সিমলিপাল অভয়ারণ্যের যমজ কন্যা বহেরাপানি-উস্কি

সিমলিপাল অভয়ারণ্যের যমজ কন্যা বহেরাপানি-উস্কি
ড. সুবীর মন্ডল
লালমাটির দেশ আলো করা জলপাইরঙা মেয়ে দামিনীর আমন্ত্রণ আসে শীতের মাঝখানে সবুজ গন্ধ নিয়ে। কিন্তু নাগরিক জীবনের হাজারো ব্যস্ততা আর সময়ের টানাটানিতে অবসর মেলে না সহজে। তাই মন কেমন করা কোন এক কাকভোরে 'দ্যুত্তেরি' বলে, কেজো জীবনকে গুডবাই জানিয়ে কাঁধের ঝোলাটা তুলে নিয়ে বেরিয়ে পড়লাম শাল-মহুয়া আর পিয়ালের দেশে। শহরের অনর্গল ডিজেল-পেট্টোলের শ্বাসরোধী কালো ধোঁয়া, নাগরিক জীবনের এই সময়ের উৎকণ্ঠা থেকে বাঁচতে, ফুসফুস ভরে অক্সিজেন নিয়ে প্রাণশক্তিকে পুনরুজ্জীবিত করতে চাইলে আস্তে হবেই এই লালমাটির স্বপ্নপুরী বাংরিপোসি- -কেওনঝড়ের আর সিমলিপাল অভয়ারণ্যে মনোমুগ্ধকর সবুজ উপত্যকার মাঝে।
ঝাড়খণ্ড-ওড়িশা সীমান্তে পশ্চিমবঙ্গের ঝাড়গ্রাম জেলার লোধাশুলি থেকে মাত্র দেড় ঘণ্টা দূরে সবুজের গন্ধ মাখা বুদ্ধদেব গুহর স্মৃতি বিজড়িত বাংরিপোসি - সিমলিপাল। অপার সৌন্দর্যের লীলাভূমি। প্রকৃতিতে প্রাধান্য পেয়েছে জঙ্গল। সবাই জঙ্গলমহল রূপে চেনে ও জানে। গাঢ় সবুজ অরণ্য দিগন্তে প্রসারিত, নীচেও তার সবুজের সমুদ্র। আর লালমাটির কাঁকুড়ে মায়া মাখানো স্বপ্নময় পথ। এই দীর্ঘ সবুজ জঙ্গল ঘিরেই এখানকার প্রান্তভূমির সাধারণ মানুষের জীবন-যাপনের এক অনুপম ছন্দ। আদিবাসী জনগোষ্ঠীর স্বপ্নের গ্রাম দিয়ে ঘেরা এই এলাকা। উপচে পড়া বন্য রূপ নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে, বুকে আছে অতীতের না বলা বর্ণময় নীরব ইতিহাস। সেই ইতিহাস ও ঐতিহ্যের খোঁজে আমাদের এই তিন দিনের উড়িষ্যার কেওনঝড়ের রোমাঞ্চকর সফর।
আজ উড়িষ্যা ভ্রমণের তৃতীয় তথা শেষ দিন। গতকাল কেওনঝড় ঘুরে যশিপুরের সাইরাম হলিডে হোমে উঠলাম। সন্ধ্যার টিফিনপর্ব সারলাম। সিমলিপাল অভয়ারণ্য প্রবেশের টিকিটের ব্যবস্থা করলেন হোটেল মালিক মহাপাত্র বাবু। নিজস্ব গাড়ি নিয়ে ঢোকা সম্ভব ছিল না।বাইরে থেকে গাড়ি ভাড়া করতে হল। আজ সকালে যশিপুরের কিছু জায়গা ঘুরে নিলাম। রামতীর্থ, ক্রোকোডাইল পার্ক, খৈরি নদী দেখলাম। সকাল সাড়ে সাতটায় সিমলিপাল অভয়ারণ্যের গেটে সবাই পৌঁছলাম। এবার স্বপ্নের অভয়ারণ্যে প্রবেশের পালা। সকাল সাতটায় অরণ্যপথে যাত্রা শুরু করলাম। এবারের গন্তব্য এশিয়ার বিখ্যাত সিমলাপাল জঙ্গল। গেট দিয়ে ঢোকার আগে গাড়ির টিকিট, আমাদের টিকিট, ক্যামেরার টিকিট ও জঙ্গলে মধ্যে দুপুরের খাওয়া কুপন সংগ্রহ করতে হলো। জঙ্গলের মধ্যে মোরামের আঁকাবাঁকা রাস্তা, আদিবাসী গ্রাম, প্রাচীন গাছ, দূর থেকে দেখা হরিনের ও হাতির পাল, বড়াপানি ও ছোটাপানির মতো ঝরনা মনকে অন্য জগৎ নিয়ে গেল।
আমরা সিমলিপাল ঢুকলাম জোশিপুর এর দিক থেকে। আর বেরোব অন্য প্রান্তের পিথাবাটা গেট দিয়ে বারিপদা হয়ে ঘাটশিলা হয়ে নিজেদের শহরে -এ ফিরব। আজকের দ্রষ্টব্য জোশিপুর এ রামতীর্থ, জঙ্গল এর ভেতরে উস্কি, বারেহেপানি ও জোরান্ডা জলপ্রপাত, চাহালা ওয়াচ টাওয়ার আর লুলুং নদী ও সীতাকুণ্ড।
ঘন্টাখানেক পর পৌঁছলাম জশিপুর এ। এখানে এন্ট্রির জন্য পারমিট নিতে হবে। মিনিট ১৫-২০ সময় লাগলো পারমিট নিতে। গাইড নিতে হলনা যেহেতু আমাদের ড্রাইভার দাদা একজন বেশ ভালো গাইড ছিলেন। উনি নিজেই সব ব্যবস্থাপনা করে দিলেন।
অল্প কিছু জলখাবার খেয়ে আমরা প্রথমে গেলাম রামতীর্থ। খৈরি নদীর ধারে রাম মন্দির। রামচন্দ্র নাকি বনবাসকালে এখানে এসেছিলেন। এখানে একটি কুমির প্রকল্প রয়েছে। ড্রাইভার দাদা বললেন খৈরি নামের যে বাঘটিকে বাঙালি দম্পতি তাদের কাছে রেখেছিলেন তার মৃত্যুর পর তার অস্থি এইখানেই নাকি রাখা আছে।
কিছু সময় এখানে কাটিয়ে আমরা এগিয়ে চললাম জঙ্গলের দিকে। প্রায় মিনিট কুড়ি পর পৌঁছলাম জশিপুর গেট, এটা সিমলিপাল এর মেন জঙ্গলে প্রবেশের গেট। এখানে এন্ট্রি পারমিট দেখিয়ে ঢুকতে হলো। এই জঙ্গল পথের পুরো রাস্তাটাই একেবারে লাল। কাঁচা মাটির রাস্তা। জঙ্গলে ঢোকা থেকেই লাল ধুলো উড়তে দেখছি। গাছের পাতা শুদ্ধ লাল লাল হয়ে আছে। আর আমরাতো বটেই। আমাদের জামাকাপড়, মুখ, হাত, ব্যাগ, চুল, চোখের পাতা শুদ্ধ লাল ধুলোতে মাখামাখি হয়ে গেছে। তা হোক। জঙ্গলে এসে নয় একটু লাল ধুলোই মাখলাম। আহা এই লাল মাটির রাস্তা। কিন্তু বর্ষাকালে কি যে অবস্থা হয় এখানে রাস্তার কে জানে। এন্ট্রি পয়েন্ট থেকে কিছুটা এগিয়ে গাড়ি থামলো, এক মহাশাল বৃক্ষ। চারশো বছরের পুরনো এই শাল গাছ। পবিত্র গাছ বলে মান্য করা হয়। কথিত আছে এই গাছ কাটতে এসে নাকি ঠিকাদার এর লোকজন ওই গাছের অভিশাপে মারা গেছিল। তা এসে সত্যি কি কল্পকাহিনী তা জানা নেই। তবে ওই পরিবেশে দাঁড়িয়ে এই গল্পকে সত্যি বলেই মানতে মন চাইল।
ভারি সুন্দর লাগছে এই জঙ্গল পথ। শাল -সেগুন এর ঘন জঙ্গল। মাঝেমাঝে দেখা যাচ্ছে কারো নদী। ড্রাইভার দাদা বলেন এটা উসকি ফলস থেকে নেমে আসা নদী। গুরগুরিয়া পেরোলাম। একটা নদীতে দেখলাম স্থানীয় বাচ্চারা হুটোপুটি করে স্নান করছে। কি সহজ সরল জীবন? সিমলিপাল এর ভেতরে অনেকগুলো আদিবাসীদের গ্রাম রয়েছে। রয়েছে পঞ্চায়েত। বেশ কয়েক শ মানুষের বাস এই জঙ্গলে। তবে পুরো সিমলিপাল ই জঙ্গল, পাহাড়, সুন্দর উপত্যকা, সুন্দর আদিবাসীদের গ্রাম, ঝর্না, নদী নিয়ে একটা ভীষণ সুন্দর জায়গা। পেরিয়ে যাচ্ছি কত সুন্দর সুন্দর গ্রাম। গ্রামের বাড়িগুলো বেশ অন্যরকম দেখতে, খুব সুন্দর। সেই বড় বড় হাঁড়ি বাড়িতে বাড়িতে, দেশী মুরগী মোরগগুলো বসে বসে আরাম করছে যেন। আর গাড়ি দেখলেই ছোট ছোট বাচ্চাগুলো হাত নাড়ছে, ছুটে আসছে। আমরা সঙ্গে নিয়ে যাওয়া কেক এর প্যাকেট থেকে ওদেরকে কেক খেতে দিয়েছিলাম।
জঙ্গলের ভেতর যে এত আদিবাসীদের গ্রাম থাকতে পারে আমি আগে জানতাম না। কি সুন্দর ধাপ কেটে কেটে ওরা চাষ ও করছে। গাড়ি চলতে চলতে কখনো গভীর জঙ্গল তো কখনো বিশাল এক উপত্যকায় এসে পড়ছে , আর সেই উপত্যকা ঘিরে পাহাড়ের সারি। গাছের পাতাগুলো অনেকাংশে হলুদ হয়ে আছে। আমিতো ভাবছিলাম দূর থেকে হলুদ ফুল ফুটেছে বুঝি। সত্যিই যেন এক হলুদ বন মনে হচ্ছিল। "ফুল ফুটুক না ফুটুক আজ বসন্ত"....
গাড়িতে লাল ধুলোর হাওয়া মেখে আমরা বনপথে চলেছি।"পাগল হওয়া কি আমার মত তুমিও হারিয়ে গেলে, ফুলেরও বনে হাজারও রঙের মেলায়, সুরভি লুটের খেলায় তারে নাহি পেলে"...গুলতি হাতে পাখি শিকার করছে কিছু গ্রামের ছেলে। ড্রাইভার দাদা বললেন এখানে গ্রামে বাঘ ঢুকে পড়লে কখনো কখনো এরা তীর ধনুক দিয়ে নাকি বাঘ শিকার ও করে। বাঘের ছাল বিক্রি করে নাকি কেউ কেউ বড়লোক হয়ে গেছে। তারা আবার বাইকে করে ঘুরে বেড়ায়। সত্যি মিথ্যে আমি জানিনা বাপু। দাদা আমাদের দেখলেন মহুয়া গাছ। আমিতো ফলের আশায় গাছের দিকে চেয়ে দেখলাম। নাহ্ মহুয়ার সময় হল ফাল্গুন। সেইসময় নাকি মহুয়ার গন্ধে মাতাল হয়ে ওঠে জঙ্গল। সেই গন্ধেই নাকি নেশা হয়ে যায়। ইশশশশ ওইসময় টায় যদি আসতাম। পলাশ, শিমুল, কুসুম এর লাল আর মহুয়া ফলের মদির গন্ধে নেশাতুর হতে আবার আসতে হবে ভরা বসন্তে। তখন আমি আবার গাইব, " ও পলাশ, ও শিমুল আমার এ মন কেন রাঙালে, জানিনা জানিনা আমার এ ঘুম কেন ভাঙ্গালে"
"এই বনপথে যেতে যেতে কত সবুজ সবুজ উপহার"....শাল, সেগুন, মহুয়া, পলাশ আরো অনেক নাম না জানা গাছের মায়া অরণ্য পথে এগোতে লাগলাম । এক ঘন্টা পর এসে পড়লাম উস্কি ফলস এর কাছে। পাহাড়ি জঙ্গল পথে পাথুরে রাস্তা পেরিয়ে আরো বেশ কিছুটা হেঁটে পৌঁছতে হবে ফলস এর একদম সামনে। হাঁটতে লাগলাম। সাহিত্যিক বুদ্ধদেব গুহর নায়িকারা তো শাড়ি পরেই জঙ্গলে ঝর্নার ধারে যেত শুনেছি।
আমার স্ত্রীর হাত ধরে ধীরে ধীরে পৌঁছই ঝর্নার ধারে। দেখলাম জায়গাটায় একটু লোকজনের ভিড় রয়েছে। সবাই কলকল করে কত কথা বলছে। পাহাড় থেকে নেমে আসছে সুন্দর উস্কি নদীর ধারা। আমরা একটা বেশ বড় পাথরের ওপর উঠে বসলাম। ভারি সুন্দর জায়গাটা। ওখানে আমরা বেশকিছুক্ষন ছিলাম। ছবি তুললাম। উঠে তো পড়েছি। এবার নামতে হবে তো। কি জ্বালা। স্ত্রীর দিকে হাত বাড়িয়ে দিলাম। প্রায় কোলে করে নামিয়ে দিল আমায়...আর যেন নেই কোনো ভাবনা, যদি আজ অকারন, কোথাও হারায়ে মন, জানি আমি খুঁজে তারে আর পাবনা"...
ঝর্নার ধার ছেড়ে ফিরতে মন চাইছিল না। তিরতির করে বয়ে চলেছে ভালোবাসার নদী, জঙ্গলের ভেতর দিয়ে পথ করে নিয়েছে। শুনেছি, সন্ধ্যার পর এইসব জায়গায় বন্য জন্তুরা জল খেতে আসে। সব লোকজন এগিয়ে গেছে। আমরাও ফেরার পথ ধরলাম। জায়গাটা কেমন শান্ত নিরিবিলি নির্জন হয়ে গেল। নির্জনে বসে ভালোবাসার উপযুক্ত পরিবেশ একদম। আমি আর আমার স্ত্রী শেষে ফিরছি, একটু দূরে সবার থেকে। ওর হাত টেনে গাছের আড়ালে নিয়ে গিয়ে আমি ওর কানেকানে বললাম চলো আবার ফিরে যাই নির্জন ঝর্নার ধারে, ওরা সামনে এগিয়ে যাক, আমি আর তুমি পালাই চলো. "ডাকছে মায়া অরণ্য, শুধু একটু ছোঁয়ার ই জন্য, আমি তোমার সাথে অন্য হতে চাই, আমি তোমায় ছুঁয়ে অন্য হতে চাই, তোমার সাথে একলা হতে চাই"...
আমার স্ত্রী কানটা মুলে দিয়ে বলল সামনে দেখো আরো লোকজন আসছে, সত্যি তো, এত লোক আসছে কেনো, একটু কি একলা হতে দেবেনা কেউ। কানমলা খেয়ে আমি রাগ করে ওর সাথে আড়ি করে দিয়ে দুমদাম পা ফেলে এগিয়ে চললাম গাড়ির দিকে। দূর থেকে দেখছি মামিমা দেখছে আমাদের এত দেরি হচ্ছে কেন আসতে। এবার বসলাম গাড়িতে। গাড়ি চলল এবার চাহলা ওয়াচ টাওয়ার এর দিকে।
যাবার পথে মাঝে মাঝেই রাস্তার দুধারে অনেক বাঁদর চোখে পড়ল। সিমলিপাল ঢ়োকার আগে স্থানীয় খাবার সুজির বড়া আর কচুরি খেলাম। সিমলিপাল রিজার্ভ ফরেস্টে ঢ়োকার পাস করানোর সাথে দুপুরের খাবারের কুপন ও নিয়ে নিলাম। সাইনবোর্ডে দেখে নিলাম নিয়মাবলী, ফরেস্টে কি কি করা যাবে আর কি করা যাবে না। ফরেস্টে ঢ়োকার আগে ভাল করে হাতে মুখে মশার কামড় থেকে বাঁচার জন্য ক্রীম লাগিয়ে নিলাম, যেহেতু সিমলিপাল রিজার্ভ ফরেস্ট ম্যালেরিয়ার মশার জন্য বিখ্যাত। একজন গাইড নিয়ে শুরু করলাম আমাদের ফরেস্ট সাফারি। যত জঙ্গলের গভীরে ঢ়ুকতে থাকলাম, অবাক হতে থাকলাম উদ্ভিদ বৈচিত্র দেখে। কিছু জানা অধিকাংশই অচেনা গাছ।একটু পরেই গাইড গাড়ি থামিয়ে আমাদের কে দেখাল এক বিশাল উঁচু এবং চওড়া শাল গাছ। শাল গাছটার বয়স ৩৪০ বছরের ও বেশি। এরপরেই দেখলাম ৩০০ বছরের একটা চম্পা গাছ। জঙ্গলে মাঝে মাঝে চোখে পড়ছিল ছোট ছোট গ্রাম। গাইডের কাছে জানলাম এরা খাদিয়া উপজাতির লোক। এরা এখানে বসবাস করে জঙ্গলের দেখাশোনা করে নিজেদের জীবন নির্বাহ করে। জঙ্গলের পথের দুধারে মাঝে মাঝে চোখে পড়ল বাচ্চারা শাল পাতায় করে আমলকি, ফুলের মালা বিক্রি করছে। অবাক হলাম দেখে যে জীবনে কোন সুখ স্বাছন্দ্য না থাকা সত্ত্বেও তারা মুখে হাসি নিয়ে বেঁচে আছে। গিয়ে পৌঁছালাম GURGURIA ECO-TOURISM CENTER এ। জানলাম এখানে জঙ্গল থেকে বাচ্চা হাতি নিয়ে এসে তাদের ট্রেনিং দেওয়া হয়।এরপর যাত্রাপথে দেখলাম দারুণ সুন্দর দুটো জলপ্রপাত বড়েপানি আর উইস্কি। দুপুরে জঙ্গলের ভেতরেই খাওয়া সারলাম রিজার্ভ ফরেস্টের থেকে ব্যবস্থা করা খাবার জায়গায়।যাত্রাপথে কিছু বাঁদর আর বনমোরগ ছাড়া অন্য প্রাণী দেখতে না পাওয়ায় মনটা একটু খারাপ লাগছিল। ঠিক তখনই গাইড জানালো যে এবার আমরা জঙ্গলের CORE এলাকায় ঢ়ুকব। সেখানে ভাগ্য ভাল থাকলে বন্য প্রাণীর দেখা পেতেও পারি। গাড়ি থেকে নেমে উঠলাম একটা টাওয়ারের মাথায়। হঠাৎই দেখতে পেলাম একদল হরিণ মনের সুখে ঘুরে বেড়াছ্ছে। একটু দূরে দেখলাম বেশ কিছু ময়ূর। আরো কিছুটা জঙ্গলের গভীরে দেখলাম তিন চারটে হাতি। সিমলিপাল যদিও TIGER RESERVE কিন্তু বাঘ দেখার সৌভাগ্য এ -যাত্রায় হলনা।ফিরে এলাম রিসোর্টে। এখানে উপভোগ করলাম অদ্ভূত নিরবতা।শুধু আরণ্যক সৌন্দর্য আর অনেক শাখা প্রশাখা নিয়ে সামনে দাঁড়িয়ে থাকা বিশাল বিভিন্ন প্রজাতির গাছ-গাছালির মায়াবী স্বপ্নের জগৎ।
সূর্যের আলোমাখা মনোমুগ্ধকর গভীর অরণ্যে ভিতরে দিয়ে বিভিন্ন জনপদ ভূমি ছুঁয়ে ছুঁয়ে বাংরিপোসির দিকে রওনা দিলাম। পেছনে পড়ে রইল সিমলিপাল রিজার্ভ ফরেস্ট আর সঙ্গে নিয়ে ফিরলাম একটা পুরো দিন জঙ্গলের সাথে একাত্ম হবার অদ্ভূত মাদকতা। পরের দিন সকালে রির্সট ছেড়ে বাড়ির পথে যাত্রা শুরু করলাম। রাস্তার ধারে মাঝে মাঝে চোখে পড়ছিল গ্রাম্য মহিলারা হাঁড়ি চাপা দিয়ে কিছু বিক্রি করছে। জানলাম তারা হাঁড়িয়া নামে একপ্রকার নেশার তরল জিনিস বিক্রি করে। ফেরার পথে গেলাম বামনকুন্ডু নামে জলাশায় দিয়ে ঘেরা জায়গায়। স্থানীয় লোকেদের কাছে পবিত্র স্থান। দেখলাম প্রাচীন এক শিব মন্দির। বুদ্ধদেব গুহর বইটি পড়া থাকলে দেখবেন লেখার সঙ্গে প্রকৃতি যেন হুবুহু মিলে গিয়েছে। যা আপনাকে আশ্চর্য করবে। এখান থেকে লাল মাটির পথ ধরে চলে যান ব্রাহ্মণকুণ্ডে। সেখানে দাঁড়িয়ে রয়েছে সারিসারি শাল-মহুয়া। এলোমেলো ঘুরে বেড়ালেই মনে হবে স্বর্গরাজ্যের দুয়ার।যাঁরা অফবিট ভ্রমণ ভালোবাসেন, বাংরিপোসি তাঁদের জন্য আদর্শ জায়গা।
একদম শেষে গেলাম ডোকরা শিল্পের জন্য বিখ্যাত ডোকরা গ্রামে। ডোকরা গ্রাম থেকে বারিপদা শহর ঘুরে ফিরতে লাগলাম নিজেদের শহরের অভিমুখে। শেষবারের মতো দেখে নিলাম বাংরিপোসিকে। একরাশ ভাললাগা আর সবুজের গন্ধমাখা স্মৃতি, আর সঙ্গে একটুখানি মনখারাপ নিয়ে ছাড়লাম বাংরিপোসি।এবার ফেরার পালা।
উড়িষ্যা অতিক্রম করে সুবর্ণরেখা নদীর ব্রীজে আসলাম। সেতু থেকে সূর্যাস্ত দেখলাম মনে হলো যেন শিল্পির আঁকা ছবি। পাশে ঝিল্লি - হাতিবাড়ি পক্ষীপ্রেমিক মানুষের কাছে জনপ্রিয় জায়গা। এখানে স্বপ্ল বিরতি। বিরসা সেতু অতিক্রম করে আমরা এই মুহূর্তে পশ্চিমবঙ্গের ঝাড়গ্রামে প্রবেশ করতে চলেছি। সুবর্ণরেখা নদী এক এক জায়গায় এক এক রূপে আমাদের যাত্রাপথে পড়ল। নানান জায়গায় ঘুরে এখন শিলদার পথে। দুদিন ধরে তিন রাজ্যে মোটামুটি ৭৫০কিমি ঘুরলাম। খরচ খুব বেশি নয়। উড়িষ্যার সীমান্ত অতিক্রম করে গোপীবল্লভপুর হয়ে ঝাড়গ্রামে পৌঁছানোর পর গৃধনী হয়ে বেলপাহাড়ির দিকে এগিয়ে চলেছি। অরণ্যকন্যা ঝাড়গ্রামের সৌন্দর্য অতুনীয়।
সৌন্দর্যের লীলাভূমি ও অমরাবতী ঝাড়গ্রাম। ঝিটকার জঙ্গল একসময়ে মাওবাদীদের ডেরা ছিল। আজ তা শুধুই অতীতের কথকতা ।গাড়ি চলছে ধীরে ধীরে। চলার পথে প্রকৃতি পালটে যাচ্ছে। একটু শিহরণ জাগছে। নানান ধরণের গাছে ভরা অরণ্য। সূর্য বলছে পূর্ব থেকে পশ্চিমে।ক্রমশ ঘন হচ্ছে জঙ্গল। যাত্রাপথের চারপাশে জমাট বেঁধে আছে অস্বাভাবিক নীরবতা। এ-যেন আমার পৃথিবী নয়, এখানে আমরা অনুপ্রবেশকারী। এবার ফেরার পালা। এখান থেকে আমাদের শহর খাতড়ার দূরত্ব মাত্র ৮০কিমি। দিনান্তের ম্লান আলোয় উঁচু পাহাড়গুলোর মাথা গেরুয়ারঙে মৌন, তপস্বীর মতো সমাহিত। আমরা তখন ফেরার পথে, হঠাৎ কানে ভেসে আসে সাঁওতালি মেঠোসুর। মাদলের চাপা আওয়াজ দ্রিমি দ্রিমী। সে সুর কেমন যেন মাতাল করা। চেয়ে দেখি দূর পাহাড়ের গায়ে গাছের ফাঁকে ফাঁকে আল পথ বেয়ে চলেছে একদল সাঁওতালি পুরুষ আর রমনী। মেয়েদের মাথায় গোঁজা বনফুল,নাকে নোলক পায়ে মল সহ ঘুঙুর। মাথায় জঙ্গলের ডালপালার বোঝা। দলের শেষে সাঁওতাল যুবকদের হাতে মাদল। যেন অবশ করা ঘুম পাড়ানি বোল। সবকিছু দেখে মনে হলো ঘুঙুর আর মলের শব্দে ঢাকার চেষ্টা করছে অভাব আর জীবনের অপ্রাপ্তির ক্ষত। গাড়ি চলছে দুরন্ত গতিতে। ঝিলিমিলি -বাঁশপাহাড়ী অতিক্রম করে রানীবাঁধের ১২মাইল পেরিয়ে চলেছি। ঝিলিমিলি আর রানীবাঁধের পাহাড়ের পিছনে লাল রঙের পূর্ণিমার চাঁদ চুপিসারে উঠেছে, সবুজ অন্ধকারে। আমরা প্রায় বাড়ির কাছাকাছি চলে এসেছি। তিন দিনের প্রাপ্তির স্মৃতি রোমন্থন করতে করতে বিভিন্ন জনপদভূমি অতিক্রম করছি।মন ভারাক্রান্ত। আবার সেই কেজো জীবনে প্রত্যাবর্তন। ঘড়িতে তখন রাত এগারোটা বেজে গেছে। মন জুড়ে একটা মুগ্ধতা ও বিষন্নতা। রাতবাড়ে, পাহাড়, জঙ্গল আর নদীর গান শেষ হয় না। আকাশ ভরা তারায় তারায় শেষ হলো জঙ্গল জীবনের বর্ণময় এক ভ্রমণের কাহিনী
কোথায় থাকবেন ও খাবেন: কলকাতা থেকে মাত্র ২৩০ কিলোমিটার দূরে দু’দিনের জন্য ঘুরে আসা যায় অল্প খরচেই। হাওড়া থেকে ট্রেনে বারিংপোসি স্টেশন। নিজস্ব গাড়ি ও ধর্মতলা থেকে বাসে যাওয়া যায়। বাংরিপোসিতে রয়েছে শিমলিপাল রিসর্ট। এসি, নন এসি দু’ধরনের রুম মিলবে। সুস্বাদু বাঙালি খাবার পাওয়া যায়। আবার বাজার করে নিজের মতো রান্না করার সুব্যবস্থ্যাও রয়েছে। শিমলিপাল রিসর্টের ফোন নম্বর: ৯৪৩৭৬১২৭৪৭।এছাড়া ঠাকুরানী পাহাড়ের দিকে যেতে পড়বে দিলখুস ধাবা। এই হোটেলের মাছভাত বাঙালি পর্যটকের কাছে খুবই প্রিয়। বাংরিপোসি বাজারে রয়েছে সন্তোষ হোটেল। সেখানেও ভালো খাবার।
লেখক: শিক্ষক, খাতড়া হাইস্কুল, বাঁকুড়া।


