গবাদি পশুর যত্ন নিতেই কুড়মি সমাজে পালন করা হয় বাঁদনা পরব

গবাদি পশুর যত্ন নিতেই কুড়মি সমাজে পালন করা হয় বাঁদনা পরব
গৌতম মাহাতো
গবাদি পশুর যত্ন নিতেই কুড়মি সমাজে পালন করা হয় বাঁদনা পরব। এই পরব কুড়মি সমাজের এটি একটি একক উৎসব। বাঁদনা পরব উদযাপিত হয় কার্তিক মাসের অমাবস্যায়। বাঁদনা শব্দটি এসেছে বন্দনা থেকে। এই উৎসব গৃহপালিত গো উৎসব। গবাদি পশুর যত্ন নিতেই কুড়মি সমাজের মানুষেরা এই উৎসব বা পরব পালন করে।
অখণ্ড চুটিয়া নাগপুর জুড়ে যে জনজাতি সুদীর্ঘ কাল ধরে তাদের নিজস্ব ঐতিহ্য বহন করে চলেছেন তারাই এই অঞ্চলের মূল আদিবাসী। তারা কুড়মি। আদিম জনজাতিগুলির মধ্যে কুড়মি উল্লেখ্যনীয়। কারণটা অবশ্যই তাদের একান্ত নিজস্বতা, নিজস্ব রীতি নীতি, পরব-তেওহার ও নেগ-নেগাচার। বর্তমানে অবশ্যই বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে কুড়মালি ভাষার স্বীকৃতির পর তা পঠনপাঠনের বিষয় হিসাবে চালু করে হয়েছে ঠিকই কিন্তু এই জনজাতিটি রয়ে গিয়েছে সেই তিমিরেই। এদের রহন-সহন, খাদ্যাভ্যাস, আদবকায়দা এবং সর্বোপরী জীবনযাপনের একটা বড় অংশ জুড়ে বয়ে গিয়েছে প্রকৃতি প্রেম। এরা হিন্দু/আর্য নয়। অনেক গবেষকের মতে এই জনজাতিটিও অন্যান্য আদিম জনজাতির মতোই টোটেমিক। অর্থাৎ এরা গোত্রে বিবেচিত নন, এরা গোষ্ঠীতে বিশ্বাসী। তাই এদের জীবনযাপন ও সংস্কৃতিতেও স্পষ্টভাবে ছাপ ফেলে প্রকৃতি। নানান ট্যাবু ও টোটেমদের মধ্যে প্রকৃতি তার গভীর প্রভাব আচ্ছাদিত করে রাখে। হাবার্ট একেই ‘প্রেতবাদ’ বলে চিহ্নিত করেছেন।
এই কুড়মি জনজাতির ভাষা ও জীবনের মতোই এদের পার্বণগুলিও ভিন্নতর স্বাদের এবং অদ্ভুত সুন্দরও। যেমন- ছাতা, জিতা,আখ্যান, টুসু, ভাদু, করম, বাঁদনা ইত্যাদি। এখানে আলোচনা করব এইসব পরব-তেওহার নিয়েই। যদিও সম্পূর্ণ পরব-পার্বণ ও নেগ নেগাচার সম্ভব হবেনা তবুও মূল কয়েকটি আলোচনার মাধ্যমে পরিচয় ঘটাব এদের সাথে।
কুড়মিদের জীবন জল, জঙ্গল ও জমির মধ্যেই আবর্তিত হয়। তাই পার্বণগুলিও এদের ব্যাতিরেকে নয়। মূল কথাটা হল এরা প্রকৃতি প্রেমিক। সাথে সাথে প্রকৃতি পুজারিও। তাই কুড়মিদের নেগ-নেগাচারে মূর্তিপূজার প্রচলন প্রায় নেই। যে কটা মূর্তিপূজার নিদর্শন দেখা যায় সেগুলি আসলে অর্বাচীন প্রথা বা বীরগাথার অংশ। তার মধ্যে পড়ে টুসু এবং ভাদু যা প্রতীকী সম্মান জ্ঞাপন। কুড়মিদের নিজস্ব ক্যালেন্ডারও বর্তমান সময়ের সাথে তাল মিলিয়ে প্রিন্টেড মেটিরিয়াল হিসেবে পাওয়া যায়। তবে সেটা যৎসামান্যই। তাছাড়া বাকি সব কিছুই স্মৃতি ও পরম্পরায় প্রায় তিনহাজার বছর ধরে বহন করে আসছেন এরা। কোন প্রামাণ্য কোনও লিখিতরূপ ছাড়াই।
এই জাতির অন্যতম সেরা পরব হল বাঁদনা। বাঁদনা পরব উদযাপিত হয় কার্তিক মাসের অমাবস্যায়। বাঁদনা শব্দটি এসেছে বন্দনা থেকে। এই উৎসব গৃহপালিত গো উৎসব। কুড়মি সমাজের এটি একটি একক উৎসব।
অমাবস্যার দিন পরিবারগুলিতে ভোর থেকে শুরু হয় ‘ঘাওয়া’। অর্থাৎ ঘরে সংস্কার পরিচর্যা। মাটি লেপা, দেওয়াল প্রলেপন, দেওয়াল চিত্রন ইত্যাদি। এদিনেই নানান ধরনের পিঠে প্রস্তুত করা হয়। তাই প্রচলিত এই দিনটিকে ‘পিঠা করা’-ও বলা হয়। সন্ধ্যাবেলা করা হয় কাঁচি দুয়ারি। চাল গুঁড়ির ঢেলা বানিয়ে শাল পাতায় কার্পাসের ইয়ুলো তেলে ভিজিয়ে সলতে মত করে চৌকাঠে জ্বালিয়ে দিতে হয়। গৃহকর্তা শুদ্ধ হয়ে নতুন ধুতি পরে গোয়ালে গিয়ে শিরি-গাই শিরি-বলদের শিঙে তেল মাখিয়ে গোহালের ধন্নাতে (কড়িকাঠে) শিকায় জাগর হাঁড়ি জ্বালিয়ে দিয়ে আসবে। কুড়মিদের বিশ্বাস এদিন ভগবান শিব স্বয়ং রাত্রে এসে ঘরে গোরুদের পরিচর্যার নমুনা দেখে যান। ভোর রাতে আসে ধাঙড়্যা। গ্রামের কিছু ছেলে সারারাত জুড়ে এই ধাঙড়্যার ভূমিকা পালন করে। সঙ্গে চনে মাঙন।
অমাবস্যার রাতে ধাঙড়্যা ছেলেযুবকের দল আহিরা গান গাইতে গাইতে ধামসা মাদলের সহযোগে গৃহস্থের ঘরে ঘরে গিয়ে গরু জাগিয়ে দিয়ে আসে। গৃহস্থ ধাঙড়্যার দলকে পিঠা খাইয়ে আপ্যায়ন করে।
অমাবস্যার পরের দিন গরয়্যা (গোয়াল পূজা)। এদিন প্রতিপদ। গৃহকর্তা ভোর থেকে উঠে আঙিনা উঠোন পরিস্কার করে গোবর ছড়া দিয়ে গরয়্যার নৈবেদ্য সাজিয়ে রাখে। গৃহকর্তা যান পুকুর বা জলাশয় থেকে গরয়্যা ফুল (শালুক ফুল) সংগ্রহ করতে। সেখানেই ফুল সংগ্রহ করে স্নান করে ভিজে কাপড়ে ফিরে এসে গোয়াল পূজা করে। কেউ কেউ ঘরে বলিও দেয়। বলি দেওয়া হয় কুঁদরা ঠাকুরের জন্য। কালো মোরগ, পাঁঠি ছাগল (কুমারী) ইত্যাদি। নৈবেদ্যে থাকে একটি বিশেষ উপকরণ।, নতুন তৈরি উনুনে ঘি-এর পিঠে। সন্ধ্যাবেলা গৃহকত্রী নতুন শাড়ি পরিধান করে মুখে পান নিয়ে শিরি-গাই ও শিরি-বলদকে বরণ করে ধানের তৈরি মোড় পরিয়ে সুসজ্জিত করে তোলে। শিং-এ মাখিয়ে দেওয়া হয় সরষের তেল ও সিঁদুর। যে মাটির প্রদীপটি দিয়ে বরণ করা হয় সেই প্রদীপটি কুলহি মুঢ়ায় (চৌরাস্তার মোড়ে) বাঁ পায়ের ফাঁকে তিনবার ঘুরিয়ে ভেঙে ফেলা হয়। এই রীতিটিকে বলা হয় ‘পছা ভাঙা’।
পরের দিন অর্থাৎ দ্বিতীয়ার দিনটি হল বাঁদনা। দুপুরে আঁকা হয় চোক পুরা নামের এক বিশেষ আলপনা। পাইন্যাহ লতার (Cissus adnata) রস চালগুঁড়ির সাথে মিশিয়ে এই আলপনা দেওয়া হয়। মূল দরজায় গোবরের ঢেলা রেখে তাতে ফুল গুঁজে রাখা হয়। শিরি-গাই ও শিরি-বলদকে বরণ করে শিং -এ তেল সিঁদুর মাখিয়ে হলুদ জলে পা ডুবিয়ে ওই ঢেলা ডিঙ্গিয়ে গোয়ালে তোলা হয়।
বিকেলে অনুষ্ঠান আকর্ষণীয়। একে বলা হয় গরু খুঁটান বা কাড়া খুঁটান। বাগাল বা রাখালরা তাদের সেরা গবাদিকে সাজিয়ে কুলহিতে (গ্রামের রাস্তায়) খুঁটি পুঁতে বিশেষ কৌশলে বেঁধে দেয়। আহিরা গান গাইতে গাইতে গ্রামের যুবকরা তার সামনে বিশেষভাবে প্রস্তুত করা গরু বা কাড়ার চামড়া নিয়ে অঙ্গভঙ্গী করে। সঙ্গে চলে ধামসা মাদলের সুরেলা বোল। এটি মূলত বাগাল বা রাখালদের আদরের গবাদির সাথে খেলা, আনন্দ উৎসবের দিন।
তারা গায় –
১) “ অহি রে- কেকরা সিরজল রে দিয়য়া
কেকরা সিরজল বাতি রে
কুমহরুকে সিরজল দিয়য়া
ধোবিয়াকে সিরজল বাতি রে।। ”
২) “ অহি রে- জাগহু ইসরু হো মহাদেব
জাগাহু ঘরাকর দেবা হো
দুধে ঘি-এ জাগহু ইসরু হো মহাদেব
গন্ধ ধূপ জাগু ঘরক দেবা হো ।।”
( লেখক - পশ্চিম মেদিনীপুরে গড়বেতার মংলাপোতা হাইস্কুলের সংস্কৃত শিক্ষক)


