বাঘমুন্ডির পুঁথি দাদু যেন চলমান এনসাইক্লোপিডিয়া

বাঘমুন্ডির পুঁথি দাদু যেন চলমান এনসাইক্লোপিডিয়া
আশিস বন্দ্যোপাধ্যায়, পুরুলিয়া
পুঁথি দাদু!
কতটা পথ হাঁটলে একজন মানুষকে এই নামে চেনেন মানুষ। হারিয়ে যায় তাঁর নাম? তা বাঘমুন্ডি না গেলে বোঝা যাবে না।
জঙ্গলমহল পুরুলিয়া জেলার বাঘমুন্ডি। বাঘমুন্ডির বুড়দা গ্রামের বাসিন্দা গুরুচরণ গড়াই। ৭৭ বছর বয়সী এই বৃদ্ধটির নামই এখন মানুষ ভুলে গিয়েছেন। গ্রামে গিয়ে ওই নাম বললে কেউ তাঁর বাড়ি দেখাতে পারবেন কিনা সন্দেহ। কিন্তু পুঁথি দাদু বললেই কেল্লা ফতে। এক লহমায় সকলেই বাড়িটি চিনিয়ে দেবেন।
কিভাবে তিনি পুঁথি দাদু হলেন? জানতে ইচ্ছে করতে তো? না, প্রথাগত পড়াশোনার পথে তিনি এগোতে পারেননি। ফলে তাঁর ঝুলিতে নেই ডিগ্রি। অথচ, অবলীলায় কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়ুয়াদের সমস্যার সমাধান করেছেন৷ তাঁকে চলমান এনসাইক্লোপিডিয়াও বলে থাকেন অনেকে৷ অনেকে আবার বইপাগলও বলে থাকেন৷ বলবেন না-ই বা কেন? সাহিত্য থেকে ব্যাকরণ, দর্শন থেকে সাধারণ জ্ঞান - সব ব্যাপারেই তিনি যে মুশকিল আসান।
গুরুচরণবাবু পেশায় কৃষক। এহেন মানুষটির পড়াশোনা কিন্তু সপ্তম শ্রেণি অবধি৷ অথচ, এম এ ক্লাসের ছাত্রছাত্রীদেরও অনায়াস দক্ষতায় সাহায্য করেন। আর তা দেখলে কে বলবে প্রথাগত ডিগ্রি নেই এই ব্যক্তির? আসলে নিজের মনের তাগিদেই পড়াশোনা করে যান তিনি। আর সেই জ্ঞান থেকেই অবলীলায় অন্যদের সমস্যার সমাধান করেন। নিজের উদ্যোগেই গড়ে তুলেছেন ‘চৈতন্য গ্রন্থাগার’৷ বইয়ের সংখ্যা এক হাজারেরও বেশি৷ সেখানে গেলেই বই পড়তে পাওয়া যায় সম্পূর্ণ বিনা মূল্যে৷ পড়াশোনায় সাহায্যের জন্য পুঁথিদাদু সবসময় প্রস্তুত৷ কোন বইয়ের কোন পাতায় কী লেখা রয়েছে, সবই নখদর্পণে তাঁর৷ টিউশনের পয়সা পুরোটাই প্রায় খরচ হয়ে যায় গ্রন্থাগারের পিছনে৷
নিজেই জানালেন ছোটবেলার কথা৷ মাত্র ১১ বছর বয়সে বাবা মারা গিয়েছিলেন৷ সংগ্রামের সেই শুরু৷ কিন্তু ভাটা পড়েনি বইপ্রীতিতে৷ অভাবে স্কুল যাওয়া বন্ধ। চেয়েচিন্তে বই আনতেন গুরুচরণ৷ মা ফুটিবালা নিরক্ষর হলেও বইয়ের কদর জানতেন৷ হতদরিদ্র পরিবারে ধান বিক্রির টাকায় কেনা হত বই৷ স্কুলে যাওয়া বন্ধ হওয়ার বছর তিনেক পর ১৯৫৩ সালে নিজের বাড়িতে গ্রন্থাগার গড়ে তোলেন গুরুচরণ৷ নাম দেন চৈতন্য গ্রন্থাগার৷ চাষের কাজের পাশাপাশি চলতে থাকে বই সংগ্রহের কাজ৷ সেই সঙ্গে পড়াশোনা৷ একটু স্বাচ্ছন্দ্যের আশায় ছাত্রছাত্রীদের পড়াতে শুরু করেন৷ লোকমুখে খ্যাতি ছড়িয়ে পড়তে বেশি সময় লাগেনি৷ এখানেই শেষ নয়, লেখালেখিও করেন গুরুচরণ৷ ‘কোরক’ নামে একটি কাব্যগ্রন্থও প্রকাশিত হয়েছে তাঁর৷ গুরুচরণের দুই ছেলেও চাষবাস করেই সংসার চালান৷ সংসারে টানাটানি থাকলে কি হবে, বাবাকে উত্সাহ জোগান তাঁরা৷ পুঁথিদাদুর বড় ছেলে শিবরাম গড়াই জানালেন, যতই দারিদ্র থাকুক, বাবাকে বাধা দেওয়ার কোনও প্রশ্নই নেই৷ একমুখ খোঁচা খোঁচা দাঁড়ি৷ পরনে আধময়লা সাদা ধুতি৷ নিতান্তই সাধারণ চেহারার মানুষটা যে এমন অসাধারণ সাধনায় মেতে রয়েছেন, তা নিয়ে গর্বিত প্রতিবেশীরাও৷ বুড়দা গ্রামের বাসিন্দা প্রাক্তন বিধায়ক তথা ফরওয়ার্ড ব্লকের রাজ্য কমিটির সদস্য নিশিকান্ত মেহেতা বলেন, ‘পুঁথিদাদু ও তাঁর লাইব্রেরি না থাকলে এলাকায় এত দ্রুত শিক্ষার প্রসার ঘটত না৷ এখানে এমন কেউ নেই, যিনি পড়াশোনায় পুঁথিদাদুর সাহায্য নেননি৷

