত। অষ্টম--নবম শ্রেণি থেকে গানের জলসা শুনতে কত নদী,মেঠো রাস্তা অতিক্রম করেছিলাম, তার ঠিক ঠিকানা নেই । তবে আমি ছিলাম বাথরুম সিঙ্গার।নিজে গায়ক,নিজেই শ্রোতা।কলকাতা-বোম্বের প্রায় সব স্বনামধন্য সঙ্গীত শিল্পীদের দেখা ও তাদের গান শোনান সৌভাগ্য হয়েছিল। লতামঙ্গেশকর দেখার সৌভাগ্য হয়নি।শীতের প্রত্যেক শনিবারের দুপুরে সঙ্গী হত রেডিওতে চলা ‘অনুরোধের আসর’। আমার বাবা একজন -শিক্ষক হওয়ায় বাড়িতে একটা রেডিও ছিল। গানবাজনার একটা চল ছোটোবেলা থেকেই দেখে এসেছি। মনে মনে একটা ইচ্ছে সেই ছোট্টবেলা থেকে মনের মধ্যে লালিত হয়ে এসেছে সেটা হল বিভিন্ন ধরনের গান শোনা ও তা সংগ্রহ করা। আমি মনে করি সুর-ছন্দ মানুষের জন্মগত ভালোলাগার জিনিস। বোল ফোটারও আগে শিশু উপভোগ করে মায়ের ঘুম পাড়ানি গান। মাথা দোলায় হাততালি দেয় কোনও ছন্দের সঙ্গে। সংগীতই জানে শ্রবণের যাদু, জানে মানুষের অন্দরের গভীরতম রসায়ন। তাই পৃথিবীর প্রায় প্রতিটি মানুষকে বশীকরণের কোনও মন্ত্র যদি কারও কাছে থাকে, সেটা একমাত্র সংগীতেরই আছে। ইতিহাস এর বারবার সাক্ষী। কত-না বিপন্ন সময়ে মানুষের বিচ্ছিন্নতা বোধকে ধূলিসাৎ করে সম্প্রীতির রাখিবন্ধন করেছে এই সংগীত। কাজেই, নিজে নাই-বা গাইলাম গান। কিন্তু গানের ইতিহাস ও সেটা সংগ্রহ করা আজও ভীষণ ভালো লাগার। মনে আছে প্রথম টিউশনের টাকা পেয়েই কিনে ফেলেছিলাম হেমন্ত মুখোপাধ্যায় , মান্না দে,শ্যামল মিত্রের গ্রাফোন রেকর্ড।সত্তর দশকের স্বর্ণযুগের গান আজও অমলিন।
সময়ের হাতধরেই নব্বই দশক থেকেই বাংলা গানের কথা-সুরের পালাবদল ঘটতে থাকল। আসলে সময়ের দাবীকে অস্বীকার করা সম্ভব নয়। তদিনে অবশ্য শুনে ফেলেছি সুমন চট্টোপাধ্যায়ের ‘তোমাকে চাই’, নচিকেতার ‘এই বেশ ভালো আছি’ ও অঞ্জন দত্তর ‘শুনতে কি চাও’ অ্যালবামটি। বাবার ব্যক্তিগত সংগ্রহের পছন্দের তালিকায় ছিল হেমন্ত, মান্না, সতীনাথ, মানবেন্দ্র, অখিলবন্ধু, লতা মঙ্গেশকর প্রমুখ শিল্পীদের অ্যালবাম।আমার মেজ কাকুর ছিল রবীন্দ্রনাথ সঙ্গীতের অসাধারণ গলা। তাছাড়া শ্যামল মিত্রের গান ছিল অত্যন্ত প্রিয়। আমার খুব ভোরে কাকুর রবীন্দ্রনাথের গান শুনে ঘুম ভাঙত।তখনকার বাঘা বাঘা শিল্পীদের সব লং প্লে রেকর্ড ও ছোটো রেকর্ড তাতে বাজত। কেন জানি না আমাদের ঘরের টেপ রেকর্ডারে চালানো গানের থেকে কাকুর খালি গলার গানগুলো যেন আমাকে বেশি টানত। মনে হত যেন সেই ঘুরন্ত কালো চাকতির ভিতরে কোথাও যেন বসে বসে সুর আর কথার মায়াজাল বুনে চলেছেন হেমন্ত মুখোপাধ্যায়, মান্না দে, গীতা দত্ত, সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়, শচীনদেব বর্মন। মনে আছে, ‘হিজ মাস্টার ভয়েস’-এর সেই ‘নিপার’ নামক কুকুরটির মতো আমিও রেকর্ড প্লেয়ারের সামনে বসে মুগ্ধ হয়ে গান শুনতাম। আর একটা আকর্ষণও অবশ্য ছিল। কাকুর সংগ্রহে ছিল এইচ এম ভি থেকে প্রকাশিত কিছু পুরোনো সংখ্যার ‘শারদ অর্ঘ্য’ পত্রিকা। আসলে ‘পুজোর গান’ মানে তো শুধু দুটি শব্দ নয়, এটি আসলে একরাশ অনুষঙ্গ নিয়ে আসে। দুর্গামূর্তি একই সঙ্গে মাতা এবং শক্তিরূপের সংস্করণ হয়ে আছে বাঙালির মননে। তাই প্রত্যেক বছর ‘শারদ অর্ঘ্য’ পত্রিকার মলাটে দুর্গামূর্তির ছবিসহ ভিতরে পাতার বামপাশে অথবা ডানপাশে শোভা পেত শিল্পীর দুইরঙা ছবি স্বাক্ষরসহ এবং ছবির পাশে সেই শিল্পীর গাওয়া গানের লিরিক এবং সেইসঙ্গে সেই গানের গীতিকার ও সুরকারের নাম। আর থাকত নানা ধরনের রেকর্ড প্লেয়ারের বিজ্ঞাপন, দামসহ। বিভিন্ন শিল্পীর প্রকাশিত লং প্লে ও ছোটো ই. পি. (Extended play) রেকর্ডও সুদৃশ্য ছোটো ইপি রেকর্ডে হয়তো শচীনদেব বর্মনের গাওয়া ‘শোনো গো দখিন হাওয়া প্রেম করেছি আমি’ গানটি বাজছে আর আমি ‘শারদ অর্ঘ্য’ পত্রিকা থেকে সেই গানের লিরিকটা মিলিয়ে নিচ্ছি। পরে কাকুকে দেখেছি হেমন্ত বা সতীনাথ মুখোপাধ্যায়ের গানের লিরিকগুলো ‘শারদ অর্ঘ্য’ পত্রিকা থেকে ডায়েরিতে লিখে নিতেন। ইছামতীর তীরে বসিরহাট শহর ছিল সংস্কৃতির শহর। প্রতি বছর শীতের সময় বিভিন্ন ক্লাব বিচিত্রানুষ্ঠানের আয়োজন করত।আসরে আসতেন কলকাতা--বোম্বের গুণী শিল্পীরা।কলেজে পড়ার সময় পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন বাংলা শিল্পীদের গান শোনার সৌভাগ্য হয়েছিল। সে -এক অন্যভুবন। সেই সময় কলেজ গুলোতে পুজোর আগে নবীন বরণ অনুষ্ঠানের আসর মাতাত নতুন প্রজন্মের শিল্পীরা সত্তর দশকের পুজোর গান। এইচ এম ভি থেকে গানের বই বেরোবার আগেই কি আগ্রহ ছিল আমাদের। বন্ধ কবে হল তা মনে করতে পারছিনা।ছয় আর সাতের দশকে পুজোর আর একটি অন্যতম আকর্ষণ ছিল, পুজোর গান। সেই সময় পেয়েছিলাম মন মাতানো কিছু শিল্পী সুরকার আর গীতিকারদের।সলিল চৌধুরী , নচিকেতা ঘোষ , অনিল বাগচি। সুধীন দাশগুপ্ত , রতু মুখোপাধ্যায় , অনল চট্টোপাধ্যায় , অভিজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায়ের মতো সুরকারদের।আর শিল্পীরা ছিলেন হেমন্ত মুখোপাধ্যায় , মান্না দে , প্রতিমা বন্দ্যোপাধ্যায়, লতা মঙ্গেশকর এবং সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়, শ্যামল মিত্র, , মানবেন্দ্র মুখোপাধ্যায়, আরতি মুখোপাধ্যায়, নির্মলা মিশ্র, বনশ্রী সেনগুপ্ত আরও অনেকে। তাঁরা এসেছিলেন তাঁদের সব অবিস্মরণীয় সুর আর গানের ডালি নিয়ে।
আর ছিলেন গীতিকারেরা যাঁরা কোনদিন কবির স্বীকৃতি পাননি। কিন্তু তাঁদের অসাধারণ কথার ওপর বাংলা গান রূপ পেয়েছিল একদিন। আজ তাঁরা অনেকেই বিস্মৃত প্রায়।- অজয় ভট্টাচার্য, প্রণব রায় , মোহিনী চৌধুরী , শ্যামল গুপ্ত ,প্রবীর রায় , গৌ্রীপ্রসন্ন মজুমদার , পুলক বন্দ্যোপাধ্যায় , মুকুল দত্ত-এঁরা বাংলা গানের কথাকে নতুন চেহারা দিয়েছিলেন। এ ছাড়া সলিল চৌধুরী তো ছিলেনই। সেই সব গীতিকারদের কথাও একই সঙ্গে মনে পড়ে।একজন বলেছিলেন
“সেই সময়ের ডিস্কে প্রকাশিত পূজোর গান নিয়ে একটি আলাদা করে ইতিহাস রচিত হলে সেই সব গুণী মানুষদের প্রতি কিছুটা সম্মান জানান হত । কিন্তু বাঙালিতো নিজেদের ইতিহাস রচনায় ভয়ানক অনীহা, হয়তো কোনও সাহেব এসে সেটাও লিখে যাবেন।”
সেই সময় বাঙালি সারা বছর অপেক্ষা করে থাকত পুজোর গানের জন্য। কিছুদিন আগে থেকেই প্রচারিত হত রেডিওতে সেই সব গান। তখন আরও একটি অন্যতম আকর্ষণ ছিল, এইচ এম ভি প্রকাশিত শারদ অর্ঘ্য। পুজোর গানের বই।তখন বলতে গেলে রেডিওই এক মাত্র প্রচার মাধ্যম ছিল।শনিবার স্কুল ছুটি হলে বাড়ি ফেরার পথে প্রত্যেক ঘর থেকে ভেসে আসত অনুরোধের আসরের সেই সব মাতাল করা সুর। বাড়িতে ফিরেও শুনতাম সেইসব গান। তখন কিছু বাঁধা ধরা অনুষ্ঠানের প্রতি ছিল সব বাঙালির এক অদম্য আকর্ষণ। যেমন শনিবার তিনটে থেকে সাড়ে তিনটে অনুরোধের আসর। রবিবার দুপুর আড়াইটে থেকে সাড়ে তিনটে আবার অনুরোধের আসর।সেই যুগটা ছিল শোনার যুগ। তখন দেখার চেয়ে শোনাই হতো বেশি। কাজেই শারদ অর্ঘ্যের বইটিতে শিল্পীদের ছবিই ছিল শিল্পীদের চেনার একমাত্র মাধ্যম।পরিচিত বেশি ছিলাম তাঁদের গান আর কণ্ঠস্বরের সঙ্গে।
নব্বই দশকে দেখলাম, একেবারেই উল্টো, টিভির দৌলতে গান চিনি না, শিল্পী চিনি। দেখলেই মানুষ বলে দিতে পারেন ইনি কে। কিন্তু তাঁর চারটে গান মনে করতে দিনের বেলাও তারা গুনতে হত। কিন্তু তখন যে কোনও শিল্পীর বহু গান মনে থাকত। এখনও আছে।
অবসান হয়েছে সেই যুগের। সেই অনুরোধের আসর নিশ্চয়ই আর নেই। পুজো প্যান্ডেলে পুজোর গান বাজছে তা এখন ধূসর স্মৃতি। এখন মোবাইল আর আইপডে ডাউনলোড করা থাকে শ’খানেক গান। পথ চলতে কানে ইয়ারপ্লাগ গোঁজা আধুনিক প্রজন্ম, ধারণাই করতে পারবে না একটি ৭৮ আর পি এমের গালার চাকতিতে ধরা দুটি মাত্র গানও তখন কী উন্মাদনা সৃষ্টি করতে পারত।
প্রায় একশো বছর আগে শুরু হওয়া পুজোর গানের যুগটা হারিয়ে গেছে কবেই। এখনও শুনি নতুন পুরনো মিলিয়ে কিছু শিল্পীর কিছু গান পুজোয় প্রকাশিত হয়, কিন্তু কে তার খবর রাখে? আর সেই উন্মাদনাই বা কোথায়?কখনো কখনো ইতিহাসও বর্তমানকে নিষ্প্রভ করে দেয়।
সেই যুগ হারিয়ে গেলেও সেই সব পাগল করা কথা, মাতাল করা সুর আর আবেশ ধরানো কণ্ঠের গান আজও অধিকার করে আছে বহু মানুষের মন।যে গান শুনলেই দুলে ওঠে হৃদয় মন।আবেশ ধরায় মনে।।অস্বীকার করার জায়গা নেই আমাদের স্বাদ bodleche..বদলেছে সমাজের ভাবধারা,চিন্তা…তৈরী হচ্ছে সুর,আসছে কথার অতিসহ্য,কিন্তু কম্পিটিশন র আওতায় পরে প্রয়োজনের থেকে আয়োজন বেশি হয়ে পড়াতে কোনো কথা,কোনো সুর ই কালজয়ী হয়ে উঠতে পারছে না..কিন্তু তার মানে যে ভালো সংগীত,ভালো মিউজিক তৈরী হচ্ছে না..এটা একেবারেই ভুল..।সংগীতের অবস্থান ভালো লাগাতেই আছে,কিন্তু স্বর্ণযুগের মতো দীর্ঘস্থায়ী নয়;বরং তা ক্ষণস্থায়ী.।স্বর্ণযুগের আমার অত্যন্ত পছন্দের গান আজও হৃদয়ে দোলা দেয়,হয়ত আমৃত্যু বেঁচে থাকবে মনে---
(1)আমার হাত ধরে তুমি----
"আমার হাত ধরে তুমি নিয়ে চল সখা,
আমি যে পথ চিনি না।"
(2)একটা গান লিখো----
"একটা গান লিখো আমার জন্য
একটা গান লিখো আমার জন্য,
না হয় আমি তোমার কাছে ছিলেম অতি নগণ্য
একটা গান লিখো আমার জন্য।"
(3)এমন একটি ঝিনুক
"এমন একটি ঝিনুক খুঁজে পেলাম না
যাতে মুক্তো আছে ,
এমন কোনো মানুষ খুঁজে পেলাম না
যার মন আছে।
বৃষ্টি নামলো চোখে,
এমন একটি আশাও খুঁজে পেলাম না
যার অন্ত আছে।"
(4)আমার বলার
"আমার বলার কিছু ছিল না,
না গো, আমার বলার কিছু ছিল না।
চেয়ে চেয়ে দেখলাম, তুমি চলে গেলে।
তুমি চলে গেলে – চেয়ে চেয়ে দেখলাম,
আমার বলার কিছু ছিল না,
না গো, আমার বলার কিছু ছিল না।"
(5)তখন তোমার একুশ বছর---
"তখন তোমার একুশ বছর বোধ হয়
আমি তখন অষ্টাদশীর ছোঁওয়ায়,
লজ্জা জড়ানো ছন্দে কেঁপেছি
ধরা পড়ি, ছিল ভয়।"
(6)নদীর যেমন ঝরণা আছে----
"নদীর যেমন ঝরণা আছে, ঝরণার ও নদী আছে
আমার আছ তুমি শুধু তুমি,
বাঁশির যেমন কৃষ্ণ আছে, কৃষ্ণেরও বাঁশি আছে
আমার আছ তুমি শুধু তুমি।"
(7)এ শুধু গানের দিন---'
"এ শুধু গানের দিন
এ লগন গান শোনাবার
এ তিথি শুধু গো যেন দখিন হাওয়ার।"
(8)নিশি রাত
"নিশি রাত, বাঁকা চাঁদ, আকাশে,
চুপি চুপি, বাঁশি বাজে, বাতাসে, বাতাসে।"
(9)প্রেম একবারই
"প্রেম একবারই এসেছিলো নীরবে
আমারি এ দুয়ার প্রান্তে,
সে তো হায়, মৃদু পায়,
এসেছিল পারিনি তো জানতে,
প্রেম একবারই এসেছিলো নীরবে।"
(10)যদি কিছু আমারে
"যদি কিছু আমারে শুধাও
কি যে তোমারে কব?
নীরবে চাহিয়া রব
না বলা কথা বুঝিয়া নাও
যদি কিছু আমারে শুধাও।"
(11)এত সুর--সুবীর সেন
"এত সুর আর এত গান
যদি কোনদিন থেমে যায়
সেইদিন তুমিও তো ওগো
জানি ভুলে যাবে যে আমায়।
এত সুর আর এত গান।
(12)আজ বিকেলের ডাকে-বনশ্রী সেনগুপ্ত
"আজ বিকেলের ডাকে তোমার চিঠি পেলাম,
রঙিন খামে যত্নে লেখা তোমার নাম।"
(13)কেউ বলে ফাল্গুন-- জটিলেশ্বর মুখোপাধ্যায়
"কেউ বলে ফাল্গুন,
কেউ বলে পলাশের মাস,
আমি বলি আমার সর্বনাশ।
কেউ বলে দখিনা,
কেউ বলে মাতাল বাতাস,
আমি বলি আমার দীর্ঘশ্বাস।
ঝড়ের পূর্বাভাস।"
(14)আমার স্বপন
"আমার স্বপন কিনতে পারে, এমন আমির কই?
আমার জল ছবিতে রঙ মেলাবে, এমন আবির কই?"
(15)আমার হাত ধ’রে
"আমার হাত ধ’রে তুমি নিয়ে চল সখা,
আমি যে পথ চিনি না।"
(16)যাক যা গেছে তা যাক
"দূর নয় বেশি দূর ঐ সাজানো সাজানো
বকুল বনের ধারে, ঐ বাঁধানো ঘাটের পাড়ে।"
(17)এই সুন্দর স্বর্ণালী সন্ধ্যায়-- গীতা দত্ত
"এই সুন্দর স্বর্ণালী সন্ধ্যায়,
এ কি বন্ধনে জড়ালে গো বন্ধু,
কোন রক্তিম পলাশের স্বপ্ন,
মোর অন্তরে ছড়ালে গো বন্ধু,
এই সুন্দর স্বর্ণালী সন্ধ্যায়,
এ কি বন্ধনে জড়ালে গো বন্ধু।"
(18)এত বড় আকাশটাকে
"এত বড় আকাশটাকে ভরলে জোছনায়,
ওগো চাঁদ, এ রাতে আর তোমায় বোঝা দায়।"
(19)"কফি হাউসের সেই আড্ডাটা আজ আর নেই
আজ আর নেই
কোথায় হারিয়ে গেল সোনালী বিকেলগুলো সেই
আজ আর নেই..."
শেষকথা: সেই কালের রবীন্দ্রসংগীতে পঙ্কজকুমার মল্লিক, দেবব্রত বিশ্বাস, সাগর সেন, সুচিত্রা মিত্র, কণিকা বন্দ্যোপাধ্যায়, পীযুষকান্তি সরকার, সুমন চট্টোপাধ্যায়, সুমিত্রা সেন, শান্তিদেব ঘোষ, হেমন্ত মুখোপাধ্যায়, সুবিনয় রায় প্রমুখ উল্লেখযোগ্য নাম। (৭) নজরুলগীতির ক্ষেত্রে ফিরোজা বেগম, ধীরেন বসু, সতীনাথ মুখোপাধ্যায়, মানবেন্দ্র মুখোপাধ্যায়, অনুপ ঘোষাল প্রমুখ। (৮) দ্বিজেন্দ্রলালের গানে কৃয়া চট্টোপাধ্যায়, সবিতাব্রত দত্ত, রবীন ব্যানার্জি, রজনীকান্তের গানে ছবি বন্দ্যোপাধ্যায়, দিলীপকুমার রায় প্রমুখ, অতুলপ্রসাদের গানে কৃয়া চট্টোপাধ্যায়, প্রতিমা বন্দ্যোপাধ্যায়। (৯) গণসংগীত উপস্থাপনার ক্ষেত্রে হেমাঙ্গ বিশ্বাস, সলিল চৌধুরী, প্রতুল মুখোপাধ্যায়। (১০) নতুন ধারার বাংলা গানে সুমন চট্টোপাধ্যায়, এরপর নচিকেতা চক্রবর্তী, অঞ্জন দত্ত, মৌসুমী ভৌমিক, শিলাজিৎ প্রমুখ। (১১) বাংলা ব্যান্ডের সৃষ্টিলগ্নে 'মহীনের ঘোড়াগুলি’,এছাড়া বর্তমানে ক্যাকটাস, চন্দ্রবিন্দু, ভূমি, ফসিলস্ ইত্যাদি। (১২) সিনেমার গানে ধনঞ্জয় ভট্টাচার্য, হেমন্ত মুখোপাধ্যায়, মান্না দে, শ্যামল মিত্র, তরুণ বন্দ্যোপাধ্যায়, কিশোর কুমার, সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়, আশা ভোঁসলে, লতা মঙ্গেশকর, আরতি মুখোপাধ্যায়, নির্মলা মিশ্র, প্রতিমা বন্দ্যোপাধ্যায়, ভূপেন হাজারিকা প্রমুখ উল্লেখযোগ্য। এঁরা একই সাথে বাংলা আধুনিক গানেরও প্রথিতযশা শিল্পী।
ধীরে ধীরে শারদীয়াতে গান করাটা একটা প্রেস্টিজের ব্যাপার হয়ে দাঁড়াল। পরবর্তীকালে আরতি ভট্টাচার্য, মাধুরী চট্টোপাধ্যায়, নির্মলা মিশ্র ,ভূপেন হাজারিকা, জটিলেশ্বর মুখোপাধ্যায়, সুবীর সেন, হৈমন্তী শুক্লা, সতীনাথ মুখোপাধ্যায়,উৎপলা সেন, কিশোর কুমার, কুমার শানু,জিৎ, লোপামুদ্রা মিত্র, নব্বই দশকে একঝাঁক তরুণ প্রজন্মের শিল্পীদের গানে বাঙালি মুগ্ধ হয়েছিল । নব্বই দশকের শেষে যাদের গানে মুগ্ধ হতে লাগলেন তাদের অন্যতম--শ্রেয়া ঘোষাল, শম্পা কুণ্ডু, মনোময় মুখোপাধ্যায়, রাঘব, শ্রীকান্ত আচার্য, সুমন চট্টোপাধ্যায়, অনুপম রায়, শ্রীরাধা বন্দ্যোপাধ্যায়, অরিজিৎ সিংহ, বাবুল সুপ্রিয়, শান প্রমুখ। গভীরভাবে ভাবলে আসলে পুজোর গান, পূজার গান নয় কিন্তু। আরাধনার গান, উপাসনার গান, ব্রহ্মসঙ্গীত ইত্যাদি সাধারণ অর্থে পূজার গান। পূজা পর্যায়ের গান। আর ‘পুজোর গান’ হল শারদোৎসবে বাঙালির মন রঙিন-করা, স্মৃতি উদ্বেল-করা রেকর্ড সংগীত। এ সময়ে গান ছাড়াও প্রকাশিত হয় রেকর্ডবদ্ধ নাটক, নাটিকা, কৌতুক নকশা, আবৃত্তি, পুজোবার্ষিকী। নতুন জামা, নতুন জুতো, নতুন শাড়ি-ব্লাউজের সঙ্গে সঙ্গে বাঙালির চাই নতুন গান তার হৃদয় ভরানোর জন্য।
বাঙালির পুজো তো চার দিনের, সেই চার দিনকে ঘিরে মাসখানেকের এক উৎসবের মেজাজ। কিন্তু পুজোর গানের প্রস্তুতি রেকর্ড কোম্পানিতে চলে প্রায় সারা বছর। শিল্পী, সুরকার, গীতিকার, রেকর্ড কোম্পানির কর্তাব্যক্তিদের পরামর্শ, পরিকল্পনা, গবেষণা। ভিজিটাল যুগের পুজোর গানের মধ্যে আমি প্রাণ খুঁজে পাইনা। আগের শিল্পীদের নিষ্ঠা সহকারে গাওয়া যে চল ছিল, আজকের যুগের শিল্পীদের গান গাওয়ার সেই নিষ্ঠার অভাব করি। পুজোর গান শুনি, কিন্ত মন ভরে না। এই সময়ের গান অনেকটাই বাণিজ্যিক হয়ে পড়েছে।যে কোন উপায়ে উপার্জন বৃদ্ধির চেষ্টা। এতে গানের মান নষ্ট হতে বসেছে।পুজো প্যান্ডেলে পুজোর গান আজও ভীষণ টানে।আসলে,সময়,রুচির বদল ঘটে গেছে। তাই পুজোর গানে বাঙালির স্বপ্নপূরণ আজ অধরা বলে মনে হয়।
উৎসবের দিনগুলো রেকর্ড কোম্পানির কাছে ব্যবসার মরশুমও বটে। শ্রোতাদের চাহিদা, রুচি পরিবর্তন, সুরের ফ্যাশন, বাণীর বৈচিত্র— এ সব নিয়ে ক্রমান্বয়ে আলোচনা-পর্যালোচনার একটাই লক্ষ্য— কী করে একটা ‘হিট’ গান সৃষ্টি করা যায়? আর হিট গান সৃষ্টি নিয়েই যত প্রতিযোগিতা ছোট-বড় রেকর্ড কোম্পানির মধ্যে। জহুরির জহর চেনার মতো হিট গান শনাক্ত করার এক অদ্ভুত ক্ষমতা রেকর্ডের ডিলারদের, যাঁদের হাত দিয়ে রেকর্ড পৌঁছে যায় জনগণের হাতে হাতে। শ্রোতার সঙ্গে কোম্পানির সম্পর্ক ঘটে এই মধ্যবর্তী বিক্রেতাদের মাধ্যমে। পুজোর গানে আর্টের সঙ্গে ট্রেড বা ব্যবসায়ের কতখানি মেলবন্ধন হল, সেই মর্মের যোগ্য বিবেচক পাওয়া যাবে এই ডিলারদের মধ্যে। একটা সময় ছিল যখন বড় বড় গুণী গায়কদের চমৎকার সমাবেশ হত ডিলারদের আখড়ায়। গ্ৰামবাংলার পূজোতে নেই শহুরে জৌলুস, চোখ ধাঁধানো রোশনাই, সারারাতের চরকিবাজি। আছে শুধু হৃদয়ের টান, সোঁদা মাটির গন্ধ, একটা মন কেমন করা ব্যাকুলতা আর আছে পুরানো গানের মাদকতা ।ছুটিতে বাড়ি ফেরার টান আর ছেলেবেলার স্মৃতিদের আরেকবার ছুঁয়ে ছুঁয়ে দেখা


