ঔরঙ্গজেব থেকে রানী ভিক্টোরিয়া- দুই বাংলার শীতলপাটির ঐতিহ্য ও ইতিহাস

ঔরঙ্গজেব থেকে রানী ভিক্টোরিয়া- দুই বাংলার শীতলপাটির ঐতিহ্য ও ইতিহাস
25 Nov 2022, 10:25 AM

ঔরঙ্গজেব থেকে রানী ভিক্টোরিয়া- দুই বাংলার শীতলপাটির ঐতিহ্য ও ইতিহাস

ডঃ সুবীর মণ্ডল

 

শীতলপাটি মেঝেতে পাতা আসন। এটি  পশ্চিমবঙ্গ ও বাংলাদেশের একটি ঐতিহ্যগত কুটির শিল্প। মুর্তা বা পাটি বেত বা মোস্তাক (বৈজ্ঞানিক নাম: Schumannianthus dichotomus) নামক গুল্মজাতীয় উদ্ভিদের ছাল থেকে এগুলো তৈরি হয়ে থাকে। হস্তশিল্প হিসাবে এগুলোর যথেষ্ট কদর রয়েছে। শহরে শো-পিস এবং গ্রামে এটি মাদুর ও চাদরের পরিবর্তে ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত হয়। সাজসজ্জা দ্বারা সজ্জিত মাদুরকে নকশি পাটিও শীতলপাটি বলে।  শীতলপাটির এক বর্ণময়  ইতিহাস লুকিয়ে আছে দুই বাংলার বাঙালির অতীত ইতিহাসে। ইতিহাস এই-রকম---

ঔরঙ্গজেব তখন দিল্লির মসনদে। তাঁর সাক্ষাৎপ্রার্থী দিল্লি যাবেন সুবে বাংলার (অবিভক্ত বাংলা) নবাব মুর্শিদকুলি খাঁ। জরুরি প্রয়োজন, কিন্তু এক বিশেষ কারণে কেবলই পিছিয়ে যাচ্ছে তাঁর যাত্রার দিন। আসলে সম্রাটের সঙ্গে দেখা করতে গেলে উপঢৌকন নিয়ে যাওয়াই প্রথা। কিন্তু নবাব শুনেছেন ধর্মপ্রাণ ঔরঙ্গজেব দিল্লিশ্বর হয়েও সাধারণ জীবনযাপন করেন। তাঁর জীবনে বিলাসিতার স্থান নেই। এ হেন সম্রাটের উপযুক্ত উপহার হিসেবে মুর্শিদকুলি খাঁ অনেক ভাবনাচিন্তা করে শেষপর্যন্ত নিয়ে গিয়েছিলেন রূপালি বেতের শীতলপাটি। কথিত আছে উপহার এতই পছন্দ হয়েছিল সম্রাটের যে তিনি নাকি আমৃত্যু শীতলপাটি পেতেই নমাজ পড়তেন।

মোঘল সম্রাট থেকে রানী ভিক্টোরিয়া, শীতলপাটির প্রেমে পড়া ব্যক্তিত্বের তালিকা দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর। গরমের প্রাণান্তকর দুপুরে মেঝের উপর কিংবা দুঃসহ রাতে বিছানায় শীতলপাটি বিছিয়ে নিশ্ছিদ্র নিদ্রার অভ্যাস গ্রীষ্মপ্রধান অঞ্চলের বাসিন্দাদের বহুকালের। গ্রামের মাটিলেপা দাওয়ায় ঘুমের বিছানার উপকরণ ছিল ওই শীতলপাটি কিংবা কাঠির মাদুর। ছেলেভুলানো ছড়ায় ঘুমপাড়ানি মাসিপিসিকে “শীতলপাটি পেড়ে দেব” এই শর্তেই ডাকা হতো।

আটের দশক অবধি গরমের দুপুরে শীতলপাটি পেতে হাতপাখা ঘুরিয়ে হাওয়া খেতে খেতে গরমের দুপুর পার করে দিতেন শহর-গ্রামের মানুষ। তার পর দ্রুত বদলে যেতে লাগল জীবনযাপনের অভ্যাস। পাটি বা মাদুরের জায়গায় বাজারে এসে গেল  রঙিন শতরঞ্চি, চাদর, বেডকভার। ছাপোষা গৃহস্থের ঘরেও তক্তপোশ সরিয়ে জায়গা করে নিল খাট, ডিভান, সোফা কাম বেড। শীতলপাটির দিন ফুরালো। বাংলাদেশের লোকায়ত মানুষের শিল্পে নেমে  এলো অন্ধকার।

সত্তরের দশক থেকেই শীতলপাটির ব্যবসা শুরু হয়। কিছুটা বাণিজ্যক সাফল্যের মুখ দেখে শিল্পী ও ব্যবসায়ীরা।     তখন ১০ থেকে ১৫ টাকার মধ্যে শীতলপাটি মিলত। চৈত্র থেকে ভাদ্র মাসের মধ্যে কয়েকশো পাটি বিক্রি হত। কোচবিহার, দুই মেদিনীপুর এবং চব্বিশ পরগনা ছিল শীতলপাটি আঁতুড়ঘর। এছাড়া অসম, কোচবিহার ও মেদিনীপুর থেকে আসত পাটি। বাংলাদেশ থেকে আসা শীতলপাটির দাম ছিল আকাশছোঁয়া। এখনও গ্রামের মানুষ পাটি ব্যবহার করেন। কিন্তু বর্তমানে দুই দেশের বিভিন্ন শহরে পাটি বিভিন্ন পুজোর মণ্ডপ সাজানোর উপকরণ হয়ে উঠেছে।

মুর্শিদাবাদের বেলুল গ্রামের সুরবান বিবি, নুরবানু বিবিরা শীতলপাটির কথাশিল্পী, বংশ পরম্পরায় এই ধরনের শিল্পকে ভালোবেসে যুক্ত আছেন। গোটা গ্রামের সব ঘরেই মহিলারা পাটি তৈরি করেন। কিন্তু তাঁদের হাতে তৈরি তাল কিংবা খেজুর পাটির ক্রেতা এখন গ্রামের মানুষ। পাঁচ বাই সাতের একটা পাটি সাড়ে চারশো থেকে পাঁচশো টাকার মধ্যে বিকোয়। পাটির উপর সুতোর বাহারি নকশা এখন  কদর কমে গেছে তাই আর বুনতে পারে না। হাজার টাকা থেকে দাম শুরু। সমস্ত শিল্পীদের একটাই বক্তব্য “বুনতেই পারি কিন্তু কিনবে কে?”

অথচ একসময় অতিথি আপ্যায়ন থেকে বিয়ের আসর, নকশাদার শীতলপাটি নিয়ে ছড়ার শেষ নেই। ‘কুটুম এলো, কুটুম এলো, ঝেড়ে ধুলো-মাটি। দাও বিছিয়ে চিকন বেতে তৈরি শীতলপাটি।’ পাত্রপক্ষের কাছে মেয়ের গুণকীর্তন করতে গিয়ে বলা হচ্ছে ‘মাছ বানাইতো কন্যা, লয় ছালি-মাটি। ইলিশ বানাতো কন্যা, বিছায় শীতলপাটি’।  বর্তমানে বাজারে  ১০০ টাকায় প্ল্যাস্টিকের মাদুর মেলে। শিল্পীদের এক কথা--"পাটির কদর করবে কে?” ডিজিটাল যুগে   ঠান্ডা-যুদ্ধে এসি-র সঙ্গে শীতলপাটির পেরে ওঠা মুশকিল বলেই মনে হয় আমার।

গ্রীষ্মের প্রচন্ড দাবদাহের হাত থেকে বাঁচতে বা ঘরের মেঝে, হোক কি দাওয়ায় বসার জন‍্য প্রাচীন কাল থেকেই পাটির ব‍্যবহার বাংলার ঘরে ঘরেই প্রচলিত, গরমের সময় শীতলতা প্রদান করে বলেই এর নাম শীতল পাটি। এপার বাংলায় কোচবিহার, দুই মেদিনীপুর, চব্বিশ পরগনা, হাওড়ায় এই লোকজ শিল্পের আধিক্য লক্ষ্য করা যায়। তবে এদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি অগ্রাধিকার ভিত্তিতে কোচবিহার জেলা অনেকটা এগিয়েছে। কোচবিহার জেলাকে   বলা হয় এপার বাংলার শীতলপাটির আঁতুড়ঘর। সময় অনেক বদলে গেলেও উত্তরবঙ্গের কোচবিহার জেলার শীতলপাটির চাহিদা কিন্তু আজও কমেনি। বরং সময়ের পরিবর্তনের সাথেই এসেছে চাহিদার তাগিদে শিল্পকর্মের অভিনবত্ব। পাটির সঙ্গে তৈরি হচ্ছে সেই বেত পাটি দিয়ে ব্যাগ, জুতো, ফাইল, টুপি সহ ঘর সাজানোর অনেক উপকরণ। তাই একসময় হারিয়ে যেতে থাকলেও কোচবিহার জেলার শীতলপাটি শিল্প আবার ঘুরে দাঁড়াচ্ছে।

 

এই কুটির শিল্পের প্রধান কাঁচামাল হল বেতগাছ। আর কোচবিহারের পরিবেশে সেই বেতগাছ ভালো তৈরি হয়।  দুই মেদিনীপুর এবং চব্বিশ পরগনায় ছিল এই গাছের আধিক্য। বর্তমানে কিছুটা কম। এই গাছের ওপর থেকে যে ছাল বের হয় তা দিয়ে নানান কারুকাজ হয়। প্রথমে জমি থেকে বেত কাটা হয়। তারপর তা হালকা শুকিয়ে নিতে হয়। এরপর তা চিরে নিতে হয়। চিরে নেওয়া কিছু বেত আবার সিদ্ধ করা হয়। তাকে বলে সিদ্ধ পাটি। এভাবে পাঁচ থেকে ছয় রকম পাটি তৈরি করা যায়। সাধারণ মোটা পাটি। একটি পাটি আছে সরু, তাকে বলে ভূষণাই। এই পাটি আবার বিভিন্ন রং করে নানান কারুকার্যের মাধ্যমে কম্বল পোষপাটি তৈরি হয়। বিভিন্ন আকৃতির ওপরও নির্ভর করে পাটির বৈচিত্র্য। গরমের সময় তা বিছানায় বা মেঝেতে ব্যবহার করা যায়। শুধু কোচবিহার জেলাতেই একশ কোটি টাকার ওপর ব্যবসা হয় পাটির। এর মধ্যে নতুন নতুন সৃজন আসায় এর চাহিদা বাড়ছে।

কোচবিহার জেলার কোচবিহার ১ ও ২ নম্বর ব্লক ঘুঘুমারী অঞ্চল, তুফানগঞ্জ ১ ও ২, মাথাভাঙ্গার কিছু অংশ ও দিনহাটা ২ নম্বর ব্লকে অনেক মানুষ এই শীতলপাটির কাজ করে জীবিকা নির্বাহ করেন। আর কোচবিহারের ধলুয়াবাড়ি হল পাটি শিল্পীদের পীঠস্থান। সেখানে প্রায় সবাই এই পাটি নিয়ে পড়ে থাকেন। গোটা জেলায় ত্রিশ হাজারেরও বেশি শিল্পী এই পাটি শিল্পের সঙ্গে যুক্ত। দুই মেদিনীপুর এবং চব্বিশ পরগনা জেলার বহু মানুষ এই শিল্পের সঙ্গে  জড়িত। মেদিনীপুরের সবং, কোলাঘাট, ডেবরা, নাচিন্দা, নন্দীগ্রাম, চব্বিশ পরগনার ক্যানিং, বাসন্তী, কাকদ্বীপ, বনগাঁ, বারুইপুর, নদীয়া, বর্ধমান, হুগলি সহ সমগ্র সুন্দরবন জুড়ে এই শিল্পের বিস্তার। 

 মূলত পূর্ববঙ্গ থেকে আসা লোকজন দুই চব্বিশ পরগনা ও কোচবিহার জেলায় এই পাটি নিয়ে কাজ শুরু করেন। পরে এর জনপ্রিয়তা বৃদ্ধি পেতে থাকে। এখন রাজবংশীরা ছাড়াও আরও অনেকে এর সঙ্গে যুক্ত।

বর্তমানে ক্ষুদ্র, মাঝারি ও কুটির শিল্প দফতরের উদ্যোগে এই শিল্পের উন্নয়নে কিছুটা একটা জোয়ার এসেছে।  এই শিল্পের সঙ্গে জড়িত অনেক কারিগর তাদের শিল্পকর্মের জন্য ঋণ পাচ্ছেন ব্যাঙ্ক থেকে। সরাসরি যাতে বিক্রি করা যায়, সেই ব্যাবস্থাও হয়েছে। আর এমন ঘটনাকেই দরাজ স্বীকৃতি দিয়েছে আন্তর্জাতিক সংস্থা ইউনেস্কো।

কোচবিহারে সংগ্রহশালা তৈরি হয়েছে সরকারি উদ্যোগে। সংগ্রহশালাতে তুলে ধরা হয়েছে বিভিন্ন ধরনের শীতলপাটি। এই শীতলপাটিকে কেন্দ্র করে পর্যটকদের আনাগোনাও বাড়ছে।এছাড়াও পশ্চিমবঙ্গের ও ভারতের অনান‍্য রাজ‍্য, তথা ভারতের বাইরে বিদেশের মাটিতে আয়োজিত বিভিন্ন হস্তশিল্প মেলায়, এখানকার শিল্পীদের তৈরি বিভিন্ন জিনিস স্থান পাচ্ছে। বিকিকিনির মাধ্যমে তার প্রসার ঘটছে ও আর্থিকভাবে স্বচ্ছল হচ্ছে এখানকার শিল্পীরা‌

 

কিন্তু বর্তমানে বিশ্বে ঘটে যাওয়া ভয়াবহ মহামারীর ফলে পরপর দুই বছর বাজার ভালো যায়নি। এই শিল্পসংস্কৃতিকে নতুন ভাবে বাঁচতে কৃষ্টিনীড়ের প্রচেষ্টাকে সাধুবাদ জানাতেই হয়। আর কৃষ্টিনীড়ের মাধ‍্যমে কোচবিহারের শীতলপাটির কথা আরো বেশি করে মানুষের আপন হয়ে উঠুক এইটুকু আশা রাখা যেতেই পারে। অতীত ইতিহাসের দিকে তাকিয়ে দেখলে লক্ষ্য করা যায় যে গরমে ঠাণ্ডা অনুভব পাওয়ার জন্য এক সময় ঘরে ঘরে একপাশে লাল কাপড় লাগানো শীতলপাটির ব্যবহার ছিল চোখে পড়ার মতো।আজ সব অতীতের কথকতা মাত্র। আমাদের শৈশবের স্মৃতিতে শীতল পাটি আজো অমলিন।

 

আগের মতো না হলেও শীতলপাটির ব্যবহার এখনও এপার-- ওপার বাংলার  বিভিন্ন জেলায়  আছে। আমাদের ঐতিহ্যের অন্যতম শীতলপাটির শিল্প, শীতলপাটির গ্রাম ও পাটি-শিল্পী- যাদের বলা হয় পাটিকর, তারা বাংলাদেশের ঝালকাঠি গ্রাম জুড়ে আজও বসবাস করে এবং আপন মনের মাধুরী মিশিয়ে শীতলপাটি তৈরি করে চলেছেন। বাংলাদেশের শীতলপাটি আজ জগৎবিখ্যাত। ইউনেস্কোর স্বীকৃতি লাভে সক্ষম হয়েছে। সমগ্র  বাংলাদেশের সিলেটের শীতলপাটি গুণগত মানে বাংলাদেশের মধ্যে শ্রেষ্ঠ। ১৯৫৩ খ্রি.) কর্তৃক বিরচিত এবং ১৯২০-এর দশকে প্রকাশিত “শ্রীহট্টের ইতিবৃত্ত” নামীয় বিশালকার গ্রন্থের প্রথম খণ্ডের ৪র্থ অধ্যায়ে শীতল পাটি সম্পর্কে নিম্নরূপ বর্ণনা পাওয়া যায়: “... এই শিল্পের মধ্যে শীতল পাটি সর্বপ্রধান ও বিশেষ বিখ্যাত। মূর্ত্তা নামক এক জাতীয় গুল্মের বেত্র দ্বারা ইহা প্রস্তুত হয়। ইহা শীতল, মসৃণ ও আরামজনক বলিয়া সর্বত্র আদৃত। বঙ্গদেশের অন্য কোথায়ও এইরূপ উৎকৃষ্ট পাটি প্রস্তুত হইতে পারে না। পাটির বেত্র রঞ্জিত ক্রমে পাশা, দাবা প্রভৃতি বিবিধ খেলার ছক ইত্যাদি চিত্রিত করা হয়। পাটির মূল্য গুণানুসারে ১০ আনা হইতে ১০ টাকা পর্যন্ত হইতে পারে। বেত্র যত চিকণ হয়, মূল্য ততই বর্ধিত হয়। পূর্বে নবাবের আমলে ২০-২৫ টাকা হইতে ৮০-৯০ টাকা, এমন কি শত দ্বিশত টাকা পর্যন্ত মূল্যের পাটি প্রস্তুত হইত বলিয়াও শুনা যায়। ২০-২১ হাত দীর্ঘ পাটিকে ‘সফ’ বলিয়া থাকে। ইট ও চোঁয়ালিশ পরগণাতেই সর্ব্বোৎকৃষ্ট শীতল পাটি প্রস্তুত হয়। পাটি প্রস্তুতকারকগণ ‘পাটিয়ারা দাস’ নামে খ্যাত। ১৮৭৬-৭৭ খৃষ্টাব্দে শ্রীহট্ট হইতে ৩৯২৭ টাকা মূল্যের পাটি রপ্তানি হইয়াছিল। নাম “মুর্তা”। স্থানভেদে একে ‘মুসতাক’, ‘পাটিবেত’ ইত্যাদি নামেও অভিহিত করা হয়। উদ্ভিদটির বৈজ্ঞানিক নাম Schumannianthus dichotomus।

মুর্তা গাছ দেখতে সরু বাঁশের মতো; জন্মে ঝোপ আকারে। গোড়া থেকে কেটে জলে ভিজিয়ে রাখা হয় মুর্তার কাণ্ড। দা দিয়ে চেঁছে পাতা ও ডাল-পালা ফেলে দেয়া হয়, দূর করা হয় ময়লা। এরপর মাটিতে মাছকাটার বটি ফেলে মুর্তার কাণ্ডটিকে চিড়ে লম্বালম্বি কমপক্ষে চারটি ফালি বের করা হয়। কাণ্ডের ভেতর ভাগে সাদা নরম অংশকে বলে ‘বুকা’। এই বুকা চেঁছে ফেলে দেয়া হয়। যে ব্যক্তি পাটি তৈরী ক’রে তাকে বলা হয় ‘পাটিকর’ বা ‘পাটিয়াল’। পাটিকরের লক্ষ্য থাকে মুর্তার ছাল থেকে যতটা সম্ভব সরু ও পাতলা ‘বেতী’ তৈরী করে নেয়া। বেতী যত সরু ও পাতলা হবে পাটি তত নরম ও মসৃণ হবে। এজন্য হাতের নখ দিয়ে ছিলে বুননযোগ্য বেতী আলাদা করা হয়ে থাকে। বেতী তৈরী হওয়ার পর এক-একটি গুচ্ছ বিড়ার আকারে বাঁধা হয়। তারপর সেই বিড়া ঢেকচিতে পানির সঙ্গে ভাতের মাড় এবং আমড়া, জারুল ও গেওলা ইত্যাদি গাছের পাতা মিশিয়ে সিদ্ধ করা হয়। এর ফলে বেতী হয় মোলায়েম, মসৃণ ও চকচকে। রঙ্গীন নকশাদার পাটি তৈরীর জন্য সিদ্ধ করার সময় ভাতের মাড় ইত্যাদির সঙ্গে রঙের গুঁড়া মেশানো হয়। দক্ষ কারিগর একটি মুর্তা থেকে ১২টি পর্যন্ত সরু বেতি তৈরী করতে সক্ষম। ছিলে ছিলে বেতী তৈরীর সময় পাটিকর বুড়ো আঙ্গুল ও মধ্যমায় কাপড় পঁচিয়ে নেয় যাতে বেতীর ধারে আঙ্গুল না ফেঁড়ে যায়। পাটিকর মাটিতে বসে কাপড় বোনার মতই দৈর্ঘ্য-বরাবর এবং প্রস্থ-বরাবর বেতী স্থাপন ক’রে নেয়। পাটি বোনার সময় বেতীগুলোকে ঘন আঁট-সাঁট ক’রে বসানো হয় যাতে ফাঁক-ফোকড় না-থাকে। নকশী পাটির ক্ষেত্রে পাটিকর তার স্মৃতি থেকে বাদামী বা প্রাকৃতিক রঙের বেতীর সঙ্গে রঙ্গীন বেতী মিশিয়ে নকশা ও পাওয়া যায়। ঢাকার নিউমার্কেট, কারওয়ান বাজারে শীতল পাটি কিনতে পাওয়া যায়। এর দাম আকার অনুযায়ী বিভিন্ন হয়। নকশা করা পাটিগুলো দাম বেশি হয়ে থাকে।

বাংলাদেশের বিভিন্ন স্থানে পাটি তৈরী-হয়। কিন্তু সিলেট এলাকায় বিভিন্ন স্থানে যে মানের শীতল পাটি তৈরী হয় তা অসাধারণ। সিলেট অঞ্চলের সুনামগঞ্জ প্রভৃতি এলাকায় পাটিকররা তাদের নিপূণতার জন্য শত শত বৎসর যাবৎ প্রসিদ্ধ। শীতল পাটিতে বসে বা শুয়ে যে আরামপ্রদায়ী শীতল অনুভূতি পাওয়া যায় তা ব্যাখ্যাতীত। আধুনিক নগর জীবনেও বিয়ের অনুষ্ঠানে কনের আসন হিসেবে শীতল পাটির ব্যবহার অব্যাহত আছে। শীতল পাটির খণ্ডাংশ অন্যান্য হস্তশিল্পজাত পণ্য তৈরীতে ব্যবহৃত হয়।পুনরুজ্জীবন করেছে রাজ্য। আর সেই উদ্যোগকে স্বীকৃতি দিয়েছে আন্তর্জাতিক সংস্থা ইউনেস্কো।

 

বর্তমানে ক্ষুদ্র, মাঝারি ও কুটির শিল্প দফতরের উদ্যোগে। এক বছর ধরে এই শিল্পের সঙ্গে জড়িত অন্তত ছয় হাজার কারিগর ঋণ পাচ্ছেন ব্যাঙ্ক থেকে। সরাসরি যাতে বিক্রি করা যায়, সেই ব্যাবস্থাও হয়েছে। আর এমন ঘটনাকেই দরাজ স্বীকৃতি দিয়েছে আন্তর্জাতিক সংস্থা ইউনেস্কোঐতিহ্যশালী কুটিরশিল্প’ হিসেবে স্বীকৃতি দিয়ে দফতরকে জানিয়েছে। বাংলার শীতলপাটিও এখন বিদেশে পাড়ি দিচ্ছে। কারিগররা শীতলপাটি, মাদুর বিক্রি করে আর্থিকভাবে লাভবান।  সরকারের ইতিবাচক  উদ্যোগেই এই জোয়ার এসেছে। শীতলপাটি, মাদুর বা শালপাতার থালা, প্লেট এখন লাভজনক ব্যবসা। এই শিল্পকে স্বীকৃতি জানিয়ে বার্তা পাঠিয়েছে ইউনেস্কো। বস্তুত, বিদেশের বাজারে এই শিল্পকে তুলে ধরতে ব্যাপক সাহায্য করছে ইউনেস্কো।”

কোচবিহারে শীতলপাটির সংগ্রহশালা তৈরি হয়েছে সরকারি উদ্যোগে। সংগ্রহশালাতে তুলে ধরা হয়েছে বিভিন্ন ধরনের শীতলপাটি। এই শীতলপাটিকে কেন্দ্র করে ঘুমানোর জন্য স্বস্তিদায়ক বলে গ্রামে শীতলপাটির কদর যুগ যুগ ধরে। ইদানীং শহুরে মানুষের ঘরেও শোভা পায় শীতলপাটি। তবে বড় সংবাদ হলো, শীতলপাটি এখন বিশ্ব ঐতিহ্যের অংশ।  সাম্প্রতিক  স্বীকৃতি দিয়েছে জাতিসংঘ শিক্ষা, বিজ্ঞান ও সংস্কৃতি সংস্থা (ইউনেসকো)। শীতলপাটির জন্য প্রসিদ্ধ বাংলাদেশের  সিলেট অঞ্চল ও পশ্চিমবঙ্গের কোচবিহার জেলা  । সিলেটের বালাগঞ্জ ও গোয়াইনঘাট উপজেলার শীতলপাটির গ্রাম ।

সিলেটের বালাগঞ্জ উপজেলার কাশীপুর গ্রাম। পাটির জন্য বিখ্যাত বলে পরিচিতি পেয়েছে পাটিপল্লি বলে। গ্রামের পাশ দিয়েই এঁকেবেঁকে চলে গেছে একটা খাল। সেখানেই  শীতলপাটির বুননের আদি  আদর্শ পীঠস্থান  ।

শীতলপাটি নিপুণ হাতের বুননে মুরতা নামে একধরনের ঝোপজাতীয় গাছের বেত দিয়ে তৈরি হয়। গ্রীষ্মকালে শীতল পরশের জন্য বেড়ে যায় শীতলপাটির কদর। পাটির সঙ্গে ‘শীতল’ নামকরণের মাহাত্ম্য এখানেই। এটি সিলেটের ঐতিহ্যবাহী একটি শিল্প। সিলেটের বালাগঞ্জ ও বিয়ানীবাজার উপজেলা মূলত এ শিল্পের আদি স্থান। এর বাইরে সিলেটের গোয়াইনঘাট ও কোম্পানীগঞ্জ উপজেলা ছাড়াও সুনামগঞ্জের জামালগঞ্জ, জগন্নাথপুর; হবিগঞ্জের চুনারুঘাট এবং মৌলভীবাজারের বড়লেখা, রাজনগরসহ সিলেট বিভাগের চার জেলার দুই শতাধিক গ্রামে শীতলপাটি বুননের সঙ্গে কয়েক হাজার  পরিবার যুক্ত রয়েছে। যুগ যুগ ধরেই বংশপরম্পরায় এসব গ্রামের নারী-পুরুষেরা এই কাজ করেন।

শীতলপাটির বৈশিষ্ট্যই হচ্ছে গরমে ঠান্ডা অনুভূত হয়। প্রাকৃতিক উপায়ে তৈরি হওয়ার কারণে এই পাটি একেবারেই স্বাস্থ্যসম্মত। সিলেটের চার জেলা ছাড়াও নোয়াখালী, সিরাজগঞ্জ, পাবনা ও চট্টগ্রামের কিছু এলাকায় শীতলপাটির কারিগরদের দেখা মেলে। তবে                                                                                                                                       দেশের অন্যান্য অঞ্চলে পাটি তৈরি হলেও সিলেটেই বুননশিল্পীদের দেখা বেশি মেলে। এখানে  বুননশিল্পীরা  বংশপরম্পরায় পাটির বুননকৌশল আয়ত্ত করেছেন।                                                                                                                                                                                                                                                                                                         নারীরা বুনছেন শীতলপাটি।

পাটি আছে হরেক রকম শীতলপাটির রয়েছে নানান নাম আর জাত। এর মধ্যে ‘পয়সা’, ‘সিকি’, ‘আধুলি’, ‘টাকা’, ‘নয়নতারা’, ‘আসমান তারা’, ‘শাপলা’, ‘সোনামুড়ি’, ‘টিক্কা’ নামের পাটির ব্যবহার গ্রামের গৃহস্থ পরিবারে বেশি। এ ছাড়া অভিজাত পাটি হিসেবে ‘লালগালিচা’, ‘ধাধুলি’, ‘মিহি’ চাহিদা অনুযায়ী তৈরি করা হয়। বিক্রি হয় ৩০০ থেকে ১০ হাজার টাকায়। ‘সিকি’ পাটি খুবই মসৃণ হয়। কথিত আছে, মসৃণতার কারণে সিকির ওপর দিয়ে সাপ চলাচল করতে পারে না। এসবের বাইরে দৈনন্দিন ব্যবহারের উপযোগী নানা ধরনের পাটি রয়েছে। বুননের মাধ্যমে পাটিতে পৌরাণিক কাহিনিচিত্র, পাখি, ফুল-লতা-পাতা বা অন্যান্য জ্যামিতিক নকশা ও মোটিফ তুলে ধরা হয়। পাটিগুলো সচরাচর ৭ X ৫ ফুট হয়ে থাকে।

 বাংলাদেশের শীতলপাটির হাটের এক পরিচিত দৃশ্য, কারও শরীর চাদর দিয়ে মোড়ানো, কেউবা আবার কেবল শার্ট-লুঙ্গি-মাফলার জড়িয়ে এসেছেন। এটি যে গ্রাম্য একটা হাট, সেটা একনজর দেখলেই বোঝা যায়। সেই হাটে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষের পাশে দাঁড় করে রাখা অসংখ্য মুরতা বেতের শীতলপাটি। সেই পাটির সামনে দাঁড়িয়ে বিক্রেতারা দাম হাঁকছেন আর ক্রেতারা মোড়ানো পাটি খুলে মাটিয়ে বিছিয়ে পরখ করছেন। এখানেই প্রতি শনি ও মঙ্গলবার সকাল ১০টা থেকে বেলা ২টা পর্যন্ত এভাবেই জমে ওঠে শীতলপাটির হাট।

সালুটিকর এলাকার অবস্থান সিলেটের তিনটি উপজেলার মধ্যবর্তী স্থানে। সিলেট সদর, কোম্পানীগঞ্জ ও গোয়াইনঘাট—এ তিন উপজেলার মাঝামাঝি অবস্থানে থাকায় পাটির হাটটি সব সময় জমজমাট থাকে। জেলার অন্যান্য স্থানে শীতলপাটির আরও কিছু হাট থাকলেও সালুটিকরের হাটের কদর সবচেয়ে বেশি। তার কারণ হচ্ছে সিলেটের যেসব উপজেলায় বন বিভাগের মুরতা বেতের বাগান রয়েছে, সেগুলোর বেশির ভাগই গোয়াইনঘাট ও কোম্পানীগঞ্জ উপজেলায় পড়েছে। পাটি তৈরির উপকরণ এখানে বেশি হওয়ায় সালুটিকরে পাটিও মেলে অন্যান্য এলাকার চেয়ে একটু বেশি। সে কারণেই সিলেটজুড়ে এই হাটের এত কদর। ক্রেতা-বিক্রেতারা জানান, বর্ষার পুরোটা সময় ও বর্ষা শেষের দুই মাসই মূলত পাটির হাট বেশি জমজমাট থাকে। প্রতি শনি ও মঙ্গলবার হাট বসে। প্রতি হাটবার গড়ে কয়েক শতাধিক পাটি বিক্রি হয়। পুরো বছর এখানে অন্তত ১৫ হাজার পাটির বেচাকেনা হয়। হাটে আসা নানা জনের সঙ্গে কথা বলে জানা  যায় প্রায় এক শ বছর আগে  থেকেই এই শীতলপাটির হাট বসছে। এখানে আসা অধিকাংশ বিক্রেতার বাড়ির গৃহিণীরা পাটি তৈরি করে থাকেন। , মান, আকার ও কারুকাজের ওপর ভিত্তি করে শীতলপাটির দাম নির্ধারিত হয়। একেকটি পাটি ৮০-১৫০ টাকা (ছোট), ২০০-৫০০ টাকা (মাঝারি) এবং ৫০০-১,২০০ টাকায় (বড়) বিক্রি , এ হাটে পাইকারি ও খুচরা দুভাবেই পাটি বিক্রি হয়। সিলেটের অন্যান্য হাটের চেয়ে এখানে তুলনামূলকভাবে সস্তায় পাটি কিনতে পাওয়া যায়। এ কারণে হাটের দুদিন ক্রেতাদের ভিড়ও থাকে বেশি। প্রতি হাটবারেই সিলেটসহ জেলার বিভিন্ন অঞ্চল থেকে পাটির ক্রেতারা হাজির হন।

সিলেটের সালুটিকর ছাড়াও মৌলভীবাজারের বড়লেখা উপজেলার দাসেরবাজার এলাকায় প্রতি রোববার ও বৃহস্পতিবার শীতলপাটির হাট বসে। একই উপজেলার বাংলাবাজার, হাজীগঞ্জ, দক্ষিণভাগ, শাহবাজপুর ও রাজনগর উপজেলা এবং সুনামগঞ্জের জামালগঞ্জসহ সিলেট বিভাগের চার জেলার অন্তত ৩০টি স্থানে শীতলপাটির হাট বসে। এসব হাট থেকে প্রতিবছর গড়ে অর্ধকোটি টাকার শীতলপাটি দেশ-বিদেশে  বিক্রি হয়।উপহার-উপঢৌকনে শীতলপাটি

সিলেট অঞ্চলে হিন্দু সম্প্রদায়ের বিয়েসহ নানা মাঙ্গলিক অনুষ্ঠানে শীতলপাটির ব্যবহার অনেকটা বাধ্যতামূলক। এই অঞ্চলে বিয়ের অনুষ্ঠানে উপঢৌকন হিসেবে বর-কনেকে পাটি দেওয়ার রেওয়াজ রয়েছে। এখনো গ্রাম এলাকায় কনে ‘নাইওর’ (বাবার বাড়িতে বেড়াতে যাওয়া) থেকে হাতে রঙিন নকশি করা উন্নত মানের পাটি নিয়ে ফেরেন। শহুরে গৃহসজ্জায়ও ব্যবহৃত হয় শীতলপাটি। চাহিদা আছে বিদেশেও। সিলেটের ইতিহাস-ঐতিহ্যের গবেষক মোস্তফা সেলিম জানান, তাঁর নিজ এলাকা মৌলভীবাজারের বড়লেখার দাসের বাজারে উৎপাদিত রুপালি বেতের শীতলপাটি মুর্শিদ কুলি খাঁ সম্রাট আওরঙ্গজেবকে উপহার দিয়েছিলেন। এ ছাড়া বাংলাদেশে আসা ভিনদেশিরা স্মারক হিসেবে সিলেটের শীতলপাটি নিয়ে যান। আদিকাল থেকেই এই প্রথা চলে আসছে। দেশের বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের সমাবেশে আমন্ত্রিত রাজনৈতিক নেতাদের উপহার দেওয়ার ক্ষেত্রে সিলেট অঞ্চলের শীতলপাটি পছন্দের শীর্ষে থাকে। এ ছাড়া নানা সাহিত্য-সংস্কৃতি উৎসব কিংবা ভিনদেশি অতিথিদের উপহার দেওয়ার ক্ষেত্রে শীতলপাটির চাহিদা ব্যাপকভাবে লক্ষণীয়।

বালাগঞ্জ উপজেলা সদরে ২০০৭ সালে থানা কমপ্লেক্সের বাসিন্দা হিমাংশু ধর ‘পাটিঘর’ নামে একটি শীতলপাটির দোকান চালু করেন। তাঁর দেখাদেখি এখন বাজারে দুটি দোকান প্রতিষ্ঠিত হয়।, বালাগঞ্জের শীতলপাটির ঐতিহ্য কয়েক শ বছরের। গত কয়েক দশক আগেও উপজেলায় পাটি তৈরিতে কয়েক শ পরিবার জড়িত ছিল, এখন সেটা কমে ৫০ জনে দাঁড়িয়েছে। তাঁর দোকানে বালাগঞ্জ উপজেলা ছাড়াও পার্শ্ববর্তী মৌলভীবাজারের রাজনগর উপজেলার পাটির বুননশিল্পীদের তৈরি পাটি পাওয়া যায়। ৮০০ থেকে ৬০০০ টাকা মূল্যের পাটি তাঁর দোকানে বিক্রি করা হয়। স্থানীয় চাহিদা মিটিয়ে তিনি অর্ডার অনুযায়ী দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে কুরিয়ারের মাধ্যমে পাটি পাঠিয়ে থাকেন। তবে মুরতা চাষ কমে যাওয়া এবং প্রয়োজনীয় পৃষ্ঠপোষকতার অভাবে বুননশিল্পীরা পেশা বদলাচ্ছেন বলে জানিয়েছেন।

বালাগঞ্জ উপজেলার সাহিত্যকর্মী ইমন শাহ ‘শীতলপাটি’ নামে একটি ছোট কাগজ দীর্ঘ দুই বছর ধরে সম্পাদনা করে আসছেন। , এ পর্যন্ত তাঁর কাগজের ১৪টি সংখ্যা বেরিয়েছে। সব কটি সংখ্যাতেই লেখার সঙ্গে বালাগঞ্জের ঐতিহ্যবাহী শীতলপাটির নকশা ব্যবহার করার কারণে বিষয়টি দেশ-বিদেশে প্রশংসিত হয়েছে। এখন শীতলপাটি বিশ্ব ঐতিহ্য হিসেবে স্থান করে নেওয়ায় তাঁর ভালো লাগছে।

২০ হাজার পাটি বুনেছেন চাম্পা বেগম। শীতলপাটিশিল্পীদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য একজন ষাটোর্ধ্ব গুণী শিল্পী  চাম্পা বেগম। জেলার বালাগঞ্জ উপজেলার কাশীপুর গ্রামে তাঁর বাড়ি। ৩০ বছর ধরে তিনি পাটি বোনেন। তাঁর নিপুণ হাতে এ পর্যন্ত অন্তত তৈরি ২০ হাজার। সাত ছেলের ছয় জনকেই বিয়ে করিয়েছেন। হাতে-কলমে ছেলে-বউদেরও বুনন শিখিয়েছেন। চাম্পা বেগম আক্ষেপ করে বললেন, ‘পাটি বুনতে এখন ম্যালা টেকা লাগে। একটা পাটিতে লাভও বেশি হয় না। অনেকে পুঁজির অভাবে পাটি বানানোর কাম ছাড়ি দিতাছে।’প্রান্তিক শিল্পীদের স্বীকৃতি,অত্যন্ত আনন্দের বিষয়। বেশ কিছু দিন আগে দক্ষিণ কোরিয়ার জেজু দ্বীপে বসেছিল অমূল্য সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য রক্ষায় ইউনেসকোর আন্তসরকার কমিটির (ইন্টারগভর্নমেন্টাল কমিটি ফর দ্য সেফগার্ডিং অব দ্য ইনটেনজিবল কালচারাল হেরিটেজ) ১২তম অধিবেশন। ৪ থেকে ৯ ডিসেম্বরের সে অধিবেশনে গুরুত্বপূর্ণ সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য রক্ষার নানা বিষয় নিয়ে আলোচনা হয়।

অধিবেশন থেকে বাংলাদেশের জন্য খুশির বার্তা আসে ৬ ডিসেম্বর। সারা বিশ্বের গুরুত্বপূর্ণ নির্বস্তুক সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের তালিকায় সিলেটের শীতলপাটিকে অন্তর্ভুক্ত করে জাতিসংঘের শিক্ষা, বিজ্ঞান ও সংস্কৃতি বিষয়ক সংস্থা ইউনেসকো। ইউনেসকোর ওয়েবসাইটে ইনটেনজিবল কালচারাল হেরিটেজের (আইসিএইচ) পাতায় বলা হয়েছে, চলতি বছরের অধিবেশনে আর্জেন্ট সেফগার্ডিং বা জরুরি সুরক্ষা, রিপ্রেজেনটেটিভ সেফগার্ডিং বা প্রতিনিধিত্বমূলক সুরক্ষা ও রেজিস্ট্রার অব গুড সেফগার্ডিং প্র্যাকটিসেস বা ভালো সুরক্ষা অনুশীলনের জন্য নিবন্ধন তালিকায় শীতলপাটিসহ বিভিন্ন দেশের ৪২টি ঐতিহ্যকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়। আইসিএইচের এই তিনটি বিভাগে এখন পর্যন্ত বিশ্বের ১১৭টি দেশের ৪৭০টি ঐতিহ্যবাহী উপাদান জায়গা পেয়েছে। যার মধ্যে বাংলাদেশ থেকে আছে জামদানি, বাউলগান ও মঙ্গল শোভাযাত্রা। পশ্চিমবঙ্গ ভারত থেকে শীতলপাটি, মাদুর, বালুচরি, ডোকরা,পাঁচমুড়ার টেরাকোটা।

শীতলপাটিকে এই স্বীকৃতির তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করতে উদ্যোগটা নিয়েছিল বাংলাদেশ জাতীয় জাদুঘর। প্রতিষ্ঠানটির ওয়েবসাইটে বলা হয়েছে, ২০১৬ সালে বাংলাদেশ জাতীয় জাদুঘর সংস্কৃতিবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সহায়তায় সিলেটের ঐতিহ্যবাহী শীতলপাটিকে ইউনেসকোর অমূল্য সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য রক্ষায় ইউনেসকোর আন্তসরকার কমিটির কাছে প্রস্তাব উত্থাপন করে। এরপর কয়েক ধাপে যাচাই-বাছাই করে ইউনেসকো। এরপরই ঠাঁই মিলল তালিকায়।

জাতীয় জাদুঘরের সচিব শওকত নবীর নেতৃত্বে সম্মেলনে বাংলাদেশ থেকে যোগ দেয় সাত সদস্যের প্রতিনিধিদল। আনুষ্ঠানিক ঘোষণার পর তাঁরা মঞ্চে একটি শীতলপাটি প্রদর্শন করেন।

বাংলাদেশ জাতীয় জাদুঘরের বোর্ড অব ট্রাস্টিজের সভাপতি ও চিত্রশিল্পী হাশেম খান বলেন, ‘আমাদের সংস্কৃতির ভিত কত যে শক্ত, সমৃদ্ধ তা বিশ্বের কাছে তুলে ধরতে আমরা ধীরে ধীরে সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়, বাংলা একাডেমি, শিল্পকলা একাডেমির সঙ্গে কাজ করছি। শীতলপাটির স্বীকৃতি সে ধারাবাহিকতায় একটি কাজ। শীতলপাটি প্রাকৃতিক গাছ থেকে পাওয়া।, 

শেষকথা: আধুনিক যুগোপযোগী শিল্প সামগ্রী তৈরি করতে পারলে শীতলপাটির সহ পাটি শিল্প একটি সম্ভাবনাময় লোকশিল্প হয়ে দুবাংলার গ্রামীণ মানুষের জীবন জীবিকায় নতুন  দিগন্ত খুলে যাবে। দূষণমুক্ত পরিবেশ বান্ধব  কুটির শিল্প।  কাঁচা মালের সহজলভ্যতা ও দক্ষ শিল্পীর প্রতুলতা এই শিল্পের ভবিষ্যতকে সমৃদ্ধ করবে। বড় ধরনের বিনিয়োগ ও সরকারি সহযোগিতায় এই শিল্প আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে  বিস্তার লাভ করবে। গ্রামীণ অর্থনীতিতে নব জোয়ার আনবে। সেই সঙ্গে বিদেশের মাটিতে একটা স্হায়ী বাজার তৈরি প্রয়োজন। নতুন নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টি করবে। এই শিল্পের নান্দনিক সৌন্দর্য রক্ষায় শিল্পীদের মনোযোগী হওয়া উচিত। সময়ের হাত ধরে  আধুনিক  প্রযুক্তির ছোঁয়া লাগলে এই শিল্প আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে বিস্তার লাভ করবে অতিসহজে। আধুনিক প্রযুক্তি নির্ভর শিল্পের সঙ্গে লোকজ শিল্প শীতলপাটি প্রতিযোগিতায় কিছুটা হলেও পিছিয়ে পড়ছে। ক্রেতার অভাব এই শিল্পের  সবচাইতে বড় ধরনের প্রতিবন্ধকতা। এটা কাটিয়ে ওঠাই হলো বড় চ্যালেঞ্জ। অতীতের বাংলার জুড়ে সেই বিখ্যাত লোকছড়ায় শীতলপাটি আজ ও অমরত্ব লাভ করে আছে।

"মাছ বানাইতো কন্যা, লয় ছালি- মাটি। ইলিশ বানাইতো কন্যা, বিছায় শীতলপাটি।" আধুনিক যুগের তরুণ  ব্যবসায়ীদের অভিমত--"  ১০০ টাকায় প্লাসটিকের মাদুর পাওয়া যাচ্ছে। শীতলপাটি  কে কিনবে? মুর্শিদাবাদের বেলুল গ্রামের সুরবান বিবি, নুরবানু বিবিরা বড়  আক্ষেপ-- “বুনতেই পারি কিন্তু কিনবে কে?” তাদের অভিমত  ঠাণ্ডা-যুদ্ধে শীতলপাটি আজ পরাজিত।  

লেখক: শিক্ষক, লোকগবেষক, প্রাবন্ধিক, রম্যরচনা, ফিচার, অণুগল্প ও ছোটগল্প এবং ভ্রমণকাহিনীর লেখক

Mailing List